বাংলা সাহিত্যের নামকরা সব সাহিত্যিকের মায়েদের জীবন কেমন ছিল, তা সাহিত্য পাঠক অনেকেরই এক আগ্রহের বিষয়। সাহিত্যিকদের মায়েরা কি সারাজীবন গৃহস্থালী জীবনের চার দেয়ালে আটকে ছিলেন, নাকি তাদের মধ্যেও ছিল নানা প্রতিভা, যা পরবর্তীকালে তাদের সন্তানদের মধ্যে স্ফূরিত হয়েছিল? বাংলার স্বনামধন্য কয়েকজন সাহিত্যিকের মায়েদের বিচিত্ররঙা জীবন সর্ম্পকে জানতে চেষ্টা করবো আজ।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার সাহসী মা প্রভাবতী দেবী
সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা প্রভাবতী দেবী ছিলেন একজন বিদুষী নারী। পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন তিনি। তার বই পড়ার খুব নেশা ছিল। আর মায়ের সে অভ্যাসই পেয়েছিলেন তারাশঙ্কর। প্রভাবতীর হাতের লেখাও ছিল মুক্তোর মতো। একবার এক বিষয়-সম্পত্তির মামলা দাখিলের কাগজে তার সই দেখে বিচারক মুগ্ধ হয়ে যান। সন্দেহ করেন, এ সই কোনো নারীর হতেই পারে না।
শুধু পড়াশোনায় নয়, প্রভাবতী দেবীর ছিল অসীম ধৈর্য ও সাহস। গ্রামে থাকতেন। গ্রামের মানুষরা একটু রাত হলেই ভূত-প্রেতের ভয়ে তটস্থ থাকতো। ভূতের অস্তিত্ব রয়েছে বলে প্রায় সময় এখানে-সেখানে গুজব রটতো। কিন্তু প্রভাবতী দেবীর তাতে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। তিনি সেসবে একদম বিশ্বাসই করতেন না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে অন্যের ভয় ভাঙাতেন।
মা সম্পর্কে তারাশঙ্কর তার এক লেখায় লিখেছিলেন,
“আমার মায়ের দেহবর্ণ ছিল উজ্জ্বল শুভ্র। আর তাতে ছিল দীপ্তি। চোখ দু’টি স্বচ্ছ, তারা দু’টি নীলাভ। কথাবার্তা অত্যন্ত মিষ্ট, প্রকৃতি অনমনীয় দৃঢ়, অথচ শান্ত।… আমার মা যদি উপযুক্ত বেদীতে দাঁড়াবার সুযোগ পেতেন, তবে তিনি দেশের বরণীয়াদের অন্যতমা হতেন—এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।”
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মাও ছিলেন একজন কবি
কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারীও ছিলেন একজন কবি। ‘ব্রহ্মবাদী’, ‘মুকুল’, ‘প্রবাসী’র মতো সে সময়ের নামকরা সব সাহিত্য পত্রিকাতে তার লেখা বের হতো। ছোটদের জন্য লেখা তার সেই অমর কবিতা-
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে।’
একান্নবর্তী পরিবারের বিশাল হেঁশেল সামলিয়ে তার এই কাব্যসাধনা বেশ কষ্টকরই ছিল। জীবনানন্দ দাশ তার মায়ের কাব্যসাধনা নিয়ে এক লেখায় জানিয়েছিলেন,
“সংসারের নানা কাজকর্মে মা খুবই ব্যস্ত থাকতেন। হঠাৎ এই সময়ে ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে উপস্থিত হতেন। এক্ষুনি পত্রিকায় প্রকাশের জন্য মায়ের লেখা কবিতা চাই। আর সেই কবিতা প্রেসে পাঠানোর জন্য লোক অপেক্ষা করছে। শুনে মা তাকে বসতে দিয়ে খাতা–কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়তেন। এক হাতে খুন্তি, আর এক হাতে কলম নাড়ছেন। কিছু সময় পরে দেখা যেতো আচার্য চক্রবর্তীকে তিনি তার কবিতার কাগজ তুলে দিচ্ছেন।”
কুসুমকুমারী ছিলেন খুবই আবেগী এবং পরোপকারী এক নারী। শুধু পরিবারের সদস্যদের জন্যই না, পাড়া-পড়শীর নানা দুঃখ-কষ্টে সবসময় তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। কোনো পড়শীর অসুস্থতার কথা শুনলে, কোনো দুঃস্থ পরিবারকে ভিটেছাড়া করা হয়েছে জানতে পারলে, কোনো পোয়াতি মায়ের প্রসব হবে- এমন খবর তার কাছে আসামাত্রই তিনি কি দিন কি রাত, কিছুই বিবেচনায় নিতেন না, ঠিকই চলে যেতেন। সারা রাত বাড়ি ফেরার সময়ই হতো না তার।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা মৃণালিনী দেবী
মা মৃণালিনী দেবী ছেলে বিভূতির পড়াশোনার দিকে কড়া নজর রাখতেন। বাবা নতুন কথকতা লিখছেন, বিভূতি পড়া সরিয়ে অন্য কাজে মন দিয়েছে, বাবার সেদিকে খেয়ালেই নেই। দূর থেকে সবই লক্ষ করতেন মৃণালিনী। দশ বছর বয়সে অভাবের সংসারে দু’পয়সা আয়ের আশায় যাত্রাদলে নাম লেখাতে চেয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। কিন্তু বাধ সাধলেন মা। তার ইচ্ছে, ছেলে পড়াশোনা করুক।
বাপের বাড়ি গেলেও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। মামারা যে শিক্ষকের কাছে পড়তেন, কয়েকদিনের জন্য সেখানেই ভর্তি করিয়ে দিতেন, যাতে ছেলের লেখাপড়ার কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। বিভূতিভূষণ যতদিন কোনো স্থায়ী চাকরি পাননি, ততদিন সংসারে দারিদ্র্যের কালো ছায়া আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। কিন্তু, তা কখনো বুঝতে দেননি বিভূতি-জননী মৃণালিনী দেবী।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও তার মা প্রসন্নময়ী
কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন মা অন্তঃপ্রাণ। মা প্রসন্নময়ীও ছেলেকে পাগলের মতো ভালবাসতেন। মেধাবী ছেলে রাত জেগে পড়াশোনা করতো বলে প্রসন্নময়ী ছেলে না ঘুমানো পর্যন্ত তার পাশে ঠায় বসে থাকতেন। ছেলের গরমে কষ্ট হবে বলে কিছুক্ষণ পরপর পাখার বাতাস করতেন। পড়াশোনার জন্য দ্বিজেন্দ্রলাল ইউরোপে যাবেন বলে ঠিক করার পর থেকেই মায়ের মন বিষাদে ঢেকে যায়। তার একদম সায় ছিল না, ছেলে বিদেশে পড়তে যাক। প্রসন্নময়ীর মনে হয়েছিল, বিলেতে গেলে ছেলের সাথে তার আর কোনোদিনই দেখা হবে না।
ইউরোপে যাবার আগের দিন সারা রাত ছেলের গলা জড়িয়ে কেঁদেছিলেন প্রসন্নময়ী। মায়ের সেই অঝোর কান্না কোনদিন ভুলতে পারেননি দ্বিজেন্দ্রলাল। বিলেতে বসে বাবার মৃত্যুসংবাদ শোনার পর দ্বিজেন্দ্রলাল তড়িঘড়ি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। জাহাজে বসে শুনলেন আরও একটি দুঃসংবাদ। তার মা’ও আর নেই! শেষপর্যন্ত মায়ের সে ধারণাই ঠিক হলো। মাকে নিয়ে ডি.এল. রায় তার এক কবিতায় লিখেছিলেন,
“জানি না জননী কেন এত ভালবাসি।
দুঃখের পীড়নে মোর হদয় ব্যথিত হলে
জানি না তোমারি কাছে কেন ধেয়ে আসি।”
লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও জাফর ইকবালের সাদাসিধে মা আয়েশা ফয়েজ
লেখক হুমায়ূন আহমেদ এবং জাফর ইকবালের মা আয়েশা ফয়েজ একজন সাদাসিধে মহিলা ছিলেন। পড়াশোনায় খুব আগ্রহ ছিল তার। সে সময় মেয়েদের লেখাপড়ার তেমন চল ছিল না বলে দ্বিতীয় শ্রেণির পর লেখাপড়া তার আর বেশিদূর এগোয়নি। কিন্তু বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহে বই পড়ার আগ্রহটা জন্মাতে থাকে। টুকটাক লেখালেখির চেষ্টা করতেন। সে সময়ের ‘বেগম’ পত্রিকায় তার বেশ কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়।
তার জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বামীকে হারিয়ে তিন ছেলে আর তিন মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় বেঁচে থাকার এক কঠিন সংগ্রাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বামীর পেনশনের অল্প টাকায় ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। কঠিন কৃচ্ছ্রতার মধ্যে দিয়ে সংসার চালাতে থাকেন। সন্তানদের পড়াশোনা যাতে থমকে না যায়, সেজন্য যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এই নারী।
সংসারে কিছু টাকা বাড়তি উপার্জনের জন্য সেলাই মেশিন জোগাড় করে কাপড় সেলাই পর্যন্ত করেছেন। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় বেশ মেধাবী ছিল। আশা করতেন, বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ পাস করে একটা চাকরি পেলেই তাদের কষ্টের দিনগুলোর অবসান হবে। এমন দারিদ্র্যের মধ্যেও ছেলেমেয়েদের ছোটখাটো আবদার মেটাতে সবসময় চেষ্টা করতেন। জাফর ইকবাল তার এক লেখাতে এমন এক গল্প শুনিয়েছেন। একদিন জাফর ইকবাল বলাকা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হলের নিচের একটি বইয়ের দোকানে পুরো মানিক গ্রন্থাবলীর এক সেট দেখতে পান।
পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা অপূর্ব প্রচ্ছদ, পুরো সেটের দাম তিনশ’ টাকা, যা এই সময়ে দশ-বারো হাজার টাকার কম হবে না। এত টাকা দিয়ে সে বইয়ের সেট কেনা তার পক্ষে অসম্ভব। তাই একপ্রকার হতাশা নিয়ে পরম লোভে বইগুলোর ওপর হাত বুলাতে থাকেন। বাসায় ফিরে এসে ভাইবোনদের তিনি সেই মানিক গ্রন্থাবলীর অসাধারণ সেটটার কথা বলতে থাকেন। ভাইবোনদের কাছে সে গল্প করতে গিয়ে তার চোখেমুখের সে উচ্ছ্বাস ঠিকই চোখে পড়ে মায়ের কাছে। জিজ্ঞেস করলেন সেটটার দাম কত? জাফর ইকবাল একটু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন ‘তিনশো টাকা।’ সেই বই কিনতে মা ছেলের হাতে তিনশো টাকা তুলে দিলেন।
সে সময় তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করলে এ ধরনের আবদার মেটানো সত্যিই দুঃসাহস বটে। কিন্তু বইয়ের প্রতি ছেলের আগ্রহ দেখে সে আবদার মেটাতে মা আয়েশা ফয়েজ একবার চিন্তাও করেননি, পরের মাসে সংসারটা কীভাবে চলবে। সন্তানের মুখের সে অনাবিল হাসিটাই যেন তার কাছে অনেক বড় ছিল।
তার লেখালেখির মধ্যে যে সাহিত্য নির্যাস ছিল, তা তার আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘জীবন যে রকম’ এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বইটি তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়। বইটিতে তিনি তার জীবন, বিয়ে, সন্তানদের জন্ম এবং মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর নিহত হওয়া এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সন্তানদের নিয়ে তার জীবন সংগ্রামের নানা বিষয় উঠে এসেছে।
বুদ্ধদেব বসু ও তার মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ
এখন আর এক মায়ের গল্প বলবো। কবি বুদ্ধদেব বসু তার দিদিমাকেই মা বলে ডাকতেন। কারণ তার জন্মদাত্রী মা বিনয়কুমারী বুদ্ধদেবের জন্মের কিছু সময় পরেই মারা যান। তার পিতা সে শোকে গৃহত্যাগী হন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহের কাছেই মানুষ হন বুদ্ধদেব বসু।
দিদিমার সংগ্রহে থাকা একটি ফটোগ্রাফই তার মায়ের একমাত্র স্মৃতি হিসেবে সারাজীবন রয়ে গিয়েছিল। ছবিতে তার পিতা ভূদেবচন্দ্র বসুর কাঁধে মাথা রেখেছেন তার মা। মায়ের মুখটি গোল মতো, পিঠ–ছাপানো একঢাল চুল, কিন্তু চোখ তার বোজা। বাবা মাকে কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। ওই ছবিটি নিয়ে সারা জীবন কোনো কৌতূহলবোধ না করলেও ষাট–পেরোনো মানুষটির একান্ত নির্জন মুহূর্তে যেন ছবিটি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতো আর মনে হতো,
“কেমন ছিল তার মা, কী পছন্দ করতেন তিনি? বই পড়তে ভালবাসতেন? মায়ের কোনো একটি অংশ কী তার মধ্যে কাজ করে, জন্ম দিতে গিয়ে যে–মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিল, কিছু কী প্রাপ্য ছিল তার কাছে?”