Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ: ভীষ্ম পর্বের সারসংক্ষেপ || শেষ পর্ব

[৬ষ্ঠ পর্ব পড়ুন]

যুদ্ধের দশম দিন: কৌরব প্রধান সেনাপতির পতন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দশম দিনে কৌরব ও পাণ্ডবরা যথারীতি ব্যূহ গঠন করে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এদিনের যুদ্ধে পাণ্ডবদের মূল লক্ষ্য ছিল কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ভীষ্মকে হত্যা করে। স্বাভাবিকভাবেই, এদিনের যুদ্ধে কৌরবদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ভীষ্মকে রক্ষা করা।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, যুদ্ধের নবম দিনের রাতে ভীষ্ম নিজেই তাকে হত্যা করার উপায় পঞ্চপাণ্ডবকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করাকে তিনি তার কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতেন, ফলে দশম দিনের যুদ্ধের শুরুতেও তিনি পূর্ণ শক্তিতে যুদ্ধ করতে শুরু করেন এবং তার তীরে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। এরপর সাত্যকি, নকুল ও সহদেব অগ্রসর হয়ে কৌরব সৈন্যদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায় এবং তাদের তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে।

এরপর ভীষ্ম অগ্রসর হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালান এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। পাণ্ডব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে তার ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে, কিন্তু ভীষ্ম তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন। এই পরিস্থিতিতে শিখণ্ডী ভীষ্মের ওপর তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করেন, কিন্তু তার তীরে বিদ্ধ হওয়ার পরেও ভীষ্ম তাকে প্রত্যাঘাত করা থেকে বিরত থাকেন। এসময় অর্জুন শিখণ্ডীকে ভীষ্মের কাছাকাছি অগ্রসর হতে বলেন এবং জানান যে, তিনি শিখণ্ডীর পিছনে অবস্থান গ্রহণ করে ভীষ্মকে হত্যা করবেন। অর্জুন ভীষ্মের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। পাণ্ডব বাহিনীর অন্যান্য শীর্ষ যোদ্ধারাও কৌরব বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন। এমতাবস্থায় কৌরব সৈন্যরা আবারো ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে থাকে।

এটি দেখে দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে গিয়ে কৌরব সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য তাকে আহ্বান জানান। ভীষ্ম তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আগের চেয়েও তীব্রভাবে যুদ্ধ করতে থাকেন এবং পাণ্ডব বাহিনীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালান। মহাভারতের বিবরণ অনুযায়ী, সেসময় ভীষ্মের হাতে পাণ্ডব বাহিনীর ১০,০০০ হাতি ও ১০,০০০ ঘোড়া তাদের আরোহীসহ নিহত হয় এবং ২,০০,০০০ পদাতিক সৈন্যও নিহত হয়। কিন্তু বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও পাণ্ডব সৈন্যরা যুদ্ধ চালিয়ে যায় এবং ভীষ্মকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। তখন দুর্যোধন ও তার ভাইয়েরা সসৈন্যে চতুর্দিক থেকে ভীষ্মকে ঘিরে রেখে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে থাকেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দশম দিনে উভয় পক্ষের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ভীষ্ম; Source: Richard Friederisk/Wikimedia Commons

এমতাবস্থান অর্জুন শিখণ্ডীকে নির্ভয়ে ভীষ্মের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য বলেন এবং নিজেও ভীষ্মের দিকে অগ্রসর হন। পাণ্ডব বাহিনীর অন্য শীর্ষ যোদ্ধারাও একইভাবে ভীষ্মের দিকে ছুটে যান। কিন্তু কৌরব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা অগ্রসর হয়ে তাদের গতিরোধ করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। দুর্যোধন দুঃশাসনকে ভীষ্মের সুরক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন, এবং এজন্য দুঃশাসন অগ্রসর হয়ে অর্জুনের গতিরোধ করেন ও তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্জুনের তীরের আঘাতে দুঃশাসনের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু তিনি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। একটি তীব্র যুদ্ধের পর অর্জুনের তীরের আঘাতে দুঃশাসন সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন এবং তার রথের সারথি রথটিকে ভীষ্মের রথের কাছাকাছি নিয়ে যায়। কিন্তু শীঘ্রই দুঃশাসন সংজ্ঞা ফিরে পান এবং আবার অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

এদিকে রাক্ষস অলম্বুষ সাত্যকির বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তারা উভয়েই একে অপরের তীরে বিদ্ধ হন। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রাগজ্যোতিষের রাজা ভগদত্তের তীরে সাত্যকি বিদ্ধ হন এবং এরপর তিনি অলম্বুষের সঙ্গে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে ভগদত্তের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ভগদত্তের তীরের আঘাতে সাত্যকির ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু সাত্যকি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভগদত্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন ও তাকে তীরবিদ্ধ করেন। তখন ভগদত্ত সাত্যকির দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সাত্যকির তীরের আঘাতে উক্ত তীরটি কাটা পড়ে। এমতাবস্থায় দুর্যোধনের নির্দেশে কৌরব বাহিনীর বহুসংখ্যক রথী সাত্যকিকে ঘিরে ফেলেন এবং সাত্যকি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

অনুরূপভাবে, কৌরব বাহিনীর অন্যান্য শীর্ষ যোদ্ধা ভীষ্মের দিকে অগ্রসরমান পাণ্ডব বাহিনীর অন্যান্য শীর্ষ যোদ্ধাদের গতিরোধ করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এসময় কম্বোজের রাজা সুদক্ষিণ অভিমন্যুর বিরুদ্ধে, অশ্বত্থামা দ্রুপদ ও বিরাটের বিরুদ্ধে, কৃপাচার্য সহদেবের বিরুদ্ধে, বিকর্ণ নকুলের বিরুদ্ধে, দুর্মুখ ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে, কৃতবর্মা ধৃষ্টদ্যুম্নের বিরুদ্ধে, ভুরিশ্রবা ভীমের বিরুদ্ধে, দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে এবং চিত্রসেন চেকিতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভগদত্ত, কৃপাচার্য, শল্য, কৃতবর্মা, জয়দ্রথ, চিত্রসেন, বিকর্ণ, দুর্মর্ষণ এবং অবন্তীর রাজপুত্র বিন্দ ও অনুবিন্দ একযোগে ভীমকে আক্রমণ করেন। তাদের মধ্যে একটি তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং উক্ত দশ কৌরব যোদ্ধা ভীমকে ও ভীম উক্ত দশ যোদ্ধাদেরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। ভীমের তীরের আঘাতে কৃপাচার্যের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু কৃপাচার্য আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীমের ওপর তীরবর্ষণ অব্যাহত রাখেন। ভীমের তীরের আঘাতে জয়দ্রথের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়, কিন্তু জয়দ্রথ তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে মাটির ওপর দাঁড়িয়েই ভীমের ওপর তীরবর্ষণ করতে থাকেন। শীঘ্রই ভীমের তীরের আঘাতে জয়দ্রথের ধনুক কাটা পড়ে এবং তিনি তখন চিত্রসেনের রথে আরোহণ করেন।

চিত্রকর্মে ভীষ্ম কর্তৃক পাণ্ডবদের নিকট তাকে বধের উপায় জানিয়ে দেয়ার দৃশ্য; Source: Wikimedia Commons

ভীম ও উক্ত কৌরব যোদ্ধাদের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলতে থাকে এবং ভীমের তীরের আঘাতে কৃতবর্মার ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু কৃতবর্মা আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীমের ওপর তীরবর্ষণ অব্যাহত রাখেন। এরপর উক্ত কৌরব যোদ্ধা ভীমের দিকে নানা ধরনের অস্ত্র নিক্ষেপ করেন। ভগদত্ত ভীমের দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন, জয়দ্রথ ভীমের দিকে একটি বর্শা ও একটি কুঠার নিক্ষেপ করেন, কৃপাচার্য ভীমের দিকে একটি শতঘ্নী নিক্ষেপ করেন এবং বাকি সাত কৌরব যোদ্ধা ভীমের ওপর তীরবর্ষণ করেন। কিন্তু ভীমের তীরের আঘাতে তার দিকে নিক্ষিপ্ত সবগুলো অস্ত্রশস্ত্রই কাটা পড়ে।

এমতাবস্থায় ভীমকে সহায়তা করার জন্য অর্জুন সেদিকে অগ্রসর হন এবং কৌরব যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। দুর্যোধনের নির্দেশে ত্রিগার্তার রাজা সুশর্মা সসৈন্যে অর্জুনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। অর্জুন ও ভীম সসৈন্যে উক্ত সুশর্মা ও পূর্বে উল্লিখিত কৌরব যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। অর্জুনের তীরে শল্যের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু শল্য আরেকটি ধনুক উঠিয়ে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। এমতাবস্থায় দুর্যোধনের নির্দেশে দ্রোণাচার্য ও মগধের রাজা জয়তসেন সসৈন্যে সেদিকে অগ্রসর হন।

জয়তসেন ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ভীমের তীরের আঘাতে জয়তসেনের রথের সারথি নিহত হয়। এর ফলে জয়তসেনের রথটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে এবং রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো সেটিকে দূরে টেনে নিয়ে যায়। এরপর দ্রোণাচার্য ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ইতোমধ্যে ভীষ্ম, দুর্যোধন ও কোশলের রাজা বৃহদ্বল অর্জুন ও ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ভীষ্মকে সেদিকে অগ্রসর হতে দেখে পাণ্ডব বাহিনী শিখণ্ডীকে অগ্রভাগে রেখে ভীষ্মের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়, এবং উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়।

এসময় দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নের বিরুদ্ধে, দুর্যোধন অভিমন্যুর বিরুদ্ধে, অশ্বত্থামা সাত্যকির বিরুদ্ধে, চিত্রসেন সুশর্মার (এই সুশর্মা ত্রিগার্তার রাজা ছিলেন না, বরং ছিলেন পাণ্ডব বাহিনীর একজন রথী) বিরুদ্ধে এবং জয়দ্রথ বিরাটের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভীম কৌরব হস্তীবাহিনীকে আক্রমণ করেন এবং সেটির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন। পৌরব চেদির রাজা দৃষ্টকেতুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাদের উভয়ে একে অপরের ধনুক কেটে ফেলেন ও তাদের একে অপরের তীরে তাদের রথগুলোর সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। এরপর তারা উভয়ে তাদের বিকল রথদ্বয় থেকে নেমে তলোয়ার যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং একে অপরের আঘাতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন।

চিত্রকর্মে ভীষ্ম কর্তৃক শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগে অস্বীকৃতি জানানোর দৃশ্য; Source: Wikimedia Commons

ভগদত্ত অর্জুনের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে দ্রুপদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। অর্জুনের রথ শিখণ্ডীর রথের পিছে ভীষ্মের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এদিকে পাণ্ডব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে ভীষ্মকে আক্রমণ করে, কিন্তু ভীষ্মের তীরে তাদের সকলেই নিহত হয়। বস্তুত সেসময় যেসব পাণ্ডব রথী ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হয়েছিল, তাদের কেউই প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেনি। ইতোমধ্যে শিখণ্ডীর তীরে ভীষ্ম বিদ্ধ হন, কিন্তু ভীষ্ম শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত করা থেকে বিরত থাকেন।

এসময় দুঃশাসন অগ্রসর হয়ে অর্জুনসহ সমগ্র পাণ্ডব বাহিনীর গতিরোধ করেন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু অর্জুন দুঃশাসনকে পরাজিত করেন এবং শিখণ্ডীর পিছে পিছে ভীষ্মের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ভীষ্ম আবারো শিখণ্ডীর তীরে বিদ্ধ হন, কিন্তু শিখণ্ডীর তীরের আঘাত তাকে তেমন ব্যথা দিচ্ছিল না। ইতোমধ্যে দুর্যোধনের নির্দেশে বিরাট এক কৌরব সৈন্যদল অর্জুনকে আক্রমণ করে। এমতাবস্থায় অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে উক্ত সৈন্যদলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়।

তখন দুঃশাসন আবারো অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু অর্জুনের তীর দুঃশাসনের শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়। অর্জুনের তীরের আঘাতে দুঃশাসনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথি নিহত হয়। এরপর অর্জুনের তীরের আঘাতে কৃপাচার্য, শল্য, বিবিংশতি ও বিকর্ণের রথগুলোর সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো এবং তাদের রথগুলোর সারথিরা নিহত হয়। এমতাবস্থায় দুঃশাসন, কৃপাচার্য, শল্য, বিবিংশতি ও বিকর্ণ সকলেই পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হন। এরপর অর্জুন আবারো মন্ত্র উচ্চারণ করে কৌরব সৈন্যদলের বিরুদ্ধে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হতে থাকে। ভীষ্ম অর্জুনের দিব্যাস্ত্র প্রতিহত করার জন্য মন্ত্র উচ্চারণ করে একটি দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন, কিন্তু তক্ষুণি শিখণ্ডী ভীষ্মের ঠিক সামনে এসে উপস্থিত হন। বাধ্য হয়ে ভীষ্মকে উক্ত অস্ত্রটি প্রত্যাহার করে নিতে হয়।

ইতোমধ্যে ভীম, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রুপদ ও বিরাট একযোগে ভীষ্মকে আক্রমণ করেন এবং ভীষ্মের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এসময় অর্জুন শিখণ্ডীর আড়ালে থেকে ভীষ্মের ওপর তীরবর্ষণ করেন এবং অর্জুনের তীরের আঘাতে ভীষ্মের ধনুক কাটা পড়ে। এমতাবস্থায় দ্রোণাচার্য, ভগদত্ত, কৃতবর্মা, ভুরিশ্রবা, জয়দ্রথ, শল্য ও শাল তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এদিকে ভীষ্মের ধনুক কাটা পড়ার পরপরই শিখণ্ডীর তীরে ভীষ্ম বিদ্ধ হতে থাকেন। শিখণ্ডীর তীরে ভীষ্মের রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং তার রথের সারথিও বিদ্ধ হয়। তখন ভীষ্ম আরেকটি ধনুক উঠিয়ে নেন, কিন্তু অর্জুন শিখণ্ডীর আড়াল থেকে তীর নিক্ষেপ করে সেটিকেও কেটে ফেলেন। এভাবে ভীষ্ম যতগুলো ধনুক উঠিয়েছিলেন, সবগুলোই শিখণ্ডীর আড়ালে থাকা অর্জুনের তীরে কাটা পড়তে থাকে।

চিত্রকর্মে ভীষ্মের শরশয্যার দৃশ্য; Source: Mahavir Prasad Mishra/Wikimedia Commons

এরপর ভীষ্ম অর্জুনের দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অর্জুনের তীরে সেটি কাটা পড়ে। এই সময়ে ভীষ্ম তার ইচ্ছামৃত্যুর বর ব্যবহার করার সংকল্প করেন এবং অস্ত্রত্যাগ করেন। এই সুযোগে শিখণ্ডী আবারো ভীষ্মকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু তার তীর ভীষ্মের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। এমতাবস্থায় অর্জুন শিখণ্ডীর আড়ালে থেকে ভীষ্মের দিকে ক্ষিপ্রগতিতে শত শত তীর নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং সেগুলো ভীষ্মের শরীরের প্রতিটি অংশে বিদ্ধ হয়। এমতাবস্থায় তীরবিদ্ধ ভীষ্ম তার রথ থেকে নিচে পড়ে যান, কিন্তু তার শরীরে এত তীর বিদ্ধ হয়েছিল যে তার শরীর মাটি স্পর্শ করেননি।

ভীষ্ম চেয়েছিলেন এই অবস্থায় তার ইচ্ছামৃত্যুর বর ব্যবহার করতে, অর্থাৎ এই সময়টিকে তার মৃত্যুর সময় হিসেবে বেছে নিতে। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেন যে, সেসময় সূর্য দক্ষিণায়নে রয়েছে, অর্থাৎ সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থান করছে। কিন্তু এই সময়টিকে অশুভ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, এবং এজন্য ভীষ্ম সেই মুহূর্তকে তার মৃত্যুর সময় হিসেবে বেছে নেয়া থেকে বিরত থাকেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি সূর্যের উত্তরায়ন, অর্থাৎ সর্ব উত্তরে অবস্থান গ্রহণ পর্যন্ত তার এই ‘শরশয্যা’তেই অবস্থান করবেন।

ভীষ্মের পতনের পরপরই পাণ্ডবরা বিজয়োৎসব শুরু করে দেয়। অন্যদিকে, দুঃশাসন তৎক্ষণাৎ কৌরব সৈন্যদলের মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং দ্রোণাচার্যকে ভীষ্মের পতনের সংবাদ দেন। এই সংবাদ পাওয়ার পরপরই দ্রোণাচার্য যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য কৌরব বাহিনীকে নির্দেশ দেন এবং অনুরূপভাবে পাণ্ডবরাও যুদ্ধ বন্ধ করেন। এরপর উভয় পক্ষের রাজপুরুষরা ভীষ্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য গমন করেন। ভীষ্ম তাদেরকে স্বাগত জানান। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, তার মাথা বেশি নিচের দিকে ঝুঁকে পড়েছে এবং তাকে যেন একটি বালিশ এনে দেয়া হয়।

উপস্থিত রাজা ও রাজপুরুষরা ভীষ্মের জন্য বহুসংখ্যক অত্যন্ত আরামদায়ক বালিশ নিয়ে আসেন, কিন্তু ভীষ্ম হেসে তাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, এ ধরনের বালিশ বীরদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এরপর তিনি অর্জুনকে তার জন্য তীরের সাহায্যে একটি বালিশ তৈরির জন্য বলেন, এবং তার কথামতো অর্জুন অশ্রুসিক্ত অবস্থায় মাটিতে এমনভাবে তীর নিক্ষেপ করেন যেন সেগুলোর ওপরে ভীষ্ম মাথা রাখতে পারেন। এরপর ভীষ্ম উপস্থিত রাজপুরুষদের জানান যে, সূর্যের উত্তরায়নের আগ পর্যন্ত তিনি এভাবেই অবস্থান করবেন। তিনি তার চারপাশে একটি পরিখা খননের নির্দেশ দেন, এবং উপস্থিত রাজপুরুষদের যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানান।

চিত্রকর্মে অর্জুন কর্তৃক ভীষ্মের জন্য ‘তীরের বালিশ’ নির্মাণের দৃশ্য; Source: Quora

এরপর দুর্যোধন ভীষ্মের চিকিৎসার জন্য বহুসংখ্যক সুদক্ষ চিকিৎসককে ডেকে পাঠান, কিন্তু ভীষ্ম কোনো ধরনের চিকিৎসা গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তার নির্দেশে দুর্যোধন উক্ত চিকিৎসকদের ফিরিয়ে নেন। এসময় ভীষ্ম দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে এই যুদ্ধ সমাপ্ত করার পরামর্শ দেন এবং মন্তব্য করেন যে, অর্জুনকে পরাজিত করা অসম্ভব। কিন্তু দুর্যোধন এই পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এরপর কৌরব ও পাণ্ডবরা এবং উভয় পক্ষের রাজপুরুষরা ভীষ্মের প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদর্শন করেন এবং ভীষ্মের সুরক্ষার জন্য রক্ষী মোতায়েন করে নিজ নিজ শিবিরে ফিরে যান।

ভীষ্মের সঙ্গে কর্ণের সাক্ষাৎ

ভীষ্মের কাছ থেকে উক্ত রাজপুরুষরা বিদায় নেয়ার পর কর্ণ ভীষ্মের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তিনি অশ্রুসিক্ত অবস্থায় ভীষ্মের পায়ের কাছে বসে পড়েন এবং এভাবে নিজের পরিচয় দেন, “হে কুরু অধিপতি! আমি রাধেয়, যাকে আপনি সর্বদাই ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে এসেছেন!”

কর্ণের কথা শুনে ভীষ্ম চোখ মেলে তাকান এবং সেখানে অবস্থানরত রক্ষীদের দূরে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর ভীষ্ম কর্ণকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বলেন:

“স্বাগতম, স্বাগতম! তুমি আমার সেই প্রতিদ্বন্দ্বী যে সর্বদাই আমার সঙ্গে তুলনা দিয়ে এসেছো! যদি তুমি আমার কাছে না আসতে, তাহলে নিঃসন্দেহে তোমার অমঙ্গল হতো! তুমি রাধার ছেলে নও, কুন্তীর ছেলে! অধিরথ তোমার পিতা নয়! হে শক্তিমান, আমি নারদ আর কৃষ্ণ–দ্বৈপায়নের কাছ থেকে তোমার ব্যাপারে সব শুনেছি! নিঃসন্দেহে এগুলো সবই সত্য! পুত্র, আমি সত্যি বলছি, তোমার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই! কেবল তোমার শক্তিক্ষয় করার জন্যই আমি তোমাকে কটু কথা বলতাম!”

চিত্রকর্মে ভীষ্মের শরশয্যার দৃশ্য; Source: Wikimedia Commons

এরপর ভীষ্ম মন্তব্য করেন যে, যেহেতু কর্ণ পাপের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন (কর্ণের জন্মের সময় তার মা কুন্তী ছিলেন অবিবাহিতা) এবং অসৎসঙ্গে রয়েছেন, এজন্য তিনি পাণ্ডবদের প্রতি এতটা বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, যেটি উচিত নয়। ভীষ্ম কর্ণের রণকুশলতার প্রশংসা করেন এবং তাকে বলেন যে, তিনি যেন তার আপন ভাইদের (অর্থাৎ পাণ্ডবদের) সঙ্গে যোগ দেন আর এর মধ্য দিয়ে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে সমাপ্ত করেন।

প্রত্যুত্তরে কর্ণ বলেন যে, তিনি নিজের প্রকৃত পরিচিতি সম্পর্কে অবগত আছেন, কিন্তু এতদিন দুর্যোধনের দেয়া সুযোগ–সুবিধা ভোগ করে তিনি এখন তাকে পরিত্যাগ করতে পারবেন না। তিনি যোগ করেন যে, পাণ্ডবদের প্রতি তার মনে যে বৈরীভাব রয়েছে, সেটিকে তিনি দূর করতে পারছেন না। তিনি যুদ্ধে যোগদানের জন্য ভীষ্মের অনুমতি প্রার্থনা করেন এবং অতীতে তিনি ভীষ্মের সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করেছেন সেজন্য ভীষ্মের কাছে ক্ষমা চান।

কর্ণের কথা শুনে ভীষ্ম আক্ষেপ করেন যে, তিনি এই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারলেন না। তিনি কর্ণকে যুদ্ধে যোগদানের অনুমতি প্রদান করেন এবং তাকে এই মর্মে উপদেশ দেন যে, কর্ণ যেন তার সামর্থ্য অনুযায়ী ধর্মের পথে চলে দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করেন। ভীষ্মের অনুমতি লাভের পর কর্ণ ভীষ্মের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করেন এবং সেখান থেকে প্রস্থান করেন। এর মধ্য দিয়ে ভীষ্ম পর্বের সমাপ্তি ঘটে।

Related Articles