আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, “বিশাল এই পৃথিবীর কেন্দ্র কোথায়?” তবে আপনি কী উত্তর দেবেন?
প্রশ্নটির উত্তর হুট করে দেওয়া একটু কঠিন। কারণ বৈজ্ঞানিক ভাবে কমলালেবুর মতো চ্যাপ্টা এই পৃথিবীর কেন্দ্র হতে পারে একের অধিক স্থানে। তবে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বহু সভ্যতা, বহু জাতি, বহু ধর্মে পৃথিবীর কেন্দ্রের কথা উঠে এসেছে। একেক জাতি কিংবা সভ্যতা ভেদে তার অবস্থানও একেক স্থানে। যেমন জাপানীদের বিশ্বাস পৃথিবীর কেন্দ্র হচ্ছে ফুজি পর্বতে। আবার তিব্বতিদের বিশ্বাস পৃথিবীর কেন্দ্রের অবস্থান কৈলাস পর্বতে। তবে বিভিন্ন প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে পৃথিবীর এই কেন্দ্রেই নাকি স্বর্গ মিলিত হয় পৃথিবীর সাথে, যা কিনা পরিচিত ‘অ্যাক্সিস মুন্ডি’ নামে।
অ্যাক্সিস মুন্ডি কী?
‘অ্যাক্সিস মুন্ডি’ টার্মটি এসেছে দুটি ল্যাটিন শব্দ থেকে, ‘Axis’ এবং ‘Mundi’। একত্রে এ দুটির অর্থ দাঁড়ায় ‘একটি কেন্দ্র যা পৃথিবী ও আকাশ বা স্বর্গকে যুক্ত করে’। প্রাচীনকাল থেকেই নানা সভ্যতা তাদের নিজেদের জন্মভূমিকেই পৃথিবীর কেন্দ্র বলে দাবী করে এসেছে। কারণ সেটি ছিল তাদের পরিচিত জগতের কেন্দ্র। এই ধারণার সেরা উদাহরণ দেখা যায় চৈনিক সভ্যতায়। চীনা ভাষায় ‘চীন’কে লেখা হয় এভাবে- ‘中国’, যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘মধ্য রাজ্য’। অর্থাৎ তাদের নিজেদের দেশের নামের মধ্যেই রয়েছে তাদের বিশ্বাস। আবার প্রাচীন মিসরীয় মানুষ মনে করতো তাদের রাষ্ট্র হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্র এবং এখানেই শুধু নিয়ম শৃঙ্খলা বিদ্যমান। তারা বিশ্বাস করতো তাদের সীমানার বাইরে সবখানে রয়েছে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা।
তবে প্রায় সব সভ্যতার বিশ্বাস অনুসারে পৃথিবীর কেন্দ্রে এমন একটি স্থান রয়েছে যেখানে স্বর্গ আর পৃথিবীর মিলন ঘটে অথবা স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব হয় সবচেয়ে কম। এই স্থানটিকেই বলা হয় ‘অ্যাক্সিস মুন্ডি’। এটিকে সাধারণত পাহাড়ের মতো ভূপৃষ্ঠ হতে তুলনামূলক ভাবে উঁচু কোনো স্থান ধরা হয় যাতে তা আকাশের কাছাকাছি হয়। যেমন চীনা সভ্যতায় এটির অবস্থান ধরা হয় ‘কুনলুন’ পর্বতে। যা কিনা ‘তাও’ ধর্ম মতে, ‘পৃথিবীর কেন্দ্রের পর্বত’ হিসেবে পরিচিত।
এছাড়াও, হিন্দু ধর্ম মতে, ভারতের মেরু শৃঙ্গ এবং তিব্বতের কৈলাস পর্বত এ দুটি পর্বতকেই এদের উচ্চতার কারণে অ্যাক্সিস মুন্ডি হিসেবে ধরা হয়। একের বেশি স্থানকে পৃথিবীর কেন্দ্র হিসেবে ধরা কিছুটা উদ্ভট হলেও অসম্ভব কিছু নয়। যেমন প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীরা বিশ্বাস করতো পৃথিবীর কেন্দ্র যা কিনা ‘ওম্ফ্যালোস’ নামে পরিচিত ছিল, তার অবস্থান কয়েকটি স্থানে। তবে বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস ছিল এটির অবস্থান ডেলফিতে। এছাড়াও তারা অলিম্পাস পর্বতকেও পৃথিবীর কেন্দ্র মনে করতো যেখানে ছিল নানা দেব-দেবীর বাস।
মানব স্থাপনা হিসাবে অ্যাক্সিস মুন্ডি
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে অ্যাক্সিস মুন্ডি হিসেবে কোনো না কোনো প্রাকৃতিক স্থানকে ধরা হয়েছে। তবে অনেক সভ্যতাতেই কিন্তু মানুষের তৈরি স্থাপনা কিংবা স্থানকেও অ্যাক্সিস মুন্ডি হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন ব্যাবিলনের অধিবাসী ও সুমেরীয়রা ‘জিজ্ঞুরাটস’ নামের সিঁড়িযুক্ত পিরামিড নির্মাণ করেছিল। এগুলো কৃত্রিম পর্বত হিসেবে ধরা হতো। এগুলোকেই তারা পৃথিবীর কেন্দ্র বলে মনে করতো।
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো প্রাকৃতিক গড়নের আদলে নির্মিত স্থানকেও অ্যাক্সিস মুন্ডি হিসেবে ধরা হতো। যেমন- কম্বোডিয়ার বিখ্যাত ‘অ্যাংকর ভাট’ মন্দির। খ্মেরদের দ্বারা নির্মিত ও নকশাকৃত এই মন্দিরটি আসলে ভারতের মেরু শৃঙ্গের আদলে নির্মাণ করা হয়েছিল। এছাড়াও অনেকের বিশ্বাস মতে, এটি গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের নানা সাধুদের দেহাবশেষের সংরক্ষণ স্থান ‘বৌদ্ধস্তুপের’ আদলে নির্মিত। তবে যেটিই হোক না কেন, এটিকেও পৃথিবীর কেন্দ্র বা অ্যাক্সিস মুন্ডি হিসেবে ধরা হয়।
বিমূর্ত রূপে অ্যাক্সিস মুন্ডি
এসব ছাড়াও অনেক সভ্যতায় অ্যাক্সিস মুন্ডি বিমূর্ত ভাব ও বিশ্বাস রূপে থাকতে পারে। যেমন নর্স সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মোট ৯টি পৃথিবী রয়েছে। আর এগুলো সব বিশাল একটি গাছের ডালপালায় অবস্থিত। এই গাছের নাম ‘ইয়াগদ্রাসিল’। আর তাদের মতে, এই ‘ইয়াগদ্রাসিল’ হলো অ্যাক্সিস মুন্ডি। এছাড়াও খ্রিস্টধর্মের ‘ট্রি অব লাইফ’ বা জীবন বৃক্ষকেও একই ভাবে অ্যাক্সিস মুন্ডি মনে করা হয়।
শামানিস্টিক ধর্মানুসারে, তাদের কিছু চিত্রকর্মে অ্যাক্সিস মুন্ডির ভিন্ন একটি রূপ দেখা যায়। এই বিশ্বাস মতে, অ্যাক্সিস মুন্ডি হলো এক ধরনের রাস্তা যার মাধ্যমে একজন শামান বা ওঝা সময় ও স্থান পরিভ্রমণ করতে পারেন। আর এই ধরনের পরিভ্রমণ বা যাত্রার মাধ্যমে একজন ওঝা অন্য একজনকে কোনো রোগ থেকে আরোগ্যলাভ করতে সাহায্য করতে সক্ষম হন এবং ভিন্ন ভিন্ন জগৎ থেকে জ্ঞান আরোহণ করতে পারেন।
আবার কিছু বিশ্বাসমতে, আমাদের এই মানবরূপকেই অ্যাক্সিস মুন্ডি হিসেবে ধরা হয়। এ বিশ্বাস অনুসারে, পৃথিবী আর স্বর্গের মধ্যবর্তী স্থানেই আমাদের অবস্থান। আমরা পৃথিবীতে জন্মলাভ করে বসবাস করি। মৃত্যুর পর আমাদের স্বর্গ কিংবা নরকে যেতে হবে। ফলে এ দুয়ের মধ্যবর্তী অবস্থান হলো আমাদের মানবরূপ। হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম অনুসারে মানবদেহে সাত চক্র রয়েছে। এই বিশ্বাসমতে, মানবদেহকে পৃথিবী ও স্বর্গের মধ্যবর্তী স্থানের এক স্তম্ভ হিসেবে ধরা হয়। মানবদেহকে ধরা হয় এক মন্দির হিসাবে এবং একজন মানুষ ধ্যান ও প্রার্থনার মাধ্যমেই এই পার্থিব অস্তিত্বকে পেরিয়ে স্বর্গীয় অস্তিত্ব লাভ করতে পারেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ চিত্রকর্মেও এই বিশ্বাসের ছাপ লক্ষ্য করা যায়।
এভাবে প্রাচীন কাল থেকেই নানা ধর্ম ও সভ্যতায় বিভিন্ন ভাবে পৃথিবী কেন্দ্র বা অ্যাক্সিস মুন্ডি উঠে এসেছে। কখনো বা তা প্রাকৃতিক কোনো স্থানের মাধ্যমে, কখনো বা তা মানুষের তৈরি কোনো স্থাপনায় আবার কখনো কখনো নানা বিমূর্ত রূপে। তবে শুধু প্রাচীন কালেই কিন্তু নয়, বরং বর্তমানে আধুনিক যুগেও প্রতীকীরূপে অ্যাক্সিস মুন্ডির অনেক উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়।
আধুনিক যুগে অ্যাক্সিস মুন্ডি
বর্তমানে নানা দেশের সুউচ্চ টাওয়ার ও ভবনগুলোকে এক দিক থেকে অ্যাক্সিস মুন্ডি বলা যায়। আকাশস্পর্শী এসব টাওয়ার কোনো কোনো ক্ষেত্রে উক্ত স্থানের সংস্কৃতি ও সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও কাজ করে। যেমন আধুনিক যুগের সর্বপ্রথম সুউচ্চ স্থাপনা আইফেল টাওয়ার অ্যাক্সিস মুন্ডির একটি সুন্দর উদাহরণ। এছাড়াও তাইওয়ানে অবস্থিত ‘তাইপেই ১০১’ নামের সুউচ্চ টাওয়ারটিকে কিন্তু একুশ শতকের একটি অ্যাক্সিস মুন্ডি বলা যেতে পারে। এটি একাধারে সিঁড়ি, প্যাগোডা, বাঁশ, স্তম্ভ এমনকি রাতে এটি মোমবাতি কিংবা মশালেরও রূপ প্রকাশ করে। এভাবে দুবাইয়ের ‘বুর্জ খলিফা’কেও আরবের অ্যাক্সিস মুন্ডি হিসেবে ধরা যেতে পারে।
শুধু এসব ভবনই নয়, বর্তমানের মহাকাশ ভ্রমণে ব্যবহৃত মহাকাশযান ও রকেটগুলোকেও অ্যাক্সিস মুন্ডি হিসেবে ধরা যায়। এগুলোর মাধ্যমেই মানুষ পৃথিবী থেকে মহাকাশ কিংবা স্বর্গে যাত্রা করে। আবার লঞ্চপ্যাডে অবস্থানকালে আকারেও এগুলোকে টাওয়ারের মতোই দেখায়। ফলে এগুলোও অ্যাক্সিস মুন্ডির রূপ প্রকাশ করে। আর মহাকাশচারী গবেষকরা পালন করেন সেই শামানদের ভূমিকা যারা পৃথিবী থেকে স্বর্গীয় এক যাত্রা করে মহাকাশে গিয়ে আমাদের জন্য বয়ে নিয়ে আসেন জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা তথ্য।
ফিচার ইমেজ – misucell.com