প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, আদিতে ঘন অন্ধকারে ঢাকা ছিল মহাজাগতিক এক সমুদ্র। এই সমুদ্রের নাম নুন। নুন শব্দের অর্থই হলো আদি পানি। নুনের সীমাহীনতা, অন্ধকার, শান্ত আর অশান্তভাবসহ আরও বিভিন্ন গুনের প্রতিরূপ ছিল তার নারীরূপ নান্টুতসহ আরো ছয় দেব-দেবী। সব মিলিয়ে আটজন দেবদেবী নিয়ে গড়ে উঠেছিল অগডড (আট দেবতার দল)। এদিকে নুনের সত্ত্বার সাথে মিশে ছিল আরেক অস্তিত্ব- আটুম।
রা
আটুমের খেয়ালে মহাজাগতিক সমুদ্রের মাঝে মাথা জাগাল এক দ্বীপ। মিশরীয়রা মনে করত, এই দ্বীপই পৃথিবীর কেন্দ্র। তিনটি শহর দাবি করত, তারাই এই দ্বীপের আদি স্থান- হেলিওপলিস, হার্মোপোলিস আর মেম্ফিস। যা-ই হোক, এই দ্বীপের মধ্যিখানে উত্থিত হলো এক পর্বত, বেন-বেন। আটুম এর শিখরে গিয়ে উঠলেন। এখানে তার জাগতিক সত্ত্বার আত্মপ্রকাশ ঘটে। তার নাম রা, মিশরের প্রধান দেবতা।
গেব আর নুট
একা একা আর কত ভালো লাগে! তাই রা সৃষ্টি করলেন বাতাসের দেবতা শু আর তার সঙ্গী আর্দ্রতার দেবী তেফনাতকে। শু আর তেফনাত থেকে ভাই গেব আর বোন নুটের জন্ম। গেব ছিল পৃথিবীর দেবতা, আর নুট আকাশের দেবী। তারা শুরুতে একসাথেই ছিল। পরে এরা একে অপরের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ালে রা ক্রুদ্ধ হলেন। কারণ নুট আর গেব একসাথে থাকলে সৃষ্টির কাজে তার অসুবিধা হবে। তিনি শু-কে আদেশ দিলেন, গেব আর নুটকে আলাদা করে ফেলতে। শু গেবের উপর পা দিয়ে নুটকে ঠেলে তুলে দিতে থাকলেন। ফলে আকাশ উঠে গেল পৃথিবীর উপরে, আর দুয়ের মাঝে জায়গা করে নিল বাতাস।
এদিকে নুট তখন অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু রা আদেশ জারি করলেন, বছরের কোনো মাসের কোনোদিনই নুট সন্তান প্রসব করতে পারবে না। তখন বছরে ছিল ৩৬০ দিন। এর কোনোদিনই প্রসব করতে না পেরে নুট অস্থির হয়ে পড়ল। তার কাতরতা দেখে জ্ঞানের দেবতা থতের মায়া হলো। তিনি চাঁদের সাথে জুয়া খেলতে বসলেন। খেলায় থতের জয় হলে তিনি চাঁদের থেকে তার কিছু আলোকচ্ছটা চেয়ে নেন। এ আলো দিয়ে তিনি আরো পাঁচদিন বানিয়ে নিলেন, একে তিনি যোগ করে দেন ৩৬০ দিনের সাথে। যেহেতু এই নতুন দিনগুলো তখনো কোনো মাসের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই নুট সক্ষম হলেন তার পাঁচ সন্তান প্রসব করতে। জন্ম হলো দেবতা ওসাইরিস, সেথ, হোরাস দ্য এল্ডার আর দেবী আইসিস এবং নেপথিসের।
সৃষ্টির সূচনা
এদিকে শু গেব আর নুটকে আলাদা করে দিয়ে যে বিস্তীর্ণ স্থান পেলেন, সেখানে তিনি সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠলেন। গাছপালা, নদী-নালা, নানা জাতির পশুপাখিতে ভরে উঠল সবকিছু। রা তার সন্তানের কর্ম দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন। সে আনন্দে তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে মাটিতে পড়ল। সৃষ্টি হলো মানবজাতির।
গ্রিক পুরাণ প্রভাবিত অন্য এক মিশরীয় গল্পে বলা হয়, রা সাতবার হেসেছিলেন। প্রথম হাসিতে তৈরি হয় আলো, দ্বিতীয় হাসির ফল ছিল পানি। পরের হাসিতে আবির্ভূত হলো পৃথিবী। চতুর্থ, পঞ্চম আর ষষ্ঠ হাসি থেকে যথাক্রমে ভাগ্য, সুবিচার আর সময়ের উত্থান। সর্বশেষ সপ্তম হাসি কোনো এক কারণে পরিণত হয় কান্নায়, সেখান থেকে জন্ম নিল আত্মা।
রা প্রথমদিকে সৃষ্টিকূলের সাথেই ছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে মানুষ তার আদেশ আর মানতে চাইল না। তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে রা সিদ্ধান্ত নিলেন, এদের বিনাশ করে ফেলতে হবে। তিনি তার চোখকে পাঠালেন। তার চোখ এক হিংস্র সিংহীর আকারে নির্বিচারে চারদিকে হত্যাযজ্ঞ চালাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত রা’য়ের মায়া হলে তিনি তার চোখকে ফিরিয়ে নেন এবং নতুন করে মানুষ সৃষ্টি করেন।
অন্য এক গল্পে বলা হয়, ক্রুদ্ধ রা গবাদি পশুর দেবী হাথোরকে পাঠালেন। তিনি সেখমেত নামে এক সিংহীর রূপে পৃথিবী জুড়ে তাণ্ডব চালাতে লাগলেন। অবশেষে রা ভাবলেন, তার বিদ্রোহী সন্তানদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। তিনি তৈরি করলেন মদ এবং সে মদে প্লাবিত করে দিলেন পৃথিবী। হাথোর মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়লে তিনি তার কাজের কথা ভুলে গেলেন। ফলে মানুষ বেঁচে যায়। যারা মারা গিয়েছিল, তাদের স্থানে রা সৃষ্টি করলেন নতুন মানুষ।
কিন্তু রা মানুষের স্বার্থপর আচরণে ঠিক করলেন, তিনি আর এদের সাথে থাকবেন না। এদিকে তাকে ছাড়া তো মানুষ বাঁচতেও পারবে না। ফলে তিনি একটি পরিকল্পনা করলেন। প্রতিদিন তিনি ১২ ঘণ্টার জন্য দেখা দেবেন। আকাশের পূর্বদিকে থেকে তিনি আসবেন সূর্যের আকারে, আর চলে যাবেন পশ্চিম দিক দিয়ে। উত্থিত সূর্য রা’য়ের জন্ম, মধ্যদুপুর তার যৌবন আর অস্তাচল তার বৃদ্ধরূপ। এরপর তিনি চলে যাবেন পাতাললোকে, ১২ ঘণ্টা লড়াই করবেন অশুভ শক্তির সাথে। সেখানেই ওসাইরিসের সাথে মিলিত হয়ে হবে তার পুনর্জন্ম। নতুন সূর্য উঠবে পরদিন।
ওসাইরিস আর আইসিস
মিশরীয় পুরাণে ওসাইরিসের ভূমিকা প্রবল। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু আর তার পরকালীন জীবনের রূপক ফুটে উঠেছে ওসাইরিসের কাহিনীতে। তার মাধ্যমেই মানবজাতি পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে। কাজেই মিশরীয় সৃষ্টিগাথা থেকে তার ঘটনা আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।
সৃষ্টির সূচনালগ্নে দেবতারা মানুষের মাঝে থেকে শাসন করতেন। পিতা গেব অনেকদিন শাসন করে ক্লান্ত হয়ে গেলে তার যোগ্য পুত্র ওসাইরিসের কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ঊর্ধ্বলোকে চলে গেলেন। ওসাইরিস আইসিসকে বিয়ে করে ন্যায়ভাবে মানবজাতিকে পরিচালনা করতে থাকলেন। তিনি তাদের দেখালেন কৃষিকাজ, শেখালেন সুর আর সঙ্গীতের সুধা পান করতে। মানুষের উন্নতি হতে লাগল খুব দ্রুত। ওসাইরিস ঠিক করলেন, এবার মিশরের বাইরের লোকদেরও পথে আনা দরকার। তিনি রাজ্য আইসিসের হাতে ছেড়ে দিয়ে সে কাজে চলে যান।
এদিকে ওসাইরিসের ভাই সেথ তো তার সমৃদ্ধি দেখে জ্বলে-পুড়ে মরছিলেন। দেবতাদের মধ্যে নীচ আর কুটিল স্বভাবের বলে সেথের নাম ছিল। তার সুপ্ত ইচ্ছা ছিল মিশরেরর রাজা হবার। কোত্থেকে ওসাইরিস তার বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে বসলেন! সেথ আর তার স্ত্রী নেপথিসের ঘরে জন্মেছিল শেয়ালমুখো এক বালক, আনুবিস। তার চেহারা দেখেই সেথ তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
অবশেষে ওসাইরিস মিশরে ফিরে এলেন। তার সম্মানে সেথ বিশাল এক ভোজের আয়োজন করলেন। সেখানে তিনি হাজির করলেন মহামূল্যবান এক বাক্স। বাক্সটি বানানো হয়েছিল একদম ওসাইরিসের মাপে। সেথ ঘোষণা করলেন যে এই বাক্সে ঢুকতে পারবে, এটা তারই হবে। অনেকেই চেষ্টা করল, কিন্তু ওসাইরিসের মাপে বানানো সে বাক্সে তাদের জায়গা হলো না। শেষে ওসাইরিসের এর মধ্যে ঢুকে পড়লেন। চতুর সেথ তৎক্ষণাৎ তার চেলাদের নিয়ে ডালা বন্ধ করে তাকে আটকে দিলেন। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ওসাইরিসের মৃত্যু হলো। সেথ বাক্স নীলনদে ফেলে দেন। পথের কাঁটা দূর হয়েছে ভেবে তিনি এবার মিশরের রাজদণ্ড তুলে নিলেন।
এদিকে স্বামীর শোকে আইসিসের পাগলপ্রায় অবস্থা। তিনি ওসাইরিসকে খুঁজতে বের হলেন। পথে দেখা হলো আনুবিসের সাথে। শিশু আনুবিসকে তিনি পরম মমতায় কোলে তুলে নিয়ে তার যত্নের ব্যবস্থা করলেন। আনুবিস বড় হয়ে উঠতে লাগলেন, আর আইসিস তার সন্ধান চালিয়ে গেলেন। একসময় তিনি খবর পেলেন, ওসাইরিসের বাক্স এক গাছের কাণ্ডের ভেতরে ঢাকা পড়েছে। সে গাছের খোঁজে আইসিস চলে এলেন ফিনিশিয়ায়। এখানে রাজপ্রাসাদের একটি স্তম্ভ হিসেবে সে গাছের দেখা পেলেন। আইসিস এখানকার নারীদের চুল বাঁধতে আর সুগন্ধির ব্যবহার শেখালেন। এভাবেই তার সাথে পরিচয় হলো রানী ইশথারের। ইশথার তাকে তার শিশুসন্তানের দেখাশোনার কাজ দিলেন।
এক রাতে আইসিস ইশথারের সামনে দেবীরূপে আবির্ভূত হয়ে তার এখানে আসার কারণ জানালেন। ইশথারের সহায়তায় তিনি ওসাইরিসের বাক্স উদ্ধার করে মিশরে ফিরে এলেন। এখানে নেপথিস তাকে সাহায্য করেন মৃত ওসাইরিসের দেহে স্বল্প সময়ের জন্য প্রাণের সঞ্চার করতে। এ সময়ের মধ্যে আইসিস অন্তঃসত্ত্বা হন। সেথ এবার আইসিসকে কারাবন্দি করলেন। কিন্তু, আনুবিস তাকে পালানোর সুযোগ করে দেন। আইসিস চলে যান নীলের জলাভূমিতে, সেথের কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য। এখানেই তিনি জন্ম দিলেন হোরাসের। হোরাস বেড়ে উঠতে লাগলেন শক্তিশালী যোদ্ধা হিসেবে।
সেথ কিন্তু ওসাইরিসের বাক্স যে আইসিস উদ্ধার করেছেন, সে খবর পেয়ে গিয়েছিলেন। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে তিনি আবার বাক্সটি নিজের নাগালে নিয়ে নেন। এবার আর সেথ কোনো ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। মৃতদেহ ১৪ টুকরো করে তিনি একেক টুকরো একেকদিকে নিক্ষেপ করলেন।
আইসিস এই নতুন বিপর্যয়েও হতোদ্যম হলেন না। তিনি আবারো কাজে নামলেন। তের টুকরো উদ্ধার করতে পারলেন তিনি, কেবল জননাঙ্গ ছাড়া। কাজেই তিনি জননাঙ্গের স্বর্ণনির্মিত একটি মডেল বানালেন। হোরাস ওসাইরিসের পুরো দেহ জোড়া লাগালেন। এরপর তিনি যাত্রা করেন সেথকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে। তার বাহিনীর সাথে সেথের সেনাদের তুমুল লড়াই হলো। হোরাস নিজে সেথের মুখোমুখি হলেন। তিন দিন তিন রাত তারা যুদ্ধ করার পর হোরাস সেথকে ধরাশায়ী করলেন। শৃঙ্খলিত সেথকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রেখে তিনি সেথের সমর্থকদের প্রতিবিধান করতে বের হলেন।
এদিকে নানা অনুনয়-বিনয় করে সেথ আইসিসের মন গলিয়ে ফেললেন। তিনি তাকে মুক্ত করে দিলেন। হোরাস ফিরে এসে এ ঘটনা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। রাগের মাথায় এক কোপে মায়ের মাথা নামিয়ে দিলেন তিনি। থত তখন হাথোরের মাথা আইসিসের দেহের সাথে জুড়ে দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তুললেন।
হোরাস ওদিকে আবার সেথের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। প্রথমবার থেকেও এবার আরো প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সেথ হোরাসের এক চোখ হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলে নেন। বিন্দুমাত্র না দমে হোরাস তার কাছ থেকে সেই চোখ ছিনিয়ে নিয়ে তাকে তাড়া করে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে দিলেন। এরপর মাকে নিয়ে ওসাইরিসের জোড়া লাগানো দেহের কাছে গিয়ে নিজের বিচ্ছিন্ন চোখ দিয়ে এতে প্রাণের জাগরন করলেন। ওসাইরিস উঠে বসলেন। মা, বাবা আর ছেলে বহুদিন পর একসাথে হলেন। কিন্তু ওসাইরিসের পুনর্জীবন হয়েছে দেবতার আকারে, কাজেই তিনি আর মর্ত্যে থাকতে পারবেন না।
হোরাস বাবার জন্য একটি সিঁড়ি তৈরি করলে ওসাইরিস একপাশে আইসিস আর অন্যপাশে নেপথিসকে নিয়ে স্বর্গে আরোহণ করেন। দেবতারা রায় দিলেন, তিনি পৃথিবীতে অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ জীবন অতিবাহিত করেছেন। তাকে তাই দেয়া হলো মৃত্যুর পর সমস্ত মানবাত্মার বিচারের দায়িত্ব, তিনি চলে গেলেন পাতাললোকে। জীবন, মৃত্যু আর পরকালের চক্র সম্পূর্ণ হলো। উত্তরাধিকারসূত্রে মিশরের শাসক হলেন হোরাস। তিনি ও পরবর্তীকালে তার চার পুত্রের থেকে উত্থান হয় ভাবী ফারাওদের।
এই সিরিজের পূর্বের লেখাগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
১) প্রাচীন সভ্যতার সৃষ্টিগাথা (পর্ব-১) : পার্সিয়ার উপাখ্যান
২) প্রাচীন সভ্যতার সৃষ্টিগাথা (পর্ব-২) : সুপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার গল্প