পৃথিবীতে যত রকমের মিথলজি বা রুপকথা আছে, তার মাঝে অন্যতম আকর্ষণীয় হলো গ্রিক মিথলজি। এতটা চমকপ্রদ হওয়ার কারণ সম্ভবত গ্রিক দেবদেবীদের বিচিত্র কার্যকলাপ, আশীর্বাদ আর অদ্ভুত সব দৈত্য-দানব। বেশ কয়েকটি দানবের নাম আমাদের অতি পরিচিত, যেমন সারবেরাস, মিনেটর, সাইক্লপ্স, ক্যারিবডিস ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে পরিচিত দানবটির নাম বোধহয় আমরা সবাই জানি- হাইড্রা!
হাইড্রার কথা বলতে গেলে মহাবীর হারকিউলিসের কথা এমনিতেই চলে আসে, কেননা হাইড্রাকে যে তিনিই বধ করেছিলেন! কেন বধ করেছিলেন তা আবার আরেক ইতিহাস। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, রাজা ইউরেস্থিউস হারকিউলিসকে ১২টি কাজ দিয়েছিলেন ‘12 labours of Hercules’ নামে পরিচিত। এই ১২টি অত্যন্ত কঠিন কাজের মধ্যে দ্বিতীয় কাজটি ছিল জলদানবী হাইড্রাকে বধ করা।
চলুন জেনে নেওয়া যাক হাইড্রার পরিচয়। অসংখ্য ভয়ানক দানবের মত হাইড্রারও জন্ম দিয়েছিল টাইফন ও একিডনা। তবে তাকে পেলে পুষে বড় করেছিলেন দেবরাজ জিউসের পত্নী হেরা। এর পেছনে আসলে তার একটি উদ্দেশ্যও ছিল, আর তা হলো হারকিউলিসকে জব্দ করা। কারণ হারকিউলিস ছিলেন হেরার সৎ পুত্র। মানবীর গর্ভে জিউসের এই পুত্রের জন্ম হেরা মেনে নিতে পারেননি কোনদিন।
হাইড্রার বাসস্থান ছিল লার্না অঞ্চলের লার্না নামের একটি হ্রদে। এজন্য হাইড্রাকে লার্নায়ান হাইড্রাও বলা হয়। অ্যামিমোন ঝর্ণার গুহার পাশেই থাকতো ভয়ংকর এই জলজ দানবী। লার্নাকে বলা হত পাতাল জগতে প্রবেশের দরজা। কথিত আছে হাইড্রা ছিল এই দরজার পাহারাদার।
অনেক কথাই হলো হাইড্রাকে নিয়ে, কিন্তু ঠিক কী কারণে হাইড্রা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল? চলুন জানা যাক।
বিকট দর্শন এই দানবীর ছিল সব মিলিয়ে ৯টি মাথা। এর মধ্যে একেবারে মাঝখানের মাথাটি ছিল আবার অমর। শুধু তাই নয়, বাকি ৮টি মাথা কেটে ফেলা হলে কাটা জায়গা থেকে প্রতিটি মাথার জন্যে নতুন দুইটি মাথা গজাতো। এই জন্যে অনেক লেখায় ও ছবিতে দেখানো হয়েছে হাইড্রার অসংখ্য মাথা। হাইড্রার অমর মাথাটিই ছিল সব সমস্যার মূলে। এই মাথা থেকে পূতি গন্ধময় বিষাক্ত শ্বাস বের হতো আর এর রক্তও ছিল বিষে ভরা।
তার শ্বাস প্রশ্বাসের বাতাসের হলকায় শরীর পুড়ে যেত, এমনকি রক্তের গন্ধ নাকে গেলেও মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকতো। অ্যামিমোনের গুহা থেকে বের হয়ে হাইড্রা মাঝে মাঝেই তান্ডব চালাতো গ্রামবাসীদের ওপর। তাদের পশুর পালের ওপর আক্রমণ করতো, বনের জন্তু জানোয়ার হত্যা করতো, সমতলভূমি একেবারে তছনছ করে দিত। লার্নার লোকজন তার অত্যাচারে ছিল অতিষ্ঠ।
রাজা ইউরেস্থিয়াসের আদেশ পেয়ে হারকিউলিস লেগে যান হাইড্রাকে বধ করার কাজে। ১২টি কাজের প্রথমটি একা সেরে ফেললেও যেহেতু হাইড্রা ছিল প্রায় অমর এবং মারাত্মক, হারকিউলিস ঠিক করলেন এবার তিনি একা যাবেন না। এই অভিযানে তিনি সঙ্গী হিসেবে সাথে নেন তার অতি বিশ্বস্ত ভাতিজা লোলাউসকে। লোলাউসের ঘোরার রথে চড় দু’জন মিলে রওয়ানা হন লার্নার দিকে।
লার্না হ্রদের অ্যামিমোন গুহার কাছাকাছি গিয়ে রথ থেকে নেমে পড়েন দু’জনে। চারদিকের বিষাক্ত গন্ধ আর ধোঁয়া থেকে তারা বুঝতে পারেন, এখানে কোথাও ঘাঁটি গেড়ে আছে অমর দানবী হাইড্রা। পূতি গন্ধময় ধোঁয়া থেকে নিজেদের বাঁচাতে দু’জনে নাকে ভাল করে কাপড় চাপা দিয়ে নিলেন, আর জ্বালিয়ে নিলেন মশাল। হারকিউলিস এবার গুহা মুখের কাছে গিয়ে তীরের মাথায় আগুন ধরিয়ে জ্বলন্ত তীরগুলো ছুঁড়তে লাগলেন। তার ফন্দি ছিল, আগুনে তীরের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে জলদানবী একসময় গুহা থেকে বের হয়ে সামনে আসবে।
হারকিউলিসের বুদ্ধি কাজে দিল, তীরের খোঁচায় ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে হাইড্রা একসময় বের হয়ে এল গুহা থেকে। আড়মোড়া ভেঙ্গে ৯টি মাথা দিয়ে ইতিউতি চেয়ে বলতে চাইল, এই অসময়ে বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে, এরা কারা? সামনে হারকিউলিসকে পেয়ে চোখের পলকে কুন্ডলী পাকিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো তাকে। এদিকে হারকিউলিসও দমবার পাত্র নন, তিনিও বেশ করে হাইড্রাকে আঁকড়ে ধরে রইলেন, সাথে থাকা তার বিখ্যাত গদা দিয়ে (মতান্তরে তলোয়ার, অনেক জায়গায় শস্য কাটার বিশেষ ছুরির কথাও উল্লেখ পাওয়া যায়) আঘাত করে হাইড্রার মাথাগুলোকে গুঁড়িয়ে দিতে থাকেন।
যেইমাত্র হারকিউলিস ভাবলেন, বিজয়ীর হাসি হাসবার সময় হয়েছে, হাইড্রা যেন মনের কথা পড়ে ফেললো তার। গুঁড়িয়ে যাওয়া মাথাগুলো থেকে দুটো করে নতুন মাথা গজিয়ে উঠল হাইড্রার। এই দেখে হারকিউলিস পড়ে গেলেন বিপাকে। বুঝলেন, একা একা এই জলজ ত্রাসকে পরাস্ত করা যাবে না। তিনি সাহায্য চাইলেন সাথে থাকা লোলাউসের।
লোলাউস হারকিউলিসকে বাৎলে দেন এক অভিনব উপায়। হারকিউলিস যখন গদার বাড়িতে হাইড্রার একেকটি মাথা গুঁড়িয়ে দেবেন, লোলাউস তখন একটা মশাল দিয়ে সেই কাটা মাথার জায়গা আগুন দিয়ে ঝলসে দেবেন যেন সেখান থেকে নতুন কোন মাথা গজাতে না পারে। বলা হয়ে থাকে, লোলাউসকে এই উপায়টি শিখিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং জ্ঞানের দেবী এথেনা, যেন তা পরবর্তীতে হারকিউলিস কাজে লাগাতে পারেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ, লোলাউস পাশের বন থেকে গাছের মোটা একটি কান্ডে আগুন ধরিয়ে নিলেন। হারকিউলিস এদিকে এক এক করে হাইড্রার মাথা বিচ্ছিন্ন করতে লাগলেন, আর লোলাউস কাটা জায়গায় আগুন দিয়ে ঝলসে দিতে থাকলেন।
এদিকে হেরা দেখলেন, তার এত সাধের হাইড্রাকে হারকিউলিস নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে। তিনি তখন হারকিউলিসকে শায়েস্তা করতে লার্নায় পাঠালেন তার পোষা বিরাট আকারের এক কাঁকড়াকে। সেই কাঁকড়াটি এসেই হারকিউলিসকে কামড় দিয়ে অস্থির করে তুলতে লাগল। বারবার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় হারকিউলিস একেবারে বিরক্তির শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছলেন। পায়ের নিচে আসামাত্র একটা মস্ত পায়ের চাপ দিয়ে কাঁকড়ার প্রাণবায়ু বের করে দিলেন।
৮টি মাথা একে একে ধ্বংস করার পর এল মধ্যখানের অমর মাথাটির পালা। হারকিউলিস এবার বের করলেন দেবী এথেনার দেয়া বিশেষ এক অস্ত্র, সোনালি রঙের একটি তলোয়ার। হাইড্রার শরীরের বিষাক্ত রক্তে ভিজিয়ে সেই তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে জলদানবীর ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে দিলেন তিনি। এভাবেই ইহলীলা সাংগ হল হাইড্রার। বিচ্ছিন্ন মাথাটি হারকিউলিস সঙ্গে নেন। কথিত আছে, লার্না থেকে ইলাউস যাবার পথে কোনো এক জায়গায় তিনি এই মাথাটিকে মাটিচাপা দিয়ে রাখেন। আর হাইড্রার শরীর কেটে বিষাক্ত রক্ত বের করে তাতে নিজের তীরগুলো সব ডুবিয়ে নেন। ফলে সেগুলো হয়ে পড়ে নিশ্চিত মারণাস্ত্র।
হেরা অবশ্য হাইড্রা আর তার পোষা কাঁকড়াকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ভোলেননি। দু’জনকে তিনি আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জ হিসাবে স্থান দেন। আন্দাজ করুন তো, কোন দুইটি নক্ষত্রপুঞ্জ হিসাবে এরা আকাশে বিরাজ করছে? ‘কন্সটেলেশন হাইড্রা’ এবং ‘কনস্টেলেশন ক্যান্সার’।
এভাবেই জলের আতংক হাইড্রার জীবন শেষ হয় হারকিউলিসের হাতে। হারকিউলিসের এই বীরত্ব গাঁথা ছড়িয়ে পড়ে সবার মুখে মুখে। কিন্তু রাজা ইউরেস্থিউস হাইড্রার বধ করাকে হারকিউলিসের ১২টি কাজের একটি হিসাবে স্বীকৃতি দেননি। তিনি দাবি করেন, যেহেতু এই কাজে লোলাউস তাকে সাহায্য করেছে কাজেই এটি তার একার হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া বিখ্যাত গ্রিক পর্যটক পসানিয়াসের মতে, হাইড্রা আসলে একটি নিরীহ গুইসাপ বা ঢোঁড়াসাপ ছাড়া আর কিছুই নয়, লোকমুখে গল্প ছড়াতে ছড়াতে হাইড্রাকে নাকি দেখানো হয়েছে ভয়ংকর দানবী হিসেবে।
এতসব রটনায় হারকিউলিস কিংবা হাইড্রা- কারো বীরত্ব বা সাহসিকতা মলিন হয়নি একটুও। বরং যুগ যুগান্তর ধরে লোকে হারকিউলিসের হাইড্রা বধের গল্পটি মনে রেখেছে, হাইড্রার ভয় দেখিয়ে কচি কাঁচাদের ঘুম পাড়িয়েছে বছরের পর বছর ধরে!
ফিচার ইমেজ – DeviantArt