ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোভিডের সময়কে আমরা কীভাবে সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পারি? অনেকের বিশ্বাস- করোনাভাইরাসের এই ভয়াবহতাই প্রমাণ করে মানুষ প্রকৃতির কাছে কতটা তুচ্ছ। আদতে, ২০২০ সাল দেখিয়েছে মানুষ প্রকৃতির সামনে ততটাও অসহায় নয়। মহামারি এখন আর প্রকৃতির কোনো অনিয়ন্ত্রিত শক্তি নয়। বিজ্ঞান এদেরকে নিয়ন্ত্রণের স্পর্ধা রাখে।
তাহলে এত মৃত্যু, এত কষ্টভোগ কেন? কারণ, অসাধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল।
আগের যুগগুলোতে মানুষ যখন ব্ল্যাক ডেথের সম্মুখীন হয়েছিল, তখন তারা জানতই না— এই রোগ আসলে কী, এবং কীভাবে এর মোকাবিলা করা যায়। ১৯১৮ সালে যখন পৃথিবীতে ইনফ্লুয়েঞ্জা আঘাত হানে, তখন বিজ্ঞানীরা সেই মারাত্মক ভাইরাসকে চিনতেই পারছিলেন না, অনেক প্রতিব্যবস্থাই ছিল অকার্যকর, এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা ছিল বৃথা।
কিন্তু কোভিড-১৯ এর সময় এটা একদমই অন্যরকম ছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে একটি মহামারি আসার বিপদসংকেত প্রচারিত হয়। ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি বিজ্ঞানীরা কেবল ভাইরাস চিহ্নিতই করেনি, তারা এই ভাইরাসের জিনোমসহ সকল তথ্য অনলাইনে প্রকাশও করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়, কীভাবে এই ভাইরাসের চেইন আক্রমণকে প্রতিহত করা যেতে পারে। এবং এক বছরেরও কম সময়ে একাধিক কার্যকর ভ্যাকসিন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। মানুষ এবং রোগজীবাণুর যুদ্ধে মানুষ এর আগে এতটা শক্তিশালী ছিল না।
অনলাইনভিত্তিক জীবন
জীবপ্রযুক্তির (Biotechnology) এই অভূতপূর্ব অর্জন ছাড়াও কোভিডের সময়ে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। আগের যুগে মানুষ কদাচিত মহামারি থামাতে পারত, কারণ তখন বাস্তবিক সময়ের ইনফেকশন চেইনকে তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারত না, কেননা অর্থনৈতিক কারণে লকডাউনের ব্যাপ্তিকাল তখন মানা হতো না। ১৯১৮ সালে আপনি সেসব মানুষকেই কোয়ারেন্টাইনে রাখতে পারতেন, যারা সেই মারাত্মক ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসত। কিন্তু যারা ভাইরাসের উপসর্গবিহীন বাহক থাকত, তাদের চিহ্নিত করা দুঃসাধ্য ছিল। আপনি যদি একটি দেশের সকলকে কয়েক সপ্তাহের জন্য বাড়িতে থাকতে বাধ্য করতেন, তাহলে অর্থনীতি ভেঙে পড়ত, সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ত, এবং মানুষকে অনাহারেই মরতে হতো।
এদিক থেকে, ২০২০ সালের ডিজিটাল নজরদারির কারণে রোগের ভেক্টর-সমীক্ষা মনিটর করা অতি তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ফলে কোয়ারেন্টাইনের ব্যাপারে আরো বেশি বাছাইপ্রবণ (selective) এবং উপযোগী হতে পেরেছে। এছাড়া অত্যাবশ্যকীয়ভাবে, অন্তত উন্নত দেশগুলোতে, স্বয়ংক্রিয়তা এবং ইন্টারনেট এই লকডাউনের ব্যাপ্তিকালকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। যদিও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানুষের অভিজ্ঞতা সেই প্লেগের সময়ের অভিজ্ঞতার মতোই ছিল, তবে বেশিরভাগ উন্নত দেশই ডিজিটাল বিপ্লবের মাধ্যমে সবকিছু পরিবর্তন করতে পেরেছে।
কৃষিকাজকে বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাই, হাজার বছর ধরে খাদ্য উৎপাদনের জন্য মানুষ কেবল কায়িক শ্রমেই বিশ্বাস করত, এবং ৯০% মানুষ কৃষিকাজের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে সেই চেহারা আর দেখা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রে এখন মাত্র ১.৫% মানুষ কেবল কৃষিকাজ করে। অথচ, এতেই তারা নিজেদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন করার পরেও খাদ্য-রপ্তানীকারক দেশগুলোর মধ্যেও শীর্ষে অবস্থান করছে। কৃষিকাজের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তারা মেশিন ব্যবহার করছে, যার ফলে রোগ ছড়িয়ে পড়া তারা প্রতিরোধ করতে পারছে। এজন্য লকডাউন তাদের কৃষিকাজে খুবই কম বিঘ্ন ঘটাতে পেরেছে।
প্লেগ মহামারিকালের একটি গমক্ষেতকে কল্পনা করে দেখুন। আপনি যদি কৃষি-মৌসুমে কৃষকদের ঘরে বন্দী থাকতে বাধ্য করেন, তবে আপনাকেই অনাহারে মরে যেতে হবে। কিন্তু আপনি যদি তাদের কৃষিকাজ করতে দেন তবে হয়তো তারা একে অপরকে রোগে সংক্রমণ করতে পারে, তাহলে আপনি কোনটা বেছে নেবেন?
এখন আপনি ২০২০ সালের একটি গমক্ষেত কল্পনা করুন। সংক্রমণের কোনো সম্ভাবনা ছাড়াই একটি জিপিএস সিস্টেমের মেশিনের মাধ্যমে গোটা ক্ষেতে খুব সফলভাবে কৃষিকাজ করা যাবে। ১৩৪৯ সালে একজন কৃষক সারাদিন কাজ করে গড়ে মাত্র ১৭৫ লিটার বা ৮ গ্যালন শস্য সংগ্রহ করতে পারতো, কিন্তু ২০১৪ সালে মেশিনের মাধ্যমে একদিনে গড়ে ১০ লক্ষ ৫০ হাজার লিটার আয়তনের শস্য কাটার রেকর্ড আছে। ফলে খাদ্যশস্য, যেমন- গম, ভুট্টা এবং ধান উৎপাদনে কোভিড-১৯ বিশ্বে তেমন কোনো বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি।
জনগণকে খাদ্যের যোগান দিতে কেবল শস্য-উৎপাদনই যথেষ্ট নয়। আপনাকে সেই শস্য পরিবহনের ব্যবস্থাও করতে হবে, কখনো কখনো হাজার হাজার মাইলের পথও অতিক্রম করতে হবে। মহামারির ইতিহাসে বাণিজ্যই মূলত প্রধান খলনায়ক ছিল। মারাত্মক রোগজীবাণুগুলো বাণিজ্যিক জাহাজ এবং দূরপাল্লার ক্যারাভ্যানের মাধ্যমেই বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, প্লেগ পূর্ব এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে সিল্ক রোডের রুটে ধাবিত হয়, এবং এরপর এই রোগ জেনোয়াবাসী বাণিজ্যিক জাহাজের মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করে। বাণিজ্য এতটা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল কারণ প্রত্যেক মালগাড়িরই অন্ততপক্ষে একজন চালকের প্রয়োজন ছিল, এমনকি একটি ছোট্ট সামুদ্রিক জাহাজেরও ডজন ডজন নাবিকের প্রয়োজন ছিল। ফলে জনবহুল জাহাজ আর পান্থশালাগুলোই রোগজীবাণুর ঘাঁটি ছিল।
২০২০ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্য মোটামুটি মসৃণভাবেই চলতে পেরেছে, কারণ অল্প সংখ্যক মানুষই এর সাথে জড়িত ছিল। বর্তমান যুগের কন্টেইনারবাহী জাহাজগুলো আগের দিনের আধুনিক বাণিজ্যিক জাহাজের থেকে অধিক পরিমাণে মালামাল বহন করতে পারে। ১৫৮২ সালে ৬৮,০০০ টন বহন-ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইংরেজ বাণিজ্যিক নৌবহর চালাতে ১৬,০০০ নাবিকের প্রয়োজন হতো। আর ২০১৭ সালে, ওওসিএল হংকং (OOCL Hong Kong) নামের কন্টেইনারবাহী জাহাজ মাত্র ২২ জন নাবিকের সাহায্যে ২,০০,০০০ টন মালামাল বহন করতে পারে।
সত্যিকার অর্থে প্রমোদতরী আর উড়োজাহাজে ভ্রমণকারীরাই কোভিড-১৯ সংক্রমণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ব্যবসার জন্য পর্যটন এবং ভ্রমণ কোনো দরকারি বিষয় নয়। যখন স্বয়ংক্রিয় জাহাজ আর মনুষ্যবিহীন ট্রেনগুলো অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পেরেছে, তখন পর্যটকরা বাড়িতেই থাকতে পারত আর ব্যবসায়ী মানুষেরা জুম অ্যাপের মাধ্যমেই ব্যবসায়িক মিটিং সারতে পারত। ২০২০ সালে যখন আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি হলো, তখন সমুদ্র-উপকূলবর্তী বাণিজ্যের মাত্র ৪ শতাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সেবাপ্রদানের ক্ষেত্রে অটোমেশন এবং ডিজিটালাইজেশন ব্যাপক অবদান রেখেছে। ১৯১৮ সালে এটা অকল্পনীয় ছিল যে, লকডাউনের সময় অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত, এবং গীর্জার কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। যদি শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষকমণ্ডলী বাড়িতেই অবস্থান করে, তবে তুমি শিক্ষা-কার্যক্রম কীভাবে চালাবে? আমরা এখন এই প্রশ্নেরও উত্তর জানি। অপরিমেয় মানসিক চাপ ছাড়াও অনলাইনে অনেক রকম অসুবিধা আছে। অকল্পনীয় বেশ কিছু সমস্যা এটি সৃষ্টি করেছে, যেমন- অনলাইন মিটিংয়ে একজন উকিল সফটওয়্যারের জটিলতায় একটি বিড়ালের অ্যানিমেশনে আদালতে বক্তব্য রেখেছিল, যা ভীষণরকম ভাইরাল হয়ে যায়। এটা আসলে হতবুদ্ধিকর ব্যাপারই বটে।
১৯১৮ সালে যখন মারাত্মক ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়ে, তখন মানুষ কেবল বাস্তব জগতের সাথেই পরিচিত ছিল, বাস্তবজগত ছাড়া আর কোথাও তাদের যাবার জায়গা ছিল না। বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষই দুটো জগতে বসবাস করে- বাস্তব এবং ভার্চুয়াল। যখন বাস্তব জগতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লো, অনেক মানুষই তখন ভার্চুয়াল জগতে বেশি বেশি জীবনযাপন শুরু করল, ভার্চুয়াল জগতে তো আর করোনাভাইরাস আক্রমণ করতে পারবে না!
মানুষ অবশ্যই এখনও বাস্তব জগতেই বসবাস করে, সকল কিছুকেই তো আর ডিজিটাল করা সম্ভব নয়। নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ট্রাক ড্রাইভার, ক্যাশিয়ার, ডেলিভারিম্যানদের মতো অল্প পারিশ্রমিকের পেশাজীবীরা আমাদের সভ্যতায় কত বড় অবদান রাখে, সে-সম্পর্কে এই কোভিডের সময়ে ধারণা পাওয়া গেছে। কথায় বলে, প্রত্যেক সভ্যতাই বর্বরতা থেকে মাত্র তিনবেলার খাবার পরিমাণ দূরে অবস্থান করে। ২০২০ সালে সভ্যতাকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে ডেলিভারিম্যানরাই বাস্তব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইন হয়ে উঠেছিল।
ইন্টারনেট আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে
মানবজাতি যখন স্থান পরিবর্তন করে স্বয়ংক্রিয়, ডিজিটাল, এবং অনলাইনভিত্তিক জীবনে প্রবেশ করছে, তখন এই জীবন আমাদেরকে নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কোভিডের সময়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, ইন্টারনেট কানেকশনে তেমন কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। আমরা যদি অধিক সংখ্যক জনগণ মিলে বাস্তবিকভাবে কোনো ব্রিজের উপর দিয়ে যাই, তাহলে ট্রাফিক জ্যাম হবার সম্ভাবনা থাকে, এমনকি অতিরিক্ত লোডে ব্রিজ ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাও আছে। ২০২০ সালে স্কুল, কলেজ এবং গির্জাগুলো সারাদিন-রাত অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম চালিয়েছে, কিন্তু ইন্টারনেট তা-ও সহ্য করেছে।
আমরা এই ব্যাপার নিয়ে এখনো চিন্তাভাবনা করছি না, কিন্তু আমাদের চিন্তা শুরু করা উচিত। ২০২০ সালে আমরা জানতে পেরেছি, একটি দেশ বাস্তবিকভাবে লকডাউনে থাকলেও আমরা চলতে পারি। এখন কল্পনা করার চেষ্টা করুন, যদি ডিজিটাল কাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে কী ঘটবে?
অর্গানিক ভাইরাস মোকাবিলায় ইনফরমেশন টেকনোলজি আমাদেরকে অনেক স্বস্তি দিয়েছে, আবার ম্যালওয়্যার এবং সাইবার-যুদ্ধের কারণে আমরা অনেকটা অস্বস্তিতেও পড়েছি। অনেক মানুষই এখন জানতে চাইছে, “পরবর্তী কোভিড আসলে কী হতে পারে?” আমাদের ডিজিটাল অবকাঠামোর উপর আঘাতই হতে পারে পরবর্তী ক্যান্ডিটেট। বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস কয়েকমাস সময় নিয়েছিল। আমাদের ডিজিটাল অবকাঠামোর পতন ঘটতে হয়তো মাত্র একদিন লাগবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যেখানে আমাদের স্কুল আর অফিসগুলো অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করতে পেরেছিল, সেখানে এই ইমেইলের যুগ থেকে আবার চিঠিপত্রের যুগে ফিরে যেতে আমাদের কত সময় লাগতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
আমাদের কী করা উচিত?
বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত শক্তির একটা বিশেষ অসুবিধার কথা এই কোভিডের সময়ে আমাদের সামনে উঠে এসেছে। বিজ্ঞান কখনো রাজনীতির জায়গা নিতে পারবে না। আমাদের যখন কোনো পলিসির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তখন অনেক রকম সুবিধা-অসুবিধা এবং নৈতিকতার ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হয়, কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়, কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই নিশ্চিতভাবে বলে দিতে পারবে না আমাদের আসলে কী করা উচিত।
উদাহরণস্বরূপ, যখন কোথাও লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তখন এরকম প্রশ্ন করা যথেষ্ট নয় যে, “যদি লকডাউন দেয়া না হয় তবে কতজন মানুষ কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে?” আমরা আরো যেসব প্রশ্ন করতে পারি, “লকডাউন দিলে কতজন হতাশায় (Depression) ভুগতে পারে? কতজন অপুষ্টিতে ভুগতে পারে? কতজন স্কুল থেকে ঝরে পড়তে পারে কিংবা কতজন চাকরি হারাতে পারে? কতজন তাদের জীবনসঙ্গীর হাতে লাঞ্ছিত হতে পারে কিংবা নিহত হতে পারে?”
আর যদি এই সকল তথ্য-উপাত্ত সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্যও হয়, তবুও আমাদের প্রশ্ন করতেই হবে, “আমাদের কী করা উচিত? কে সিদ্ধান্ত নেবে আমাদের কী করা উচিত? আমরা কীভাবে এক জরিপের বিরুদ্ধে আরেক জরিপকে মূল্যায়ন করবো?” এটা আসলে বৈজ্ঞানিক কোনো কাজ নয়, এটা রাজনৈতিক কাজ। রাজনীতিবিদদেরকেই চিকিৎসাখাত, বাণিজ্যখাত এবং সামাজিক সকল বিষয়ের দিকে খেয়াল রেখে একটি গ্রহণযোগ্য পলিসি বের করে আনতে হবে।
একইভাবে, ইঞ্জিনিয়াররা এখন নতুন সব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে, যা আমাদেরকে লকডাউনের মাঝেও কাজ করতে সাহায্য করছে, আর নতুন নতুন এসব তত্ত্বাবধায়ক টুল সংক্রমণের চেইন ভাঙতে আমাদেরকে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ডিজিটাল এবং তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিগুলো আমাদের প্রাইভেসি বিপন্ন করে তুলেছে, এবং অভূতপূর্ব সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থার জন্য রাস্তা করে দিচ্ছে। ২০২০ সালে জনগণকে নজরদারিতে রাখা আরো বেশি বৈধ এবং সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে। মহামারির বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা দরকার, কিন্তু তাই বলে কি এটা আমাদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে করতে হবে? দরকারি তত্ত্বাবধান এবং ডিসটোপিয়ান দুঃস্বপ্নের মাঝে সমতা সাধন করা আসলে রাজনীতিবিদদের কাজ, এটা ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ নয়।
এমনকি প্লেগের মতো মহামারির সময়ও তিনটি মৌলিক নিয়ম আমাদের ডিজিটাল স্বৈরতন্ত্র থেকে বাঁচাতে পারে। প্রথমত, যখনই আপনি জনগণের থেকে তথ্য সংগ্রহ করবেন— বিশেষত, তাদের দৈহিক কোনো তথ্য, তখন তাদের বিভ্রান্ত, নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষতিসাধনের পরিবর্তে সেই তথ্য তাদের উপকারে ব্যবহার করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত ডাক্তার আমার সম্পর্কে অনেক গোপনীয় তথ্য জানে। এতে আমি অভ্যস্ত, কারণ আমি জানি এই তথ্যগুলো তিনি আমার উপকারেই ব্যবহার করবেন। আমার ব্যক্তিগত ডাক্তারের কখনো কোনো করপোরেশনের কাছে কিংবা রাজনৈতিক দলের কাছে এসব তথ্য বিক্রি করা উচিত নয়। যেকোনো ‘মহামারি তত্ত্বাবধায়ক অথোরিটি’কে ঠিক এভাবেই কাজ করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধান সব দিক থেকেই হওয়া উচিত। নজরদারি যদি কেবল শীর্ষ থেকে তলদেশ পর্যন্ত করা হয়, তবে এটা স্বৈরতন্ত্রের রাস্তাই হবে। তাই আপনি যখন ব্যক্তিবিশেষে নজরদারি বৃদ্ধি করবেন, একইসাথে আপনাকে সরকার এবং করপোরেশনের উপরও নজরদারি বাড়াতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে সরকার প্রচুর পরিমাণে অর্থকড়ি প্রদান করছে। এই ফান্ড প্রদানের পদ্ধতি অনেক বেশি স্বচ্ছ হওয়া উচিত। একজন নাগরিক হিসেবে আমি জানতে চাই— কে কী পাচ্ছে এবং অর্থকড়ি কাকে দেওয়া হবে, এই সিদ্ধান্ত কে নিচ্ছে। কোনো মন্ত্রীর পরিচিত বড় করপোরেশনের মালিকের পরিবর্তে ছোট কোনো ব্যবসায়ী যার অনুদান সত্যিই দরকার সে-ই অনুদান পাচ্ছে, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে চাই। যদি কোনো সরকার বলে, এই মহামারির সময়ে এতটা পুঙ্খানুপুঙ্খ তত্ত্বাবধান করা সম্ভব নয়, তবে তাদেরকে বিশ্বাস করবেন না। আপনি কখন কী করছেন, তা নজরদারিতে রাখা যদি কোনো বিষয় না হয়, তবে সরকারের কর্মকাণ্ডে নজরদারি রাখাও খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
তৃতীয়ত, কখনোই একটা জায়গায় অধিক তথ্য জমা রাখার অনুমোদন দেবেন না। মহামারির সময়েও নয়, মহামারি শেষ হয়ে যাবার পরেও নয়। একটা একীভূত তথ্য সংগ্রহশালা হলো স্বৈরতন্ত্রের একটি কৌশল। তাই যদি মহামারি প্রতিরোধ করতে কোনো বায়োমেট্রিক তথ্য-সংগ্রহ শুরু হয়, তবে এই কাজ হয় পুলিশের মাধ্যমে আর নয়তো স্বাধীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করা উচিত। এবং এই তথ্যগুলোকে সরকারের মন্ত্রীসভা ও বড় করপোরেশনের থেকে আলাদা করে রাখতে হবে। এটা অবশ্যই আতিশায্য এবং অদক্ষতা সৃষ্টি করবে। অদক্ষতা কেবল একটি বৈশিষ্ট্য, এটা কোনো রোগজীবাণু নয়। আপনি কি ডিজিটাল স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিরোধ করতে চান? বিষয়গুলোকে কিছুটা অন্তত অদক্ষই থাকতে দিন।
রাজনীতিবিদদের বিষয়ে
বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির এত সফলতার পরেও ২০২০ এর কোভিড-১৯ সংকট সমাধান করা যায়নি। এই মহামারি একটি প্রাকৃতিক সংকট থেকে রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। প্লেগে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখন কেউই রাজা কিংবা সম্রাটের কাছে কোনোরকম প্রত্যাশা করেনি। প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ ইংরেজ জনগণ প্লেগের প্রথম ওয়েভেই মারা গিয়েছিল, কিন্তু তাতে ইংরেজ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের সাম্রাজ্য হারানোর ভয় ছিল না। মহামারিকে থামানো তখনকার রাজাদের সাধ্যের বাইরের কাজ ছিল, তাই এই ব্যাপার নিয়ে কেউ কাউকে দোষারোপ করেনি।
কিন্তু বর্তমানে মানুষের কাছে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে, যার মাধ্যমে কোভিড-১৯ থামানো যেতে পারত। বিভিন্ন দেশ, ভিয়েতনাম থেকে অস্ট্রেলিয়া, প্রমাণ করে দিয়েছে, ভ্যাকসিন ছাড়াও শুধু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মহামারি দমিয়ে রাখা যেতে পারে। যদিও এসব যন্ত্রপাতি অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে অনেক দামী। আমরা ভাইরাসকে পরাজিত করতে পারি, কিন্তু আমরা সফলতার জন্য সেই দাম দিতে নারাজ। আর এজন্যই রাজনীতিবিদদের কাঁধে বৈজ্ঞানিকভাবে অর্জিত বিশাল দায়িত্ব চেপে বসেছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক রাজনীতিবিদই এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। যেমন ধরুন, আমেরিকা এবং ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টরাই ভয়ংকর খেলায় মেতেছিল। তারা বিশেষজ্ঞদের কথা না শুনে কেবল কন্সপিরেসি থিওরি নিয়েই জল্পনা-কল্পনা করেছিল। তারা মহামারি থামাতে কেন্দ্রীয়ভাবে তো কোনো পরিকল্পনা করেইনি, বরং প্রাদেশিক এবং মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষকে নানারকম অন্তর্ঘাত করেছে। ট্রাম্প এবং বলসোনারোর নেতৃত্বের এই অবহেলার কারণে হাজার হাজার অপ্রত্যাশিত মৃত্যু দেখতে হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সরকার তো কোভিড-১৯ এর থেকে ব্রেক্সিটের ব্যাপারেই বেশি আচ্ছন্ন ছিল। ব্রেক্সিটের বিচ্ছিন্নতাবাদী পলিসির কারণেই জনসন-সরকার ব্রিটেনকে ভাইরাস থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। আমার (হারারি) মাতৃভূমি ইসরায়েলও রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য বেশ ভুগেছে। তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড, সাইপ্রাসের সীমান্ত এলাকার জন্য ইসরায়েল একটা ‘দ্বীপদেশ’-এর মতো যার একমাত্র প্রবেশপথ হলো বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর। যা-ই হোক, মহামারীর সেই মারাত্মক সময়েও নেতানিয়াহু সরকার ভ্রমণকারীদের কোয়ারেন্টাইন কিংবা যথাযথ নজরদারি ছাড়া ভ্রমণের সুযোগ দিয়েছিল।
যদিও পরবর্তীতে ইসরায়েল এবং যুক্তরাজ্য ভ্যাকসিন আবিষ্কারে প্রথমসারিতে কাজ করেছে, কিন্তু প্রথমদিকের ভুল সিদ্ধান্তগুলোর জন্য তাদের ভালো পরিমাণে খেসারত দিতে হয়েছে। ব্রিটেনে এই মহামারিতে লক্ষাধিক মানুষ মারা গিয়েছে। মৃতের সংখ্যার দিক থেকে তারা ৬ষ্ঠ অবস্থানে আছে। এদিক দিয়ে ইজরায়েল আছে ৭ম অবস্থানে। আর এই সংকট কাটাতে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফাইজারের সাথে তাদের “তথ্যের বিনিময়ে টিকা” শীর্ষক চুক্তিনামা হয়েছে। ফাইজার ইজরায়েলকে যথেষ্ট পরিমাণে টিকা দিতে চেয়েছে, আর তার বিনিময়ে তারা ইসরায়েলের নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য নেবার চুক্তি করেছে। বর্তমানে ব্যক্তিগত তথ্য অনেক মূল্যবান জিনিস।
কিছু কিছু দেশ মহামারিকে ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারলেও, গোটা পৃথিবী একসাথে ভাইরাস মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২০ সালের প্রথমদিকের ব্যাপারটা ছিল অনেকটা স্লো-মোশনে দুর্ঘটনা দেখার মতো বিষয়। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার কল্যাণে ভাইরাস প্রথমে উহান থেকে, তারপর ইতালি থেকে, আর তারপর অন্যান্য দেশ থেকে কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল তা আমরা বাস্তব সময়ে বাস্তব ছবির মাধ্যমে দেখতে পেয়েছি; কিন্তু বৈশ্বিক কোনো নেতাই এই ধ্বংসযজ্ঞকে তখন থামাতে পারেনি। যন্ত্রপাতি আমাদের হাতেই ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক জ্ঞান আমাদের ছিল না।
বিদেশীদের উদ্ধার করার গল্প
বিজ্ঞানীদের সফলতার কারণ, তারা বৈশ্বিকভাবে কাজ করেছে। আর রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণ, তারা জাতিবিদ্বেষে লিপ্ত হয়েছে। অত্যধিক চাপ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করেও বিজ্ঞানীরা বিশ্বজুড়ে একে অন্যকে বিনামূল্যে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছে। অনেক গবেষণাই আন্তর্জাতিকভাবে দলগত মানসিকতায় সম্পন্ন করা হয়েছে। যেমন ধরুন, ব্রিটিশ একটি দল, চীনের তিনটি দল এবং মার্কিন পাঁচটি দলের গবেষকেরা মিলে লকডাউনের ফলপ্রসূতা বিষয়ক গবেষণা চালিয়েছিল।
অন্যদিকে, রাজনীতিবিদগণ একটি আন্তর্জাতিক মতৈক্য গড়ে ভাইরাস-মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বের দুই পরাশক্তি চীন এবং আমেরিকা একে অন্যকে দোষারোপ করেই সময় নষ্ট করেছে। যখন ভাইরাস মারাত্মকভাবে ছড়াচ্ছিল তখন তারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপনের দোষারোপে মেতে ছিল। অন্যান্য অনেক দেশও তখন ভাইরাস সংক্রমণের মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল।
এই তথ্য-যুদ্ধে কেবল বৈশ্বিক যোগাযোগেই ঘাটতি ছিল না, এছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভীষণ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়েও সংঘাত ছিল। যখন সহযোগিতা আর বদান্যতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে, তখনও চিকিৎসাবিজ্ঞানের রিসোর্স, বৈশ্বিক উৎপাদন এবং ডিস্ট্রিবিউশনকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়নি। বিশেষত, “জাতিভিত্তিক টিকাসেবা” মানে যে দেশগুলো জনগণকে টিকাসেবা দিতে পেরেছে এবং যারা পারেনি; এই ব্যাপারটি দেশে দেশে অসমতা সৃষ্টি করেছে।
দুঃখের বিষয় হলেও, অনেক ব্যর্থতার পর এই মহামারি সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা আমরা পেয়েছি: যতদিন পর্যন্ত এই ভাইরাস সংক্রমণ ছড়াবে ততদিন পর্যন্ত কোনো দেশই সত্যিকারের সুরক্ষিত বোধ করবে না। ধরুন, ইসরায়েল কিংবা যুক্তরাজ্য নিজেদের দেশে ভাইরাসকে দমিয়ে রাখতে পারল; কিন্তু ভারত, ব্রাজিল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় ঠিকই লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। তাতে এক নতুন মিউটেশনের সৃষ্টি হয়েছে। এই মিউটেশনের জন্য আবার এই টিকা অকার্যকর। আর এই নতুন মিউটেশন থেকে সংক্রমণের আরো একটা নতুন ওয়েভ শুরু হতে পারে।
বর্তমানের সংকটময় সময়ে, পরার্থপরতা কোনো জাতীয়তাবাদী-স্বার্থের বাইরের কিছু নয়। যা-ই হোক, এই সংকটময় সময়ে বৈশ্বিক যোগাযোগ কোনো পরার্থপরতাও নয়। এই ব্যাপারটি জাতিগত-স্বার্থকেই নিরাপদ করেছে।
পৃথিবীর জন্য এন্টি-ভাইরাস
২০২০ সালে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, এই বিষয়ে বিতর্ক অনেকদিন পর্যন্ত চলতেই থাকবে। কিন্তু রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে তিনটি মূল বিষয় মেনে নিতেই হবে।
প্রথমত, আমাদের ডিজিটাল অবকাঠামোকে নিরাপদ করতে হবে। মহামারিকালে এর মাধ্যমে আমরা পরিত্রাণ পেলেও ভবিষ্যতে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মই আমাদের ধ্বংসের কারণ হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক দেশেরই তাদের গণস্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। যদিও এই ব্যাপারটি আমাদের কাছে স্পষ্ট, তবুও মাঝে মাঝে রাজনীতিবিদ, এবং ভোটাররা সবচেয়ে জরুরি বিষয়কেই অবহেলা করে থাকে।
তৃতীয়ত, আমাদেরকে এমন এক গ্লোবাল সিস্টেম তৈরি করতে হবে, যাতে পরবর্তীকালে আসন্ন মহামারিকে আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি এবং প্রতিহত করতে পারি। সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানবজাতি এবং রোগজীবাণুর যুদ্ধে, মানুষকে রোগভোগ সহ্য করেই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হয়েছে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যদি কোনো ভাইরাস আক্রমণ করে, তবে তা আমাদের সবাইকেই বিপদে ফেলবে। যদিও উন্নত দেশের ধনী ব্যক্তিগণ অনুন্নত দেশের অসহায় মানুষদেরকে সাহায্য করতে পছন্দ করে, তবু কোনো প্রত্যন্ত জঙ্গলের একটি গ্রামে যদি কোনো বাদুড়ের দেহ থেকে মানুষের দেহে ভাইরাস আক্রমণ করে, তাহলে অল্প কিছু দিনের মাঝেই সেই ভাইরাস ওয়ালস্ট্রিটেও পৌঁছে যেতে পারে।
যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এরকম আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের আদলে একরকম এন্টি-প্লেগ সিস্টেমের কঙ্কাল পৃথিবীতে আছে। কিন্তু এদের বাজেট অনেক কম এবং এদের তেমন কোনো রাজনৈতিক ছত্রছায়া নেই। তাই এই সংস্থাগুলোকে আমাদের কিছুটা রাজনৈতিক ছত্রছায়া দেয়া উচিত এবং প্রচুর অর্থের যোগান দেয়া উচিত, যাতে অন্য কারো উপর এই সংস্থাগুলোকে নির্ভর করতে না হয়। আগেই বলেছিলাম, কোনো অনির্বাচিত বিশেষজ্ঞের উপর জটিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেয়া উচিত নয়। সিদ্ধান্তগ্রহণের দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। তবে মেডিকেল ডাটা সংরক্ষণ, বিপদ পর্যবেক্ষণ, গবেষণা পরিচালনা এবং উন্নয়নের জন্য একরকমের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ব স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত।
কোভিড-১৯-কে মহামারি শুরুর একটা নতুন ওয়েভ হিসেবে উল্লেখ করে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু উপরে উল্লেখিত সকল শিক্ষাকে যদি আমরা প্রয়োগ করতে পারি, তবে মহামারি আমাদের জন্য তুচ্ছ বিষয় হয়ে যাবে। মানুষ কোনোভাবেই ভাইরাসের জন্ম ঠেকাতে পারে না। এটা কোটি কোটি বছর ধরে একরকম প্রাকৃতিক বিবর্তনবাদের অংশ এবং ভবিষ্যতেও এটা থাকবে। তবে বর্তমানে মানুষের হাতে এমন প্রযুক্তি এবং জ্ঞান আছে, যার সাহায্যে রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ এবং তা থেকে মহামারি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কোভিড-১৯ যদি ২০২১ সালেও সংক্রমিত হতে থাকে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ তাতে মারা যায়, কিংবা ২০৩০ সাল নাগাদ যদি আরো কোনো মারাত্মক ভাইরাস আক্রমণ করে, তবে এটা কোনো অদম্য প্রাকৃতিক দুর্যোগও নয় কিংবা ঈশ্বরপ্রদত্ত কোনো শাস্তিও নয়। এটা হবে মানুষের ব্যর্থতা, যদি আরো স্পষ্ট করে বলি তবে রাজনৈতিক ব্যর্থতা।