অশ্বত্থামার নারায়ণাস্ত্র: কৃষ্ণের সমাধান এবং ভীমের ঔদ্ধত্য
অশ্বত্থামা কর্তৃক প্রয়োগকৃত নারায়ণাস্ত্রের প্রভাবে পাণ্ডব বাহিনীতে সংঘটিত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে পাণ্ডব সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে কৃষ্ণ পাণ্ডব সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণ বন্ধ করতে নির্দেশ দেন এবং প্রতিটি পাণ্ডব সৈন্যকে নিজ নিজ বাহন থেকে নিচে নেমে এসে মাটিতে দাঁড়িয়ে অস্ত্রত্যাগ করার পরামর্শ দেন। কৃষ্ণ জানান যে, নারায়ণাস্ত্রের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার কেবল একটি উপায় রয়েছে। সেটি হচ্ছে: যারা নারায়ণাস্ত্রের সামনে অস্ত্রত্যাগ করে, দিব্যাস্ত্রটি তাদের কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু যারা নারায়ণাস্ত্রের সামনে অস্ত্রত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানাবে, নারায়ণাস্ত্র তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে। কৃষ্ণের পরামর্শ মোতাবেক পাণ্ডব বাহিনীর সকল যোদ্ধা নিজ নিজ বাহন থেকে মাটিতে নেমে আসে এবং অস্ত্রত্যাগ করে।
পাণ্ডব বাহিনীর যোদ্ধাদের মধ্যে কেবল ভীম নারায়ণাস্ত্রের সামনে অস্ত্রত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। কৃষ্ণ ও অর্জুন ভীমকে বারবার অস্ত্রত্যাগ করার জন্য আহ্বান করেন, কিন্তু ভীম বলেন যে, তিনি তার গদার সাহায্যে নারায়ণাস্ত্রকে বিনষ্ট করবেন। এই বলে তিনি অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এদিকে পাণ্ডব বাহিনীর সকল যোদ্ধা অস্ত্রত্যাগ করায় নারায়ণাস্ত্রের পুরো শক্তি ভীমের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীভূত হয় এবং অস্ত্রটি থেকে উদ্ভূত একটি ভয়ঙ্কর আগুনের গোলা ভীমকে গ্রাস করে ফেলার উপক্রম করে। অর্জুন দ্রুত মন্ত্র উচ্চারণ করে ভীমকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বরুণাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং বরুণাস্ত্রের প্রভাবে নারায়ণাস্ত্র থেকে উদ্ভূত ও ভীমকে পুড়িয়ে ফেলতে উদ্যত আগুনের গোলাটির গতি সাময়িক সময়ের জন্য রুদ্ধ হয়।
এই সুযোগে কৃষ্ণ ও অর্জুন ক্ষিপ্রগতিতে দৌড়ে ভীমের রথের নিকটে যান এবং কৃষ্ণ তার নির্দেশনা অমান্য করার জন্য ভীমকে তিরস্কার করেন। তিনি ও অর্জুন মিলে ভীমকে জোরপূর্বক তার রথ থেকে টেনে নামান এবং তাকে অস্ত্রত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ভীমের অস্ত্রত্যাগের পর পাণ্ডব বাহিনীর আর কোনো যোদ্ধার হাতেই অস্ত্র ছিল না, সুতরাং নারায়ণাস্ত্রের প্রকোপ বিলীন হয়ে যায়। নারায়ণাস্ত্রের প্রভাব দূরীভূত হওয়ার পর পাণ্ডব যোদ্ধারা আবার অস্ত্রধারণ করেন এবং নিজ নিজ বাহনে আরোহণ করেন। এরপর কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে আবার যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়।
নারায়ণাস্ত্রের প্রভাব অকার্যকর হয়ে যেতে দেখে দুর্যোধন পুনরায় উক্ত দিব্যাস্ত্রটি প্রয়োগ করার জন্য অশ্বত্থামার প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে জানান যে, এই অস্ত্রটি এক সময়ে কেবল একবার প্রয়োগ করা যায়। একবার প্রয়োগ করার পর অস্ত্রটিকে আবার প্রয়োগ করা হলে যে উক্ত অস্ত্রটি প্রয়োগ করবে অস্ত্রটি তাকেই ধ্বংস করে দেবে। এটি শুনে দুর্যোধন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অন্যান্য দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করার জন্য অশ্বত্থামাকে পরামর্শ দেন এবং অশ্বত্থামা সেই মোতাবেক চিন্তাভাবনা করতে থাকেন।
অশ্বত্থামা–ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ: অশ্বত্থামার নিকট ধৃষ্টদ্যুম্ন পর্যুদস্ত
দুর্যোধনের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখতে পান এবং ক্রুদ্ধ অবস্থায় দ্রোণাচার্যের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তার দিকে অগ্রসর হন। অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তাকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে ধৃষ্টদ্যুম্ন অশ্বত্থামাকে, অশ্বত্থামার রথের সারথিকে ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে তীরবিদ্ধ করেন, এবং এরপর আবার অশ্বত্থামার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অনুরূপভাবে, অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নকে বারবার তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের ঝাণ্ডা ও ধনুক কাটা পড়ে এবং রথটির সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। পাঞ্চালের যে সৈন্যদলটি ধৃষ্টদ্যুম্নকে অনুসরণ করছিল, অশ্বত্থামা তাদের দিকেও তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং এর ফলে বহু সংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়। এমতাবস্থায় পাঞ্চালের সৈন্যরা সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করে এবং অশ্বত্থামা তীরের সাহায্যে ধৃষ্টদ্যুম্নকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন।
সাত্যকি–অশ্বত্থামা যুদ্ধ: অশ্বত্থামার নিকট সাত্যকির পরাজয়
অশ্বত্থামার নিকট ধৃষ্টদ্যুম্নকে পর্যুদস্ত হতে দেখে সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সেদিকে অগ্রসর হন এবং অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি অশ্বত্থামাকে বারবার তীরবিদ্ধ করেন এবং অশ্বত্থামার রথের সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকেও তীরবিদ্ধ করেন। ক্ষিপ্ত অশ্বত্থামা সাত্যকির উদ্দেশ্যে বলেন যে, তিনি গুরুহন্তা ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি সাত্যকির পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু সাত্যকি অশ্বত্থামার হাত থেকে নিজেকে বা ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করতে পারবেন না। এই বলে অশ্বত্থামা সাত্যকির দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর সজোরে নিক্ষেপ করেন এবং সেটি সাত্যকির বর্ম ও শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সেটির আঘাতে সাত্যকির পুরো শরীর রক্তরঞ্জিত হয়ে পড়ে এবং সাত্যকি সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর বসে পড়েন। পরিস্থিতি দেখে সাত্যকির রথের সারথি দ্রুতগতিতে সংজ্ঞাহীন সাত্যকিকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে অশ্বত্থামার নিকট সাত্যকি পরাজিত হন।
অশ্বত্থামার ওপর শীর্ষ পাণ্ডব রথীদের আক্রমণ: তিন শীর্ষ পাণ্ডব রথীর পতন
সাত্যকিকে পরাজিত করার পর অশ্বত্থামা আবার ধৃষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করেন। অশ্বত্থামা কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীর ধৃষ্টদ্যুম্নের দুই ভুরুর মাঝখানে আঘাত করে এবং প্রচণ্ড ব্যথায় ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় ধৃষ্টদুম্নকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে অর্জুন, ভীম, বৃহৎক্ষত্র (পুরু বংশের রাজপুত্র), সুদর্শন (মালবের রাজা) এবং চেদির এক রাজপুত্র একযোগে অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তারা অশ্বত্থামার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অশ্বত্থামা তীরের সাহায্যে পাণ্ডব রথীদের দ্বারা নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর অশ্বত্থামা ও উক্ত পাণ্ডব যোদ্ধারা একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে ভীমের রথের সারথি আহত হয় এবং ভীমের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। এরপর অশ্বত্থামা অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে সুদর্শন নিহত হন। সুদর্শনকে হত্যা করার পর অশ্বত্থামা বৃহৎক্ষত্রকে বর্শাবিদ্ধ করেন এবং বৃহৎক্ষত্রের রথটিকে তীরের সাহায্যে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। এরপর অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে প্রথমে বৃহৎক্ষত্র এবং পরবর্তীতে চেদির রাজপুত্র নিহত হন।
ভীম–অশ্বত্থামা যুদ্ধ: অশ্বত্থামার নিকট ভীমের পরাজয়
অশ্বত্থামার হাতে বৃহৎক্ষত্র, সুদর্শন ও চেদির রাজপুত্রের মৃত্যুর ফলে ভীম অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন এবং অশ্বত্থামার দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অশ্বত্থামা তীরের সাহায্যে ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর অশ্বত্থামা ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন। ভীমের তীরের আঘাতে অশ্বত্থামার ধনুক কাটা পড়ে এবং ভীম অশ্বত্থামাকে তীরবিদ্ধ করেন। অশ্বত্থামা আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন এবং এরপর অশ্বত্থামা ও ভীম একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। ভীম অশ্বত্থামার দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন এবং সেটির আঘাতে অশ্বত্থামা মুহূর্তের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি মুহূর্তের মধ্যেই সংজ্ঞা ফিরে পান এবং এরপর অশ্বত্থামা ও ভীম আবার পরস্পরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন। অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে ভীমের ধনুক কাটা পড়ে এবং অশ্বত্থামা ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন। ভীম আরেকটি ধনুক উঠিয়ে নেন এবং অশ্বত্থামাকে তীরবিদ্ধ করেন।
অশ্বত্থামা ও ভীম পরস্পরের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ অব্যাহত রাখেন। অশ্বত্থামা ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীম তীরের সাহায্যে অশ্বত্থামা কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর ভীম অশ্বত্থামার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অশ্বত্থামা তীরের সাহায্যে ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে ভীমের ধনুক কাটা পড়ে। এরপর অশ্বত্থামা ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন। ভীম একটি বর্শা উঠিয়ে সেটিকে ঘুরিয়ে সজোরে অশ্বত্থামার দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে। এরপর ভীম আরেকটি ধনুক উঠিয়ে নেন এবং অশ্বত্থামাকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে অশ্বত্থামা কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীর ভীমের রথের সারথির কপালে আঘাত করে এবং প্রচণ্ড ব্যথায় সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ভীমের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে এবং রথটিকে টেনে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
ভীম আর এই দ্বৈরথ সম্পূর্ণ করার জন্য ফিরে আসেননি, সুতরাং অশ্বত্থামা এই দ্বৈরথে বিজয়ী হন এবং শঙ্খধ্বনি করেন। অশ্বত্থামার নিকট ভীমের পরাজয়ের পর পাঞ্চালের সৈন্যরা ধৃষ্টদ্যুম্নের রথ পরিত্যাগ করে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। অশ্বত্থামা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং তার তীরের আঘাতে পাঞ্চালের বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। কৃষ্ণ ও অর্জুন পাঞ্চালের আতঙ্কিত সৈন্যদেরকে থামান এবং পুনরায় সংগঠিত করেন।
অর্জুন–অশ্বত্থামা যুদ্ধ: অশ্বত্থামার আগ্নেয়াস্ত্রের বিপরীতে অর্জুনের ব্রহ্মাস্ত্র
পশ্চাৎপসরণরত পাঞ্চালের সৈন্যদেরকে পুনরায় সংগঠিত করার পর অর্জুন অশ্বত্থামার দিকে অগ্রসর হন এবং তাকে তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আহ্বান জানান। অশ্বত্থামা অর্জুনের আহ্বান গ্রহণ করেন এবং উভয়ের মধ্যে দ্বৈরথ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অশ্বত্থামা মন্ত্র উচ্চারণ করে অর্জুন ও পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করেন। আগ্নেয়াস্ত্রের প্রভাবে আকাশ থেকে অজস্র আগুনে তীর পাণ্ডব বাহিনীর ওপর পতিত হতে থাকে, চতুর্দিক ঘন কালো অন্ধকারে ছেয়ে যায় এবং প্রচণ্ড তীব্র বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে। অশ্বত্থামা কর্তৃক প্রয়োগকৃত আগ্নেয়াস্ত্র পাণ্ডব বাহিনীকে আক্ষরিক অর্থেই ভস্ম করে দিতে শুরু করে। এসময় কৃষ্ণ ও অর্জুনকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না এবং সকলে মনে করছিল, তারা দুজনেই অশ্বত্থামা কর্তৃক প্রয়োগকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের প্রভাবে নিহত হয়েছেন।
এমতাবস্থায় অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে অশ্বত্থামা কর্তৃক প্রয়োগকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন। অর্জুন কর্তৃক প্রয়োগকৃত ব্রহ্মাস্ত্রের প্রভাবে অশ্বত্থামা কর্তৃক প্রয়োগকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের প্রভাব বিনষ্ট হয়ে যায়, চতুর্দিকে সৃষ্ট অন্ধকার কেটে যায় এবং বাতাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। অশ্বত্থামা কর্তৃক ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের প্রভাব কেটে যাওয়ার পর দেখা যায় যে, হাজার হাজার পাণ্ডব সৈন্যের জ্বলন্ত মৃতদেহ কুরুক্ষেত্র জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাণ্ডব সৈন্যরা কৃষ্ণ ও অর্জুনকে জীবিত অবস্থায় দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে এবং শঙ্খধ্বনি করতে শুরু করে।
এদিকে অশ্বত্থামা কর্তৃক প্রয়োগকৃত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন এবং মনোবলহীন হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। পথিমধ্যে তিনি মহর্ষি বেদব্যাসের সাক্ষাৎ লাভ করেন। তিনি বেদব্যাসের কাছে তার প্রয়োগকৃত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যর্থ হওয়ার কারণ জানতে চান। বেদব্যাস অশ্বত্থামাকে এর একটি ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন এবং অশ্বত্থামার মনকে শান্ত করেন।
অশ্বত্থামার পশ্চাৎপসরণের পর কৌরব ও পাণ্ডব উভয় পক্ষ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাদের নিজ নিজ সৈন্যদলকে প্রত্যাহার করে নেয়। এদিনের যুদ্ধে কৌরব বাহিনীর সর্বাধিনায়ক দ্রোণাচার্য নিহত হন এবং এটি ছিল কৌরব বাহিনীর জন্য একটি বিরাট মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি। তদুপরি, এদিনের যুদ্ধের শেষভাগে অশ্বত্থামা কর্তৃক প্রয়োগকৃত দিব্যাস্ত্র ব্যর্থ হয় এবং অর্জুনের নিকট অশ্বত্থামা পরাজিত হন। অন্যদিকে, এদিনের যুদ্ধে প্রথমে দ্রোণাচার্য ও পরে অশ্বত্থামা দিব্যাস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে পাণ্ডব বাহিনীর মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন এবং এদিনের যুদ্ধে কৌরবদের তুলনায় পাণ্ডবদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ছিল বহুগুণ বেশি। এজন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পঞ্চদশ দিনের লড়াই কার্যত প্রকৃত অর্থে জয়–পরাজয় ছাড়াই সমাপ্ত হয়।
দ্রোণ পর্বের সামগ্রিক ফলাফল
দ্রোণাচার্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একাদশ থেকে পঞ্চদশ দিন পর্যন্ত কৌরব বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দ্রোণাচার্যের সেনাপতিত্বে কৌরব বাহিনী পাণ্ডবদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে এবং সত্যজিৎ, অভিমন্যু, বৃহৎক্ষত্র, দৃষ্টকেতু, ঘটোৎকচ, দ্রুপদ, বিরাটসহ পাণ্ডব বাহিনীর বহুসংখ্যক শীর্ষ যোদ্ধা যুদ্ধের এই পর্যায়ে নিহত হন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দ্রোণাচার্য কৌরবদেরকে যুদ্ধে বিজয় এনে দিতে ব্যর্থ হন।
দ্রোণাচার্য কৌরব বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করাকে কৌরব বাহিনীর মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন। যুদ্ধের একাদশ ও দ্বাদশ দিনে দ্রোণাচার্য প্রাণপণ চেষ্টা করেও যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু এসময় অন্তত যুদ্ধের চাকা তুলনামূলকভাবে কৌরবদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে দ্রোণাচার্য চক্রব্যূহ গঠন করে যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার চেষ্টা করেন, কিন্তু অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশ করে পুরো দিন কৌরবদেরকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন এবং কৌরবদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন। চক্রব্যূহের অভ্যন্তরে অভিমন্যু নিহত হন, কিন্তু তার মৃত্যু কার্যত যুদ্ধের চাকাকে পাণ্ডবদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে তোলে।
যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে কৌরবরা তাদের সমস্ত শক্তি যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার পরিবর্তে জয়দ্রথকে রক্ষা করার কাজে ব্যয় করতে বাধ্য হয়। অবশ্য সেক্ষেত্রেও তারা ব্যর্থ হয় এবং অর্জুন কৌরব বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে জয়দ্রথকে হত্যা করতে সক্ষম হন। যুদ্ধের চতুর্দশ রাতের লড়াই ছিল বহুলাংশে উদ্দেশ্যহীন প্রতিশোধমূলক লড়াই। এই রাতে কর্ণ ঘটোৎকচকে হত্যা করে কৌরব বাহিনীকে রক্ষা করেন, কিন্তু এর ফলে অর্জুনের বিরুদ্ধে তার অব্যর্থ অস্ত্রটি হাতছাড়া হয়ে যায়। যুদ্ধের পঞ্চদশ দিনে দ্রোণাচার্য যুদ্ধের চাকাকে কৌরবদের পক্ষে ফিরিয়ে আনার সর্বশেষ চেষ্টা করেন এবং পাণ্ডবদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হন এবং পাণ্ডবদের হাতে নিহত হন। এর মধ্য দিয়ে দ্রোণ পর্বের সমাপ্তি ঘটে।
দ্রোণ পর্বে, অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একাদশ দিন থেকে পঞ্চদশ দিনে, কৌরবদের মোট ৪ অক্ষৌহিণী সৈন্য নিহত হয় এবং পাণ্ডবদের মোট ২ অক্ষৌহিণী সৈন্য নিহত হয়। অর্থাৎ, সামগ্রিকভাবে যুদ্ধের এই পর্বে কৌরবদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল পাণ্ডবদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের তুলনায় দ্বিগুণ। তদুপরি, দ্রোণাচার্য, ভগদত্ত, ভুরিশ্রবা, জয়দ্রথ, অলম্বুশ, অলায়ুধ, লক্ষ্মণ এবং দুর্যোধনের অন্তত ৪০ জন ভাই প্রমুখ বড় বড় কৌরব যোদ্ধা যুদ্ধের এই পর্বে নিহত হন। সব মিলিয়ে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পঞ্চদশ দিন নাগাদ এই যুদ্ধে পাণ্ডবদের বিজয় লাভের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং কৌরবদের বিজয় লাভের সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পায়।