Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেমন হয় বাংলার ভূত-পেত্নীরা?

সেই যে গ্রামের বুড়ো বটগাছটা, যার ডাল কেউ ভাঙতে পারেনি, বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দাদুকে কে যেন বলেছিল “এঁইঁ কেঁ যাঁয়ঁ রেঁ?”, অথবা বাজার থেকে রাত করে ইলিশ নিয়ে ফেরার সময় মামার পিছু নিয়েছিল এক ভীষণ মাছলোভী ভূত- এমন সব গল্প তো আমরা সবাই শুনেছি। ভূত আছে কি নেই, সে বিষয়ে তর্ক থাকলেও, ভূতের গল্প কিন্তু সবারই প্রিয়। প্রতিটি দেশের সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে থাকে তাদের একান্ত নিজস্ব গল্প, সেখানে নিজেদের মতো রাজকুমার, অলৌকিক প্রাণীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকে নিজস্ব ভূতেরাও। তেমনি আমাদের লোকসাহিত্যেও আছে নানান ভূতের সমাবেশ। তারা আমাদের মতোই ইলিশ মাছ, পিঠা খেতে ভালোবাসে। পশ্চিমে ভূতেদের জন্য হ্যালোউইন হয়, আমাদের দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও পালন করে ভূত চতুর্দশী। তাহলে চিনে নেয়া যাক বাংলা লোকসাহিত্যের ভূতেদের।

ব্রহ্মদৈত্য

ব্রহ্মদৈত্য হচ্ছেন খানিকটা ভূতেদের সর্দার গোছের। ব্রাহ্মণ মরে ব্রহ্মদৈত্য হয়। তারপর পায়ে খড়ম চাপিয়ে, সাদা ধুতি পরে খট খট শব্দে হেঁটে বেড়ায়। তার থাকার প্রিয় স্থান বেলগাছ বা শিমুল গাছ। ব্রহ্মদৈত্য খুশি হয়ে বর দেন মাঝে মাঝে। কেউ তাকে রাগিয়ে দিলে শাস্তি পায়। সাধারণত ব্রহ্মদৈত্য মশাই কারোর অনিষ্ট করেন না। কিন্তু যেহেতু ব্রাহ্মণের ভূত বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে, অপরিচ্ছন্ন কাউকে পেলে ঘাড়টা মটকেও দেন কখনো কখনো।

পেত্নী

পেত্নী হলো ভূতের নারী সংস্করণ। সংস্কৃত ‘প্রেতনী’ থেকে লৌকিক পেত্নীর আবির্ভাব। অল্পবয়সী, অবিবাহিতা কোনো মেয়ে অপঘাতে মারা গেলে পেত্নী হয়। এরা তেঁতুল আর শ্যাওড়া গাছে পা ঝুলিয়ে বসে নাকি সুরে কথা বলে আর মানুষকে বিরক্ত করে। তাদের পায়ের গোড়ালি উল্টোদিকে ঘোরানো থাকে।

শাঁকচুন্নি

শাঁকচুন্নি; চিত্রাংকন: তিয়াসা ইদরাক

নারী ভূতেদের ভেতর পেত্নীর পরেই পরিচিতির তালিকায় আসে শাঁকচুন্নির নাম। শঙ্খ বা শাঁখা চূর্ণী থেকে মানুষের মুখে ঘুরেফিরে অবশেষে শাঁকচুন্নিতে গিয়ে ঠেকেছে। শাঁকচুন্নি হলো অল্পবয়সী বিবাহিত নারীর অতৃপ্ত আত্মা। তার হাতে থাকে শাঁখা। লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরে এরা পুকুর ঘাটে বসে থাকে। যদি কোনো বিবাহিত নারী একা একা চুল খুলে পুকুরে কাজ করতে আসে, তবে তার ভেতর ঢুকে তার মতোই সুখে জীবন কাটাতে চায়। অন্যদিকে কোনো তরুণ যদি পুকুরে মাছ ধরতে আসে, তবে তার কাছে মাছ চায় সে। প্ররোচনায় ভুলে মাছ দিলেই হল, তরুণের আত্মা কব্জা করে নেয় শাঁকচুন্নি। অনেক এলাকাতে এরা শাঁকিনী বলেও পরিচিত।

স্কন্ধকাটা

এদের দেহের উপর মাথা থাকে না। দুর্ঘটনা বা শাস্তি হিসেবে যাদের গলা কেটে দেয়া হয়, তারাই এই ভূতে পরিণত হয়। এরা সন্ধ্যার পর বাড়ির পেছনের জংলামতো জায়গায় দু’হাতে মাথা নিয়ে লোফালুফি করে আর অযথাই কথা বলে মানুষকে বিরক্ত করে। আবার কিছু আছে তাদের মাথা হাতেও থাকে না। তারা নিজেদের মাথা খুঁজে বেড়ায়। আর মানুষ দেখলে তার মাথা ছিঁড়ে নিজের করে নিতে চায়।

মামদো

ব্রাহ্মণের ভূত আছে মুসলমান ভূত থাকবে না তাই কি হয়? মামদো হলো মুসলমান ভূত।

রাক্ষস

হাঁউ মাঁউ খাঁউ; Source: The-Daily-Star

বিশালদেহী, বড় বড় নখ-দাঁতওয়ালা এই ভূত বাংলার রূপকথায় একটি অনিবার্য অংশ। এরা বেশ প্রাচীন। পুরাণেও এদের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মানুষলোভী এই ভূতেদের প্রিয়বাক্য ‘হাউ মাউ খাউ, মানুষের গন্ধ পাউ’।

খোক্কস

খোক্কস হল রাক্ষসের ছোট সংস্করণ। এরা অনেকটা রাক্ষসের কর্মচারীর মতো।

চোরাচুন্নি

চোর বা তার বউ যদি অপঘাতে মরে, তবে তারা চোরাচুন্নি হয়। মৃত্যুর পরও তারা অন্যের বাড়ির জিনিসের লোভ ছাড়তে পারে না। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাই জিনিসপত্র ভাংচুর করে বেড়ায়। ভূতে বিশ্বাসীরা এদের হাত থেকে ঘরকে বাঁচাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা রাখে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঘরে গঙ্গাজল ছিটান আর মুসলমানরা কোরআনের আয়াত রাখেন।

মেছোভূত

মাছলোভী মেছোভূত; Source: Vagabomb.com

বাংলার ভূতেদের ভেতর সবচাইতে লোভী ভূত। তার মাছ এতই পছন্দ যে খালে-বিলে-পুকুরে নদীতে সে শুধু মাছ খেয়ে বেড়ায়। রান্নাঘরে এনে রাখা মাছকেও ছাড় দেয় না। তার সবচেয়ে বেশি পছন্দ ইলিশ মাছ। কেউ যদি রাত করে ইলিশ মাছ হাতে বাড়ি ফেরে, রাস্তাতে অনুনয় করে মাছ চাইতে থাকে মেছোভূত। অনুনয়ে কাজ না হলে ভয় দেখিয়ে মাছ কেড়ে নেয়।

গেছোভূত

ইনি এক বৃক্ষপ্রেমী ভূত। গাছেই থাকেন সারা রাতদিন।

পেঁচাপেঁচি

এটি হল পেঁচা আর তার বউ পেঁচির ভূত। তারা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে। না, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর মতো মিষ্টি মিষ্টি করে তারা কথা বলে না। বরং রাতদুপুরে কেউ জঙ্গলে গেলে তাকে ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলে। এদের প্রধান শিকার হল শিশুরা।

কানাখোলা/কানাভুলো

এরা চরাঞ্চল অথবা রাতের বেলা গ্রামের খালি রাস্তা অথবা বড় মাঠে ঘোরে। পথিককে পথ ভুলিয়ে একই স্থানে বার বার নিয়ে আসে। ভয়ে ক্লান্তিতে একসময় পথিক মারা যায়।

আলেয়া

আলেয়া; Source: Vagabomb.com

রাতের বেলা জলাভূমিতে জ্বলতে থাকা একরকম আলো, অনেকেই একে ভূতের আলো বলে। এরা জাল কেড়ে নিয়ে জেলেকে ডুবিয়ে মারে। আবার অনেক সময় নাকি আলেয়া জেলেদেরকে সমূহ বিপদ সম্পর্কে জানিয়ে দেয়। আলেয়া কিন্তু সত্যই আছে। কিন্তু সেটা কোনো ভূত নয়, বরং জলাশয়ের গাছপালা পচে তৈরি হওয়া মার্শ গ্যাস। এটি দেখে ভূত ভেবে অনেক জেলে অজ্ঞান হয়ে পানিতে পড়ে মারা যায়।

নিশি

রাতের বেলা ডাক দেয়ার কারণে এর নাম নিশি। যারা নিশির ডাকে সাড়া দেয় তারা নাকি আর ফিরে আসে না। বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকে। সিনেমা নাটকের নিশিরা দুই-তিনবার ডাকলেও লোকজ সাহিত্যের আসল নিশি নাকি একবারই ডাকতে পারে। তাই লোকজ বিশ্বাসমতে, রাতের বেলা দুই-তিনবার ডাক না শুনে বের হওয়া উচিত না।

কাঁদরা-মা

এটিও একটি ভীষণ কেঁদো বয়স্ক নারীভূত। তারা সাদা শাড়ি পরে ইনিয়ে বিনিয়ে জঙ্গলের পাশে ঘুরে বেড়ায়।

বেঁশোভূত

এরা বাঁশঝাড়ের ভূত। কবরস্থানের পাশে বাঁশঝাড়ে এদের বাস। লোকগাথায় এসব রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যাবে এরা বাঁশ নামিয়ে অপেক্ষা করছে পথিকের জন্য।

বেঘোভূত

ইনি যে সে ভূত নন! একেবারে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের শিকার ভূত। সুন্দরবনের আশেপাশের গ্রামগুলোতে বেঘোভূতের গল্প শুনতে পাওয়া যায়। মানুষ বাঘের শিকার হয়ে মারা গিয়ে বেঘোভূত হয়। মৌয়াল আর বাওয়ালদের ভয় দেখিয়ে পথ ভুলিয়ে এরা বাঘের সামনে নিয়ে যায়।

ডাইনী

ইনি আবার একটু ব্যতিক্রম। ইনি মৃত নন, জীবিত ও সাধারণত নারী। প্রচলিত গল্পগুলোতে কেউ কেউ জন্ম থেকে ডাইনী বা অশুভলক্ষণা হয়। আবার কেউ হয় তন্ত্র সাধনা আর কালোজাদু করে। অনেক গল্পে আমাদের ডাইনীদেরকেও কিন্তু ঝাঁটার পিঠে উড়তে দেখা যায়।

দেও-দানো

দেও হল পানির ভূত। মানুষকে পানিতে ডুবিয়ে মারা তার অভ্যাস।

বোবা

ইনি অন্য ভূতেদের মতো অত ভয়ঙ্কর নন। ঘুমের ভেতর মানুষকে আক্রমণ করে এই ভূত। তখন মানুষ কথা না বলতে পেরে শব্দ করতে থাকে। একে বলে বোবায় ধরা। আধুনিক বিজ্ঞানে এর ব্যাখ্যা থাকলেও ভূতের গল্প হিসেবে বোবায় ধরা বেশ আকর্ষণীয়।

পিশাচ

রক্তপিপাসু ভ্যাম্পায়ার আর ড্রাকুলার বাঙালি সংস্করণ। তাদের গায়ে থাকে বোঁটকা গন্ধ। সে মানুষের শরীরে ভর করে অন্যদের রক্ত খেতে পারে।

শিকল টানা ভূত/ হাঁড়া ভূত

কমবয়সী বিবাহিত মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যদি অত্যাচার করে পানিতে ডুবিয়ে মারে, তবে তৈরি হয় শিকল ভূত। লম্বা লম্বা চুলকে শিকলের মতো ব্যবহার করে এরা পানিতে থাকা মানুষের পা ধরে টান দেয়। যেসব পুকুরে মানুষ ডুবে মরার হার বেশি সেসব পুকুরের পেছনে মানুষ শিকল টানা ভূতের গল্প খোঁজে।

যক্ষ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ গল্পটির কথা মনে আছে? এমনি করে একসময় বিশ্বাস করা হতো। কৃপণ ব্যক্তিরা তাদের অঢেল ধন-সম্পত্তি মাটির নিচে ঘর করে রাখতেন। সাথে বসিয়ে দিতেন কোনো শিশুকে। শিশুটি সেখানে না খেতে পেয়ে মারা যেত। তারপর সে যক্ষ হয়ে ধন-সম্পত্তি আসল মালিকের কাছে হস্তান্তরের জন্য অপেক্ষা করত।

বাড়ুল ভূত

বাড়ুল ভূত হলো বৈশাখ মাসে ঘূর্ণী বাতাসের ভূত। যারা এই ভূতে বিশ্বাস করেন, তারা ঝড়ের সময় পিঁড়ি পেতে বাড়ুল ভূতকে চলে যেতে বলেন।

ঘোড়াভূত, গোভূত

ঘোড়াভূত; Source: GQ

বাংলা সাহিত্যে ঘোড়া আর গরুরও ভূত হয়। রাতের বেলা জ্বলন্ত চোখে টগবগ করতে দেখা যায় ঘোড়াভূতকে। কখনো কখনো তাদের সাথে থাকে স্কন্ধকাটা। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি গোভূত দেখেছিলেন।

ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি গ্রাম থেকে, এতসব লোকজ ভূতের গল্প থেকে। ভূতেরা থাক আর না থাক, লোকসাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বেঁচে থাকুক গ্রামবাংলার ভূতের গল্পগুলো।

ফিচার ইমেজ সূত্র: GQ-India

Related Articles