
বাংলা কথাসাহিত্যে পলিটিক্যাল স্যাটায়ার লেখক হিসেবে যদি একজনের নাম বলতে হয়, তাহলে চলে আসবেন আবুল মনসুর আহমেদ। খুব কম লেখকই সমসাময়িক রাজনৈতিক অবস্থা এবং সামাজিক অবস্থাকে কলমের আঁচড়ে এমন অপরূপভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন । আবুল মনসুর আহমদের সৃষ্ট চরিত্রগুলো এবং কাহিনীগুলো তখনকার জন্য যেমন উপযুক্ত ছিল, এখনকার জন্যও ঠিক একইরকম প্রাসঙ্গিক। আজও আমরা আমাদের সেই সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। তাই আবুল মনসুর আহমেদের লেখা পড়ে আমরা সবসময়ই নিজেদেরকে নতুন নতুন করে বুঝতে পারি। খুঁজে পাই নিজেদের অস্তিত্বকে, নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়কে, নিজেদের সামাজিক অবস্থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বাংলা ১৩৫০ সনে (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে) ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। এই দুর্ভিক্ষকে নিয়ে দু’জন শিল্পী তাদের শিল্পকর্মে নিঁখুতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন- তার তুলির আঁচড়ে, আর আবুল মনসুর আহমেদ- তার স্যাটায়ারে।

‘ফুড কনফারেন্স’ আবুল মনসুর আহমেদের সে রকম একটি রচনা, এটিকে লেখকের শ্রেষ্ঠ পলিটিক্যাল স্যাটায়ারও বলা যায়। অন্নদাশঙ্কর রায় তো বলেছেনই, আবুল মনসুর আহমেদ ফুড কনফারেন্স লিখে অমর হয়েছেন। আসলেই, ব্যঙ্গাত্মক লেখার মাধ্যমে বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সমাজকে সেইসাথে সমাজের মানুষের চরিত্র যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা নিঃসন্দেহে অনবদ্য।
এতে রয়েছে বিভিন্ন স্বাদের নয়টি ছোটগল্প। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ফুড কনফারেন্স, সায়েন্টিফিক বিযিনেস, লঙ্গরখানা, গ্রো মোর ফুড, জমিদারি উচ্ছেদ ইত্যাদি। প্রতিটা গল্পই ভিন্ন স্বাদের, কিন্তু মূল ভাবধারা এক। তা হলো, সমাজের সুবিধাবাদী, স্বার্থান্বেষী রূপ। গল্পগুলোর সময়কাল বাংলা ১৩৫০-১৩৫৪ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এর উপজীব্য। দুর্ভিক্ষে মানুষের মানবেতর জীবন তার সাথে সাথে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থপরতা, উদাসীনতা ক্ষেত্রবিশেষে নির্বুদ্ধিতা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার- এ সবই ফুটে উঠেছে গল্পগুলোতে। সময়কাল আজ থেকে বহু বছর আগে হলেও, আজও এর গল্পগুলো ঠিক একইরকম প্রাসঙ্গিক।
যে গল্পের নামানুসারে এই বই সেই ‘ফুড কনফারেন্স’ গল্পে দেখা যায় সমসাময়িক দুর্ভিক্ষের বাস্তব চিত্র। সেখানে শেরে-বাংলা, মহিষে বাংলা, সিংগীয়ে বাংলা, কুত্তায় বাংলা ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন, সমাজের সাধারণ মানুষের যে সমস্যা, দুঃখ-দুর্দশা, দুর্ভিক্ষ- তাতে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নিষ্ঠুর উদাসীনতা। সমাজের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কিছু অবাস্তব নীতি নির্ধারণ, সমাজের মূল সমস্যাকে চিহ্নিত করার অনীহা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, মিটিং-কনফারেন্সের নামে অহেতুক কালক্ষেপণ আর ভোজনবিলাস- এরকম নানা অসংগতি। একপর্যায়ে এসব জটিল সমস্যা সমাধান করতে না পারার দরুন দুর্ভিক্ষে মানুষের করুণমৃত্যু এবং সমাজে মানুষহীন হয়ে যাওয়ার শেষ পরিণতি।
যদিও এটি রম্যগল্প, কিন্তু এই রম্য গল্পের মধ্য দিয়েই সমাজের নিষ্ঠুর এবং করুণ বাস্তব চিত্র এখানে তুলে ধরেছেন। সবশেষে তাই তার সৃষ্ট চরিত্র ছাগলে বাংলার জবানিতে লেখক উচ্চারণ করেছেন, “কিন্তু শেরেবাংলা, হাতিয়ে বাংলা, শুধু জানোয়ারের বাংলায় আমরা বেঁচে রইলাম। আর মানুষে বাংলারা যা আছে সবাই মরে গেল।” পশু-এ-বাংলাকে জিন্দাবাদ আর মানুষ-এ-বাংলাকে মুর্দাবাদ জানিয়ে শেষ হয়ে যায় প্রহসনমূলক সেই ফুড কনফারেন্স।

‘সাইন্টিফিক বিজনেস’ গল্পটিতে দেখা যায় ব্যবসায় বাঙালির অসততার নির্মম রূপ। ব্যবসায় বাঙালি সীমাহীন লোভের লালসা যে কতখানি ভয়ংকর হতে পারে, সেটাই এই গল্পের মূল প্রতিপাদ্য। গল্পের শুরুতেই, বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বাঙালিকে কেরানীর পেশা ছেড়ে ব্যবসায় উদ্যোগী হতে বলেছেন, কেরানিগিরি ছেড়ে ব্যবসার সূচনা করতে বলছেন। তার বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আজিজ ও নরেন নামে দুই বাঙালি বন্ধু ব্যবসা করার উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তারা তাদের মাড়োয়ারি বন্ধুর সাথে পরামর্শ করতে বসে। মাড়োয়ারিরা জাত ব্যাবসায়ী, বাঙালি ব্যবসার পরিকল্পনায় আজিজার নরেনের অসততা এবং ধূর্ততা দেখে মাড়োয়ারি বন্ধু তাদের সঙ্গ ত্যাগ করেন। এতটা অসৎ হয়ে ব্যবসা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আজিজ নরেনের উদ্যোগে ‘নিখিলবঙ্গ বণিক সংঘ’ গঠন করা হয়। বাঙালি জাতির কল্যাণার্থে সেই সঙ্ঘ ব্যবসা শুরু করে। তাদের ব্যবসায় এতই বেশি ধূর্ততায় ভরা ছিল যে এক পর্যায়ে যে তাদের অসততার কারণে, তাদের ব্যবসার দুই নম্বরীর কারণে বাঙালি জাতি একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এমনকি এই অসততার চক্রে পতিত হয়ে একসময় তাদের আত্মীয়রা এবং সর্বোপরি সবশেষে তারা নিজেরাও একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এভাবে পৃথিবীর বুক থেকে ঐতিহাসিক একটি জাতি- বাঙালি জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাঙালি জাতির জন্য কাঁদবে এমন একটা লোকও অবশিষ্ট থাকে না।
গল্পের সবশেষে অংশে দেখা যায়, শেষ বিচারের পর বাঙালিকে জাতিশুদ্ধ জাহান্নামে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানেও অসততা এতটাই প্রকট হয়ে উঠে যে তাদের দুর্নীতির প্রভাব জান্নাত-জাহান্নামের ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের শঠতা আর দুর্নীতির কাছে বেহেশত ও দোযখের প্রহরীরাও নিরুপায় হয়ে যায়।
সবকিছু দেখেশুনে স্রষ্টা, তার সৃষ্ট এই অদ্ভুত বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং যেখানে যেখানে বাঙালি জাতির জন্ম হয়েছিল সেখানে হাইজেনিক মেজার হিসেবে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিতে বলেন। নিঃসন্দেহে এটা এই প্রহসনমূলক রচনার শ্রেষ্ঠ অংশ।

‘রিলিফ ওয়ার্ক’ গল্পটি দুর্নীতিপরায়ণ বাঙালীর চিরাচরিত এক প্রতিচ্ছবি। যে চরিত্র বাঙালির আগেও ছিল, আজও বদলায়নি, ভবিষ্যতে কোনদিন বদলাবে কিনা জানা নেই। গল্পের প্রধান চরিত্র হামিদ এক কর্মচারী। দেশের প্রবল বন্যায় পীড়িত মানুষের দুর্দশা দেখে তার মন কাঁদে। সে কিছু করতে চায় দুর্দশাগ্রস্ত এই লোকদের জন্য। হামিদের সামান্য সামর্থের মধ্যে তার বেতনের টাকার একটা বড় অংশ সে রিলিফ কাজের জন্য দিয়ে দেয় এবং এজন্য তাকে পরবর্তীতে ধন্য ধন্য করে রিলিফ কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট করে নেওয়া হয়। পরে দেখতে পারে যে রিলিফের নামে আসলে কতখানি অসততার চর্চা হয়। আর্তমানবতার সেবার জন্য অফিস থেকে ছুটি মঞ্জুর করে রিলিফ ওয়ার্ক এ যোগদান করে।
সে দেখে রিলিফের নামে চলছে সেখানে আরও বড় প্রহসন। ক্ষুধার জ্বালায় রুগ্ন-দুস্থ মানুষগুলো যখন রিলিফের জন্য আকুল হয়ে আসে, তখন তাদের সাথে যে দুর্ব্যবহার করা হয়। এক টিকিটে পেন্সিলের দাগ মুছে আবার যাওয়ার জন্য যে অসততাটুকু তারা করে- সেটুকুও তাদের ক্ষমা করা হয় না। অথচ অপর দিকে দেখা যায় যে সমাজের তথাকথিত ভদ্র লোক যারা আছেন তাদের আদতেই সাহায্যের কোনো দরকার নেই, তাদেরকে বস্তা ভরে ভরে রিলিফের ত্রাণসামগ্রী, খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়ে আসা হয়। যেখানে শত শত লোক বন্যা পীড়িত হয়ে দু’বেলা ঠিকমতো খেতেও পারছে না, সেখানে দেখা যায় কমিটির লোকেরা খাদ্য বিলাসে মত্ত হয়ে আছে।
হামিদ জিনিসগুলো মেনে নিতে পারে না। কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের বেশ বাকবিতণ্ডা হয় এই নিয়ে। পরিস্থিতির চরমে যায় যখন সে দেখতে পায় এই বঞ্চিত দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষ বন্যা পীড়িত মানুষগুলো ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে রাতের অন্ধকারে রিলিফ কমিটি গোডাউন থেকে চালের বস্তা চুরি করতে আসে এবং ধরা পড়ে যায়। এই অপরাধে শত শত লোক গ্রামের লোককে পরবর্তীতে রিলিফ কমিটি সহায়তায় পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কঠিন বিচার হয় শেষে তাদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। হামিদ আর সহ্য করতে পারে না। এহেন দুর্দশা দেখে রিলিফের কাজে ইস্তফা দিয়ে হামিদ পরের দিনই চাকরিতে যোগদান করে আর এভাবেই শেষ হয়ে যায় হামিদের রিলিফ ওয়ার্কের আগ্রহ।
আসলে এখানে হামিদ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রতিভূ- যারা দেশের জন্য কিছু করতে চায়। কিন্তু একসময় তাদের এই চেষ্টা বাধা পড়ে যায় সিস্টেমে সমস্যার কারণে।
আরও উল্লেখ করা যেতে পারে ‘গ্রো মোর ফুড’এর কথা। গল্পে রাজা হবুচন্দ্র আর তার গবুচন্দ্র মন্ত্রীকে নিয়ে এসে গাঁজার চাষ করে খাদ্যসমস্যা সমাধানের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে লেখক কৃষির অব্যবস্থাপনার গল্পই শুনিয়েছেন। ‘জমিদারী উচ্ছেদ’-এ মুন্সিজি কিংবা ‘জনসেবা ইয়ুনিভার্সিটি’র ইয়াকুব থেকে লর্ড জ্যাকব- এরা সমাজের সুবিধাবাদী ক্ষমতালোভীদের প্রতিভূ। মানুষের সেবার নামে কীভাবে নিজের আখের গোছানো যায় সেটাই দেখা গেছে।
বইয়ের গল্পগুলো পড়ে একটা জিনিসই উপলব্ধি হয়, তা হলো- মানুষের মানসিকতা যদি অসৎ হয়, তাহলে সেই অসদুদ্দেশ্যকে হাসিল করতে মানুষ নানা যুক্তি-কুযুক্তির শরণাপন্ন হয়। এর বিপরীতে যারা ভুক্তভোগী- তারা থাকে নীরব-অসহায়।
লেখক আবুল মনসুর আহমেদ এর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ, রাজনীতি জ্ঞানও অত্যন্ত তীক্ষ্ণ- তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে এত খানি গভীর তীক্ষ্ণধীসম্পন্ন রাজনৈতিক প্রহসন লেখা। ক্লাসিক পর্যায়ের এই বইটি সচেতন পাঠকের জন্য অবশ্যপাঠ্য।