যুদ্ধের ষষ্ঠ দিন: ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্নের কৌরব ব্যূহ ভেদ, ভীষ্মের তীরবৃষ্টি এবং কৌরবদের আংশিক বিজয়
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ষষ্ঠ দিনে যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘মকরব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ পাণ্ডব বাহিনীকে একটি মকর/কুমিরের আকারে সজ্জিত করেন। একে প্রতিহত করার জন্য ভীষ্ম কৌরব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘ক্রৌঞ্চব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ কৌরব বাহিনীকে একটি বকের আকারে সজ্জিত করেন। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ভীম দ্রোণাচার্যের সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালান এবং দ্রোণাচার্য ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে ভীমের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্যের রথের সারথি নিহত হয় এবং রথটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, কিন্তু দ্রোণাচার্য নিজেই রথটিকে সামলে নেন এবং এরপর পাণ্ডব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্যের হাতে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়, এবং অর্জুন ও ভীমের হাতে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। ভীম কৌরব ব্যূহ ভেঙে সেটির ভিতরে প্রবেশ করেন এবং কৌরব সৈন্যরা তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু ভীমের তীরের আঘাতে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয় এবং এরপর ভীম গদা হাতে নিয়ে রথ থেকে নেমে কৌরব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন।
এ সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীমের খোঁজে কৌরব ব্যূহে প্রবেশ করেন। তিনি দেখতে পান যে, ভীম কৌরব ব্যূহের সম্মুখভাগে তার রথ রেখে ব্যূহের গভীরে প্রবেশ করেছেন এবং তীরবিদ্ধ অবস্থায় গদা নিয়ে কৌরব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীমকে নিজের রথে তুলে নেন। তাদেরকে দেখতে পেয়ে দুর্যোধন তাদেরকে হত্যা করার জন্য তার ভাইদেরকে নির্দেশ দেন এবং সেই মোতাবেক দুর্যোধনের ভাইয়েরা ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন মন্ত্র উচ্চারণ করে দুর্যোধনের ভাইদের বিরুদ্ধে প্রমোহনাস্ত্র প্রয়োগ করেন, এবং এই অস্ত্রের প্রভাবে দুর্যোধনের ভাইয়েরা সকলেই অচেতন হয়ে পড়েন। তাদেরকে এভাবে পরাজিত হতে দেখে কৌরব সৈন্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে।
এ সময় দ্রোণাচার্য দ্রুপদের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তার তীরের আঘাতে দ্রুপদ ক্ষতবিক্ষত হন এবং পশ্চাৎপসরণ করেন। দ্রুপদকে পরাজিত করার পর দ্রোণাচার্য দেখতে পান যে, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীম কৌরব সৈন্যদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করছেন এবং দুর্যোধনের ভাইয়েরা অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। দ্রোণাচার্য দ্রুত সেদিকে অগ্রসর হয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রজ্ঞাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং সেটির সাহায্যে ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্তৃক প্রয়োগকৃত প্রমোহনাস্ত্রের প্রভাব নষ্ট করেন। এর ফলে দুর্যোধনের ভাইয়েরা সংজ্ঞা ফিরে পান এবং আবার ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ইতোমধ্যে যুধিষ্ঠির ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীমের সন্ধান করার জন্য অভিমন্যুর নেতৃত্বাধীনে ১২ জন শীর্ষ যোদ্ধাকে (উপপাণ্ডবগণ, কৈকেয়া রাজ্যের পাঁচ রাজপুত্র ও চেদির রাজা দৃষ্টকেতু) প্রেরণ করেন। তারা ‘সূচিমুখব্যূহ’ গঠন করে (অর্থাৎ তাদের সৈন্যদেরকে সূঁচের আকারে সজ্জিত করে) কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এসময় ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীম কৌরবদের এত ক্ষয়ক্ষতি করেছিলেন যে, তারা অভিমন্যুর নেতৃত্বাধীন পাণ্ডব যোদ্ধাদের কার্যকর কোনো বাধাই দিতে পারেনি।
ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীমের কাছে পৌঁছানোর পর অভিমন্যুর নেতৃত্বাধীন পাণ্ডব যোদ্ধারা তাদের সঙ্গে মিলে কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে থাকেন। ভীম ধৃষ্টদ্যুম্নের রথ থেকে নেমে আরেকটি রথে আরোহণ করেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধনের ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সংকল্প পরিত্যাগ করে দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন। দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের দুইটি ধনুক কাটা পড়ে এবং তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথি নিহত হয়। এরপর ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রুতগতিতে তার বিকল রথ থেকে নেমে অভিমন্যুর রথে আরোহণ করেন। ধৃষ্টদ্যুম্নকে পরাজিত করার পর দ্রোণাচার্য পাণ্ডব সৈন্যদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালান এবং তার তীরবর্ষণের ফলে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়।
এদিকে দুর্যোধন ও ভীম সেসময় দূরে থেকে একে অপরকে তীরের আঘাতে বিদ্ধ করছিলেন। এসময় দুর্যোধনের ভাইয়েরা অগ্রসর হয়ে একযোগে ভীমের ওপর আক্রমণ চালান, কিন্তু ভীমের তীরের আঘাতে তারা নিজেরাই ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন। যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে অভিমন্যুসহ ১২ জন শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধা ভীমকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন, এবং তাদেরকে অগ্রসর হতে দেখে দুর্যোধনের ভাইয়েরা ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করে পশ্চাৎপসরণ করেন। কিন্তু ভীম, অভিমন্যু ও অন্যান্য শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধা দুর্যোধনের ভাইদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। এটি দেখতে পেয়ে দুর্যোধনসহ অন্যান্য শীর্ষ কৌরব যোদ্ধা সেদিকে অগ্রসর হন এবং পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণ, চিত্রসেন ও দুর্জয় অভিমন্যুর বিরুদ্ধে, দুঃশাসন কৈকেয়ার পাঁচ রাজপুত্রের বিরুদ্ধে এবং দুর্যোধন উপপাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভীষ্মের তীরবৃষ্টির ফলে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়, এবং উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে।
সেদিন বিকেলে দুর্যোধন ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই ভীমের তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ধনুক কাটা পড়ে, তার রথের সারথি ও রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং তার রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। এরপর ভীমের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে দুর্যোধন আহত হন। দুর্যোধনকে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় দেখে জয়দ্রথ তাকে সহায়তা করার জন্য একদল সৈন্য নিয়ে তার দিকে অগ্রসর হন, এবং দুর্যোধন তার বিকল রথ থেকে নেমে কৃপাচার্যের রথে আরোহণ করেন। আহত দুর্যোধন প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় রথটিতে বসে পড়েন।
ভীমের নিকট দুর্যোধনের পরাজয়ের পর জয়দ্রথের সৈন্যরা ভীমকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে, এবং অভিমন্যু, উপপাণ্ডবগণ, দৃষ্টকেতু ও কৈকেয়ার পাঁচ রাজপুত্র ভীমকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হয়ে কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। বিকর্ণ অভিমন্যুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু শীঘ্রই অভিমন্যুর তীরের আঘাতে বিকর্ণের রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং রথের সারথি ও রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। অভিমন্যুর তীরের আঘাতে বিকর্ণ আহত হন এবং তাকে সহায়তা করার জন্য তার ভাই দুর্মুখ, জয়তসেন ও দুষ্কর্ণ সেদিকে অগ্রসর হন, কিন্তু উপপাণ্ডবরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
দুর্মুখ শ্রুতকর্মার (সহদেব ও দ্রৌপদীর ছেলে) বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। শীঘ্রই দুর্মুখের তীরের আঘাতে শ্রুতকর্মার রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথি নিহত হয়। শ্রুতকর্মা সেই বিকল রথে অবস্থান করেই দুর্মুখকে লক্ষ্য করে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন এবং সেটি দুর্মুখের বর্ম ও শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়। এরপর শ্রুতকর্মা তার বিকল রথ থেকে নেমে সুতসোমের (ভীম ও দ্রৌপদীর ছেলে) রথে আরোহণ করেন।
শ্রুতকীর্তি (অর্জুন ও দ্রৌপদীর ছেলে) জয়তসেনের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু জয়তসেনের তীরের আঘাতে তার ধনুক কাটা পড়ে। এটি দেখে শতানীক (নকুল ও দ্রৌপদীর ছেলে) জয়তসেনকে আক্রমণ করেন এবং তার তীরের আঘাতে জয়তসেন আহত হন। জয়তসেনকে আহত হতে দেখে তার ভাই দুষ্কর্ণ শতানীকের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দুষ্কর্ণের তীরের আঘাতে শতানীকের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু শতানীক আরেকটি ধনুক উঠিয়ে দুষ্কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। শীঘ্রই শতানীকের তীরের আঘাতে দুষ্কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে, তার রথের সারথি ও রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং অবশেষে দুষ্কর্ণ নিজেও নিহত হন।
উল্লেখ্য, প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, ধৃতরাষ্ট্রের ১০০ জন ছেলের সকলেই ভীমের হাতে নিহত হয়েছিলেন, কিন্তু মহাভারতের বিবরণ অনুসারে, ধৃতরাষ্ট্রের কয়েকজন ছেলে ভীম বাদে অন্যান্য পাণ্ডব যোদ্ধার হাতে নিহত হন এবং এদের মধ্যে দুষ্কর্ণ ছিলেন একজন। শতানীকের হাতে দুষ্কর্ণ নিহত হওয়ার পর দুর্যোধনের ভাই দুর্মুখ, দুর্জয়, দুর্মর্ষণ, সত্রঞ্জয় ও সত্রুশ একযোগে শতানীককে আক্রমণ করেন। কিন্তু কৈকেয়ার পাঁচ রাজপুত্র শতানীককে রক্ষা করার জন্য অগ্রসর হন এবং দুর্যোধনের উক্ত পাঁচ ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
একই সময়ে ভীষ্মের তীরবর্ষণের ফলে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয় এবং পাণ্ডব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। পাণ্ডব সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করার পর এবং সূর্যাস্তের সময় হয়ে আসায় ভীষ্ম যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে শুরু করেন। এরপর পাণ্ডবরাও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাদের অবশিষ্ট সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়। এভাবে পাণ্ডবদের আংশিক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ষষ্ঠ দিনের অবসান ঘটে।
সপ্তম দিনের যুদ্ধ: দ্বৈরথের দিন এবং ফলাফলবিহীন পরিসমাপ্তি
ষষ্ঠ দিনের যুদ্ধে কৌরবরা বিজয়ী হলেও দুর্যোধন সন্তুষ্ট ছিলেন না, কারণ সেদিন কৌরবদেরও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সেদিন ভীম ও অন্যান্য পাণ্ডব শীর্ষ যোদ্ধারা যে কৌরব ব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং দুর্যোধন নিজে যে ভীমের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন, এই বিষয়টি দুর্যোধনকে পীড়া দিচ্ছিল। সপ্তম দিন ভোরে তিনি ভীষ্মের সঙ্গে দেখা করে তার নিকট এই বিষয়ে অনুযোগ করেন এবং তাকে বলেন যে, তিনি ভীষ্মের সাহায্যে পাণ্ডবদের পরাজিত ও নিহত করতে চান। ভীষ্ম আবারো দুর্যোধনকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি তার সাধ্যমতো যুদ্ধ করবেন। এরপর দুর্যোধন সৈন্য সমাবেশ করেন, কিন্তু তখনো তিনি চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন। এমতাবস্থায় ভীষ্ম আবার দুর্যোধনকে বলেন যে, পঞ্চপাণ্ডবকে পরাজিত করা অসম্ভব, কিন্তু হয় তিনি পাণ্ডবদেরকে পরাজিত করবেন, নয়ত তারা তাকে পরাজিত করবে। এটি বলার পর তিনি আহত দুর্যোধনকে তার ক্ষতের উপশমের জন্য একটি গাছড়া প্রদান করেন এবং সেটি ব্যবহার করে দুর্যোধন সুস্থ হয়ে ওঠেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সপ্তম দিনে ভীষ্ম কৌরব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘মণ্ডলব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ কৌরব বাহিনীকে একটি বৃত্তাকৃতির প্রতিরক্ষামূলক আকারে সজ্জিত করেন, যেটির কেন্দ্রে ছিলেন প্রধান সেনাপতি ভীষ্ম স্বয়ং এবং তার চারপাশে কৌরব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদের নেতৃত্বাধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৈন্যদল ছিল। এটিকে প্রতিহত করার জন্য যুধিষ্ঠির পাণ্ডব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘বজ্রব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ পাণ্ডব বাহিনীকে বর্গক্ষেত্র আকারে সজ্জিত করেন, যেটির কেন্দ্রে ছিলেন পাণ্ডব বাহিনীর সকল শীর্ষ যোদ্ধা। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।
যুদ্ধের সপ্তম দিন কার্যত উভয় পক্ষের শীর্ষ যোদ্ধাদের ব্যক্তিগত রণকুশলতা প্রদর্শনের দিনে পরিণত হয়। সেদিন উভয় পক্ষের শীর্ষ যোদ্ধাদের মধ্যে বহুসংখ্যক দ্বৈরথ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এবং এই যুদ্ধগুলোতে তাদের সকলের ব্যক্তিগত রণনৈপুণ্য, সাহসিকতা ও মনোবলের মাত্রা প্রকাশিত হয়।
অবশ্য অর্জুনের ক্ষেত্রে যুদ্ধটি দ্বৈরথ যুদ্ধ ছিল না। যুদ্ধের শুরুতেই কৌরব বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত বহুসংখ্যক রাজা তীর–ধনুক, বিশেষ ধরনের তীর, বর্শা, গদা ও দণ্ডে সজ্জিত হয়ে অর্জুনকে ঘিরে ফেলেন। অর্জুন তাদের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করলে তারা অর্জুনের ওপর পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাদের তীরে অর্জুন ও কৃষ্ণ ক্ষতবিক্ষত হন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে তাদের বিরুদ্ধে ঐন্দ্রাস্ত্র প্রয়োগ করেন। এই দিব্যাস্ত্র প্রয়োগের ফলে অর্জুনের ওপর উক্ত রাজাদের নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টি প্রতিহত হয় এবং উক্ত রাজাদের ও তাদের সৈন্যসামন্তদের ওপর বিপুল সংখ্যক তীর বর্ষিত হয়। বস্তুত অর্জুনের প্রতিপক্ষদের মধ্যে তখন এমন কেউ ছিল না যে এই তীরবর্ষণের ফলে আহত হয়নি। এমতাবস্থায় তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে।
এরপর ভীষ্ম অর্জুনের দিকে অগ্রসর হন, এবং ভীষ্মকে একাকী অর্জুনের দিকে অগ্রসর হতে দেখে দুর্যোধন অর্জুনের কাছে সদ্য পরাজিত রাজাদের ভীষ্মকে সুরক্ষা প্রদান করার নির্দেশ দেন। তারা দুর্যোধনের নির্দেশ মোতাবেক ভীষ্মকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং তাদের দ্বারা সুরক্ষিত হয়ে ভীষ্ম অর্জুনের মুখোমুখি হন। কিন্তু তাদের রথ পরস্পরের থেকে দূরে অবস্থান করছিল এবং এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে কোনো দ্বৈরথ অনুষ্ঠিত হয়নি, কারণ শীঘ্রই তারা তাদের কাছাকাছি থাকা শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন।
দ্রোণাচার্য বিরাটের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং শুরুতেই তার তীরের আঘাতে বিরাটের রথের ঝাণ্ডা ও ধনুক কাটা পড়ে। এরপর তাদের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়, এবং শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে বিরাটের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথি নিহত হয়। বিরাট তার বিকল রথ থেকে নেমে তার ছেলে শঙ্খের রথে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে বিরাট ও শঙ্খ উভয়ে দ্রোণাচার্যের ওপর তীরবর্ষণ করেন। কিন্তু শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে শঙ্খ নিহত হন এবং রথ থেকে মাটিতে পড়ে যান। দ্রোণাচার্যের হাতে শঙ্খ নিহত হওয়ার পর আতঙ্কিত বিরাট পশ্চাৎপসরণ করেন। এভাবে বিরাটকে পরাজিত করার পর দ্রোণাচার্য পাণ্ডব সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করেন।
অশ্বত্থামা শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে শিখণ্ডীর রথের সারথি ও রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং রথের ঝাণ্ডা ও শিখণ্ডীর ধনুক কাটা পড়ে। শিখণ্ডী একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার হাতে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন। অশ্বত্থামা তার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে এদিকে ওদিকে সরে শিখণ্ডী সেই তীরবৃষ্টি এড়াতে সক্ষম হন। এরপর অশ্বত্থামা শিখণ্ডীকে লক্ষ্য করে বিপুল সংখ্যক তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু শিখণ্ডী তার তলোয়ারের সাহায্যে প্রতিটি তীর কেটে ফেলেন। এরপর অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে শিখণ্ডীর ঢাল ও তলোয়ার টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং তিনি নিজেও তীরবিদ্ধ হন। আহত শিখণ্ডী তার হাতে থাকা তলোয়ারের একটি খণ্ডিত অংশকে অশ্বত্থামার দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে সেটিও টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং শিখণ্ডী নিজেও ক্ষতবিক্ষত হন। এমতাবস্থায় শিখণ্ডী দ্রুতগতিতে সাত্যকির রথে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে প্রস্থান করেন। এভাবে অশ্বত্থামার নিকট শিখণ্ডীর পরাজয় ঘটে।
এদিকে আহত শিখণ্ডীকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়ার পর সাত্যকি রাক্ষস অলম্বুষের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অলম্বুষের তীরের আঘাতে সাত্যকির ধনুক কাটা পড়ে এবং সাত্যকি নিজেও তীরবিদ্ধ হন। এরপর অলম্বুষ নিজের ইন্দ্রজালের সাহায্যে একটি বিরাট তীরবৃষ্টির সৃষ্টি করেন এবং সেটি ক্ষিপ্রগতিতে সাত্যকির দিকে ধাবিত হয়। সাত্যকি মন্ত্র উচ্চারণ করে সেটির বিরুদ্ধে ঐন্দ্রাস্ত্র প্রয়োগ করেন। এই দিব্যাস্ত্র প্রয়োগের ফলে অলম্বুষের ইন্দ্রজাল দ্বারা সৃষ্ট তীরবৃষ্টি দূরীভূত হয় এবং অলম্বুষের ওপর বিপুল সংখ্যক তীর পতিত হয়। এর ফলে অলম্বুষ আহত হন এবং পশ্চাৎপসরণ করেন। অলম্বুষকে পরাজিত করার পর সাত্যকি কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করেন এবং তারা আতঙ্কে পশ্চাৎপসরণ করতে থাকে।
যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক প্রান্তে দুর্যোধন ধৃষ্টদ্যুম্নের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ধৃষ্টদ্যুম্নের তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ধনুক কাটা পড়ে ও তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। দুর্যোধন একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের দিকে ছুটে যান। কিন্তু শকুনি এসে দুর্যোধনকে তার রথে তুলে নেন এবং সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। এভাবে দুর্যোধনকে পরাজিত করার পর ধৃষ্টদ্যুম্ন কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করেন।
যুদ্ধক্ষেত্রের অন্য আরেক প্রান্তে কৃতবর্মা ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ভীমের তীরের আঘাতে কৃতবর্মার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথি নিহত হয় এবং রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। এরপর ভীমের তীরের আঘাতে কৃতবর্মা গুরুতরভাবে আহত হন এবং তার বিকল রথ থেকে নেমে শকুনির ভাই বৃষকের রথে আরোহণ করে সেখান থেকে প্রস্থান করেন। এভাবে কৃতবর্মাকে পরাজিত করার পর ভীম কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করেন।
সেদিন দুপুরের প্রাক্কালে অবন্তীর রাজপুত্র বিন্দ ও অনুবিন্দ অর্জুনের ছেলে ইরাবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তাদের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ইরাবানের তীরের আঘাতে অনুবিন্দের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং তার ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। অনুবিন্দ তার বিকল রথ থেকে নেমে তার ভাই বিন্দের রথে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে দুই ভাই ইরাবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু শীঘ্রই ইরাবান তাদের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং ইরাবানের তীরের আঘাতে তাদের রথের সারথি নিহত হয়। এর ফলে রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে এবং রথটিকে সেখান থেকে দূরে টেনে নিয়ে যায়। বিন্দ ও অনুবিন্দকে পরাজিত করার পর ইরাবান কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করেন।
যুদ্ধক্ষেত্রের অন্য প্রান্তে ভগদত্ত তার হাতির পিঠে চেপে পাণ্ডব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন এবং পাণ্ডব সৈন্যদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করছিলেন। এমতাবস্থায় ঘটোৎকচ ভগদত্তের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। উভয়ের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়, এবং এরপর ভগদত্তের তীরের আঘাতে ঘটোৎকচের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। ঘটোৎকচ তার বিকল রথ থেকে ভগদত্তের দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভগদত্ত তীরের সাহায্যে সেটিকে কেটে ফেলেন। এতে ভীত হয়ে ঘটোৎকচ তার বিকল রথ থেকে নেমে পশ্চাৎপসরণ করেন। এভাবে ঘটোৎকচকে পরাজিত করার পর ভগদত্ত পুনরায় পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তার তীরের আঘাতে ও তাকে বহনকারী হাতির চাপে পিষ্ট হয়ে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক প্রান্তে শল্য নকুল ও সহদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর শল্যের তীরের আঘাতে নকুলের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং নকুল দ্রুতগতিতে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে সহদেবের রথে আরোহণ করেন। সেখান থেকে দুই ভাই শল্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। শীঘ্রই সহদেব শল্যকে লক্ষ্য করে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন এবং সেটি শল্যের বর্ম ও শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়। তীব্র ব্যথায় শল্য তার রথে বসে পড়েন এবং সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। এমতাবস্থায় শল্যের সারথি তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। এভাবে শল্যকে পরাজিত করার পর নকুল ও সহদেব কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করেন।
সেদিন দুপুরে সূর্য যখন একেবারে মধ্য গগনে, তখন শ্রুতায়ু যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং উভয়ের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর যুধিষ্ঠিরের তীরের আঘাতে শ্রুতায়ুর ধনুক কাটা পড়ে এবং তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথি নিহত হয়। এমতাবস্থায় শ্রুতায়ু তার বিকল রথ থেকে নেমে পশ্চাৎপসরণ করেন। যুধিষ্ঠিরের নিকট শ্রুতায়ুর পরাজয়ের পর কৌরব সৈন্যরা সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে এবং যুধিষ্ঠির কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করেন।
যুদ্ধক্ষেত্রের অন্য প্রান্তে কৃপাচার্য চেকিতনের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর কৃপাচার্যের তীরের আঘাতে চেকিতনের ধনুক কাটা পড়ে এবং তার রথের সারথি ও রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। চেকিতন একটি গদা হাতে নিয়ে তার বিকল রথ থেকে ক্ষিপ্রগতিতে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং কৃপাচার্যের রথের দিকে ছুটে গিয়ে গদার আঘাতে তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথিকে হত্যা করেন। এরপর কৃপাচার্য ধনুক হাতে তার বিকল রথ থেকে নেমে পড়েন এবং চেকিতনকে তীরবিদ্ধ করেন। চেকিতন কৃপাচার্যকে লক্ষ্য করে তার গদা নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কৃপাচার্য তীরের সাহায্যে গদাটিকে প্রতিহত করেন। এরপর চেকিতন একটি তলোয়ার হাতে কৃপাচার্যের দিকে ছুটে যান এবং কৃপাচার্যও ধনুক রেখে তলোয়ার হাতে নিয়ে চেকিতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তীব্র যুদ্ধের পর তারা একে অপরের আঘাতে সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান। এমতাবস্থায় করকর্ষ এসে সংজ্ঞাবিহীন চেকিতনকে তার রথে তুলে নেন এবং শকুনি এসে সংজ্ঞাবিহীন কৃপাচার্যকে তার রথে তুলে নেন।
যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক স্থানে ভুরিশ্রবা দৃষ্টকেতুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। শীঘ্রই ভুরিশ্রবার তীরের আঘাতে দৃষ্টকেতুর রথের সারথি ও রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়, এবং দৃষ্টকেতু নিজেও আহত হন। এরপর দৃষ্টকেতু তার অচল রথ পরিত্যাগ করে শতানীকের রথে আরোহণ করেন। এভাবে ভুরিশ্রবার নিকট দৃষ্টকেতু পরাজিত হন। একই সময়ে চিত্রসেন, বিকর্ণ ও দুর্মর্ষন অভিমন্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই অভিমন্যু তাদের সকলের রথ বিকল করে দেন। অবশ্য ভীমের প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখে অভিমন্যু তাদেরকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকেন। উল্লেখ্য, পাশাখেলায় যুধিষ্ঠিরের পরাজয়ের পর ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ১০০ জন ছেলের সকলকেই হত্যা করবেন।
ভীষ্ম দুর্যোধনের ভাইদেরকে অভিমন্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন, এবং তাকে অভিমন্যুর দিকে অগ্রসর হতে দেখে অর্জুনও সেদিকে অগ্রসর হন। ত্রিগার্তার রাজা সুশর্মাসহ কৌরব পক্ষের বহুসংখ্যক রাজা ভীষ্মকে সুরক্ষা প্রদান করছিলেন। তাদের দিকে অগ্রসর হয়ে অর্জুন সুশর্মাকে যুদ্ধের আহ্বান জানান। সুশর্মার নির্দেশনায় উক্ত রাজারা ও তাদের সৈন্যসামন্তরা চতুর্দিক থেকে অর্জুনকে ঘিরে ফেলেন এবং এর ফলে এক ভয়াবহ যুদ্ধ আরম্ভ হয়। অর্জুনের তীরের আঘাতে বহুসংখ্যক রাজা নিহত হন, এবং এরপর সুশর্মার নেতৃত্বে আরেকদল রথী অর্জুনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
এমতাবস্থায় অর্জুনকে সহায়তা করার জন্য শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধারা অর্জুনের চারপাশে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং দুর্যোধন ও জয়দ্রথসহ কৌরব যোদ্ধারা ভীষ্মকে সহায়তা করার জন্য তার চারপাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। ভীম, যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব একযোগে ভীষ্মের ওপর আক্রমণ চালান, কিন্তু জয়দ্রথের তীরের আঘাতে তাদের সকলের ধনুক কাটা পড়ে। দুর্যোধন, কৃপাচার্য, চিত্রসেন প্রমুখও উক্ত চার পাণ্ডবের ওপর তীরবর্ষণ করেন। এদিকে শিখণ্ডী ভীষ্মকে আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হন, কিন্তু ভীষ্ম তাকে আঘাত না করে তীরের সাহায্যে তার ধনুক কেটে ফেলেন এবং এরপর শিখণ্ডী পশ্চাৎপসরণ করেন। যুধিষ্ঠির তাকে থামিয়ে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করেন এবং শিখণ্ডী পুনরায় ভীষ্মের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
কিন্তু শল্য শিখণ্ডীকে বাধা প্রদান করেন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। শল্য মন্ত্র উচ্চারণ করে শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করেন, কিন্তু শিখণ্ডী পাল্টা মন্ত্র উচ্চারণ করে বরুণাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং সেটির সাহায্যে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় করেন। এসময় ভীম তার ধনুক নামিয়ে রেখে গদা হাতে নিয়ে রথ থেকে নেমে জয়দ্রথের দিকে ছুটে যান। জয়দ্রথ ভীমের ওপর তীরবর্ষণ করে তার গতিরোধ করার প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু ভীম জয়দ্রথের তীরবৃষ্টি অগ্রাহ্য করে তার রথের কাছে পৌঁছান এবং গদার আঘাতে জয়দ্রথের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে হত্যা করেন।
এমতাবস্থায় চিত্রসেন রথে চড়ে ভীমের দিকে ছুটে আসেন। ভীমও তার দিকে ছুটে গিয়ে তার গদাটি চিত্রসেনের দিকে নিক্ষেপ করেন। ভীমের নিক্ষিপ্ত গদাটিকে নিজের দিকে আসতে দেখে চিত্রসেন একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে যান, এবং এর ফলে তার প্রাণ রক্ষা পায়। ভীমের নিক্ষিপ্ত গদার আঘাতে চিত্রসেনের রথটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং রথটির সারথি ও রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। বিকর্ণ সেদিকে অগ্রসর হয়ে চিত্রসেনকে নিজের রথে আরোহণ করান।
এদিকে ভীষ্মের তীরের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে, এবং যুধিষ্ঠির সাময়িকভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীষ্মের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র যুদ্ধের পর ভীষ্মের তীরের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং যুধিষ্ঠির দ্রুতগতিতে তার বিকল রথ থেকে নেমে নকুলের রথে আরোহণ করেন। যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করার পর ভীষ্ম নকুল ও সহদেবের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শুরু করেন, এবং যুধিষ্ঠির ভীষ্মের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য পাণ্ডব যোদ্ধাদের নির্দেশ দেন। কিন্তু ভীষ্মের তীরের আঘাতে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। এসময় শিখণ্ডী ভীষ্মের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু ভীষ্ম তাকে এড়িয়ে পাণ্ডব সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
সেদিন বিকেলে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকির তীরবর্ষণের ফলে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়, কিন্তু বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও কৌরব সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করতে থাকে। এসময় অবন্তীর রাজপুত্র বিন্দ ও অনুবিন্দ ধৃষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করেন এবং তাদের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। ধৃষ্টদ্যুম্ন তার বিকল রথ থেকে দ্রুতগতিতে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং সাত্যকির রথে আরোহণ করেন। এরপর যুধিষ্ঠির একটি বৃহৎ সৈন্যদল নিয়ে বিন্দ ও অনুবিন্দর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন, কিন্তু বিন্দ ও অনুবিন্দকে সহায়তা করার জন্য দুর্যোধনও একটি সৈন্যদল নিয়ে সেদিকে অগ্রসর হন এবং সৈন্যদল দুইটি একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অর্জুনের তীরের আঘাতে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হতে থাকে, এবং ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্যের তীরবর্ষণের ফলে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হতে থাকে।
এমতাবস্থায় সূর্য অস্তমিত হয় এবং উভয় পক্ষ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করে। সেদিনের যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়, কিন্তু কোনো পক্ষই অপর পক্ষের বিরুদ্ধে পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। কার্যত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সপ্তম দিনে কোনো পক্ষই বিজয়ী হতে পারেনি।