ভাগবত পুরাণে রাবণের ভূলোকে জন্মানোর কাহিনীটি বর্ণিত হয়েছে। যেসময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটি ছিল কৃতযুগ। সৃষ্টির আদিযুগ। সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার মানস থেকে চারজন কুমারের জন্ম হয়। এদের কুমার চতুষ্টয় বলা হয়। কুমারগণ হলেন সনক কুমার, সনাতন কুমার, সনন্দন কুমার ও সনৎ কুমার। কুমারগণ ব্রহ্মার সাথে সাক্ষাতান্তে বৈকুণ্ঠধামে ভগবান বিষ্ণুর সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা করেন। বৈকুণ্ঠধামে যাওয়ার পরে সেখানকার দ্বারপাল জয় ও বিজয় তাদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়, কারণ ভগবান বিষ্ণু তাদের বলেছিলেন, যে-ই আসুক, তাকে যেন ঢুকতে দেওয়া না হয়। এ আদেশ দিয়ে বিষ্ণু যোগনিদ্রায় গমন করেন।
কুমারগণ দ্বারপালদ্বয়ের আচরণে রুষ্ট হয়ে তাদের অভিশাপ দেন যে, তারা দুজন তাদের দেবত্ব হারিয়ে ভূলোকে জন্ম নেবে এবং জরা, মৃত্যু, ভয়াদি তাদের গ্রাস করবে। ভগবান বিষ্ণু যোগবলে সব জানতে পেরে ত্বরিত তাদের সামনে এসে মূর্তিমান হলে জয়-বিজয় ভগবানের পায়ে লুটিয়ে কান্না শুরু করে। ভগবান তাদের আশ্বস্ত করেন যে, চিরকালের মতো যেতে হবে না। হরিভক্ত মানে, বিষ্ণুর উপাসক হয়ে ধর্মের পক্ষে জন্ম নিলে সাত জন্ম আর, বিষ্ণুর বিরোধী হয়ে অধর্মের পক্ষে জন্ম নিলে তিন জন্ম ভূলোকে জন্মাতে হবে। তারা দ্বিতীয়টি পছন্দ করে। প্রথম জন্মে দুই ভাই দিতির পুত্র দৈত্যবীর হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু হয়ে জন্ম নেয়। ভগবান বিষ্ণু বরাহ ও নৃসিংহ অবতার নিয়ে তাদের বধ করেন।
পরের জন্মে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ হয়ে জন্মালে ভগবান বিষ্ণু রাম অবতার নিয়ে বধ করেন তাদের। শেষবারে শিশুপাল ও দন্তবক্র রাক্ষস হয়ে জন্মানোর পরে ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণের অবতার ধরে তাদের বধ করেন। তিন জন্ম পার করে জয়-বিজয় পুনরায় বৈকুণ্ঠধামে গমন করে।
রামায়ণে সীতাকে অপহরণের মাধ্যমেই রামের সাথে রাবণের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। রাবণের নারীলোলুপতার কথা সর্বজনবিদিত। সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে গেলেও সীতার শারীরিক অনিষ্টের চেষ্টা করেনি রাবণ। সীতার কাছে প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসতে হয় তাকে। কেউ কেউ বলেন, (বিশেষ করে হিন্দুস্তানী রামায়ণ আখ্যানে প্রচলিত) সীতা রাবণকে শর্ত দেয়, যদি এক বছরের মধ্যে রাম তাকে মুক্ত করতে না আসে, তবে এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরদিনই তিনি রাবণের প্রেম স্বীকার করবেন। তবুও সীতাকে স্পর্শ না করার আরো দুটি কারণ ছিল রাবণের।
দেবতাদের গুরু বৃহস্পতির পুত্র কুশধ্বজের বেদবতী নামীয় একটি অপরূপা গুণবতী কন্যা ছিল। ঋষিপুত্রী বেদবতী প্রাপ্তবয়স্কা হওয়ার পরে ভগবান বিষ্ণুকে স্বামী হিসেবে পেতে কঠিন তপস্যায় লিপ্ত হয়। পুষ্পক বিমান নিয়ে যাওয়ার সময় রাবণের বেদবতীকে মনে ধরে। সে নেমে বেদবতীর কেশগুচ্ছ ধরে টানার চেষ্টা করলে বেদবতী অগ্নিতে আহুতি দিয়ে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করে সাথে রাবণকে অভিশাপ দেয়, আমি পরের জন্মে কোনো রাজর্ষির অযোনিজ কন্যা হয়ে জন্ম নেব এবং তোর মৃত্যুর কারণ হবো রে রাক্ষস!
রাজর্ষির অর্থ, যিনি কর্মে রাজা ও স্বভাবে ঋষি। আর অযোনিজ অর্থ, যার জন্ম কোনো নারীর যোনি বা গর্ভ থেকে হয়নি। জেনে রাখা ভালো, সীতার পিতা মিথিলার রাজা জনক ছিলেন একজন রাজর্ষি এবং সীতার জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর গর্ভ থেকে। তাই, সীতার আরেক নাম ‘ভূমিজা’। সীতাকে শোকে রাম কাতর ও হতাশ হয়ে পড়লে মহামুনি অগস্ত্য এসে রামের কাছে সীতার জন্মান্তরের কাহিনী শোনান এবং রামের মনোবল বাড়ান।
পরের কারণটি ছিল রম্ভা নামীয় এক অপ্সরা। সমুদ্রমন্থনে অপ্সরাদের জন্ম হয়েছিল। তারা সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় পটু ছিলেন। স্বর্গসভায় নেচে-গেয়ে দেবতাদের আনন্দদানই ছিল তাদের ধর্ম। রম্ভা কুবেরের পুত্র নলকুবেরকে ভালোবাসত। নলকুবেরের কাছে যাওয়ার সময় রাবণ তাকে ধর্ষণ করলে নলকুবের তাকে অভিশাপ দেয় যে, কোনো নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে রাবণের মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হবে।
রাবণ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের অনেক লোকের সাথে যুদ্ধ করেছেন। অনেককাল কালে রাবণ উষীরবীজ নামক এক জায়গায় মরুত্ত নামক এক রাজার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। রাজা সেখানে যজ্ঞ করছিলেন। মরুত্ত রাজার সে যজ্ঞে দেবতারাও উপস্থিত ছিলেন। রাবণের সাথে মরুত্তের যুদ্ধের উপক্রম দেখে একেক দেবতা একেক প্রাণীর রূপ ধরে লুকিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচান। ইন্দ্র হন ময়ূর, যম ধর্মরাজ হন কাক, কুবের হন গিরগিটি আর বরুণ হন হংস। ঋষিদের অনুরোধে যজ্ঞের স্বার্থে মরুত্ত রাবণের কাছে পরাজয় স্বীকার করলে রাবণ খুশি হয়ে সে স্থান ত্যাগ করেন। রাবণ গেলে দেবতারা আবার তাদের স্ব স্ব রূপে ফিরে আসেন। যে দেবতা যে জন্তুর বেশ ধরেছিলেন, সে দেবতা সেই জন্তুকে একেকটি বর দেন। ইন্দ্র ময়ূরকে বলেন,
“তোমার আজ থেকে সাপের ভয় থাকবে না। আমার যেমন হাজারটি চোখ, তোমার লেজেও তেমনি হাজার চোখ হবে।”
ধর্মরাজ কাককে বর দিলেন,
“হে কাক, তোমার কোনো অসুখ হবে না। রোগবালাইয়ে তোমার মরণ নাই, যদি না মানুষ তোমায় মারে।”
বরুণদেব হাঁসকে বললেন, “তোমার গায়ের রং ধবধবে সাদা হোক।”
কুবের গিরগিটিকে বললেন, “তোমার মাথা সোনার মতো হোক।”
রাবণ দুষ্মন্ত, গাধি, সুরথ, গয়, পুরূরবার মতো রাজাদের যুদ্ধ করে হারিয়ে দিলেন একে একে। চারশো কালকেয় দানবকে হারানোর পরে বরুণের পুত্রদেরও হারিয়ে দেন রাবণ। সমুদ্রে প্রবেশ করে প্রথমে নাগদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের হারিয়ে দেন। পরে নিবাতকবচ নাম্নী এক দৈত্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। নিবাতকবচও ব্রহ্মার বরে অজেয় ছিলেন, তাই, স্বয়ং ব্রহ্মা সেখানে এসে মধ্যস্থতা করেন। পরে নিবাতকবচের সাথে রাবণের সখ্য স্থাপিত হয়। দৈত্যের থেকে রাবণ বহুবিধ মায়াবিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন।
একবার রামের পূর্বপুরুষ অযোধ্যার রাজা অনরণ্যের সাথে ভয়ানক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। অনরণ্য যুদ্ধে পরাজিত হলেও মৃত্যুর পূর্বে রাবণকে অভিশাপ দেন যে, তার বংশেরই কোনো উত্তরপুরুষের হাতে যেন রাবণের অন্ত হয়। রাবণ মায়ের দিক থেকে রাক্ষস হলেও পিতার দিক থেকে ব্রাহ্মণ ছিলেন। চার বেদ ও ছয় শাস্ত্রের মহাপণ্ডিত ছিলেন। বিভীষণ রাবণকে ‘বেদান্তবিদ, অগ্নিহোত্রী, মহাতপস্বী, যাগযজ্ঞে পারদর্শী’ বলে উল্লেখ করেছেন। শিব-পার্বতীর বিয়ের পুরোহিত ছিলেন রাবণ। সীতার খবর আনতে রাম হনুমানকে লঙ্কায় পাঠালে হনুমান রাবণের রাজসভায় গিয়ে হাজির হন। প্রথম দর্শনে রাবণকে দেখে অতিশয় মুগ্ধ হন তিনি। তিনি বলেন,
“অহো রূপমহো, ধৈর্যমহো সত্ত্বমহো দ্যূতি অহো রাক্ষসরাজস্য সর্বলক্ষণ যুক্ততা।”
অর্থাৎ,
“আহা! কী মহৎ রূপ, মহৎ ধৈর্য, মহৎ পরাক্রম; আহা! রাক্ষসরাজ সর্বলক্ষণযুক্ত।”
(রামায়ণ, সুন্দরকাণ্ড – ৪৯ : ১৭)
হনুমান একইসাথে রাবণের খারাপ গুণগুলোর কথাও উল্লেখ করেছেন। অহংকার, কামুকতাই রাবণের পতনের মূল। হনুমান বলেছেন, এই খারাপ গুণগুলো না থাকলে রাবণ দেবতাদেরও রাজা হতেন।
রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে রাবণবধের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। রাবণ নিজের অমরত্বকে পুরোপুরি পাকাপোক্ত করতে শিবের আরাধনা শুরু করেন। শিব এসে তার নাভিকূপে অমৃত স্থাপন করে দেন। অমৃত ধারণ করে রাবণ আরো অহঙ্কারী হয়ে ওঠেন। মৃত্যুদেবতার কাছ থেকে রাবণ তার মৃত্যুবাণটি নিয়ে এসে প্রাসাদের একটি মজবুত শিলাস্তম্ভের ভেতর সেটি লুকিয়ে রাখেন। এ কথা একমাত্র জানতেন তার স্ত্রী মন্দোদরী।
রাবণকে বধ করতে রামের খুব বেগ পেতে হয়েছিল। রাম অকালবোধন করেন। অর্থাৎ, অসময়ে দেবী দূর্গার পূজো করেন। বিভীষণ রামকে রাবণের মৃত্যুবাণটির ব্যাপারে বললেও সেটি প্রাসাদের কোথায় লুকোনো আছে, তা বলতে পারলেন না।
সম্মুখসমরে যখন হারানো যাচ্ছিল না, তখন রাম হনুমানকে রাবণের অন্দরমহলে পাঠান রাবণের লুকিয়ে রাখা মৃত্যুবাণটি নিয়ে আসতে। হনুমান এক জ্যোতিষীর বেশে অন্দরে ঢুকে মন্দোদরীকে বললেন,
“শোন মা, কোনোকিছুর লোভেই যেন তুই তোর স্বামীর মৃত্যুবাণের অবস্থান কাউকে বলিস না। আর, বিভীষণের ব্যাপারে সাবধান থাকিস। ও ব্যাটা তো রামের পক্ষে। রামকে না জানি কত কী বলে দিয়েছে এতক্ষণে!”
জ্যোতিষীর হিতাকাঙ্ক্ষার আধিক্যে মন্দোদরী আর ঝোঁক সামলাতে পারলেন না। একটি স্তম্ভ দেখিয়ে দিয়ে জ্যোতিষীরূপী হনুমানকে বললেন,
“তব আশীর্বাদে তাহা কে লইতে পারে,
রেখেছি জড়িত ঐ স্তম্ভের ভেতরে।”
হনুমান তখনই নিজরূপে আবির্ভূত হয়ে সেটি ভেঙে মৃত্যুবাণটি নিয়ে রামচন্দ্রকে দিলেন। পরদিন যুদ্ধে রাম সেই হংসমুখী বাণটি তার ধনুকে যোজনা করে বিভীষণের পরামর্শে রাবণের নাভি বরাবর নিক্ষেপ করলেন। নাভি চিরে অমৃত বেরিয়ে আসার পরে রাবণ প্রাণত্যাগ করেন। রাবণের প্রাণত্যাগের পূর্বে একটি ঘটনা ঘটে। রাবণের ভেতর যত রাক্ষসোচিত গুণ থাকুক না কেন তিনি ছিলেন দক্ষ রাজ্যশাসক। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিও ছিল অনেক ভারী। রাবণের মৃত্যুর পূর্বে রাম তাকে রাবণের কাছে পাঠান রাবণের থেকে বিভিন্ন বিষয়ে কিছু উপদেশ ও পরামর্শ নেওয়ার জন্য। লক্ষ্মণ স্বভাবে ছিলেন একটু রাগী। তিনি এসে যুদ্ধক্ষেত্রে পরে থাকা রাবণের মাথার দিকে বসে রাবণকে বলেন, “হে রাক্ষসরাজ, আমাকে ভ্রাতা রাম পাঠিয়েছেন আপনার থেকে কিছু উপদেশ নেওয়ার জন্যে। আপনার সারা জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমায় কিছু উপদেশ দান করুন।”
লক্ষ্মণের কথায় রাবণ কোনো সাড়াশব্দ করেন না। চুপচাপ মাটিতে অন্যদিকে চেয়ে পড়ে থাকেন। এতে লক্ষ্মণ রেগে চলে যায়। রামের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলার পরে রাম লক্ষ্মণের ওপর কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বলেন, “এটি তোমার উচিত হয়নি, ভ্রাতা। রাবণ ছিলেন একজন রাজা। আর তুমি গিয়ে তার মাথার কাছে বসেছিলে। এতেই, তিনি অপমানবোধ কর মুখ বুজে ছিলেন। এবার গিয়ে পায়ের কাছে বসবে।”
রামের কথামতো এবার লক্ষ্মণ রাবণের পায়ের কাছে বসে উপদেশ প্রার্থনা করলে রাবণ তাকে কিছু উপদেশ প্রদান করেন। রাবণের সে বাণীগুলো ‘রাবণ-গীতা’ নামে প্রসিদ্ধ হয়।
রাবণের দশটি মাথা সত্যিই রক্ত-মাংসের মস্তক, না কি অন্যকিছু- সেটি নিয়ে মতপার্থক্য দেখা যায়। জৈন ও বৌদ্ধ পুরাণমতে, রাবণের দশটি মাথা আসলে রক্ত-মাংসের মাথা নয়। এটি বরং রূপকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পুরাণানুযায়ী রাবণের দশ মাথা মানবচরিত্রের দশটি মন্দ গুণকে নির্দেশ করে- ১) অহমিকা, ২) মোহ, ৩) অনুতাপ, ৪) ক্রোধ, ৫) ঘৃণা, ৬) ভয়, ৭) হিংসা, ৮) লোভ, ৯) কাম, ও ১০) জড়তা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন পুরাণভেদে এসব কাহিনীতে মতান্তর রয়েছে, তাই অমিল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এই লেখাতে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।