যুদ্ধের অষ্টম দিন: ভীমের পরাক্রম, অর্জুনের ছেলের মৃত্যু, ঘটোৎকচের ইন্দ্রজাল এবং পাণ্ডবদের বিজয়
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অষ্টম দিনে ভীষ্ম কৌরব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘ঊর্মিব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ কৌরব বাহিনীকে সমুদ্রের আকারে সজ্জিত করেন। এটিকে প্রতিহত করার জন্য ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘শৃঙ্গাতকব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ পাণ্ডব বাহিনীকে একটি শৃঙ্গ/শিংযুক্ত প্রাণির আকারে সজ্জিত করেন। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
যুদ্ধের শুরুতেই ভীষ্ম পাণ্ডব সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেন। ভীষ্মের তীরবর্ষণের ফলে পাণ্ডব বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত পাঞ্চাল, সোমক ও শ্রীঞ্জয় রাজ্যের বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হয় এবং পাণ্ডব বাহিনীর বহু শীর্ষ রথী ভীষ্মের হাতে নিহত হন। এমতাবস্থায় ভীম ভীষ্মকে প্রতিহত করার জন্য তার দিকে অগ্রসর হন, এবং এটি দেখে দুর্যোধন ও তার ভাইয়েরা ভীষ্মের সুরক্ষার জন্য অগ্রসর হন। ভীষ্ম ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই ভীমের তীরের আঘাতে ভীষ্মের রথের সারথি নিহত হয় এবং রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে রথটিকে সেখান থেকে টেনে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। অর্থাৎ, ভীমের নিকট ভীষ্মের পরাজয় ঘটে।
এরপর ভীমের তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ভাই সুনাভ নিহত হন। সুনাভ নিহত হওয়ার পর দুর্যোধনের সাত ভাই (আদিত্যকেতু, বহ্বাশী, কুণ্ডধর, মহোধর, অপরাজিত, পণ্ডিতক ও বিশালাক্ষ) একযোগে ভীমকে আক্রমণ করেন। কিন্তু শীঘ্রই ভীমের তীরের আঘাতে তাদের সাতজনই নিহত হন। দুর্যোধনের বাকি ভাইয়েরা আতঙ্কিত হয়ে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। ভাইদের মৃত্যুতে দুর্যোধন শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ভীমকে আক্রমণ করার জন্য তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হন।
ভীষ্মের কাছে গিয়ে দুর্যোধন অনুযোগ করেন যে, ভীষ্ম নির্লিপ্ত দর্শকের মতো তার ভাইদের মৃত্যু অবলোকন করছেন। তার বক্তব্যে ভীষ্ম দুঃখিত হন এবং দুর্যোধনকে বলেন যে, ইতোপূর্বে বহুবার দুর্যোধনকে এই পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে, কিন্তু দুর্যোধন তাতে কর্ণপাত করেননি। ভীষ্ম আরো যোগ করেন যে, তিনি ও দ্রোণাচার্য যে এই যুদ্ধে প্রাণ হারাবেন, এই ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তিনি দুর্যোধনকে মন শক্ত করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
সেদিন দুপুর নাগাদ যুদ্ধ অত্যন্ত রক্তাক্ত আকার ধারণ করে এবং উভয় পক্ষের প্রচুর সৈন্য নিহত হয়। ভীমের তীরে কৌরবদের হস্তীবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, নকুল ও সহদেব কৌরবদের অশ্বারোহী বাহিনীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালান, এবং অর্জুনের হাতে কৌরব বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত বহুসংখ্যক রাজা নিহত হন। অনুরূপভাবে, ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা প্রমুখ শীর্ষ কৌরব যোদ্ধা পাণ্ডব বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করেন।
এসময় শকুনির ছয় ভাইয়ের (গয়, গবাক্ষ, বৃষব, চর্মবৎ, অর্জব ও সুক) নেতৃত্বে গান্ধারের সৈন্যরা পাণ্ডব অশ্বারোহী বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছিল। এমতাবস্থায় ইরাবান (অর্জুন ও নাগ রাজকন্যা উলুপির ছেলে) তার সৈন্যদের নিয়ে গান্ধারের সৈন্যদলের ওপর আক্রমণ চালান এবং তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শকুনির ছয় ভাই ও তাদের সৈন্যরা ইরাবানকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং তার দিকে বর্শা নিক্ষেপ করেন। ইরাবানের বুকে, পিঠে ও পাশে অনেকগুলো বর্শা বিদ্ধ হয়, কিন্তু আহত ইরাবান সেই অবস্থাতেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে শকুনির ভাইয়েরা কয়েক মুহূর্তের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। তখন ইরাবান তার শরীরে বিদ্ধ বর্শাগুলোকে টেনে বের করেন এবং একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে রথ থেকে নেমে শকুনির ভাইদের দিকে ছুটে যান। ইতোমধ্যে শকুনির ভাইয়েরা সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে ইরাবানের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ইরাবান এত দ্রুত সরে যাচ্ছিলেন যে তাকে আঘাত করা সম্ভব হচ্ছিল না। এরপর শকুনির ভাইরা ইরাবানকে বন্দি করার জন্য রথ থেকে নেমে সশস্ত্র অবস্থায় তার দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু তাদেরকে হাতের নাগালে পেয়ে ইরাবান তলোয়ারের আঘাতে তাদেরকে হত্যা করতে শুরু করেন। শকুনির পাঁচ ভাই ইরাবানের হাতে নিহত হন এবং কেবল বৃষব গুরুতর আহত অবস্থায় পশ্চাৎপসরণ করতে সক্ষম হন।
ইরাবানের হাতে শকুনির পাঁচ ভাই নিহত হওয়ার পর দুর্যোধন তাকে আক্রমণ করার জন্য রাক্ষস অলম্বুষকে নির্দেশ দেন। অলম্বুষ ইন্দ্রজালের সাহায্যে একটি রাক্ষস সৈন্যদলের সৃষ্টি করেন এবং তাদেরকে নিয়ে ইরাবানের দিকে অগ্রসর হন। অলম্বুষ ও ইরাবানের সৈন্যদলের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয় এবং শীঘ্রই উভয় সৈন্যদলই ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর অলম্বুষ ইরাবানের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং ইরাবানের একেবারে কাছাকাছি এসে তার ওপর তীরবর্ষণ করতে থাকেন। ইরাবান তার তলোয়ারের আঘাতে তার দিকে নিক্ষিপ্ত তীরগুলোকে কেটে ফেলেন এবং এরপর তার তলোয়ারটিকে অলম্বুষের দিকে নিক্ষেপ করেন, যেটির আঘাতে অলম্বুষের ধনুক কাটা পড়ে। এরপর অলম্বুষ ও ইরাবান উভয়েই ইন্দ্রজালের সাহায্যে মাটি থেকে ওপরে উঠে বাতাসে ভাসতে থাকেন এবং ইরাবান তলোয়ারের আঘাতে অলম্বুষের শরীরের অংশগুলো কাটতে শুরু করেন।
কিন্তু অলম্বুষের শরীরের অংশগুলো কাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার নতুন করে সৃষ্টি হতে থাকে। এমতাবস্থায় ইরাবান ইন্দ্রজালের সাহায্যে বহুসংখ্যক নাগ সৃষ্টি করেন এবং সেগুলো অলম্বুষকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরে। এরপর অলম্বুষ ইন্দ্রজালের সাহায্যে গরুড়ের রূপ ধারণ করেন এবং সেই নাগগুলোকে ভক্ষণ করেন। নিজের ইন্দ্রজাল ব্যর্থ হতে দেখে ইরাবান বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন এবং সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অলম্বুষ তৎক্ষণাৎ তলোয়ারের আঘাতে ইরাবানকে হত্যা করেন। এদিকে সেসময় ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে এবং অর্জুন, ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন কৌরবদের বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, এবং অর্জুনের ছেলে যে যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, সেটি অর্জুন তখনো জানতে পারেননি।
অলম্বুষের হাতে ইরাবান নিহত হওয়ার পর ঘটোৎকচ তার রাক্ষস সৈন্যদল দিয়ে কৌরব বাহিনীর দিকে অগ্রসর হন। ঘটোৎকচ ও তার রাক্ষস সৈন্যদলকে দেখে কৌরব সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং তাদের বড় একটি অংশ পশ্চাৎপসরণ করে। তাকে প্রতিহত করার জন্য দুর্যোধন নিজেই তার দিকে অগ্রসর হন এবং বঙ্গের রাজার নেতৃত্বাধীনে একটি বৃহৎ হস্তীবাহিনী দুর্যোধনকে অনুসরণ করে। ঘটোৎকচের রাক্ষস সৈন্যরা দুর্যোধনের হস্তীবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে বহুসংখ্যক হাতিকে হত্যা করে। তীব্র যুদ্ধের পর উক্ত হস্তীবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
এরপর ক্ষিপ্ত দুর্যোধন একাকী ঘটোৎকচের রাক্ষস সৈন্যদলকে আক্রমণ করেন এবং তার তীরে ঘটোৎকচের সৈন্যদলের বহু শীর্ষ যোদ্ধা নিহত হয়। এরপর দুর্যোধনের তীরে ঘটোৎকচের সৈন্যদলের শীর্ষ চার রাক্ষস (বেগবৎ, মহারুদ্র, বিদ্যুজিহ্বা ও প্রমথীন) নিহত হন। এরপর ঘটোৎকচ দুর্যোধনের দিকে ছুটে আসেন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ঘটোৎকচ দুর্যোধনকে হত্যা করার জন্য একটি বিশেষ ধরনের তীর হাতে নেন, কিন্তু তক্ষুণি বঙ্গের রাজা একটি বৃহৎ হাতির পিঠে চেপে অগ্রসর হন এবং দুর্যোধনকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে তার ও ঘটোৎকচের রথের মাঝখানে হাতিটিকে দাঁড় করান। ক্ষিপ্ত ঘটোৎকচ তীরটিকে বঙ্গের রাজার দিকে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু বঙ্গের রাজা ক্ষিপ্রগতিতে হাতির পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং ঘটোৎকচের তীরের আঘাতে বঙ্গের রাজাকে বহনকারী হাতিটি নিহত হয়।
এরপর দুর্যোধন ঘটোৎকচের দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ঘটোৎকচ ক্ষিপ্রগতিতে সরে গিয়ে তীরটিকে এড়িয়ে যান। এরপর তিনি বিকট গর্জন করতে শুরু করেন এবং তার গর্জন শুনে কৌরব সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এসময় ভীষ্মের নির্দেশে দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, ভুরিশ্রবা, শল্য, সোমদত্ত, বাহ্লিক, জয়দ্রথ, বিন্দ, অনুবিন্দ, বৃহদ্বল, বিকর্ণ, চিত্রসেন, বিবিংশতি এবং আরো বহুসংখ্যক শীর্ষ কৌরব যোদ্ধা দুর্যোধনকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন। তাদের সঙ্গে ঘটোৎকচের সৈন্যদলের তীব্র যুদ্ধ শুরু হয় এবং ঘটোৎকচ অগ্রসর হয়ে তাদের সকলকে আক্রমণ করেন।
ঘটোৎকচের তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্যের ধনুক ও সোমদত্তের রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। এরপর তিনি বাহ্লিক, কৃপাচার্য ও চিত্রসেনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে বিকর্ণ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। তার তীর ভুরিশ্রবার বর্ম ভেদ করে বেরিয়ে যায় এবং ভুরিশ্রবাকে গুরুতরভাবে আহত করে। এরপর তার তীরে অশ্বত্থামা ও বিবিংশতির রথের সারথি নিহত হয় এবং রথ দুইটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এরপর তার তীরের আঘাতে জয়দ্রথের রথের ঝাণ্ডা ও ধনুক কাটা পড়ে এবং অবন্তীর রাজার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। সর্বশেষ তার তীরের আঘাতে বৃহদ্বল সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং শল্য আহত হন। এমতাবস্থায় উক্ত কৌরব যোদ্ধাদের সকলেই ঘটোৎকচের সঙ্গে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে পশ্চাৎপসরণ করেন, কিন্তু দুর্যোধন সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন।
তখন ঘটোৎকচ আবার দুর্যোধনের দিকে ধাবিত হন, কিন্তু কৌরব সৈন্যরা দুর্যোধনকে রক্ষা করার জন্য ঘটোৎকচকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং তার ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকে। এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে ভীমের নেতৃত্বাধীনে একদল শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধা নিজ নিজ সৈন্যদল নিয়ে ঘটোৎকচকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন। এরপর কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং উভয় পক্ষেরই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৌরব সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে আরম্ভ করে।
কৌরব বাহিনীর দুরবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দুর্যোধন ক্ষিপ্ত হয়ে ভীমের দিকে অগ্রসর হন এবং ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর দুর্যোধনের তীরের আঘাতে ভীমের ধনুক কাটা পড়ে, এবং দুর্যোধনের আরেকটি তীর ভীমের বুকে বিদ্ধ হয়। তীব্র ব্যথায় ভীম তার রথের ঝাণ্ডা আঁকড়ে ধরেন। ভীমের এই অবস্থা দেখে ঘটোৎকচ গর্জন করে উঠে দুর্যোধনের দিকে ধাবিত হন এবং অভিমন্যুর নেতৃত্বে শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধারাও দুর্যোধনের দিকে অগ্রসর হন। এটি দেখে দ্রোণাচার্যের নেতৃত্বে শীর্ষ কৌরব যোদ্ধারা আবার সেদিকে অগ্রসর হন এবং শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
দ্রোণাচার্য ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ভীমের তীরের আঘাতে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দুর্যোধন ও অশ্বত্থামা ভীমের দিকে অগ্রসর হন এবং ভীম একটি গদা হাতে নিয়ে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের দিকে ছুটে যান। ইতোমধ্যে দ্রোণাচার্য সংজ্ঞা ফিরে পান এবং তার নেতৃত্বে একদল কৌরব যোদ্ধা অগ্রসর হয়ে ভীমকে ঘিরে ফেলেন। তারা ভীমের দিকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করতে থাকেন। তখন অভিমন্যুর নেতৃত্বে একদল শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধা ভীমকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন।
এসময় অশ্বত্থামা রাজা নীলের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং নীলের তীরের আঘাতে অশ্বত্থামা আহত হন। এরপর অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে নীলের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। তারপর নীল নিজেও অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। অশ্বত্থামার নিকট নীলের পরাজয়ের পর ঘটোৎকচ তার রাক্ষস সৈন্যদল নিয়ে অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন, কিন্তু অশ্বত্থামার তীরে ঘটোৎকচের সৈন্যদলের অগ্রভাগে থাকা বহুসংখ্যক রাক্ষস সৈন্য নিহত হয়।
এরপর ক্ষিপ্ত ঘটোৎকচ তার ভয়ঙ্কর ইন্দ্রজাল ব্যবহার করতে শুরু করেন। তার ইন্দ্রজালের প্রভাবে অশ্বত্থামা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। ঘটোৎকচ এমন একটি ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করেছিলেন যে, তার প্রভাবে কৌরব সৈন্যরা চতুর্দিকে কেবল নিজেদের বাহিনীর সৈন্যদের মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছিল। শুধু তাই নয়, তারা দেখতে পাচ্ছিল যে, দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা ও দুর্যোধনসহ কৌরব বাহিনীর সকল শীর্ষ যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পশ্চাৎপসরণ করছেন। অবশ্য বাস্তবে এরকম কিছুই ঘটছিল না, কিন্তু কৌরব সৈন্যদের সেটা বোঝার সামর্থ্য ছিল না। তারা আতঙ্কিত অবস্থায় ক্ষিপ্রগতিতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে।
ভীষ্ম যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক প্রান্ত থেকে এসব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি ঘটোৎকচের ইন্দ্রজালে প্রভাবিত হননি, এবং তিনি কৌরব সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণ থেকে বিরত রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তিনি চেঁচিয়ে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন যে, এগুলো ঘটোৎকচের সৃষ্ট ইন্দ্রজাল। কিন্তু বিভ্রান্ত কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করে।
ঘটোৎকচের এই বিজয়ের পর ক্ষিপ্ত দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে যান এবং তার পরাজয়ের বর্ণনা দিয়ে ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করেন, কীভাবে তিনি নিজে ঘটোৎকচকে হত্যা করতে পারবেন? প্রত্যুত্তরে ভীষ্ম দুর্যোধনকে বলেন যে, প্রত্যেকের উচিত সকল অবস্থায় নিজেকে রক্ষা করা। তিনি যোগ করেন যে, দুর্যোধনের উচিত যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল বা সহদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, কারণ একজন রাজা বা রাজপুত্র কেবল অন্য একজন রাজা বা রাজপুত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে থাকেন। ভীষ্ম বলেন যে, ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কৌরব বাহিনীতে তিনিসহ আরো বহুসংখ্যক যোদ্ধা রয়েছেন এবং এজন্য দুর্যোধনের ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
এভাবে দুর্যোধনকে শান্ত করার পর ভীষ্ম ঘটৎকচকে আক্রমণ করার জন্য ভগদত্তকে নির্দেশ দেন। ভগদত্ত তার অতিকায় হাতিতে চড়ে ঘটোৎকচের দিকে অগ্রসর হন। ভগদত্তকে অগ্রসর হতে দেখে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা নিজ নিজ সৈন্যদল নিয়ে ভগদত্তের বিরুদ্ধে ছুটে যান, কিন্তু ভগদত্তের তীরের আঘাতে ও তার হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। পাণ্ডব বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধনের পর ভগদত্ত ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভগদত্তের তীরে বিদ্ধ হয়ে ক্ষিপ্ত ভীম তীরের সাহায্যে ভগদত্তের সঙ্গে থাকা শতাধিক সৈন্যকে হত্যা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ভগদত্ত তার হাতিটিকে ভীমের রথের দিকে চালিত করেন।
এসময় অভিমন্যু, উপপাণ্ডবগণ, কৈকেয়ার পাঁচ রাজপুত্র, দশর্নার রাজা, ক্ষত্রদেব, দৃষ্টকেতু ও চিত্রকেতু ভগদত্তকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং তাদের তীরের আঘাতে ভগদত্তের হাতিটি বিদ্ধ হয়। এরপর দশর্নার রাজা একটি হাতিতে চড়ে ভগদত্তের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন, কিন্তু ভগদত্ত হাতিটির দিকে ১৪টি বর্শা নিক্ষেপ করেন এবং সেগুলো হাতিটির শরীরে বিদ্ধ হয়। আহত হাতিটি ব্যথায় কাতর হয়ে ক্ষিপ্রগতিতে পশ্চাৎপসরণ করে এবং সেটির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়।
ভগদত্তের নিকট দশর্নার রাজার পরাজয়ের পর ভীমের নেতৃত্বে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা নিজ নিজ সৈন্যদল নিয়ে ভগদত্তের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন, কিন্তু ভগদত্তের তীরের আঘাতে ও তার হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে আবারো বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। তখন ঘটোৎকচ ভগদত্তের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং ভগদত্তের হাতিটির দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন। ভগদত্ত তীরের সাহায্যে উক্ত তীরটিকে কেটে ফেলেন এবং ঘটোৎকচের দিকে একটি বৃহৎ বল্লম নিক্ষেপ করেন। কিন্তু ঘটোৎকচ লাফিয়ে উঠে সেই বল্লমটিকে ধরে ফেলেন এবং সেটিকে ভেঙে ফেলেন। এটি দেখে পাণ্ডব বাহিনী উল্লাস করতে শুরু করে।
কিন্তু তাদের উল্লাসে ভগদত্ত ক্ষিপ্ত হন এবং অগ্রসর হয়ে শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধাদের আক্রমণ করেন। তার তীরে ঘটোৎকচ, অভিমন্যু, উপপাণ্ডবগণ, পাঁচ কৈকেয়া রাজপুত্র ও ক্ষত্রদেব সকলেই বিদ্ধ হন। এরপর ভগদত্তের তীরের আঘাতে ভীমের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়, রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং রথের সারথি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। ভীম একটি গদা হাতে নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন। ঠিক এই সময়ে কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে করতে অর্জুন সেখানে এসে উপস্থিত হন, এবং দুর্যোধনের নির্দেশে একটি কৌরব সৈন্যদল অর্জুনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে ভগদত্ত পাণ্ডব সৈন্যদের হত্যা করতে করতে যুধিষ্ঠিরের দিকে ছুটে যান।
এসময় ভীম অর্জুনকে জানান যে, অর্জুনের ছেলে ইরাবান যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এই সংবাদে অর্জুন শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি কৃষ্ণকে বলেন যে, যুধিষ্ঠিরের যে কোনো মূল্যে শান্তি বজায় রাখার প্রচেষ্টার কারণ তিনি এখন অনুধাবন করতে পারছেন। তিনি এটিও যোগ করেন যে, নিজের আত্মীয়দের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ তার কাছে মোটেই পছন্দনীয় নয়, কিন্তু তিনি দুর্বলতা দেখালে তার সমালোচনা করা হবে এবং কেবল সেজন্যই তিনি যুদ্ধ করছেন। কিন্তু তিনি মনকে শক্ত করেন এবং আবার যুদ্ধে লিপ্ত হন।
সেদিন বিকেলে দ্রোণাচার্যের নেতৃত্বে দুর্যোধনের আট ভাই ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তাদের তীরে ভীম বিদ্ধ হন। কিন্তু শীঘ্রই ভীমের তীরের আঘাতে একে একে ব্যুদোরোস্ক, কুণ্ডলীন, অনাধৃতি, কুণ্ডভেদী, বিরাট, দীর্ঘবাহু, দীর্ঘলোচন এবং কণ্যকধ্বজ নিহত হন। এভাবে দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থাতেই ভীম দুর্যোধনের আট ভাইকে হত্যা করেন।
ভীষ্ম, ভগদত্ত ও কৃপাচার্য অর্জুনের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অর্জুন তীরের সাহায্যে সেগুলোকে প্রতিহত করেন এবং তার তীরে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। এদিকে রাজা অম্বস্ত অভিমন্যুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, কিন্তু অভিমন্যু তার রথ বিকল করে দেন এবং তিনি একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে উক্ত বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে তলোয়ারটি অভিমন্যুর দিকে নিক্ষেপ করেন। এরপর তিনি কৃতবর্মার রথে আরোহণ করেন। কিন্তু অভিমন্যু ক্ষিপ্রগতিতে সরে গিয়ে তার দিকে অম্বস্তের নিক্ষিপ্ত তলোয়ারটিকে এড়িয়ে যান।
এভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। সূর্যাস্তের পর উভয় পক্ষ তাদের ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত সৈন্যদলকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এদিনের যুদ্ধে পাণ্ডবদের তুলনায় কৌরবদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি, এজন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অষ্টম দিনের লড়াইয়ে কৌরবদের পরাজয় ঘটেছে বলে বিবেচনা করা হয়।
সেদিন রাতে শিবিরে ফিরে দুর্যোধন কর্ণ, শকুনি ও দুঃশাসনের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেন। তিনি এই বলে আফসোস করেন যে, ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, শল্য এবং ভুরিশ্রবা পূর্ণ শক্তি দিয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন না। কর্ণ তাকে পরামর্শ দেন যে, ভীষ্মকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করা হোক, সেক্ষেত্রে কর্ণ যুদ্ধে যোগ দিতে পারবেন এবং পাণ্ডবদের পরাজিত করে দুর্যোধনকে বিজয় এনে দিতে পারবেন। কর্ণের পরামর্শ অনুযায়ী দুর্যোধন ভীষ্মের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ভীষ্মকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ভীষ্ম পাণ্ডবদেরকে পরাজিত করবেন বলে দুর্যোধনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি ভীষ্মকে প্রস্তাব দেন যে, হয় ভীষ্ম নিজে যেন পাণ্ডবদের পরাজিত করেন, নয়ত তিনি যেন যুদ্ধ থেকে সরে গিয়ে কর্ণকে যুদ্ধে প্রবেশের সুযোগ করে দেন।
ভীষ্ম দুর্যোধনের কথায় ব্যথিত হন, কিন্তু দুর্যোধনের উদ্দেশ্যে তিক্ত কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। তিনি দুর্যোধনকে অর্জুনের পূর্ববর্তী কৃতিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি আবারো প্রতিশ্রুতি দেন যে, হয় তিনি পাণ্ডবদের পরাজিত করবেন, নয়ত পাণ্ডবরা তাকে পরাজিত করবে। তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, পরবর্তী দিন তিনি এমনভাবে যুদ্ধ করবেন যে, যতদিন বিশ্বের অস্তিত্ব থাকবে ততোদিন সেটি নিয়ে আলোচনা হবে। ভীষ্মের এই বক্তব্য শুনে দুর্যোধন তাকে সম্মান জ্ঞাপন করে নিজের শিবিরে ফিরে যান।