কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ: ঘটোৎকচ–বধ পর্বের সারসংক্ষেপ || পর্ব–২

[১ম পর্বের পর]

কর্ণের সঙ্গে কৃপাচার্য ও অশ্বত্থামার দ্বন্দ্ব

দ্রোণাচার্যের তীব্র আক্রমণে পাণ্ডব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর অর্জুন ও ভীম পাণ্ডব সৈন্যদেরকে পুনরায় সংগঠিত করেন এবং তারা দুইজন দুইটি বৃহৎ সৈন্যদল সমেত কৌরব বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। অর্জুনের নেতৃত্বাধীন সৈন্যদল কৌরব বাহিনীর ডান ভাগের ওপর এবং ভীমের নেতৃত্বাধীন সৈন্যদল কৌরব বাহিনীর বাম ভাগের ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের তীব্র আক্রমণে কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। দ্রোণাচার্য ও দুর্যোধন তাদেরকে সংগঠিত করার জন্য চেষ্টা করেন, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এমতাবস্থায় দুর্যোধন কর্ণকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, এখন কর্ণের বন্ধুদের তাকে প্রয়োজন। তিনি তার সৈন্যদেরকে রক্ষা করার জন্য কর্ণকে আহ্বান জানান।

প্রত্যুত্তরে কর্ণ দুর্যোধনকে বলেন যে, পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন সবচেয়ে শক্তিশালী এবং তিনি ইন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত ‘বাসব শক্তি’ অস্ত্র প্রয়োগ করে অর্জুনকে হত্যা করবেন। তিনি দুর্যোধনকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি পঞ্চপাণ্ডবকে পরাজিত করে দুর্যোধনকে বিজয় প্রদান করবেন এবং তিনি যতক্ষণ জীবিত আছেন, ততক্ষণ দুর্যোধনের শোকগ্রস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। কর্ণের বক্তব্য শুনে কৃপাচার্য কর্ণকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করেন। কর্ণকে ‘সুতপুত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি মন্তব্য করেন যে, কর্ণ দুর্যোধনের সামনে বড়াই করেন, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তার পরাক্রম দেখা যায় না। কৃপাচার্য কর্ণকে স্মরণ করিয়ে দেন, গন্ধর্বরা যখন দুর্যোধনকে বন্দি করেছিল, তখন কর্ণ পশ্চাৎপসরণ করেছিলেন এবং বিরাট নগরের যুদ্ধে কর্ণ অর্জুনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি কর্ণকে বলেন যে, কর্ণ কেবল ততক্ষণই বড়াই করেন, যতক্ষণ তিনি অর্জুনের তীরের আওতার বাইরে থাকেন।

কৃপাচার্যের ভর্ৎসনার উত্তরে কর্ণ বলেন যে, তিনি তার নিজের শক্তিবলেই বড়াই করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে পাণ্ডবদেরকে ও তাদের অনুসারীদেরকে পরাজিত করে দুর্যোধনকে বিজয়ী করার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রত্যুত্তরে কৃপাচার্য পাণ্ডবদের প্রশংসা করেন এবং মন্তব্য করেন যে, তাদেরকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তিনি কর্ণকে বলেন যে, কর্ণ নির্বোধ এবং এজন্যই তিনি পাণ্ডবদেরকে পরাজিত করতে পারবেন বলে মনে করেন। প্রত্যুত্তরে কর্ণ কৃপাচার্যকে বলেন যে, কৃপাচার্য পাণ্ডবদের প্রসঙ্গে যেসব প্রশংসা করেছেন, সবই সত্য, কিন্তু তিনি ইন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত ‘বাসব শক্তি’ অস্ত্র প্রয়োগ করে অর্জুনকে হত্যা করবেন এবং অন্য পাণ্ডবদেরকে পরাজিত করবেন। তিনি কৃপাচার্যকে হুমকি দেন যে, কৃপাচার্য যদি আবার তাকে এভাবে অপমান করেন, সেক্ষেত্রে তিনি তার তলোয়ারের আঘাতে কৃপাচার্যের জিহ্বা কেটে ফেলবেন।

চিত্রকর্মে অঙ্গের রাজা ও দুর্যোধনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্ণ; Source: Svk Arts/YouTube

কর্ণের হাতে কৃপাচার্যকে অপদস্থ হতে দেখে অশ্বত্থামা ক্ষিপ্ত হয়ে একটি তলোয়ার উঠিয়ে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং কর্ণকে হত্যা করার হুমকি দিয়ে তার দিকে ছুটে যান। উল্লেখ্য, কৃপাচার্য ছিলেন অশ্বত্থামার মামা এবং এজন্য কৃপাচার্যকে অপমানিত হতে দেখে অশ্বত্থামা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্যোধন ও কৃপাচার্য তাদের রথ থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটে গিয়ে অশ্বত্থামার গতিরোধ করেন। কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে দুর্যোধনকে বলেন যে, “দুর্যোধন! তাকে ছেড়ে দাও এবং আমার শক্তির সংস্পর্শে আসতে দাও!” অশ্বত্থামা শান্ত হয়ে কর্ণকে বলেন যে, তিনি কর্ণের অপরাধ ক্ষমা করছেন, কিন্তু অর্জুন যুদ্ধে কর্ণের দর্প চূর্ণ করবেন। এসময় পাণ্ডব সৈন্যরা কর্ণকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে তার দিকে ছুটে আসছিল। এটি দেখে দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে বুঝিয়ে শান্ত করেন এবং এরপর অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও দুর্যোধন তাদের নিজ নিজ রথে আরোহণ করেন। কৃপাচার্য কর্ণকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, তিনিও কর্ণের অপরাধ ক্ষমা করছেন, কিন্তু অর্জুন যুদ্ধে কর্ণের দর্প চূর্ণ করবেন।

কর্ণের ওপর পাণ্ডব সৈন্যদের প্রচণ্ড আক্রমণ

কর্ণের সঙ্গে কৃপাচার্য ও অশ্বত্থামার বাকবিতণ্ডার সময় অজস্র পাণ্ডব সৈন্য কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হয় এবং কর্ণ ধনুক উঠিয়ে তাদের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কর্ণের মুখোমুখি হয়ে পাণ্ডব সৈন্যদের একাংশ চিৎকার করে বলছিল, “শয়তান কর্ণ! নিকৃষ্ট মানব! আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো!” পাণ্ডব সৈন্যদের আরেক অংশ বলছিল, “এই উদ্ধত সুতপুত্রকে হত্যা করা হোক। তার বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। এই পাপিষ্ঠ সর্বদাই পাণ্ডবদের প্রতি অত্যন্ত শত্রুভাবাপন্ন। দুর্যোধনের অনুগত এই ব্যক্তি সকল পাপকার্যের মূল। তাকে হত্যা করো!” কর্ণের ব্যাপারে এসব বলতে বলতে পাণ্ডব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে কর্ণকে আক্রমণ করে এবং পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ রথীরা কর্ণের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কর্ণ তীরের সাহায্যে একাকী উক্ত বৃহৎ পাণ্ডব সৈন্যদলকে প্রতিহত করেন। পাণ্ডব যোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে কর্ণের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করে, কিন্তু কর্ণ তীরের সাহায্যে উক্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন।

কর্ণ পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ রথীদেরকে ব্যাপকভাবে তীরবিদ্ধ করেন এবং কর্ণের তীরবৃষ্টির ফলে গুরুতরভাবে আহত ও বিভ্রান্ত হয়ে তারা পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। কর্ণের তীরে পাণ্ডব বাহিনীর বিপুল সংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্য, হাতি ও রথী নিহত হয়। বস্তুত কর্ণের তীরে এত বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য হতাহত হয় যে, চতুর্দিকে পাণ্ডব সৈন্যরা নিহত, মরণাপন্ন বা আর্তনাদরত অবস্থায় ছিল এবং রাতের অন্ধকারে যুদ্ধক্ষেত্রটিকে নরকের মতো মনে হচ্ছিল। পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কর্ণের বীরত্ব দেখে দুর্যোধন তাকে সহায়তা করার জন্য অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা, শল্য ও কৃপাচার্যকে প্রেরণ করেন।

কর্ণ–অর্জুন যুদ্ধ: ফলাফলবিহীন পরিসমাপ্তি

কর্ণের নিকট সুবৃহৎ পাণ্ডব সৈন্যদলটির শোচনীয় পরাজয়ের পর অর্জুন ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণের দিকে অগ্রসর হন এবং তাকে দেখতে পেয়ে কর্ণও তার দিকে অগ্রসর হন। কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যে তীব্র দ্বৈরথ যুদ্ধ শুরু হয়। অর্জুন কর্ণের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণ তীরের সাহায্যে অর্জুন কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে  প্রতিহত করেন এবং অর্জুনের দিকে পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অর্জুন তীরের সাহায্যে কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং কর্ণের দিকে পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণ তীরের সাহায্যে অর্জুন কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর কর্ণ অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে অর্জুন কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। অর্জুনের তীর কর্ণের বাম বাহু ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায় এবং এর ফলে কর্ণের হাত থেকে তার ধনুক পড়ে যায়, কিন্তু কর্ণ মুহূর্তের মধ্যে ধনুকটি উঠিয়ে অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অর্জুন তীরের সাহায্যে কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন।

চিত্রকর্মে কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যে দ্বৈরথ যুদ্ধ; Source: Museum of Fine Arts Boston/Wikimedia Commons

এভাবে কর্ণ ও অর্জুন একে অপরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং তীরের সাহায্যে একে অপরের তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করতে থাকেন। বেশ কিছুক্ষণ সমানে সমানে যুদ্ধ চলার পর অর্জুনের তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে এবং কর্ণের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। এরপর অর্জুন কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন এবং কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে তার বিকল রথ থেকে ক্ষিপ্রগতিতে লাফিয়ে নেমে কৃপাচার্যের রথে আরোহণ করেন। সেখান থেকে তিনি অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে রাখেন। এরপর তার জন্য নতুন একটি রথ আনা হলে তিনি কৃপাচার্যের রথ থেকে নেমে সেটিতে আরোহণ করেন এবং অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ অব্যাহত থাকেন।

এদিকে অর্জুন কর্ণের রথ বিকল করে দেয়ার পরে কৌরব সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে এবং এমতাবস্থায় দুর্যোধন তাদেরকে থামিয়ে কর্ণকে সহায়তা করার জন্য অর্জুনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু কৃপাচার্য দুর্যোধনের নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অশ্বত্থামার কাছে যান এবং তাকে বলেন যে, তারা জীবিত থাকতে দুর্যোধনকে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, এটি মোটেই শোভনীয় নয়। অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে থামিয়ে বলেন যে, তিনি জীবিত থাকতে দুর্যোধনকে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে না এবং তিনি নিজেই অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। ইতোমধ্যে কৃষ্ণ অর্জুনকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান এবং কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যেকার দ্বৈরথ যুদ্ধ অসমাপ্ত থেকে যায়।

ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, অর্জুন একটি দৈব রথে চড়ে ও দৈব ধনুক গাণ্ডীব ব্যবহার করে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন এবং কৃষ্ণ অর্জুনের সারথি হিসেবে ও হনুমান অর্জুনের রথের ওপরে অবস্থান নিয়ে অর্জুনকে সুরক্ষা প্রদান করতেন। বিপরীতক্রমে কর্ণ সাধারণ রথে চড়ে ও সাধারণ ধনুক ব্যবহার করে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন এবং কৃষ্ণ ও হনুমানের মতো কোনো সহায়তাকারী তার ছিল না। সুতরাং অর্জুনের বিরুদ্ধে কর্ণ বরাবরই অসুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। কেবল যুদ্ধের সপ্তদশ দিনে কর্ণ মহর্ষি পরশুরাম কর্তৃক প্রদত্ত দৈব রথ ও দৈব ধনুক বিজয়া ব্যবহার করেন এবং অর্জুনের বিরুদ্ধে তার অসুবিধাজনক অবস্থানে বহুলাংশে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের প্রবেশের পর থেকে চতুর্দশ রাত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কর্ণ ও অর্জুন তিনবার পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন — দ্বাদশ দিনের বিকেলে, চতুর্দশ দিনের বিকেলে এবং চতুর্দশ দিনের সন্ধ্যায়। দ্বাদশ দিনের বিকেলের দ্বৈরথ যুদ্ধের সময় ভীম, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যেকার লড়াইয়ে হস্তক্ষেপ করেন এবং সেটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। চতুর্দশ দিনের বিকেলের দ্বৈরথ যুদ্ধের সময় অর্জুন কর্ণের রথ বিকল করে দেন, কিন্তু অর্জুনের হাতে জয়দ্রথের মৃত্যু হওয়ার আগ পর্যন্ত কর্ণ অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। চতুর্দশ দিনের সন্ধ্যার দ্বৈরথ যুদ্ধের সময় অর্জুন কর্ণের রথ বিকল করে দেন, কিন্তু কর্ণ অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং কৃষ্ণ অর্জুনকে সরিয়ে নিয়ে যান।

চিত্রকর্মে কৌরব বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ যোদ্ধা অশ্বত্থামা; Source: Mythgyaan

এক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সেসময় পর্যন্ত কর্ণ তিনবার যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু কোনোবারই তিনি অর্জুনের বিরুদ্ধে ইন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত ‘বাসব শক্তি’ অস্ত্র ব্যবহার করেননি। চতুর্দশ রাতে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ঠিক আগেই দুর্যোধন ও কৃপাচার্যকে বলেছিলেন যে, তিনি ইন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত ‘বাসব শক্তি’ অস্ত্র ব্যবহার করে অর্জুনকে হত্যা করবেন। অথচ অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তিনি সেই অস্ত্র ব্যবহার করেননি। পরবর্তীতে কৃষ্ণ কর্ণের এই আচরণের ব্যাখ্যা প্রদান করেন এবং কর্ণ কেন বারবার অর্জুনের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও উক্ত অস্ত্র ব্যবহার করেননি, সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ব্যাখ্যা যথাসময়ে উল্লেখ করা হবে।

পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অশ্বত্থামার পরাক্রম এবং অশ্বত্থামা–ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ

কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যেকার অসমাপ্ত দ্বৈরথ যুদ্ধের পর অশ্বত্থামা পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে তাদের ওপর তীরবর্ষণ করেন এবং তাদেরকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানান। পাণ্ডব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে অশ্বত্থামার দিকে অজস্র অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করে, কিন্তু অশ্বত্থামা তীরের সাহায্যে সেগুলোকে প্রতিহত করেন এবং তার তীরে ১০ জন শীর্ষ পাণ্ডব রথী নিহত হয়। অশ্বত্থামার তীরবৃষ্টির তোড়ে পাণ্ডব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং এটি দেখে ধৃষ্টদ্যুম্নের নেতৃত্বে ১০০ জন পাণ্ডব রথী অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। ধৃষ্টদ্যুম্ন অশ্বত্থামাকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করেন এবং তাকে তীরবিদ্ধ করেন। অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে ধৃষ্টদ্যুম্ন অশ্বত্থামার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এভাবে অশ্বত্থামা ও ধৃষ্টদ্যুম্ন একে অপরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন।

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে যুদ্ধ চলার পর অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং রথটির দুই পার্শ্বনী সারথি, মুখ্য সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। এরপর অশ্বথামার তীরবৃষ্টির তোড়ে পাণ্ডব সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে এবং অশ্বত্থামার তীরে ১০৩ জন শীর্ষ পাণ্ডব রথী ও বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। অশ্বত্থামার নিকট ধৃষ্টদ্যুম্ন ও পাণ্ডব সৈন্যদলের পরাজয়ের পর কৌরব সৈন্যরা অশ্বত্থামার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।

অশ্বত্থামার পরাক্রম দেখে যুধিষ্ঠির ও ভীমের নেতৃত্বে পাণ্ডব সৈন্যরা অশ্বত্থামার দিকে অগ্রসর হয় এবং তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। দ্রোণাচার্য ও দুর্যোধন সসৈন্যে অশ্বত্থামাকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন এবং এর ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। যুধিষ্ঠির ও ভীমের তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। দ্রোণাচার্য মন্ত্র উচ্চারণ করে পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে বায়ব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। পাণ্ডব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে, কিন্তু অর্জুন ও ভীম তাদেরকে পুনরায় সংগঠিত করেন এবং যথাক্রমে ডান ও বাম দিক থেকে কৌরব বাহিনীর ওপর সসৈন্যে তীব্র আক্রমণ চালান। অর্জুন ও ভীম দ্রোণাচার্যের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাদের তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হতে থাকে। এমতাবস্থায় কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। দ্রোণাচার্য ও দুর্যোধন তাদেরকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

সোমদত্তের বিরুদ্ধে সাত্যকি ও ভীমের লড়াই

যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক অংশে সোমদত্ত ও সাত্যকি পরস্পরের দিকে অগ্রসর হন এবং একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তারা একে অপরের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন। সোমদত্ত সাত্যকিকে ও সাত্যকি সোমদত্তকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তাদের উভয়ের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। সোমদত্তের তীরের আঘাতে সাত্যকির ধনুক কাটা পড়ে এবং সোমদত্ত পরপর দুইবার সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন। সাত্যকি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে সোমদত্তকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে সোমদত্তের রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। প্রত্যুত্তরে সোমদত্ত সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু সাত্যকির তীরের আঘাতে সোমদত্তের ধনুক কাটা পড়ে এবং সাত্যকি সোমদত্তকে তীরবিদ্ধ করেন। সোমদত্ত আরেকটি ধনুক উঠিয়ে সাত্যকির দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং এরপর তারা পরস্পরকে তীরবিদ্ধ করেন।

চিত্রকর্মে পাণ্ডব বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ যোদ্ধা সাত্যকি; Source: Ramanarayanadatta Shastri/Wikimedia Commons

এমতাবস্থায় ভীম সাত্যকিকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন এবং সোমদত্তকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু প্রত্যুত্তরে সোমদত্ত ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন। সাত্যকি একটি পরিঘা উঠিয়ে সেটিকে সোমদত্তের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সোমদত্তের তীরের আঘাতে সাত্যকি কর্তৃক নিক্ষিপ্ত পরিঘাটি কাটা পড়ে। এরপর সাত্যকির তীরের আঘাতে সোমদত্তের ধনুক কাটা পড়ে এবং সোমদত্তের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। তারপর সাত্যকির তীরের আঘাতে সোমদত্ত নিজেও নিহত হন। সাত্যকির হাতে সোমদত্ত নিহত হওয়ার পর একটি বৃহৎ কৌরব সৈন্যদল সাত্যকির বিরুদ্ধে অগ্রসর হয় এবং এটি দেখে একটি বৃহৎ পাণ্ডব সৈন্যদল উক্ত কৌরব সৈন্যদলের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়।

দ্রোণাচার্য–যুধিষ্ঠির যুদ্ধ: যুধিষ্ঠিরের রণনৈপুণ্য এবং কৃষ্ণের হস্তক্ষেপ

যুধিষ্ঠির কৌরব সৈন্যদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং তার তীরে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এটি দেখে দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে এবং যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন। দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের রথের ঝাণ্ডা ও ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু যুধিষ্ঠির ক্ষিপ্রগতিতে আরেকটি ধনুক উঠিয়ে দ্রোণাচার্য, তার রথ, রথের ঝাণ্ডা, সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে তীরবিদ্ধ করেন। যুধিষ্ঠিরের তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্য সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর বসে পড়েন, কিন্তু শীঘ্রই তিনি সংজ্ঞা ফিরে পান এবং মন্ত্র উচ্চারণ করে যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে বায়ব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন। যুধিষ্ঠির মন্ত্র উচ্চারণ করে পাল্টা বায়ব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত দিব্যাস্ত্রটিকে নিষ্ক্রিয় করেন এবং এরপর যুধিষ্ঠিরের তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্যের ধনুক কাটা পড়ে। দ্রোণাচার্য আরেকটি ধনুক উঠিয়ে নেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের তীরের আঘাতে সেটিও কাটা পড়ে।

এসময় অর্জুন ও কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন এবং কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার জন্য চেষ্টা করছেন এবং এই অবস্থায় তার দ্রোণাচার্যের কাছাকাছি অবস্থান করা উচিত নয়। তিনি আরো যোগ করেন যে, রাজাদের উচিত রাজা বা রাজপুত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং এজন্য যুধিষ্ঠিরের উচিত দুর্যোধনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। কৃষ্ণের পরামর্শ শুনে যুধিষ্ঠির সেখান থেকে সরে পড়েন এবং যুদ্ধক্ষেত্রের অন্য এক অংশে গিয়ে কৌরব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। দ্রোণাচার্য পাঞ্চালের সৈন্যদের আক্রমণ করেন এবং তার তীরে পাঞ্চালের বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়।

নৈশকালীন যুদ্ধের চমকপ্রদ রূপ

উভয় পক্ষের মধ্যে চলমান যুদ্ধের মাত্রা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছিল। দ্রোণাচার্য, কর্ণ ও কৃপাচার্যের তীরে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয় এবং বিপরীতক্রমে সাত্যকি, ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্নের তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এসময় নাগাদ চতুর্দিক এমন ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল যে, উভয় পক্ষের সৈন্যরা কার্যত আশেপাশের কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় দুর্যোধনের নির্দেশে কৌরব সৈন্যরা অসংখ্য প্রদীপ জ্বালিয়ে চতুর্দিক আলোকিত করে। কৌরব বাহিনীর প্রতিটি রথের ওপর পাঁচটি করে, প্রতিটি হাতির ওপরে তিনটি করে এবং প্রতিটি ঘোড়ার ওপরে একটি করে প্রদীপ স্থাপন করা হয়। এভাবে কৌরবদেরকে তাদের সৈন্যদলকে আলোকিত করতে দেখে পাণ্ডবরাও তাদের সৈন্যবাহিনীকে অনুরূপভাবে আলোকিত করার নির্দেশ দেন। পাণ্ডব বাহিনীর প্রতিটি রথের ওপর দশটি করে, প্রতিটি হাতির ওপর সাতটি করে এবং প্রতিটি ঘোড়ার ওপর দুইটি করে প্রদীপ স্থাপন করা হয়। এভাবে সম্পূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রকে আলোকিত করে কৌরব ও পাণ্ডব বাহিনীদ্বয় পরস্পরের বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

চিত্রকর্মে কৃষ্ণের ‘নারায়ণী সেনা’র অধিনায়ক এবং কৌরব বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ যোদ্ধা কৃতবর্মা; Source: Shri Ram Programming Academy/YouTube

দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৌরব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদেরকে নির্দেশ দেন। তিনি তাদেরকে বলেন যে, একমাত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ছাড়া আর কেউ দ্রোণাচার্যকে হত্যা করতে পারবেন না, সুতরাং তাদের উচিত দ্রোণাচার্যকে সুরক্ষিত রাখা, যাতে তিনি নির্বিঘ্নে পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন। দুর্যোধন যোগ করেন যে, অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নকে, কর্ণ অর্জুনকে এবং তিনি নিজে ভীমকে হত্যা করবেন, এবং এরপর পাণ্ডবদের পরাজয় সুনিশ্চিত হয়ে যাবে। বিপরীতক্রমে যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যের ওপর সকল আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করার জন্য পাণ্ডব সৈন্যদেরকে নির্দেশ যেন এবং যে কোনো মূল্যে দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার জন্য তাদেরকে আহ্বান জানান। পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, কিন্তু কৌরব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাদের মধ্যে বহুসংখ্যক দ্বৈরথ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

কৃতবর্মা–যুধিষ্ঠির যুদ্ধ: কৃতবর্মার নিকট যুধিষ্ঠিরের পরাজয়

যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, কিন্তু কৃতবর্মা যুধিষ্ঠিরের গতিরোধ করেন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুধিষ্ঠির কৃতবর্মাকে পরপর দুইবার তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু কৃতবর্মার তীরের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের ধনুক কাটা পড়ে এবং কৃতবর্মা যুধিষ্ঠিরকে তীরবিদ্ধ করেন। যুধিষ্ঠির আরেকটি ধনুক উঠিয়ে কৃতবর্মাকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে কৃতবর্মা যুধিষ্ঠিরকে তীরবিদ্ধ করেন। যুধিষ্ঠিরের তীরের আঘাতে কৃতবর্মার ধনুক কাটা পড়ে এবং যুধিষ্ঠির কৃতবর্মাকে এমনভাবে তীরবিদ্ধ করেন যে তার নিক্ষিপ্ত তীরগুলো কৃতবর্মার বর্ম ও শরীর ভেদ করে বের হয়ে মাটিতে গেঁথে যায়। কৃতবর্মা আরেকটি ধনুক উঠিয়ে যুধিষ্ঠিরকে পরপর দুইবার তীরবিদ্ধ করেন। যুধিষ্ঠির তার ধনুক নামিয়ে রেখে একটি বিশেষ ধরনের তীর উঠিয়ে কৃতবর্মার দিকে নিক্ষেপ করেন এবং সেটি কৃতবর্মার ডান বাহু ভেদ করে বের হয়ে মাটিতে গেঁথে যায়। এরপর যুধিষ্ঠির তার ধনুক উঠিয়ে কৃতবর্মার দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।

এবার কৃতবর্মার তীরের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের ধনুক কাটা পড়ে এবং তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। যুধিষ্ঠির একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার উঠিয়ে নেন, কিন্তু কৃতবর্মার তীরের আঘাতে সেগুলো কাটা পড়ে। যুধিষ্ঠির একটি বর্শা উঠিয়ে সেটিকে কৃতবর্মার দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কৃতবর্মার তীরের আঘাতে সেটিও কাটা পড়ে। এরপর কৃতবর্মা যুধিষ্ঠিরকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের বর্ম কাটা পড়ে। এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠির তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করার পর কৃতবর্মা দ্রোণাচার্যের রথের চাকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে থাকেন।

উল্লেখ্য, কিছুক্ষণ আগেই যুধিষ্ঠির পরপর দুইবার দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে অংশ নেন এবং দুইবারই দ্রোণাচার্য তাকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হন। দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে অত্যন্ত শক্তিশালী বিভিন্ন দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেও যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হন। রণনৈপুণ্যের বিচারে কৃতবর্মা দ্রোণাচার্যের সমকক্ষ ছিলেন না, বরং তাকে দ্রোণাচার্যের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী যোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তিনি যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। এর থেকে বুঝতে পারা যায় যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় সংঘটিত দ্বৈরথ যুদ্ধগুলোতে জয়–পরাজয় ছিল বহুলাংশেই অনিশ্চিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী যোদ্ধারা অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষ যোদ্ধাদের চেয়েও বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারেন।

ভুরি–সাত্যকি যুদ্ধ: সাত্যকির হাতে ভুরির মৃত্যু

কৌরব রথী ভুরি সাত্যকির গতিরোধ করেন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। সাত্যকি ভুরিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং ভুরির শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। ভুরি সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তারা একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। এভাবে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর সাত্যকির তীরের আঘাতে ভুরির ধনুক কাটা পড়ে এবং সাত্যকি ভুরিকে তীরবিদ্ধ করেন। ভুরি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে সাত্যকির ধনুক কাটা পড়ে। তখন সাত্যকি একটি বিশেষ ধরনের তীর উঠিয়ে সেটিকে ভুরির দিকে নিক্ষেপ করেন এবং সেটির আঘাতে ভুরি নিহত হন।

অশ্বত্থামা–ঘটোৎকচ যুদ্ধ: অশ্বত্থামার নিকট ঘটোৎকচের পরাজয়

সাত্যকির হাতে ভুরি নিহত হওয়ার পর অশ্বত্থামা ক্রুদ্ধ হয়ে সাত্যকিকে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে তার দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু ঘটোৎকচ অশ্বত্থামার গতিরোধ করেন এবং তাকে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। ঘটোৎকচ অশ্বত্থামার দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অশ্বত্থামা তীরের সাহায্যে ঘটোৎকচ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং ঘটোৎকচকে ব্যাপকভাবে তীরবিদ্ধ করেন। ঘটোৎকচের শরীরের প্রায় প্রতিটি অংশ অশ্বত্থামার তীরে বিদ্ধ হয়। প্রত্যুত্তরে ঘটোৎকচ অশ্বত্থামাকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করেন এবং তার দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অশ্বত্থামা মন্ত্র উচ্চারণ করে একটি দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে ঘটোৎকচ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং ঘটোৎকচের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।

চিত্রকর্মে শূণ্যে ভাসমান অবস্থায় পাণ্ডব বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ যোদ্ধা ও ভীমের ছেলে রাক্ষস ঘটোৎকচ; Source: Ramanarayanadatta Shastri/Wikimedia Commons

এরপর ঘটোৎকচের তীরের আঘাতে অশ্বত্থামা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং তার রথের ওপর বসে পড়েন। অশ্বত্থামার এই অবস্থা থেকে কৌরব সৈন্যরা শোক প্রকাশ করে এবং পাণ্ডব সৈন্যরা উল্লাস করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অশ্বত্থামা সংজ্ঞা ফিরে পান এবং ধনুক উঠিয়ে ঘটোৎকচের দিকে সজোরে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন। উক্ত তীরটি ঘটোৎকচকে তীব্র বেগে ঘটোৎকচকে আঘাত করে তার শরীর ভেদ করে বেরিয়ে মাটিতে গেঁথে যায় এবং সেটির আঘাতে ঘটোৎকচ সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর বসে পড়েন। এমতাবস্থায় ঘটোৎকচের রথের সারথি তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। অশ্বত্থামার নিকট ঘটোৎকচের পরাজয়ের পর কৌরব বাহিনীর শীর্ষ রথীরা এবং কৌরব সৈন্যরা অশ্বত্থামার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।

দুর্যোধন–ভীম যুদ্ধ: ভীমের নিকট দুর্যোধনের পরাজয়

দুর্যোধন ও ভীম দ্রোণাচার্যের রথের সম্মুখভাগে পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দুর্যোধন ও ভীম একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। ভীমের তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং এরপর ভীম দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন। দুর্যোধন আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন এবং ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীম তীরের সাহায্যে দুর্যোধন কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং এরপর দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন। দুর্যোধনের তীরের আঘাতে ভীমের ধনুক কাটা পড়ে এবং দুর্যোধন ভীমকে তীরবিদ্ধ করেন। ভীম আরেকটি ধনুক উঠিয়ে দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু দুর্যোধনের তীরের আঘাতে আবার ভীমে ধনুক কাটা পড়ে। এরপর ভীম আবারো ধনুক উঠিয়ে নেন, কিন্তু দুর্যোধনের তীরের আঘাতে বারবার ভীমের ধনুক কাটা পড়তে থাকে। ভীমের অন্তত ৬টি ধনুক দুর্যোধনের তীরের আঘাতে কাটা পড়ে।

এমতাবস্থায় ভীম একটি বিশেষ ধরনের তীর উঠিয়ে সেটিকে দুর্যোধনের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু দুর্যোধনের তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে। এরপর ভীম একটি ভারী গদা উঠিয়ে সেটিকে ঘুরিয়ে সজোরে দুর্যোধনের দিকে নিক্ষেপ করেন। সেটির আঘাতে দুর্যোধনের রথটি ধ্বংস হয় এবং রথটির সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। অবশ্য ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত গদাটি দুর্যোধনের রথকে আঘাত করার আগেই তিনি ক্ষিপ্রগতিতে লাফিয়ে তার রথ থেকে নেমে পড়েন এবং এভাবে কোনোক্রমে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হন। এরপর তিনি ক্ষিপ্রগতিতে তার ভাই নন্দকের রথে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। ভীমের নিকট দুর্যোধনের পরাজয়ের পর ভীম কৌরব সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হন।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, চতুর্দশ দিনের যুদ্ধের সময় কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে কর্ণের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত থাকা অবস্থায় ভীম তীরচালনায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন রাতেই দুর্যোধনের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত থাকা অবস্থায় ভীম তীরচালনায় অনুরূপ দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভীম অত্যন্ত দক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন বটে, কিন্তু কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তীরচালনার ক্ষেত্রে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তার মূল কৃতিত্ব ছিল ভীম কর্তৃক ব্যবহৃত দৈব ধনুক বায়ব্য–এর (এবং ভীমের বিরুদ্ধে কর্ণের হালকাভাবে যুদ্ধ করাটাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল)। কিন্তু কর্ণের তীরে ভীমের বায়ব্য ধনুক কাটা পড়ার পর ভীম আর কখনো কর্ণ বা অন্য কারো বিরুদ্ধে তীরচালনায় চতুর্দশ দিনের অনুরূপ বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ, চতুর্দশ রাতের যুদ্ধের সময় তিনি তীর–ধনুক ব্যবহার করে দুর্যোধনকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হন এবং দুর্যোধনের তীরে তার অন্তত ৬টি ধনুক কাটা পড়ে৷ অবশেষে তিনি গদা নিক্ষেপ করে দুর্যোধনের রথ ধ্বংস করেন এবং তাকে পরাজিত করেন।

Related Articles

Exit mobile version