ত্রিমূর্তির গল্পের পরে এবার ত্রিপুরের গল্প শোনার পালা। শিবের যে ছেলেটি দেবতাদের সেনাপতি, সেই কার্তিকের জন্ম হয়েছিল তারকাসুর নামক ভয়ানক এক অসুরকে বধ করার জন্য। তারকাসুর ব্রহ্মার বরে অমরত্ব লাভ করে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল দখল করে ত্রিলোকের অধিপতি বনে বসেছিল। পরে তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কার্তিকের জন্ম হয় এবং কার্তিক তাকে বধ করে স্বর্গ আবার দেবতাদের ফিরিয়ে দেন। সে গল্প সবিস্তারে অন্যদিন করা যাবে। আজকে বলব তারকাসুরের তিন শক্তিমান পুত্র তারকাক্ষ, কমলাক্ষ ও বিদ্যুন্মালীর গল্প।
বাবার হত্যার খবর শুনে তিন ভাই মুষড়ে পড়ে। তবে, তারা ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিদ্যুন্মালী অমরত্বের বর পাওয়ার জন্য ব্রহ্মার তপস্যা শুরু করলে তার দেখাদেখি বাকি দুই ভাইও সবকিছু ছেড়েছুড়ে তার সাথে তপস্যায় যুক্ত হয়। কখনও এক পা তুলে, কখনও উল্টো হয়ে মাথা নিচের দিক পা উপরের দিকে দিয়ে, কখনও শুধু বাতাস ভক্ষণ করে রোদ, বৃষ্টি, শীত সয়ে তিন ভাই ব্রহ্মদেবের ঘোর তপস্যা করে। সহস্র বছর তপস্যার পরে ব্রহ্মা তাদের সামনে প্রকট হয়ে বলেন,
“পুত্রগণ, আঁখি খোল। তোমাদের তপে আমি অতি প্রসন্ন। এবার আমায় বলো তো, কী বাসনায় এতদিন ডাকলে আমায়।”
তারা ব্রহ্মদেবকে দেখে প্রণাম-নমস্কার সেরে অমরত্বের বর চাইলে ব্রহ্মদেব তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অন্য কিছু চাওয়ার সুযোগ দিলে তারা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে এক অদ্ভুত বর প্রার্থনা করে। তারা বলে,
“যদি অমরত্ব না পাই, তবুও মনে দুঃখ নাই। প্রভু, তবে এমন এক শক্তিশালী দুর্গের বর দিন, যেটির ভেতর থাকলে আমরা পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকব এবং যেটি কারো অস্ত্রেই নষ্ট হবে না।”
ব্রহ্মা এবারও অপারগতা প্রকাশ করলে তারা বরে কিছুটা সংশোধনী আনে। এবার তারা বলে, দুর্গ তিনভাগে, অর্থাৎ স্বর্গ, মর্ত্য ও আকাশে বিভক্ত থাকবে। একমাত্র শিবই সে দুর্গ ধ্বংস করতে পারবেন। তবে সেটি তাকে করতে হবে একটিমাত্র তীর নিক্ষেপ করে। ব্রহ্মদেব ‘তথাস্তু’ বলে ময়দানবকে সেখানে ডেকে পাঠান। ময় অসুরদের প্রকৌশলী। সে তার মায়া ও সূক্ষ্ম প্রকৌশলের জন্য বিখ্যাত। মায়াবী ময়দানব মায়াবলে যেকোনো কিছু নির্মাণ করতে পারে। সে আসার পর ব্রহ্মা তাকে তারকাসুরের তিন পুত্রের জন্য অদ্ভুত তিনটি দুর্গ নির্মাণের নির্দেশ দিয়ে অন্তর্হিত হন।
ময়দানব সোনা, রূপা ও লোহা দিয়ে তিনটি দুর্গ নির্মাণ করে সেগুলো তিন জায়গায় স্থাপন করে। লোহা দিয়ে নির্মিত দুর্গটি মর্ত্যে, রূপা দিয়ে নির্মিত দুর্গটি আকাশে এবং সোনা দিয়ে নির্মিত দূর্গটি স্বর্গে স্থাপন করা হয়। বিদ্যুন্মালী, কমলাক্ষ ও তারকাক্ষ যথাক্রমে লোহা, রূপা ও সোনার দুর্গের দখল গ্রহণ করে। এ তিনটি দুর্গকে একত্রে বলা হয় ত্রিপুর।
দুর্গের ভেতর নদী-নালা খনন করা হয়, বাজার বসানো হয়, শহর স্থাপন করা হয়। গন্ধর্বগণ এসে সেখানে গান গাইত, অপ্সরাগণ এসে নৃত্য পরিবেশন করত। মনোরঞ্জনের সমস্ত ব্যবস্থাই করা হয়। এমনভাবে দুর্গগুলো সাজানো হয়, যাতে কোনোকিছুর জন্য বাইরে আসার প্রয়োজন না পড়ে। ত্রিভুবনে যেখানে যত অসুর-রাক্ষস ছিল, সবাইকে দুর্গে এসে থাকার আহ্বান করা হয়। ধীরে ধীরে সব অসুর এসে তিনটি দুর্গে জড়ো হতে থাকে। ত্রিপুর অসুরে ভরে যায়।
অসুরদের অত্যাচারে স্বর্গে দেবতারা, মর্ত্যে মানুষেরা, আকাশে পাখিরা অতিষ্ঠ হয়ে সবাই একসাথে বিষ্ণুর কাছে যায়। বিষ্ণু সব শুনেটুনে সবাইকে বলেন,
“অসুরেরা তোমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করলেও ওরা কিন্তু ধর্ম-কর্ম ছেড়ে দেয়নি। ওরা সবাই শিবের পূজো করে। সারাদিন একে-ওকে নাড়িয়ে-ঘাঁটিয়ে সন্ধ্যায় ঠিকই শিবলিঙ্গে বেলপাতা চড়ায় ব্যাটারা। তাই ওদের পাপ ধুয়ে যায়। ওদের এ সময় মারাটাও অন্যায় হবে। ওদের আগে ধর্ম থেকে সরিয়ে আনতে হবে তারপর প্রহার করতে হবে।”
সবার শুকনো মুখে হাসির ঝিলিক দেয়। নারায়ণের কথায় সবাই আশার আলো দেখতে পায়। বিষ্ণু আরো বলেন, “ভেবো না। ওদের ধর্ম থেকে সরিয়ে আনার কাজটি আমিই করব”। বিষ্ণু তখন একটি মায়াময় মানবাকৃতি সৃষ্টি করে সেটিতে প্রাণ সঞ্চার করেন। মায়াময়ের মাথা ছিল ন্যাড়া, গায়ে মলিন কাপড়, হাতে কাঠের কমণ্ডুলু। বিষ্ণু তাকে মায়াশাস্ত্র শিক্ষা দেন। শিক্ষা শেষ হওয়ার পরে তাকে ত্রিপুরে গিয়ে অসুরদের ধর্মচ্যুত করার নির্দেশ দেন। মায়াময় মানবটি যোগীর ঢঙে মর্ত্যের ত্রিপুরের পাশের এক জঙ্গলে গিয়ে আস্তানা গাড়ে। তার সাধনার হম্বিতম্বি, মুখের মিষ্টি বচন ও সদ্ব্যবহারে অসুরদের কেউ কেউ তার কাছে গিয়ে দীক্ষা গ্রহণ করে।
দীক্ষিত অসুরেরা তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়গণকেও দীক্ষাদান করে। মায়াময়ের নাম পুরো ত্রিপুর মহলে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে স্বয়ং বিদ্যুন্মালী এলেন দেখা করতে। তিনি মায়াময়ের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তার কাছে দীক্ষিত হলেন। আকাশ ও স্বর্গের ত্রিপুর রাক্ষসেরাও দীক্ষা নিয়ে গেল এক এক করে। তারপরেই ঘটল অঘটন। তাদের পুজো-অর্চনা দূষিত হয়ে গেল। তারা ধর্ম থেকে সরে এলো। তাদের তপস্যা তখন আর শিব গ্রহণ করলেন না। ত্রিপুর থেকে লক্ষ্মী বিদায় হলেন। অলক্ষ্মী বাসা বাঁধলেন।
এ সুযোগে বিষ্ণু দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে শিবকে ধরলেন, যাতে তিনি একবাণে ত্রিপুর নষ্ট করে দেন। কিন্তু ত্রিপুর যে তিন জায়গায়, এক তীরে সেটি কীভাবে ভেদ করা সম্ভব! তখন ব্রহ্মা বললেন,
“পুষ্যা নক্ষত্রের তিথিতে যখন চন্দ্র ও সূর্য এক রেখায় মিলবে, তখন ত্রিপুর একসাথে মিলবে। আর তখনই এক তীরে সেটি ভেদ করা সম্ভব।”
কয়েকদিন পরেই ছিল সে তিথি। তাই সবার ব্যতিব্যস্ততা ছিল বেশি। শিব বললেন,
“ত্রিপুরকে ভেদ করার মতো তীর কোথায়? রথ কোথায়? আগে সেগুলো তৈয়ার করো। তারপরে আমায় ডেকো।”
তখনই সকল দেবতা মিলে এক অদ্ভুত রথ, ধনুক ও তীর বানিয়ে দিলেন। বিশ্বকর্মা সকলের দেওয়া তেজ ও শক্তি দিয়ে রথটি তৈরি হলো। পৃথিবী হয় রথের দেহ, সূর্য ও চন্দ্র হন রথের দুই চাকা। মেরুপর্বত হয় ধনুক, বাসুকি নাগ হয় ধনুকের অঙ্কুশ। বিষ্ণু হন তীর, অগ্নিদেব তীরের ডগা হতে ইচ্ছা করেন। বায়ুদেবতা নিজের পুরো গতি নিয়ে তীরের ভেতর ঢুকে পড়েন। সকল দেবতাই নিজেদের একটু একটু তেজ রথে, তীর ও ধনুকে দান করেন। রথনির্মাণ হয়ে গেলে ব্রহ্মা রথের সারথীর আসন অলংকৃত করেন। শিব অনেকক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে রথ-ধনু-বাণের দিকে চেয়ে থেকে সেগুলোর বিপুল প্রশংসা করেন।
সবাই একসাথে ত্রিপুরের দিকে এগোতে থাকে। শিব যখন রথে চড়ে যুদ্ধে যাচ্ছেন, তখন শিবের অনুচর ভূতেরা ভয়ংকরভাবে দাঁত খিঁচিয়ে আগে আগে চলতে থাকে। শিবের বাহন নন্দী নামক ষাঁড়কে দেবতারা খেপিয়ে দেন অসুরদের বিরুদ্ধে। সে শিং উঁচিয়ে দৌড়াতে থাকে। অসুর ও দেবতাদের ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হয়। দু’পক্ষেই হাজারে হাজারে সৈন্য মরতে থাকে। শিবের বাহন নন্দীর শিংয়ের আঘাতে বিদ্যুন্মালী নিহত হলে অসুরপক্ষে হতাশা নেমে আসে।
তখন ময়দানব সবাইকে দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করতে বলে। সবাই ভেতরে ঢোকার পরে ময় মায়াবলে সৃষ্ট অমৃত সরোবর থেকে মৃত অসুরদের গায়ে অমৃত ছিটিয়ে দেয়। এতে মৃত সব অসুর দেহে প্রাণ ফিরে পায়। আবার নতুন উদ্যমে অসুরেরা যুদ্ধ শুরু করে। মৃত অসুরদের আবার যুদ্ধক্ষেত্রে দেখে দেবতাদের মাথায় বাজ পড়ে। সবাই আবার বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়। এর মধ্যে শিবের রথের চাকা মাটিতে আটকে যায়। দেবশিবিরে ত্রাহি ত্রাহি শুরু হয়। তখনই বিষ্ণু বিশাল এক ষাঁড়ের রূপ ধরে গুঁতিয়ে শিবের রথের চাকা তুলে দেন।
ষাঁড়রূপী বিষ্ণুর ভয়াবহতা দেখে অসুরেরা ভয় পেয়ে পালাতে শুরু করে। বিষ্ণু দৌড়ে ত্রিপুরে ঢুকে অমৃত সরোবর থেকে সবটুকু অমৃত চুষে খেয়ে ফেললে অসুরেরা আর মৃত অসুরদের জীবিত করতে পারে না। অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে ময়দানব ত্রিপুরকে সমুদ্রের উপর নিয়ে যায়। এদিকে চন্দ্র ও সূর্য পুষ্যা নক্ষত্রে প্রবেশ করা শুরু করলে শিব ধনুকে তীরযোজনা করেন। ময়ের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সময়মতো ত্রিপুরের তিনখণ্ড এক জায়গায় মিলিত হয়।
তীর নিক্ষেপের আগে শিব তার ভক্ত ময়দানবকে রক্ষা করতে নন্দীকে ত্রিপুরের ভেতর ঢুকে ময়কে পালানোর নির্দেশ দিতে বলেন। শিবের আদেশে প্রাণ বাঁচাতে ময়দানব তৎক্ষণাৎ সবকিছু ফেলে ত্রিপুর ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। সময়মতো শিব ত্রিপুরে তীর নিক্ষেপ করলে এক তীরেই পুরো ত্রিপুর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভেতরের সমস্তকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে সেবার শিব দেবতাদের বাঁচিয়েছিলেন। ত্রিপুরকে ধ্বংস করার পরে শিবের একটি নাম হয় ‘ত্রিপুরহন্তা’।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন পুরাণভেদে এসব কাহিনীতে মতান্তর রয়েছে, তাই অমিল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এই লেখাতে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।