পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে সবচেয়ে বেশিবার যে শব্দটি উচ্চারিত হয় সেটি হল- অভিশাপ। দেব-দেবী আর পুরোহিতের অভিশাপে ইতিহাসের কত নায়ক আর নায়িকার জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্গতি, তা বলে শেষ করা যায় না। সামান্য কথাতেও দেবতারা চটে যান, আর বাকি জীবন তাদের অভিশপ্ত হয়ে কাটাতে হয়। এমনই এক অভিশাপের কথা নিয়ে আজকের আয়োজন।
সর্পকেশী মেডুসা- গ্রীক মিথলজির এই দানবীর কথা কে শোনেনি? তার চোখে চোখ পড়লেই সব পাথর হয়ে যায়, এতই ভয়ানক তার দৃষ্টি। হলিউডের সিনেমা Clash of the Titans (২০১০) এ মেডুসাকে দেখানো হয়েছে বেশ নিখুঁতভাবে। পার্সিয়াসের হাতে বধ হয়, আর নিজে হয় দানব ক্র্যাকেনকে বধ করার অস্ত্র। কিন্তু সিনেমায় আসল ঘটনার কত পরিবর্তনই তো হয়। পুরাণ অনুসারে মেডুসা আসলে কে ছিল? কী করে মারা যায় সে?
জন্ম
মেডুসার জন্মের ইতিহাস নিয়ে বেশ খানিকটা বিতর্ক আছে। মনে করা হয়, গ্রীক মিথলজির আর সব দানব-দানবীর মতো মেডুসার জন্মও দিয়েছিল টাইফন আর একিডনা দম্পতি। এরা নিজেরাও ছিলেন দানব-দানবী। মেডুসারা ছিল তিন বোন। এর মাঝে সে সবচেয়ে ছোট। বড় দুই বোন অমর হলেও মেডুসা ছিল মরণশীল। এই তিন বোনকে একসঙ্গে বলা হত গর্গন।
আবার মতান্তরে, মেডুসার বাবা-মা ছিলেন সাগরের দেবতা ও দেবী ফোরসিস ও সিটো। এ-ও বলা হয় যে মেডুসা প্রথমে দানবী ছিল না, অপূর্ব সুন্দরী ছিল। কিন্তু দেবী অ্যাথেনার অভিশাপে সে গর্গনদের একজন হয়ে পড়ে।
প্রথম জীবন
অনিন্দ্যসুন্দরি মেডুসা বাস করত পৃথিবীর একদম উত্তরে, যেখানে কখনো সূর্য দেখা যেত না। অনেক ছোটবেলাতেই নিজেকে দেবী অ্যাথেনার সেবায় উৎসর্গ করেছিল স্বর্ণকেশি মেডুসা। তাই ধর্মযাজিকা হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিল দেবীর মন্দিরে।
একবার তার সাধ হয় সূর্য দেখার। দেবী অ্যাথেনার কাছে অনুমতি চাইতে গেল। কিন্তু দেবীর মর্জি বলে কথা। স্রেফ না করে দিল। মেডুসার মনে মনে খুব রাগ হল। রেগে মেগে বলেই ফেলল, এতদিন ধরে নিষ্ঠার সাথে পূজা করার পরেও তাকে যেতে না দেওয়ার কারণ নিশ্চয়ই ঈর্ষা, কেননা মেডুসা যে অপরূপ সুন্দরী। মেডুসার এহেন মন্তব্যে এথেনা ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি তাকে অভিশাপ দিলেন, যে রূপ নিয়ে তার এত অহংকার, সে রূপই হারিয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, তার দিকে যে তাকাবে সে নিষ্প্রাণ পাথরে পরিণত হয়ে যাবে।
সাথে সাথে মেডুসার দুধে-আলতা গায়ের রং বদলে সাপের মতো সবুজ হয়ে যায়। চামড়া হয়ে যায় আঁশটে। মাথার ঘন চুল পরিণত হয় হাজার হাজার বিষাক্ত সাপে, কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত সাপের লেজে বদলে যায়। চোখ দুটো হয়ে যায় আশ্চর্য রকম শীতল।
একাধিক ভাষ্য থেকে মেডুসার অভিশাপের পেছনে সমুদ্রের দেবতা পসাইডনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। বলা হয়, মেডুসার অপরূপ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে পসাইডন প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তার। একদিন কামনার ফাঁদে পা দিয়ে দুজন অ্যাথেনার মন্দিরের ভেতরেই সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
পবিত্র মন্দিরের ভেতর সঙ্গম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সেটা দেবতা হোক বা যে-ই হোক। কিন্তু স্বয়ং সাগরের দেবতাকে তো কিছু বলা যায় না। অ্যাথেনার সব রাগ গিয়ে পড়ল বেচারি মেডুসার ওপর। তখনই তিনি অভিশাপ দেন মেডুসাকে, আর রমণীয় মেডুসা হয়ে পড়ে কুৎসিত।
অভিশপ্ত জীবন
রূপ হারিয়ে ভয়ানক কুৎসিত মেডুসা দুঃখে আর হতাশায় মন্দির ছেড়ে চলে গেল অনেক দূরে। মানসিক শান্তি লাভের আশায় ঘুরে বেড়াতে লাগল গহীন জঙ্গলে। মাথা থেকে সাপ খসে পড়তে লাগল মাটিতে। কথিত আছে, সেটি পড়েছিল আফ্রিকায় এবং এর পর থেকেই আফ্রিকা বিষাক্ত সাপদের অন্যতম একটি আবাসস্থল হয়ে দাঁড়ায়।
মেডুসার সাথে সবসময় থাকত লম্বা একটি ধনুক, পিঠে থাকত তীর। তবে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল তার চোখ-জোড়া। চোখের দৃষ্টিতে পাথর বানিয়ে দিয়েছিল অগণিত প্রাণি। থাকত সমুদ্রের এক নির্জন দ্বীপে, সেই দ্বীপে তাকে মারার জন্যে যারা যেত তারা কেউ আর ফিরে আসত না।
রাজা পলিডেকটাসকে পার্সিয়াসের উপহার
মেডুসার কথা বললে পার্সিয়াসের নাম নিতেই হয়, কেননা পার্সিয়াসের হাতেই যে তার অন্তিম পরিণতি। পার্সিয়াস ছিল ডেমি গড। অর্ধেক দেবতা ও অর্ধেক মানব। তার পিতা ছিলেন দেবরাজ জিউস।
সেরিফোস দ্বীপের রাজা পলিডেকটাস ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির লোক। এই দ্বীপেই বাস করত পার্সিয়াস। একবার রাজা তার এক বিশাল ভোজসভায় পার্সিয়াসের সামনে গর্গন তিনবোনের গল্প করলেন। এ কথাও বললেন যে কেউ যদি তিন বোনের একজনের মাথা তাকে কেটে এনে দিতে পারত তবে তিনি খুব খুশি হতেন। এদিকে ভোজসভায় সব অতিথি অনেক মূল্যবান উপহার এনেছিল রাজার জন্য, এক পার্সিয়াসই কিছু আনেনি। এটি ছিল রীতিমত অপমান। তরুণ পার্সিয়াস তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এখানকার সব থেকে মূল্যবান উপঢৌকন সে এনে দেবে রাজার জন্য, তা হল গর্গন মেডুসার কাটা মাথা।
কথিত আছে, পার্সিয়াসের সুন্দরী মা ড্যানির ওপর রাজা পলিডেকটাসের দৃষ্টি ছিল অনেকদিন ধরেই। পার্সিয়াসের উপস্থিতিতে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই কৌশলে পার্সিয়াসকে তিনি সরিয়ে দেন, কেননা মেডুসার মাথা আনতে গেলে সে যে আর কোনদিন ফিরে আসবে না- এ তো অবধারিত।
মেডুসার বধ
পার্সিয়াস বেরিয়ে পড়লেন এই অসম্ভব কাজটি সম্পন্ন করতে। কিন্তু একা এই কাজটি করা সম্ভব? প্রায় অসম্ভব কাজটি করতে পার্সিয়াসের পাশে ছিলেন জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনা স্বয়ং, আর দেবতাদের বার্তাবাহক হার্মিস। তারা পার্সিয়াসকে শিখিয়ে দিলেন বেশ কিছু কৌশল, আর দিলেন বিশেষ কিছু জিনিস। অ্যাথেনা তাকে দিলেন নিজের বুকের পাতলা বর্ম (মতান্তরে ব্রোঞ্জের একটি ঢাল), হার্মিস তাকে দিলেন একটি তরবারি আর হেডিসের জাদুর টুপি- যা পরলে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে থাকা যায়, জাদুর থলি, যার ভেতরে যেকোন কিছু আঁটানো যায়। হার্মিস তাকে আরো দিলেন পাখাওয়ালা এক জোড়া জুতো, যা পরে যেখানে খুশি যাওয়া যায়। এতকিছু পেয়ে পার্সিয়াসের মনে বল পেল, মেডুসাকে হত্যা করা এখন তার কাছে আর কোনো ব্যাপারই নয়।
বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে মেডুসার দ্বীপে এসে পৌঁছুল পার্সিয়াস। গর্গনরা তিন বোনই থাকত এখানে। দেবী অ্যাথেনা পার্সিয়াসকে মেডুসা কোনটি তা চিনিয়ে দিলেন, কারণ অন্য দুই বোন ছিল অমর। তিনি তাকে আরও বললেন, মেডুসার দিকে যেন সে কোনভাবেই সরাসরি না তাকায়। কারণ তাতে সে পাথর হয়ে যাবে। তাই তিনি চকচকে ব্রোঞ্জের সেই ঢালের মাঝে মেডুসার প্রতিফলনের দিকে তাকে চোখ রাখতে বলেন।
পার্সিয়াস জাদুর জুতো জোড়া পায়ে পরে উড়ে উড়ে সেই ঢালের দিকে তাকিয়ে মেডুসার দিকে লক্ষ রাখতে লাগল। একসময় মেডুসা এসে পড়ল তার হাতের নাগালে, সে ঢালের দিকে তাকিয়ে তলোয়ারের এক কোপে মেডুসার মাথা কেটে ফেলল। ঢাল থেকে চোখ না সরিয়েই মেডুসার মাথাটি মুঠি করে ধরে জাদুর থলেতে ঢুকিয়ে ফেলল। অন্য দুই বোন মেডুসার এই পরিণতি খেয়াল করে তাকে ধরবার আগেই জাদুর টুপি আর জুতোর সাহায্যে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।
পার্সিয়াস সেরিফোস দ্বীপে ফিরে গিয়ে রাজা পলিডেকটাসকে উপহার দিল মেডুসার কাটা মুণ্ডু। রাজা তাতে বেশ খুশি হলেন।
ক্র্যাকেনের মৃত্যুতে মেডুসা
এদিকে আরেক ভাষ্য বলে অন্য গল্প। গ্রীস দেশের আর্গোস রাজ্যের রাজা আর রাণী ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারা দেবতার অস্তিত্বে আর বিশ্বাস করেন না। এই শুনে দেবতারা চরম অপমানিত হন। ক্রুদ্ধ দেবতারা পাতালের কারাগার টারটারাস থেকে ভয়ঙ্কর দানব ক্র্যাকেনকে পৃথিবীতে মুক্ত করে দেন। বিশাল এই জলদানবকে ভয় পেত স্বয়ং দেবতারাই। একে মারার জন্য কোনো অস্ত্রও ছিল না। আর্গোস রাজ্যের সমস্ত প্রাণী হত্যা করতে ধেয়ে আসে ক্র্যাকেন।
ক্র্যাকেনকে থামানোর একটি মাত্র উপায় ছিল। রাজার একমাত্র মেয়ে এন্ড্রোমিডাকে বলি দিতে হবে ক্র্যাকেনের কাছে। তা না হলে সবাইকে মরতে হবে। রাজ্যের এক ভবিষ্যৎবক্তা তখন রাজাকে জানায়, মেডুসার চোখের দৃষ্টিই ক্র্যাকেনকে মারার উপায় হতে পারে। আর মেডুসাকে মেরে তার মাথা এনে দিতে পারে কেবল জিউসের পুত্র পার্সিয়াস। আর্গোসের রাজা তখন পার্সিয়াসকে দায়িত্ব দেন, মেডুসার কাঁটা মুণ্ডু নিয়ে আসার। মুণ্ডু কাটার কাহিনী তো আগেই বলা হল। মেডুসার মাথা নিয়ে এসে পার্সিয়াস ক্র্যাকেনের চোখের সামনে ধরতেই মস্ত দানব নিমিষে পাথর হয়ে গেল, বেঁচে গেল আর্গোস।
পেগাসাসের জন্ম
এখানেই মেডুসার গল্প শেষ নয়। রয়ে গেছে গল্পের ভিন্ন এক মোড়। সেই যে পসাইডনের সাথে মন্দিরের ভেতর সঙ্গম করেছিল মেডুসা, তখন সে হয়ে পড়েছিল অন্তঃসত্ত্বা! পার্সিয়াস যখন সমুদ্রের ওপর দিয়ে মেডুসার কাটা মাথা নিয়ে উড়ে আসতে থাকে, তখন সেখান থেকে দু’ফোটা রক্ত পড়ে সমুদ্রের পানিতে। সেখান থেকে জন্ম হয় পেগাসাস নামক এক আশ্চর্য পাখাওয়ালা ঘোড়ার, যাকে বাংলা ভাষায় পক্ষীরাজ ঘোড়া বলে চেনে সবাই। পেগাসাসের সঙ্গে আরও একজনের জন্ম হয় তখন, নাম তার ক্রাইসেওর।
আরেকটি কাহিনী প্রচলত আছে এ ব্যাপারে। মেডুসার মাথা নিয়ে আসার সময় পার্সিয়াস অ্যাটলাস নামক টাইটানের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। এটি সেই টাইটান, যে পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে একে মাথায় বহন করে রেখেছে। পরে পার্সিয়াস মেডুসার মাথার সাহায্যে তাকেও পাথর বানিয়ে দেয়। উত্তর আফ্রিকার অ্যাটলাস পর্বতমালা এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে বলে গ্রীক পুরাণে উল্লেখ আছে।
আধুনিক জগতে মেডুসা
মেডুসা মরে গেলেও, বর্তমান সাহিত্য, চিত্র, শিল্প আর কলায় বেঁচে আছে দিব্যি। দানবী হওয়া সত্ত্বেও সৈন্যদের ঢাল আর বর্মে রক্ষাকবজ হিসেবে আঁকা হত মেডুসাকে। সেই থেকে শুরু, মেডুসার চিত্র এখনো বিখ্যাত গোটা বিশ্বে। তাছাড়া প্রাচীন পুরাণ রচনা থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্য রচনায় মেডুসা ছিল কবি সাহিত্যিকদের এক প্রেরণার নাম। অনেক স্থাপত্য আর প্রাচীন মুদ্রায় স্থান পেয়েছে মেডুসা।
বর্তমানে আধুনিক শিল্প জগতে মেডুসা মিশে গিয়েছে বহু আগেই। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের প্রধান নগরচত্বরে পার্সিউস এবং মেডুসার বিখ্যাত স্থাপত্য কর্মটি দেখা যায়। প্রতিবছর পর্যটকদের ভীড় থাকে সেখানে। এছাড়া ইতালির বিখ্যাত ফ্যাশনব্রান্ড ভার্সাচি-এর লোগোতেও ব্যবহৃত হয়েছে মেডুসার মাথা।
ফিচার ইমেজ- DeviantArt