বাংলা ভাষায় ও বাঙালির জীবনে বাগধারা-বাগবিধির বহুল ব্যবহার রয়েছে। বাগধারা মূলত একটি বা একগুচ্ছ শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়, যা রূপক বা উপমার অন্তরালে বাস্তব কোনো অর্থ প্রকাশ করে। যেমন, ‘দা-কুমড়া’, বা ‘অহি-নকুল’ অথবা ‘আদায়-কাঁচকলায়’ শব্দগুচ্ছ দ্বারা বোঝায় চিরশত্রুতা। কারণ দা দিয়ে কুমড়াকে কাটা হয়, এটি শত্রুতা। তেমনি অহি অর্থাৎ সাপ এবং নকুল বা নেউল বা বেজির মধ্যে চিরশত্রুতা। ঠিক একইভাবে আদা এবং কাঁচকলা একসাথে খেলে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হবার কথা শোনা যায়। অর্থাৎ, সামগ্রিক অর্থে এই শব্দগুচ্ছ দ্বারা চিরশত্রুতাকে প্রকাশ করে।
লেখার শিরোনাম দেখেই পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন, একটি বিশেষ বাগধারা নিয়েই এই লেখা। ‘অগস্ত্য যাত্রা’; এর অর্থ- চিরপ্রস্থান বা চিরবিদায়। কেউ চিরদিনের জন্য কোনো স্থান ত্যাগ করলে সেই ঘটনাকে অগস্ত্য যাত্রা বলা যায়।
কিন্তু কেন এই বাগধারাটির দ্বারা চিরপ্রস্থানকে নির্দেশ করা হয়? এর নেপথ্যে আছে এক কিংবদন্তী কাহিনী। সে কাহিনীই জানব আজ।
কাহিনীর সূত্রপাত নারদ মুনির হাত ধরে। সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার মনন থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন নারদমুনি। তাই তাঁকে ব্রহ্মার মানসপুত্র বলা হয়। পালনকর্তা বিষ্ণুর আরাধনা করেই নারদ মুনির দিনাতিপাত হয়। কিন্তু তিনি যেখানেই যান, সেখানেই কোনো না কোনো অনর্থ করে বসেন। কখনো সেই অনর্থ ভালো কিছু বয়ে আনে, কখনো বয়ে আনে খারাপ। তাই তাকে ‘অনর্থের দেবতা’-ও বলা হয়। সত্যিকার অর্থে নারদমুনি এ আশীর্বাদই পেয়েছিলেন বিষ্ণুদেবের থেকে যে, তিনি কখনো এক জায়গার স্থির থাকতে পারবেন না আর যেখানেই যাবেন, কোনো না কোনো অনর্থের কারণ হবেন।
তো নারদমুনি একবার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। একসময় তিনি বিন্ধ্য পর্বতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, বিন্ধ্য পর্বতশ্রেণীর অবস্থান বর্তমানে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে। বিন্ধ্য পর্বতশ্রেণি অঞ্চলকে বিন্ধ্যাচলও বলা হয়। যদিও এটি ভূতাত্ত্বিকভাবে কোনো সঠিক পর্বতশ্রেণি নয়, বরং গিরিখাদ, পর্বত, মালভূমি এবং উপত্যকার সমন্বয়ে গঠিত। তো আবার কাহিনীতে ফেরা যাক।
বিন্ধ্য পর্বতের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় বিন্ধ্য পর্বতের বিশালতা দেখে এবং এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নারদ মুনি বিন্ধ্য পর্রবতের সাথে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি এগিয়ে গেলেন বিন্ধ্য পর্বতের কাছে। তিনি যদিও বিন্ধ্যের সাথে কেবল কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি তো অনর্থের দেবতা। অনর্থ না করে কি হয়! কথা বলার ছলে তিনি বিন্ধ্যকে খানিকটা রাগিয়ে দিতে চাইলেন।
নারদ মুনি বললেন,
“ওহে, বিন্ধ্য পর্বত। তোমার এই অপরূপ সৌন্দর্য যেকোনো পর্বতের সৌন্দর্যের থেকে অতুলনীয়। সৌন্দর্যের দিক থেকে তুমি সকল পর্বতের থেকে অগ্রগামী হতে পারতে। অন্তত আমি তা-ই মনে করি। কত প্রকার জীবদের তুমি ধারণ করে আছ। কত মুনি ঋষি তোমাকে আশ্রয় করে আছেন, গুহায় বসে নির্বিঘ্নে তপস্যা করছেন।”
কিন্তু এসব বলে নারদ মুনি মলিন মুখে দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়লেন।
নারদ মুনির গুণগান শুনে বিন্ধ্য পর্বত খুবই গর্ববোধ করছিল এতক্ষণ, কিন্তু তাঁর দীর্ঘঃশ্বাসও বিন্ধ্যের নজর এড়াল না। সে বলল,
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মহর্ষি নারদ। কিন্তু আপনি যেমন বললেন যে, আমি মহৎ পর্বত হতে পারতাম। আমি কি মহৎ পর্বত নই?”
নারদ বুঝতে পারলেন, পরিকল্পনা সফল হয়েছে। কিন্তু মুখে সেই মলিন ভাব বজায় রেখে ইতস্তত ভাব দেখিয়ে বললেন,
“আমি তো বলতে চাই, তুমিই পর্বতদিগের মধ্যে সেরা, কিন্তু সেটা সঠিক হবে না।”
বিন্ধ্য পর্বতের এবার ক্রোধের উদ্রেক হলো। সে বলল,
“কেন? আমার থেকে মহৎ পর্বত আর কে আছে?”
নারদ মুনি এবার একটু শঙ্কিত হলেন। কারণ তিনি জানেন যে, যদি তিনি এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেন, তাহলে বিন্ধ্য আরো ক্রুদ্ধ হবে এবং তাঁকে পিষেও ফেলতে পারে ক্রোধে। কাজেই নিজের পিঠ বাঁচিয়ে তিনি বললেন,
“ওহে, মহৎ পর্বত! আমি এ কথা বলতে পারব না তোমাকে। কিন্তু তুমি সূর্যের অনেক কাছাকাছি আছ। তাকে জিজ্ঞাসা করো যে, সে কোন পথে যাতায়াত করে। তাহলেই তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।”
এই বলে নারদ মুনি তাড়াতাড়ি সরে পড়লেন সেখান থেকে।
নারদ মুনির কথা অনুযায়ী ক্রোধান্বিত বিন্ধ্য সূর্যকে আহ্বান করল। সূর্যদেব তখন অস্ত যাচ্ছিলেন। বিন্ধ্য এতটাই ক্রুদ্ধ ছিল যে, সে সূর্যদেবকে প্রণিপাত পর্যন্ত করল না। বরং রাগান্বিতভাবে জিজ্ঞেস করল,
“সূর্যদেব, আপনার যাত্রাপথের বিবরণ দিন আমাকে এখনই।”
সূর্যদেব নারদ মুনির অনর্থের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না, তারপরও বিন্ধ্যের রাগান্বিত চেহারা দেখে বলে দিলেন,
“আমি তো প্রতিদিন পূর্ব থেকে শুরু করে পশ্চিমদিকে যাত্রা করি, এরপর মেরু পর্বতের পাশ কাটিয়ে শেষে অস্ত যাই।”
তখন বিন্ধ্য বললো,
“আচ্ছা, তাহলে মেরু পর্বতই সেই পর্বত! কোথায় মেরু পর্বত?”
সূর্যদেব এবার আরো শঙ্কিত হয়ে বললেন,
“স্বয়ং ব্রহ্মাদেব মেরু পর্বতে থাকেন এবং এটি এতটাই উঁচু যে, তার পাশ দিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো পথ নেই।”
সূর্যের কথা শুনে বিন্ধ্য বললো,
“কিন্তু আপনি আমার পাশ দিয়ে তো যান না। আমি কি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নই?”
শুনে সূর্যদেব বললেন,
“নাহ বিন্ধ্য, ঠিক তা নয়। মেরু অনেক উঁচু এবং সৃষ্টির আদি থেকে আমার যাত্রাপথ একই ছিল, এখনও যেমন আছে।”
এই বলে সূর্যদেব আর বেশি অপেক্ষা করলেন না, অস্তে চলে গেলেন।
এদিকে বিন্ধ্য তখন রাগে ফুঁসছে আর পর্বতের উপর জমে থাকা পাথরখণ্ডগুলোকে নিক্ষেপ করছে ভূমিতে। মেরু পর্বত তার থেকে উঁচু এবং তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ- একথাটি একদম মেনে নেয়া যায় না। শেষে বিন্ধ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে, সে নিজেকে মেরুর থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করে দেখাবে। এই ভেবে সে নিজের উচ্চতা বৃদ্ধি করতে শুরু করল। তাকে মেরু পর্বতের থেকে উঁচু হতে হবে।
এদিকে বিন্ধ্যের এই উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবী হয়ে পড়ল ভারসাম্যহীন, যা মানুষ ও দেবতা উভয়পক্ষের জন্যেই হয়ে উঠল সমস্যার কারণ। বিন্ধ্যকে থামানোর কোনো উপায় না পেয়ে শেষে দেবরাজ ইন্দ্র এলেন মুনি অগস্ত্যের কাছে। অগস্ত্য মুনি ছিলেন বিন্ধ্য পর্বতের গুরুদেব। কাজেই তাকে শান্ত করতে পারলে কেবল অগস্ত্য মুনিই পারবেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর অভিপ্রায় জানালেন মুনির কাছে। সব শুনে মুনি মুচকি হাসলেন এবং দেবরাজকে নিশ্চিন্তে ফিরে যেতে বললেন স্বর্গে।
কুটিরে ফিরে এসে তিনি তাঁর স্ত্রী লোপামুদ্রা এবং দুই পুত্রকে সবকিছু গুছিয়ে নিতে বললেন। এরপর তারা চারজন পথ চলা শুরু করলেন। একসময় তাঁরা পৌঁছে গেলেন বিন্ধ্য পর্বতের সামনে। তিনি বিন্ধ্যকে আহ্বান করলেন।
বিন্ধ্য নিচে তাকিয়ে দেখে যে, গুরুদেব অগস্ত্য ডাকছেন। সে মুনিবরকে অভিবাদন জানিয়ে করে বললেন,
“গুরুদেব, আজ্ঞা করুন”।
মুনি তখন বললেন,
“বৎস, আমি খুবই ব্যস্ত এবং খুব শীঘ্রই আমাকে দক্ষিণে যেতে হবে। কাজেই তুমি যদি নিচু হয়ে আমাদের চলার পথ করে দাও, তাহলে আমার পথ সহজ হবে”।
একথা শুনে বিন্ধ্য খুশিমনে নত হয়ে তাঁদের পথ তৈরি করে দিলো। পর্বত পার হয়ে মুনি আবার বিন্ধ্যকে ডেকে বললেন,
“ওহে বিন্ধ্য। আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসব। কাজেই আমি না আসা পর্যন্ত যদি তুমি এভাবে থাকো, তাহলে তোমারও আবার কষ্ট করে নত হতে হবে না এবং আমাকেও তোমাকে ডাকার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না”।
বিন্ধ্য গুরুর কথার গূঢ় অর্থ ভালোভাবে বুঝতে না পেরেই তাঁকে বললো,
“যথা আজ্ঞা গুরুদেব, আপনি না আসা পর্যন্ত আমি এভাবেই থাকব।”
অগস্ত্য মুনি মুচকি হেসে সেই যে দক্ষিণে চলে গেলেন, আর ফিরলেন না। আর বিন্ধ্যও মুনির অপেক্ষায় নত হয়ে থাকল। ফলে পৃথিবীতে আবার ভারসাম্য ফিরে এল। অগস্ত্য মুনি আর ফিরলেন না, তাই বিন্ধ্য গুরুর কথা রাখতে আজো নত হয়ে আছে।
অগস্ত্য মুনির এই চিরতরে দক্ষিণে যাত্রা করা থেকেই ‘চিরবিদায়’ অর্থে ‘অগস্ত্য যাত্রা’ শব্দগুচ্ছকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।