বর্তমান যুগ প্রতিযোগিতার যুগ, সবাই চায় নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করে পাশের মানুষটির থেকে এগিয়ে যেতে। এসব দক্ষতার মধ্যে অন্যতম একটি হলো মাতৃভাষার পাশাপাশি অপর একটি ভাষা শিখতে পারা। কাজটা বেশ কঠিন বটে। একটি ভাষার ঠিক কতটুকু শিখলে আসলে বলা যায় যে, “আমি এই ভাষাটি শিখতে পেরেছি”, সেটা বোঝাই দুষ্কর।
তাই নতুন ভাষা শিখতে গিয়ে হতাশ হয়ে যায় অনেকেই। দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে একটি ভাষা শিখছে, অথচ সেই ভাষায় যোগাযোগ করার ক্ষমতা এখনো তার হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, শব্দের পর শব্দ মানুষটি শিখে গেছেন সত্য, কিন্তু ঠিক যেসব শব্দ তার জানা প্রয়োজন, সেগুলোই তিনি ঠিকঠাক আয়ত্তে আনেননি।
এ প্রবন্ধে চেষ্টা করা হবে বিদেশি ভাষা শেখার সহজ কিছু উপায় বাতলানোর। ঠিক কতগুলো শব্দ একটি ভাষায় নিয়মিত ব্যবহৃত হয়, তা বের করার।
যেকোনো ভাষার ঠিক কতগুলো শব্দ জানলে আপনি সে ভাষায় কথা বলতে পারবেন, তা বের করার জন্য চলুন আমরা প্রথমে পর্যবেক্ষণ করি আমাদের পরিচিত এবং অহরহ ব্যবহৃত গ্লোবাল ল্যাঙ্গুয়েজ ইংরেজিকে।
অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী, ইংরেজি ভাষায় বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে ১,৭১,১৪৬টি শব্দ, আর অকেজো হয়ে গেছে ৪৭,১৫৬টি শব্দ।
জার্মান বা মান্দারিন শিখতে গিয়ে এতগুলো শব্দ শেখা কি আদৌ সম্ভব? মোটেও নয়। তাই কোনো একটা চালাকি তো আমাদের করতেই হবে।
সেই চালাকির জন্য আমরা দ্বারস্থ হব প্রখ্যাত ভাষাবিদ পল ন্যাশন আর জন রিডের কাছে। কী করেছিলেন তারা? তারা তাদের সহকর্মী রবিন গোল্ডেনকে সাথে নিয়ে ভয়ংকর এক কাজ করে ফেলেছিলেন, তৈরি করে ফেলেছিলেন মাত্র ৫০ শব্দের একটি তালিকা এবং বলেছিলেন এই ৫০ শব্দ দিয়েই একজন মানুষের ইংরেজি শব্দভাণ্ডার বিচার করা সম্ভব।
তাদের তত্ত্বটা ছিল এরকম, এই পঞ্চাশ শব্দের মধ্যে একজন মানুষ যে কয়টা শব্দ জানবে, সে সংখ্যাটিকে ৫০০ দিয়ে গুণ করলেই মানুষটি ইংরেজি ভাষার ঠিক কয়টা শব্দ জানে তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
তাদের তালিকার শুরুতে সহজ শব্দই ছিল- Dog, Editor, Immense… কিন্তু তালিকাতে আপনি যত সামনে এগোতে থাকবেন ততই শব্দগুলো কঠিন হতে থাকবে। একসময় দেখা যায় ‘oleaginous’ বা ‘cowsucker’ এর মতো শব্দ চলে আসছে। এগুলোকে কি আদৌ আপনি কোনো বাক্যে ব্যবহার করতে পারবেন? অনেকে হয়তো বলবেন cowsucker’ মানে তো বোধহয় ‘গরুচোষা’ বা এ ধরনের কিছু। তাদেরকে হতাশ করে বলতে হয়, শব্দটির সাথে ‘গরু’ বা ‘চোষা’-এর ন্যূনতম কোনো সম্পর্কও নেই। উত্তর আমেরিকার নিরীহ একধরনের সাপের নাম এটা।
পল ন্যাশনের এই তালিকা এখন অনলাইনে একটি টেস্ট হিসেবে পাওয়া যায়, নাম ‘পলস ফ্রি ভোকাবুলারি সাইজ টেস্ট’, ১০০ শব্দের একটি টেস্ট সেটা।
আরেকজন ভাষাবিদ, ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অন্টারিওতে ফলিত ভাষাবিজ্ঞানের প্রফেসর স্টুয়ার্ট ওয়েব, ভোকাবুলারি শেখার প্রক্রিয়ার উপর ব্যাপক গবেষণা করে ব্যাপারটার একটি আলংকরিক নামও দিয়ে ফেলেছেন- ‘ল্যাংগুয়েজ একুইজিশন’ বা ভাষা অর্জন। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভাষা আদতেই অর্জন করার মতো কিছু।
তিনি দেখিয়েছেন, একজন নতুন ভাষা শেখা মানুষের জন্য মাতৃভাষার সমান শব্দ শেখা রীতিমতো অসম্ভব।
তিনি উদাহরণ হিসেবে নিয়েছেন নিজের মাতৃভাষা ইংরেজিকে। ইংরেজি ভাষাভাষী লোকজন সাধারণত পনের থেকে বিশ হাজার ওয়ার্ড ফ্যামিলি বা লেমা (lemma) জানে।
প্রশ্ন হলো, লেমা কী? রুট ওয়ার্ড, বা বাংলায় যাকে আমরা বলি ধাতু, সেই ধাতু এবং ধাতু থেকে আগত সব শব্দ মিলে তৈরি হয় একেকটি লেমা। যেমন- run, running, ran; red, reddish ইত্যাদি।
কিন্তু একজন দ্বিতীয় ভাষায় বাকপটু ব্যক্তি কি সেই ভাষারও পনের থেকে বিশ হাজার রুট ওয়ার্ড জানেন? আমাদেরও কি জানতে হবে এতগুলো শব্দ? প্রফেসর ওয়েব বলছেন, তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
তিনি দেখেছেন, গতানুগতিক পন্থায় যারা দ্বিতীয় ভাষা শিখছেন- ধরুন ব্রিটেনে বসা কেউ ফ্রেঞ্চ, বা জাপানে বসা কেউ ইংরেজি- কেউই দুই থেকে তিন হাজারের বেশি শব্দ জানেন না, বছরের পর বছর শেখার পরেও না।
এমনকি তাইওয়ানের একটা অধ্যয়নে দেখা গেছে, বিদেশী ভাষা শেখা শিক্ষার্থীরা, ৯ বছর একটা ভাষা শেখার পরেও, সে ভাষার সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ১০০০ শব্দই ঠিকঠাক জানে না।
অথচ সেটাই কিন্তু একটি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে মূল দেখার বিষয়, যেসব শব্দ আপনি শিখছেন, দৈনন্দিন জীবনে সেগুলো আসলে কতটুকু ব্যবহৃত হয়। একটি ভাষার সব শব্দ তো আর আমাদের শেখার দরকার নেই, যেমন ফ্রান্সের একজন মানুষের তো আর বাংলা শিখতে গেলে শেখার দরকার দরকার নেই যে ‘ল্যাংড়া’ একপ্রকার আমের নাম।
তবে আমরা কী কী শব্দ শিখব? প্রফেসর ওয়েব বলছেন, যেকোনো ভাষা শেখার সবচেয়ে ফলপ্রসূ উপায় হচ্ছে সে ভাষার সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ৮০০ থেকে ১০০০ লেমাগুলোকে বের করে, সেগুলো শিখে ফেলা।
কেউ যদি ইংরেজির সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ৮০০টি লেমা শিখে ফেলে, তবে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ইংরেজির শতকরা ৭৫ ভাগ সে বুঝতে পারবে। ইতালিয়ান ফুটবল ম্যানেজার ফ্যাবিয়ো ক্যাপেলো ইংলিশ ফুটবল টিমের ম্যানেজার থাকা সময়ে বলেছিলেন, তিনি মাত্র ১০০টি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেই তার দলকে ম্যানেজ করে ফেলেন। ব্যাপারটা পুরোপুরিভাবে সত্য না হলেও ট্যাক্টিক্স বোঝাতে কখনোই তার খুব বেশি শব্দ লাগেনি, আর কোনো ইংরেজি শেখার কোচও তার ছিল না। শুধু নিয়মিত ব্যবহৃত শব্দগুলো তিনি তার মুখে লুফে নিয়েছেন।
তাই এই ৮০০ টি লেমাই অন্যান্য যেকোনো শব্দ থেকে অনেক বেশি কার্যকর, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ শব্দগুলোই ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। যেমন, ‘house’ শব্দটি জানা ‘abode’ শব্দটি জানার তুলনায় অনেক বেশি কার্যকরী; আবার ‘perhaps’ বলেই যেখানে আপনি ‘সম্ভাব্য’ বোঝাতে পারবেন, ‘peradventure’ বলার সেখান কোনো প্রয়োজন নেই।
তবে কি শব্দের পর শব্দ শিখে গিয়েও একটি ভাষাকে আয়ত্তে আনতে না পারা মানুষগুলোর এখনো আশা আছে? কিংবা সেসব তাইওয়ানের শিক্ষার্থীদের ৯ বছরের ব্যর্থতা কি এখনো সাফল্যে রূপ নিতে পারে? নির্ভর করবে তারা কেন নতুন ভাষাটি শিখতে চাচ্ছে তার উপর।
৮০০ লেমা আপনাকে প্রতিদিনের জীবনে একটি ভাষায় কথা বলে চালিয়ে নেবার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু টিভি বা চলচ্চিত্রকে ভালোভাবে বুঝতে হলে আপনাকে সবচেয়ে কমন ৩০০০ লেমা শিখতে হবে।
আর লেখা পড়তে হলে, যেমন উপন্যাস, পত্রিকা বা ভালো লেখা কোনো প্রবন্ধ- সেগুলোর জন্য আপনাকে জানতে হবে ৮০০০ থেকে ৯০০০ লেমা।
তবে এক হাজার লেমায় আপনার শব্দভাণ্ডার এবং ভাষার ব্যবহার কেমন হতে পারে, তা বুঝতে ঘুরে আসতে পারেন থিও অ্যান্ডারসনের তৈরি এই সাইটটিতে।
তাহলে নতুন ভাষা শিখতে ইচ্ছুক উৎসাহীরা আজই বসে পড়ুন, আপনার পছন্দের ভাষাটি নিয়ে। ইন্টারনেট রিসার্চ করে বের করে ফেলুন সে ভাষায় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ৮০০-১০০০ শব্দ। প্রতিদিন ৪-৫টি করে শব্দ এবং তার ব্যবহারকে আয়ত্তে আনতে পারলে এক বছরের মাথাতেই সে ভাষায় আপনি যোগাযোগ করতে পারবেন, যা বর্তমান সময়ের জন্য অনেক কার্যকরী একটি দক্ষতা।