রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রহস্যময় প্রেমের গল্প

“আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী” – এ গান লেখার ত্রিশ বছর পরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পান তার সেই চেনা, শারদপ্রাতে কিংবা কোনো মায়াময়ী মাধবী রাতে দেখা বিদেশিনীকে, নাম তার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ভিক্টোরিয়া শব্দটিকে বাংলায় অনুবাদ করে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ‘বিজয়া’ নামে। বিজয়া বা ভিক্টোরিয়া- যা-ই বলুন না কেন, রবীন্দ্রনাথের সাথে ছিল তার এক গভীর প্লেটোনিক প্রেমের সম্পর্ক। কিন্তু প্রেমিক রবীন্দ্রনাথের বহু প্রেমের গল্প ছাপিয়ে কেন বিজয়া এত জনপ্রিয়? সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারের বিদেশিনীর সাথে কী করে রহস্যময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের? কে এই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো?

‘সুর’ পত্রিকা হাতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো; Image Source : tumblr.com

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো একজন আর্জেন্টাইন নারীবাদী লেখিকা, একজন পুরোদস্তুর সাহিত্যিক। ‘সুর’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার পরিচয় হয় সাহিত্যের হাত ধরেই। তবে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে চেনার আগে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটে ভিক্টোরিয়ার। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হতে থাকে ‘গীতাঞ্জলী’। ভিক্টোরিয়ার হাতে এসে পড়ে গীতাঞ্জলীর ইংরেজি, স্প্যানিশ ও ফরাসি অনুবাদ। এর মধ্যে আঁদ্রে জিদের ফরাসি ভাষায় করা গীতাঞ্জলীর অনুবাদ ছিল তার প্রিয়। গীতাঞ্জলী পড়ে রবীন্দ্রনাথের একজন ভক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের লেখা তাকে এতটাই ছুঁয়ে গিয়েছিল যে, তিনি সেসময়ে ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ’ নামে একটি লেখাও লিখে ফেলেন।

সান ইসিদ্রোর সে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পো: Image Source : parabass.com

১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরুর উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু মাঝপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি, ফলে বাধ্য হয়ে তাকে আর্জেন্টিনায় অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখন কে জানতো যে এই অসুস্থতা, এই যাত্রাবিরতিই রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে দেবে তার আরাধ্য বিদেশিনীকে। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের হোটেল প্লাসাতে সহযাত্রী ও সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্টের সাথে অবস্থান করেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের লেখার ভক্ত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কোনোভাবেই এ সুযোগ হাতছাড়া করে চাননি। ১৯২৪ সালের নভেম্বরের শুরুতে এক দিন রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করা জন্য হোটেল প্লাসাতে চলে আসেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো৷ ভিক্টোরিয়ার সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর এলমহার্স্ট তাকে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেন। আদরের উপবাস বইয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, চৌত্রিশ বছর বয়স্ক ভিক্টোরিয়া তেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথকে দেখে মুগ্ধতা নিয়ে লিখেছিলেন,

… প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এও সত্যি যে ঘরে যেন তিনি নেই। … তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী, অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোন দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তাঁর সোনালী শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। শ্মশ্রুমণ্ডলে মুখের নিচের দিকটা আড়াল, আর তারই ফলে উপরের অংশ হয়ে উঠেছে আরো দীপ্যমান। মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তার সমগ্র মুখায়ববের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তাঁর কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব। শুভ্র কেশদাম আর স্নিগ্ধ শ্মশ্রু, এর বৈপরীত্যে জ্বলে উঠছে তাঁর চোখের সজীবতা। …

অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে হোটেল থেকে নিয়ে গেলেন তার এক আত্মীয়ের বাসা ‘মিলারিওতে’। বাড়ির উত্তর দিক দিয়ে বয়ে চলেছে প্লাতা নদী। প্লাতা নদীর ধারের সে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ কাটিয়েছিলেন প্রায় দুই মাস। রবীন্দ্রনাথ যেদিন মিলারিওতে পৌঁছান, সেদিনই তিনি ‘বিদেশী ফুল’ কবিতাটি লিখেন –

হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম—

‘কী তোমার নাম’,

হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তবে

নামেতে কী হবে।

আর কিছু নয়,

হাসিতে তোমার পরিচয়।

হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে বুকের কাছে ধরে

শুধালেম ‘বলো বলো মোরে

কোথা তুমি থাকো

হাসিয়া দুলালে মাথা, কহিলে ‘জানি না, জানি নাকো’।

বুঝিলাম তবে

শুনিয়া কী হবে

থাকো কোন দেশে

যে তোমারে বোঝে ভালোবেসে

তাহার হৃদয়ে তব ঠাঁই,

আর কোথা নাই।

১২ নভেম্বরে ‘বিদেশী ফুল’ লেখার পরে, কবি ১৫ নভেম্বরে ‘অন্তর্হিতা’, ১৭ তারিখে ‘আশঙ্কা’ আর ২১ তারিখে ‘শেষ বসন্ত’ লিখলেন। এসব কবিতায় প্রেমের প্রকাশ এতটাই তীব্র ছিল যে রবীন্দ্রনাথ এলমহার্স্টকে কবিতাগুলো দেশে তার পুত্র ও পুত্রবধূদের কাছে পাঠাতে নিষেধ করেছিলেন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথমে সাত দিন থাকার কথা ছিল আর্জেন্টিনায়। তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে এসে দাঁড়ায় বায়ান্ন দিনে। সান ইসিদ্রোর সেই বাড়ি মিলারিওর বারান্দায় বসে বসে রবীন্দ্রনাথ এবং ভিক্টোরিয়া একসাথে নদী দেখতেন। কখনো বা বাড়ি সংলগ্ন তিপা গাছের নিচে বসে অবিশ্রান্ত আড্ডা দিতেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন বিজয়াকে, বিজয়াও শোনাতেন শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা। সে সময়টাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপভোগ করেছেন প্রাণভরে। সুদূর সান ইসিদ্রোর সেই বাড়ির স্মৃতি রোমন্থন করেছেন শান্তিনিকেতনে বসেও।

তিপা গাছের নিচে বসে তাঁদের অবিশ্রান্ত আড্ডা চলত; Image Source : thehindu.com

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে । তিনি কেবল দুটো শব্দ লিখেছিলেন- ‘বিজয়ার করকমলে’। এই বিজয়া যে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোই তা বলা বাহুল্য! তিনি যে তার একটি বই ভিক্টোরিয়াকে উৎসর্গ করেছেন সেটি আর্জেন্টিনায় চিঠি লিখেও জানিয়েছিলেন। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “বইখানা তোমায় উৎসর্গ করা, যদিও এর ভিতরে কী রয়েছে তা তুমি জানতে পারবে না।” ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কিন্তু ১৯২৫ সালের ২৮ ডিসেম্বরের চিঠিতে লিখেছিলেন, “বইটাতে কী আছে তা জানার জন্য আমি পাগল হয়ে আছি।” প্রেমের প্রকাশে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন! রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি পুরো একটি বই-ই লিখে ফেললেন । ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বই ‘Tagore en las barrancas de San Isidro’, বাংলায় বলা যায় ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় ঠাকুর’ বা ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বায়োপিক ‘থিঙ্কিং অব হিম’ সিনেমায় উঠে এসেছে বিজয়ার সাথে তার এই প্রেমের গল্প ।

‘থিঙ্কিং অব হিম’ সিনেমার একটি দৃশ্য; Image Source : scroll.in

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয় মাত্র দু’বার। ১৯২৪ সালে আর্জেন্টিনায় দেখা হওয়ার পর আবার দেখা হয় প্যারিসে, ১৯৩০ সালে। সেবার প্যারিসের বিখ্যাত পিগাল গ্যালারিতে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দেন ভিক্টোরিয়া। তাদের লেখা চিঠিগুলোতে দেখা যায়, একজন আরেকজনকে বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করছেন। রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে বারবার শান্তিনিকেতনে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যদিও আর্জেন্টিনা ও প্যারিস ছাড়া আর কোথাও দেখা হয়নি দুজনের। দেখা না হলেও যোগাযোগ কিন্তু বন্ধ ছিল না। প্রায় নিয়মিতই একজন আরেকজনকে চিঠি লিখতেন, টেলিগ্রামে বার্তা আদান-প্রদান হতো।

রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া: Image Source: flickr.com

রবীন্দ্রনাথ তাঁর একেবারে শেষ চিঠিতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লিখেছিলেন,

“এতোদিন পরে তোমার আমাকে মনে পড়ল – কী যে ভালো লাগছে! পৃথিবীর সব রঙ ফিকে হয়ে আসছে যখন, বিমর্ষ মন কেবল তাদের নৈকট্যই কামনা করে যাদের স্মৃতি সুখময় দিনগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে। যতো দিন যায়, সেই স্মৃতিগুলো যেন গাঢ় হতে থাকে।”

এভাবেই তিনি ভিক্টোরিয়াকে তার সেসময়ের অনুভূতির কথা জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, সেসময়েও তার পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, খোঁজখবর নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের মৃত্যুসংবাদ ভিক্টোরিয়া পান তাঁর গাড়িতে বসে, রেডিওর সংবাদে। নিজ স্মৃতিকথায় ভিক্টোরিয়া লিখেছিলেন,

“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেছেন, তাঁর ভারতবর্ষে। খবর পেলাম পথে, রেডিও থেকে, বুয়েন্স আয়ার্স আর মার দেল প্লাতার মাঝামাঝি জায়গায়। নির্জন রাজপথে ছুটে চলেছে গাড়িটা। চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ সমতলভূমিকে ঢেকে আছে শীতের ধূসর আকাশ…।”

মৃত্যুর চার মাস আগে ভিক্টোরিয়াকে ভেবে লেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ পৌঁছে দিয়েছিলেন গন্তব্যে। যে কবিতাটি ছিল অনেকটা এরকম-

“বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে

যে প্রেয়সী পেতেছে আসন

চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া

কানে কানে তাহারি ভাষণ।

ভাষা যার জানা ছিল নাকো,

আঁখি যার কয়েছিল কথা,

জাগায়ে রাখিবে চিরদিন

সকরুণ তাহারি বারতা।”

কী বলা যায় এ প্রেমকে? নিষ্কাম প্লেটোনিক প্রেম? যা-ই বলা হোক না কেন, দূরত্ব আর বয়সের বাঁধা ছাপিয়ে এ প্রেম ছিল বাধাহীন, ছিল স্মৃতিময়, আর ছিল পৃথিবীর এক ঐতিহাসিক সম্পর্কের সাক্ষী।

ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসমূহ পড়তে ক্লিক করতে পারেন এই লিঙ্কেঃ

১) রবীন্দ্র-রচনাবলি (১-৩০খণ্ড)

Related Articles

Exit mobile version