সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন এশিয়া মাইনরের উত্তরে অবস্থিত ছিল বিখ্যাত এক নগরী। ইতিহাস হোক বা উপকথা, এই নগরীর নাম বিবিধ কারণেই পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। সমুদ্র উপকূল থেকে খানিক দূরে এই অবস্থিত বর্ণিল সৌন্দর্যমণ্ডিত এই নগরীর নাম ছিল ‘ট্রয়’। উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ আছরে পড়ত ট্রয় বন্দরের সুদীর্ঘ বেলাভূমিতে। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করতো সাগরের নীল জলরাশি, সাথে অন্ধকারের নীরবতা ভেঙে দিত সমুদ্রের মুহুর্মুহু গর্জন।
ট্রয় নগরী উত্থানের আখ্যান বর্ণনা করতে হলে ফিরে যেতে হবে সম্রাট ড্যারডানাসের আমলে। ড্যারডানাস হলেন গ্রিক পুরাণে বর্ণিত পৃথিবীর একদম শুরুর দিকের একজন বাদশাহ। পৃথিবীতে মহাপ্লাবন সংঘটিত হবার আগে তিনি অ্যারকাডিয়া সাম্রাজ্যের মসনদে আসীন ছিলেন। তবে পরিচালনার দায়ভার শুধু তার একার ছিল না। ড্যারডানাসের অগ্রজ ইয়াজিনও ছোট ভাইয়ের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্রাজ্য দেখাশোনা করেছেন। এই দুজন ছিলেন দেবরাজ জিউস এবং ইলেক্ট্রার ঔরসজাত সন্তান। সেই হিসেবে তারা ছিলেন টাইটান অ্যাটলাসের দৌহিত্র।
গ্রিক পুরাণ অনুসারে, এই ধরণী অধার্মিক, ঝগড়াটে ও হিংসুক মানুষ দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে গেলে দেবরাজ জিউস এক মহাপ্লাবনের পরিকল্পনা করেন। জিউসের উদ্দেশ্য ছিল, তিনি পৃথিবী থেকে সকল পাপী ও পাপের চিহ্ন মুছে ফেলবেন। মহাপ্লাবনের সময় বেঁচে থাকা অ্যারকাডিয়ানরা আশ্রয় নিয়েছিল এক পাহাড়ের চূড়ায়। জিউসের আদেশেই ড্যারডানাস এবং ইয়াজিয়ন সিদ্ধান্ত নিলেন, অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হবার জন্য তারা বিশাল এক নৌকা নির্মাণ করবেন। সবাই হাত লাগালে দ্রুতই ফুরিয়ে এলো নৌকার কাজ। ভ্রমণের জন্য মহাপ্লাবনের বুকে প্রজাদের নিয়ে তরী ভাসালেন ড্যারডানাস। বলে রাখা ভালো, আইডাস ও ডেইমাস নামে দুই পুত্র সন্তান ছিল ড্যারডানাসের। আইডাস তার বাবার সাথে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলেও ডেইমাস ওখানেই থেকে গেলেন। মহাপ্লাবনের সমাপ্তি ঘটার পর ডেইমাস হয়ে উঠেছিলেন ওই জায়গার শাসনকর্তা।
এভাবে দিনের পর দিন গড়িয়ে যেতে লাগল। চলতে চলতে তরী গিয়ে ঠেকল স্যামোথ্রেসের এক দ্বীপে। সবাই সেই দ্বীপে কিছুদিন অবস্থান করল। অনুর্বর জমির জন্য সেই দ্বীপ মনে ধরেনি ড্যারডানাসের। এছাড়াও দ্বীপটিতে বড় ভাই ইয়াজিয়নকে হারিয়ে ফেলেছিলেন ড্যারডানাস। তবে ইয়াজিয়নকে নিয়ে অন্যরকম আরেকটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। ক্যাডমাস ও হারমোনিয়ার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল ড্যারডানাস এবং ইয়াজিয়নকে। বিবাহ ভোজনের সময় দেবী ডিমিটার ভুলিয়ে ভালিয়ে মোহের মায়ায় আচ্ছন্ন করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ইয়াজিয়নকে। রঙ-তামাশার পর যখন তারা বিবাহ ভোজনে ফিরে আসলেন, তখন পুরো ব্যাপারটি জানতে পারেন দেবরাজ জিউস। ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে তিনি বজ্রাঘাতে সাথে সাথে খুন করে ফেলেন ইয়াজিয়নকে।
যা-ই হোক, ড্যারডানাস এবং তার পুত্র আইডাস স্যামোথ্রেস ত্যাগ করার পর এশিয়া মাইনরের নিকটবর্তী শহর অ্যাবিডসে এসে পৌঁছলেন। আগন্তুক হিসেবে তাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন ওখানের বাদশাহ টিউকার। তারপর ড্যারডানাসের সাথে বাদশাহ টিউকার তার নিজ কন্যা বাটেয়াকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেন। উত্তরাধিকারসূত্রে টিউকাস তার রাজ্যের কিছু অংশ ড্যারডানাসকে দিয়ে দেন। ওই স্থানে ড্যারডানাস নতুন এক বসতি গড়ে তুললেন, এবং ওই অঞ্চলের নামকরণ করলেন নিজের নামানুসারেই।
সময়ের সাথে সাথে সেই ড্যারডানিয়া নগরীর ক্রমশ বিস্তৃতি ঘটতে লাগল। সম্রাট ড্যারডানাস এবং বাটেয়ার কোল আলো করে আইরাস ও এরিক্টোনিয়াস নামে দুই সন্তান জন্মগ্রহণ করে, যাদের উত্তরসূরিরাই গ্রিক উপকথার পাতায় পাতায় সুবিদিত হয়ে আছেন। এরিক্টোনিয়াসের সাথে নদীর দেবী সিমোয়েসের কন্যা অ্যাস্টিওসির বিয়ের ফলে তাদের ঘরে জন্ম নেয় ট্রস নামক এক সন্তান। এই ট্রসের পুত্রের মধ্যে আবার আইলাস, গ্যানোমিড এবং অ্যাসারাকাস অন্যতম। এই আইলাস ইলিয়ান নামে এক নগরীর নির্মাণে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। বাবা ‘ট্রস’ এর সম্মানার্থে পরবর্তীতে ইলিয়ান নগরীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ট্রয়’।
কিংবদন্তি অনুসারে, গ্যানোমিডকে দেখে প্রচণ্ড ভালো লেগে যাওয়ায় তাকে অপহরণ করেন দেবরাজ জিউস। ছেলে হারানোর শোকে পাথর হওয়া ট্রসকে সান্ত্বনাস্বরূপ জিউস তখন উপহার পাঠালেন। তিনি দেবদূত হারমেসকে দিয়ে দুটি স্বর্গীয় ঘোড়া ট্রসের নিকট উপঢৌকন হিসেবে প্রেরণ করলেন, যেগুলো ছুটতে পারত হাওয়ার বেগে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, স্বর্গীয় সামগ্রী হওয়ায় দুটি ঘোড়াই ছিল অমর। হারমেস ট্রসকে এ বলেও আশ্বস্ত করে দিয়েছিল যে, গ্যানোমিডকে নিযুক্ত করা হয়েছে দেবতাদের মদ্য পরিবেশক হিসেবে। যেহেতু সে দেবতাদের সেবায় সরাসরি নিযুক্ত, তাই সে অমরত্বও লাভ করে ফেলেছে।
ট্রয় নগরীর বর্ণনা দিতে হলে সম্রাট লাওমেডনের পরিচিতিও খোলাসা করার প্রয়োজন। লাওমেডন ছিলেন আইলাসের সন্তান এবং গ্যানোমিড এবং অ্যাসারাকাসের ভ্রাতুষ্পুত্র। লাওমেডনের মায়ের নাম ছিল ইউরিডাইসি, যিনি ছিলেন অ্যারগসের বাদশাহ অ্যাড্রাস্টাসের কন্যা। থেমিস্ট ও টেলেক্লিয়া নামে দুই বোনও ছিল লাওমেডনের। একাধিক স্ত্রী নিয়ে রাজমহল আলোকিত করে রেখেছিলেন সম্রাট লাওমেডন।
তাদের মধ্যে পটামই স্ক্যামান্ডারের কন্যা স্ট্রেইমো এবং রিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্য স্ত্রীদের নাম হলো প্ল্যাসিয়া, থোসা, এবং লিওসিপ। এই স্ত্রীদের গর্ভেই জন্ম নিয়েছিল লাওমেডনের সন্তান থিটোনাস, ল্যাম্পাস, ক্লাইটিয়াস, হাইসটাও, পোডারসেস প্রমুখ। এদের মধ্যে উপকথায় প্রথম জনপ্রিয়তার মুখ দেখে থিটোনাস, যাকে দেবী ইয়োস অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য পোডারসেসের কপালেই জনপ্রিয়তার মুকুট চিরস্থায়ী হয়। লাওমেডনের কন্যাদের মধ্যে হেসিওনি, সিলা, অ্যাস্টিওসি, অ্যান্টিগন, প্রোক্লিয়ার নাম উপকথার পাতায় অক্ষয় হয়ে আছে।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, ট্রয় নগরীর সুবিশাল প্রাচীর তৈরিতে হাত লাগিয়েছিল খোদ দেবতারাও। প্রাচীর নির্মাণের কাহিনীটাও বেশ চমৎকার। দেবরাজ জিউস একবার ষড়যন্ত্রের অপরাধে সঙ্গীতের দেবতা অ্যাপোলো এবং সমুদ্র দেবতা পসেইডনকে এক বছরের জন্য অলিম্পাসের চূড়া থেকে নির্বাসিত করে দিলেন। ফলে মর্ত্যলোকে এসে ঠাঁই নিলেন দেবতা অ্যাপোলো এবং পসেইডন।
পৃথিবীতে এসে জনসাধারণের মতোই কর্মসন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন দুই দেবতা। তারা কাজ পেয়ে গেলেন তৎকালীন ট্রয়ের অধীশ্বর রাজা লাওমেডনের কৃপায়। অ্যাপোলোকে নিযুক্ত করা হলো পশুসম্পদ দেখভালের জন্য, আর পসেইডন পেলেন ট্রয়ের প্রাচীর নির্মাণের কাজ। পসেইডন একা হাতে কাজ সামলাতে পারছিলেন না বলে তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন অ্যাগিনার মরণশীল রাজা অ্যাকাস। লাওমেডন সমুদ্র দেবতা পসেইডন এবং দেবতা অ্যাপোলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেন যে, দুই দেবতা মিলে যদি ট্রয়ের দুর্ভেদ্য এক প্রাচীর নির্মাণ করে দেন তাহলে বাদশাহ তাদেরকে বিপুল পারিতোষিকে তুষ্ট করবেন। কিন্তু প্রাচীর নির্মাণের পর শঠতার কালো ছায়ায় আশ্রয় নিলেন লাওমেডন। তিনি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ফেললেন। ফলে দারুণ ক্ষোভে ফেটে পড়লেন দেবতা অ্যাপোলো এবং পসেইডন। ক্রুদ্ধ হয়ে অ্যাপোলো পুরো ট্রয়ের মাটিতে মড়ক বিস্তার করে দিলেন।
ওদিকে ট্রয়ের ধ্বংস কামনা করে সমুদ্র থেকে ‘ট্রোজান সিটাস‘ নামে বিশালাকার এক দানব পাঠালেন পসেইডন। লাওমেডন সেই দানব বধের জন্য সৈন্য পাঠালেও আদতে কোনো লাভ হয়নি। ওই দানবের সামনে একমুহূর্তও টিকতে পারেনি লাওমেডনের ফৌজ। দানবটা একে একে নগরবাসীর বাড়িঘর, শস্য, ফসল সবকিছুই ধ্বংস করে ফেলতে লাগল। প্রজাদের জন্য কেঁদে উঠল বিশ্বাসঘাতক লাওমেডনের মন। তিনি মন্দিরে গিয়ে বিষণ্ণ মনে নিজ প্রজাদের জন্য দয়া ভিক্ষা চাইলেন। লাওমেডনের জন্য খানিক দয়া উদয় হলো দেবতাদের মন কোণে। তাই মন্দির থেকে দৈববাণী হলো, প্রতি বছর ট্রয়ের একজন কুমারীকে ওই দানবের কাছে দিয়ে আসতে হবে, তবেই দেবতাদের সন্তুষ্টি মিলবে। এভাবে প্রতি বছর লটারির মাধ্যমে বেছে নেয়া হতো একজন কুমারীকে, এবং তাকে উৎসর্গ করা হতো ওই সমুদ্র রাক্ষসের নিকট।
লাওমেডনের বিশ্বাসভঙ্গের ক্ষতিপূরণ চুকাতে গিয়ে একে একে বলি হলো পাঁচজন কুমারী। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে ষষ্ঠ বছরে লটারি পরীক্ষায় উঠে এলো স্বয়ং লাওমেডন কন্যা রাজকুমারী হেসিওনির নাম! কপাল চাপড়াতে থাকলেন বাদশাহ লাওমেডন, মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়লেন তিনি। তখন রাজা গিয়ে আবারও তার ললাট ঠেকিয়ে পড়ে রইলেন দেবতাদের মন্দিরে। ফের দেবতারা সম্রাটের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বিপদ থেকে পরিত্রাণের জন্য এক সাহায্যের ব্যবস্থা করলেন। বীরযোদ্ধা হেরাক্লিস (হারকিউলিস) তখন রাজা অ্যারিসকাসের রাজদরবার থেকে সঙ্গীদের সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তার জাহাজ ট্রয় নগরীর বন্দরে এসে থামার পর হঠাৎ তিনি দেখলেন, রাজকন্যা হেসিওনিকে নিয়ে সমুদ্রপাড়ে বিরাট শোকের মাতম চলছে। বাদশাহ লাওমেডন এবং তার রানী অঝোরে অশ্রুবর্ষণ করে যাচ্ছেন। কৌতূহলপরবশ হয়ে সমাগমের দিকে এগিয়ে গেলেন হেরাক্লিস, ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলেন লাওমেডনের কাছে। বাদশাহর কাছ থেকে সমস্ত বিবরণ জানার পর ওই দানবের সাথে যুদ্ধ লড়তে সম্মত হলেন হেরাক্লিস।
যুদ্ধে লড়ার আগে হেরাক্লিস শর্ত জুড়ে দিলেন, সেই দানবকে বধ করলে তাকে যেন সম্রাটের সেই স্বর্গীয় ঘোড়া জোড়া উপহার দেয়া হয়। রাজা সানন্দে মেলে নিলেন সেই শর্ত। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন হেরাক্লিস। যেই তিনি তার সিংহচর্মে নির্মিত বস্ত্র খুলে শক্ত হাতে মুগুরটা পাকরাও করলেন, তখন বীরত্ব যেন তার ইস্পাত সদৃশ শরীর থেকে ঠিকরে পড়ছিল। খানিক পরেই বিশাল জলরাশির বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো বিশালাকার সেই দানব। বড় বড় দাঁতের ফাঁকে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে তার, ভারিক্কি ও ভয়ংকর চেহারার জন্য পুরো সমুদ্রটাকে মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে। দুঃসাহসী হেরাক্লিসের মুগুরের এক আঘাতেই ধরাশায়ী হলো দানব, অচেতন হয়ে গেলো সে। পরবর্তীতে হেরাক্লিস তার তরবারি দাবনটার হৃৎপিণ্ড বরাবর ঢুকিয়ে দিতেই সমুদ্রের নীল জলরাশি টকটকে লাল শরবতের রূপ নিলো।
এই যাত্রায় বেঁচে গেলো রাজকন্যা হেসিওনি। সকলেই ভাবল, পূর্বের বিশ্বাসঘাতকতার ফল ভোগ, পাপের প্রায়শ্চিত্ত এবং হেরাক্লিসের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রাজা লাওমেডন হয়ত তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। কিন্তু সকলের ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে এবারেও বেঁকে বসলেন রাজা লাওমেডন। কিছুদিন পর একটি পরীক্ষা শেষ করে রাজা লাওমেডনের কাছে ফিরে এলেন হেরাক্লিস। কিন্তু হেরাক্লিসের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিলেন লাওমেডন। তিনি দুটো ঘোড়া পাঠালেন ঠিকই, তবে সেগুলো দেবরাজ জিউসের দেয়া স্বর্গীয় ঘোড়া নয়। প্রবঞ্চনার শিকার হওয়ায় হেরাক্লিস ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, লাওমেডনকে তিনি উপযুক্ত শাস্তি দিয়েই ছাড়বেন।
ট্রাকিসে যুবতী স্ত্রী ডিয়ানিরাকে রেখে ভ্রাতুষ্পুত্র আইওলাসকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হেরাক্লিস। সাহায্যে পাওয়ার আশা নিয়ে প্রথমেই দ্বারস্থ হলেন পুরনো বন্ধু টেলামন এবং পেলিয়াসের কাছে। টেলামন মাত্র কিছুদিন আগেই অ্যাথেন্সের স্যালামিসে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন। সাংসারিক সকল ব্যস্ততার পাট চুকিয়ে মোট ছ’টা জাহাজের ব্যবস্থা করলেন টেলামন। সাথে যোগ দিলেন পেলিয়াস, ওইক্লিস, আইওলাস, ডাইমাকাসের মতো গ্রীক বীরেরা। প্রত্যেককে একটি করে জাহাজের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হলো।
মহাবীর হেরাক্লিসের নেতৃত্বে সমুদ্রের বুক চিরে আপন গতিতে ট্রয়ের দিকে এগিয়ে চলল যুদ্ধজাহাজগুলো। ট্রয়ের উপকূলে এসে ওইক্লিসকে জাহাজের পাহারায় রেখে বাকিরা আক্রমণ চালালেন নগরীতে। অকস্মাৎ এই হামলার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না রাজা লাওমেডন। তবে তৎক্ষণাৎ তিনি ফন্দি আঁটলেন। কিছু সৈন্য যোগাড় করে গোপন পথে এগোতে থাকলেন জাহাজগুলোর দিকে। প্রথমেই কব্জায় পেয়ে গেলেন অপ্রস্তুত ওইক্লিসকে, নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো তাকে। ওই গোপন পথের বাঁক ধরেই ট্রয়ে ফিরে এলেন লাওমেডন। পথে অবশ্য হেরাক্লিসের কিছু সৈন্যের সাথে হালকা যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি, কিন্তু সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেন। সুস্থ দেহে নগরীতে পৌঁছানোর সাথে সাথেই বন্ধ করে দিলেন নগরীর দরজা।
ওদিকে, পুরো ট্রয় নগরীকেই চারদিক থেকে অবরোধ করে রাখলেন হেরাক্লিস। তবে তাকে বেশিদিন এ নগরী অবরোধের বেষ্টনীতে রাখতে হয়নি। ট্রয় নগরীর প্রাচীর দেবতা অ্যাপোলো এবং পসেইডন নির্মাণ করলেও, তাদের সাহায্য করেছিলেন টেলামন আর পেলিয়াসের বাবা সম্রাট অ্যাকাস। মরণশীল মানুষের হাত লেগেছে বলে প্রাচীরটি পুরোপুরি অমর হতে পারেনি। বাবার মুখে ট্রয়ের বিখ্যাত প্রাচীরের গল্প শুনতে শুনতেই বড় হয়েছেন পেলিয়াস। প্রাচীরের কোথায় ফাঁকফোকর আছে, তা পেলিয়াস ভালো করেই জানতেন। বাকিদের জানিয়ে দিলেন সেই দুর্বলতার কথা, গর্ত দিয়ে পঙ্গপালের মতো প্রবেশ করল তার অনুসারীরা। হেরাক্লিস নগরীর প্রধান দুর্গে আক্রমণ শুরু করলেই দু’পক্ষের মাঝে বাধে মরণপণ লড়াই। খানিক বাদে দেখা গেলো মৃত লাওমেডনের নিথর দেহ লুটিয়ে আছে মাটিতে। রাজার ছোট সন্তান পোডারসেস বাদে আর কেউ বেঁচে নেই তখন। যুদ্ধের পর সকল বন্দীদের সামনে এনে দাঁড় করালেন হেরাক্লিস। বন্দীদের মধ্যে রাজকুমারী হেসিনওনিও ছিল। তখন হেরাক্লিস বললেন,
“টেলামন, উপহার হিসেবে নিয়ে নাও এই রাজকুমারীকে। আর হেসিওনি, তুমি চাইলে এই বন্দীদের মাঝখান থেকে যেকোনো একজনকে মুক্ত করে নিতে পারো।”
বেদনায় জর্জরিত হেসিওনি তখন ক্রন্দনরত কণ্ঠে জবাব দিলো,
“হে মহাবীর হেরাক্লিস, আমার ভাইকে আপনি মুক্ত করে দিন। সে যেন এই ধ্বংসপ্রাপ্ত ট্রয়কে আবার নিজ হাতে পুনর্নির্মাণ করতে পারে।”
প্রত্যুত্তরে হেরাক্লিস জানান দিলেন,
“আমি তোমার এই প্রার্থনা এক শর্তে মঞ্জুর করব। যেহেতু সে আমার দাস, সেজন্য তাকে ক্রয় করে নিতে হবে
আমার কাছ থেকে। তোমার মুখাবরণটাও মুক্তিপণ হিসেবে মন্দ নয়।”
সাথে সাথে নিজের স্বর্ণ-খচিত মুখাবরণ খুলে দিলো হেসিওনি, মুক্ত করল পোডারসেসকে। এরপর থেকেই পোডারসেসের নাম হয়ে গেলো ‘প্রায়াম’, যার অর্থ ‘মুক্তিপণ দেয়া হয়েছে’। হেসিওনিকে অনুচর টেলামনের সাথ বিয়ে দিয়ে, প্রায়ামকে ট্রয়ের মসনদে বসিয়ে আসলেন হেরাক্লিস। তারপর তিনি দলবল নিয়ে চিরদিনের জন্য ট্রয় ছেড়ে চলে আসেন। রাজা লাওমেডন চিরনিদ্রায় শায়িত ছিলেন ট্রয়ের সিয়ান ফটকের কাছে। কথিত আছে, লাওমেডনের কবর যতদিন অক্ষত ছিল, ততদিন ট্রয় নগরীতে কোনো শত্রুর অনুপ্রবেশ হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখব গ্রিস ও ট্রয়ের টানা দশ বছরের যুদ্ধ শেষে কাঠের ঘোড়া নগরীতে ঢোকানোর সময় নগরীর প্রধান ফটক বড় করার প্রয়োজন পড়ে। ফলে উচ্ছেদ করা হয় লাওমেডনের অক্ষত কবর। এরপরেই পতন ঘটে শত বছর শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিখ্যাত ট্রয় নগরীর।
ওদিকে, ধীরে ধীরে শৌর্যবীর্য নিয়ে ট্রয়ের নির্মল আলো-বাতাসে বেড়ে উঠতে লাগলেন প্রায়াম। একসময় তিনি হেকুবার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রাজা প্রায়াম এবং তার রানী হেকুবার রাজত্বকালে ট্রয় ক্রমশ সম্পদ ও শক্তিতে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। নগরীর কল্যাণ এবং সেটাকে সংঘাত-সংঘর্ষের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুললেন, নির্মাণ করলে বিশাল বিশাল সুউচ্চ এবং সুদৃঢ় দুর্গ। ট্রয়ের পাশ দিয়ে কোনো জাহাজ গেলে সেটা থেকেও কর আদায়ের ব্যবস্থা করলেন। ক্রমে ক্রমে প্রায়ামের শাসনামলে ট্রয় নগরী হয়ে উঠলো তৎকালীন প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর এবং পরাক্রমশালী এক রাষ্ট্রে। রাজা প্রায়াম এবং রানী হেকুবার কোল আলো করে মোট উনিশজন সন্তান জন্ম নিয়েছিল।
তাদের মধ্যে হেক্টর, প্যারিস, হেলেনাস, ক্যাসান্ড্রা, ডেইফোবাস, ট্রলিয়াস, পলিক্সেনা, ক্রিউসা, পলিডোরাস অন্যতম। তবে পৃথিবীজোড়া খ্যাতি অর্জন করতে পারা একমাত্র সন্তান ছিল হেক্টর। মহাবীর অ্যাকিলিসের নাম নিলে হেক্টরের নামও শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করা হয়। তার যুদ্ধনীতির জ্ঞান এবং যুদ্ধকৌশলে পারদর্শিতা তৎকালীন ট্রয়ের আর কারও ছিল না। মনের উদারতা, এবং আনুগত্যেও তিনি সকলের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন। যদি গুণের দিকগুলো তুলনা করা হয়, তবে প্রেমের দেবী আফ্রোদাইতির সন্তান এবং প্রায়ামের ভ্রাতুষ্পুত্র ইনিয়াস ছাড়া তার সমকক্ষ আর কেউ ছিলেন না। এই ইনিয়াসই রোমান জাতির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।