‘শনু পণ্ডিতের ইসকুল’
আট হাত লম্বা কাঠের ওপর পেরেক আঁটা একটি চমৎকার ফলক। এতদিন এই ফলকে জ্বলজ্বল করতো জুলু চৌধুরী নামের এক চৌধুরীর নাম। এই স্কুল নির্মাণ করতে খরচ দিয়েছিলেন এই চৌধুরী। কিন্তু এখন আর সেই নামের দরকার নেই। এই লোক এখন আর গ্রামে স্কুল নির্মাণ করার তাগিদ অনুভব করেন না।
গ্রামের মানুষ এখন পেয়ে গেছেন তাদের আসল মানুষের সন্ধান। যে মানুষ এতদিন তাদের মাঝেই ছিলো। তাদের মতই সবকিছু করতো। তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার জন্য তাদের চেয়ে এই মানুষটার চিন্তা ছিলো বেশি। তিনি তাদের প্রিয় শনু পণ্ডিত। তার নামেই এবার স্কুল বানাবে গ্রামবাসী।
প্রখ্যাত লেখক জহির রায়হানের গল্প ‘নয়া পত্তন’। এই গল্পে পাওয়া যাবে শনু পণ্ডিতের সন্ধান। জহির রায়হানকে অনেকেই বলে থাকেন ভাষা আন্দোলনের লেখক। তার লেখায় বাংলাদেশের ইতিহাসের সংগ্রামী এক অধ্যায়ের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে তিনি সিনেমা নির্মাণেও যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখান।
তবে ‘নয়া পত্তন’ গল্পটি একটি ভিন্ন মেজাজের গল্প। সরল ও স্বাভাবিক ভাষায়, সোজাসাপ্টা প্লটের মাধ্যমে তিনি এখানে মানবজাতির মুক্তির অন্যতম পথের সন্ধান দিয়েছেন। যে পথের ধূলো গায়ে মেখে মানুষ সামনে এগিয়ে যাবে। অর্জন করবে তাদের মুক্তির চাবিকাঠি। তাদের পরের প্রজন্ম তাদের দেখে এই পথেই আসবে। অর্জন করবে সাফল্যের সোপান।
‘নয়া পত্তন’ গল্পের মূলকথা
একটি অজপাড়াগাঁ। বলতে গেলে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। গাঁয়ের আশেপাশে কোনো গ্রামেও নেই কোনো স্কুল। ফলে গাঁয়ের মানুষের অত্যন্ত চিন্তার বিষয় ছিলো তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করানো। নিজেরা তো অজ্ঞ হয়ে আছেন। কিন্তু পরের প্রজন্মও কি তা-ই হয়ে থাকবে?
সেই সময়ে এন্ট্রান্স পাশ করে বেরিয়েছেন সেই গ্রামের বাইশ বছরের এক যুবক। তার চোখে-মুখে তখন স্বপ্ন। গায়ের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার একটা ব্যবস্থা তিনি করবেন। তিনি গল্পের মূল চরিত্র শনু পণ্ডিত। কিন্তু ইচ্ছাপূরণের পুরো সামর্থ্য নেই তার। ফলে তার ইচ্ছেটা বলতে হয় সবচেয়ে ধনী পরিবারের যুবক জুলু চৌধুরীর কাছে।
জুলু চৌধুরী এবং শনু পণ্ডিতের দ্বৈত চেষ্টায় গায়ের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তারা শিক্ষার আলো না পেলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে বড় হবে। যাক, অবশেষে একটা সমাধান পাওয়া গেলো।
কিন্তু আকস্মিক ঝড়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে স্কুলটা। এর সাথে গায়ের মানুষের আশাও যেন হারিয়ে যেতে থাকে অতল গহ্বরে। তৎপর হয়ে উঠেন শনু পণ্ডিত। তার স্বপ্ন এভাবে ভেঙে যেতে পারে না। তিনি তাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান সরকারের কাছে। সরকার থেকে কোনো ধরনের আশার বাণী না পেয়ে তাকে ছুটতে হয় সেই জুলু চৌধুরীর কাছেই। কিন্তু চৌধুরী সাহেবও তাকে আশাহত করেন।
ব্যর্থ হয়ে গাঁয়ে ফিরে আসেন শনু পণ্ডিত। তার আশা আর পূরণ হলো না। গায়ের মানুষও হতাশ হন সরকার এবং চৌধুরীর এমন আচরণে।
কিন্তু তাদের ভেতরে জেদ চেপে যায়। সিদ্ধান্ত নেন, তারা নিজেরাই একত্রে এই স্কুল দাঁড় করাবেন। সবাই অল্প করে স্কুলের জন্য কিছু জিনিস দিলে একত্রে তা বড় কিছু তৈরি করতে পারবেন। এমন ধারণা শোনার পর মুহূর্তেই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠে শনু পণ্ডিতের মন। এবার তাহলে আশার পালে হাওয়া লাগলো।
কিন্তু কায়িক পরিশ্রম করবে কে? তা নিয়ে ফের চিন্তায় পড়ে যান তারা। জিনিসপত্র না হয় যোগাড় করা গেলো। কিন্তু যারা কাজ করে স্কুল তৈরি করবেন, তাদের মজুরি দেবে কে? এর আরেকটি চমৎকার সমাধান দেন শনু পণ্ডিত। তারা নিজের কাজ নিজে করলেই তো সব সমস্যার সমাধান করা হয়ে যায়।
শেষে চমৎকার এক স্কুল দাঁড় করায় তারা। স্কুলের নাম দেয় ‘শনু পণ্ডিতের ইসকুল’।
বক্তব্যের আলোকে ‘নয়া পত্তন’ গল্পের গুঢ়ার্থ
জহির রায়হান তার বেশিরভাগ সাহিত্যকর্ম ভিন্ন ধাঁচের আশ্রয়ে লিখেছেন। এই গল্পটিও তেমনই। নন-লিনিয়ার স্টাইলে গল্পটি লিখেছেন তিনি। গল্পের মাঝের অংশ অর্থাৎ গাঁয়ের লোকদের কোথাও সাহায্য না পাওয়া থেকে শুরু করেছেন গল্প। ফিরে গেছেন অতীতে। আবার বর্তমানে ফিরে গল্পকে নিয়ে গেছেন সামনে।
জহির রায়হান তার ‘একুশের গল্প’ নামের এক গল্পেও ঠিক একই কাজ করেছেন। শুরু করেছেন বর্তমান দিয়ে। একটি কঙ্কাল পাওয়ার দৃশ্য দিয়ে। ফিরে গেছেন অতীতে। আবার বর্তমানে ফিরে আসেন তিনি।
“ভোরের ট্রেনে গায়ে ফিরে এলেন শনু পণ্ডিত”
তার গল্পের অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য হলো নাটকীয়ভাবে শুরু করা। তার প্রায় গল্পেই এমনটা লক্ষ করা যায়। পাঠককে শুরু থেকেই গল্পে ধরে রাখার চেষ্টা রয়েছে এই গল্পেও।
এই গল্পের বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সমাজের কিছু দিক তুলে ধরেন।
“ন্যুব্জ দেহ, রুক্ষ চুল, মুখময় বার্ধক্যের জ্যামিতিক রেখা”
গায়ের এক ত্যাগী শিক্ষকের বর্ণনা এটি। গায়ের পণ্ডিত বলতে অনেকেই মনে করেন বেত হাতে থাকা এক জাঁদরেল লোক। যিনি কঠিন কঠিন শাস্তির জন্য ওস্তাদ। কিন্তু আমাদের সমাজে এমন অনেক শিক্ষক ছিলেন, যারা শিক্ষাদানে বিশেষ ব্রতে ব্রতী। একইসাথে শিক্ষকসমাজের বেহাল দশার একটি চিত্র এখানে ফুটে উঠেছে।
তেমনি একজন শিক্ষক শনু পণ্ডিত। যিনি ছাত্রদের স্কুল বন্ধ হয়ে যাবার ফলে চিন্তায় পড়ে যান, তারা কী শিখবে, কী করে শিখবে- তা নিয়ে। তাদের এহেন চিন্তার কারণে তার নিজের দিকে খেয়াল করার সময় নেই। নিজের শরীরের প্রতিও খেয়াল করেন না। আমরা আরও দেখি নিজের জমি বিক্রি করে স্কুল নির্মাণের জিনিসপত্র কিনেন তিনি।
সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০) সিনেমায়ও আমরা আদর্শ এক শিক্ষকের সাথে পরিচিত হই। রাজা রাজ্যে পাঠশালা বন্ধ করে দেয়ার পর উদয়ন পণ্ডিত তার ছাত্রদের যাচাই করে নেন, তারা পড়া ভুলে গেছে কিনা। কিন্তু বর্তমানের শিক্ষাবাণিজ্যের যুগে অনেক শিক্ষকের মধ্যেই এই চমৎকার মানসিকতার কত অভাব!
“রাজধানীতে দুটো নতুন হোটেল তুলে, আর সাহেবদের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা ইংলিশ ইস্কুল দিতে গিয়ে প্রায় কুড়ি লাখ টাকার মতো খরচ”
স্কুলের জন্য টাকা চাইতে গেলে শনু পণ্ডিতকে এমন কথা শোনান সরকারের শিক্ষা বিভাগের বড় সাহেব। এই বক্তব্যে ফুটে উঠে শিক্ষায় চরম অবহেলার চিত্র। দেশের এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে ভালো স্কুল নেই, শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু শহরের বাবুদের আরাম আয়েশ আগে দেখতে হবে। তাদের সন্তানদের জন্য সবচেয়ে সেরা ব্যবস্থা রাখতে হবে৷ তাদের জন্য থাকবে সেরা শিক্ষক।
“গায়ের ছেলেগুলো লেখাপড়া শিখুক তা আর কেউই চান না”
মানুষকে অশিক্ষিত করে রাখতে পারলেই যেনো সমাজপতিদের লাভ। তাদের অজ্ঞ করে রাখলে তারা কোনো আওয়াজ করবে না। প্রতিবাদ করবে না। সমাজের জটিল জটিল প্যাঁচের খেলা তারা ধরতে পারবে না। এতে করে ভং ধরে থাকা রাঘব বোয়ালরা দেশ ফাঁক করে নিজের পকেটে পুরবে৷
চাষার ছেলের স্কুল দিয়ে কী হবে? তারা স্কুল থেকে শিখে তাদের সাথে করা অবিচারকে প্রতিহত করার আন্দোলনে নামবে। অধিকার আদায় করতে শিখে যাবে। আজকের যুগে অবশ্য স্কুলে পাঠদান করতে বাধা দেয়া হয় না। পরিবর্তে চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের করা হয় মগজ ধোলাই। এর নমুনা আজকাল আমরা অহরহই পাচ্ছি। খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে কথা বলার লোক নেই আজ। যে যেভাবে পারছে, তাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে। এর পরিবর্তে সস্তা কোনো ইস্যু নিয়ে মজে আছেন আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ।
“নিজের কাম নিজে করুম, পইসা আবার কে দিবো?”
পুরো গল্পের সারকথা যেন শনু পণ্ডিতের এই কথাটি। সবাই একত্রে থাকলে কঠিন বাধাও অতিক্রম করা যায় সহজে। গ্রামের মানুষ তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য সরকার এবং সমাজপতিদের দিকে তাকিয়ে থাকতো এতদিন। কিন্তু তাদের থেকে অবহেলা পেয়েছেন।
অবশেষে তাদের টনক নড়েছে। তারা অবশেষে অনুধাবন করেছেন যে সফলতার আসল রহস্য হচ্ছে একতা। সেই সাথে কায়িক পরিশ্রম খুবই জরুরি একটি জিনিস। আমরা যখন নিজেরা নিজেদের কাজ করি এবং তার ফল পাই, তখন ভেতরটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। যে কাজ আমি নিজে করতে পারবো, তা অন্যদের দিয়ে কেন করাবো?
জহির রায়হান তার ‘নয়া পত্তন’ গল্পে মূলত ঐক্যের জয়গান গেয়েছেন। কোনো শত্রুর মোকাবিলা করার ক্ষেত্রেও সবাইকে এক থাকতে হয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেটি জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়। এই গল্পেও কিন্তু শত্রুর মোকাবিলা করার জন্যই ঐক্য দেখানো হয়েছে। যারা চান না নিচুশ্রেণির মানুষেরা জ্ঞানের আসল রহস্য জানুক, তাদের বিরুদ্ধেই এই ঐক্যের প্রতিবাদ। আর তাদের সাথে রয়েছেন আদর্শ এক শিক্ষক, যিনি এক শ্রেণিযুদ্ধের পত্তন ঘটিয়েছেন।