ধর্মের ইতিহাসে মহাপ্লাবন অন্যতম আকর্ষণ। আদি সৃষ্টির আখ্যানের ঠিক পরেই মানুষ সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছে একটা মহাপ্লাবনের কথা। শুধু আব্রাহামিক ধর্মগুলো না; প্রত্যেকটা ধর্ম পৃথকভাবে বর্ণনা করেছে এর স্মৃতি। সাধারণত দেবতা বা এক পরম স্রষ্টা পৃথিবীতে স্থিত সভ্যতাকে নির্মূল করার জন্য মহাপ্লাবনের কলকাঠি নাড়ান। সে হিসেবে একে বরং খোদায়ী প্রতিশোধ বলা যেতে পারে।
উপকথায় পানি বলতে আদিম বিশৃঙ্খলাকে ইঙ্গিত করা হয়। নিঃসীম ও নিশ্চল পানির মধ্য দিয়েই সৃষ্টিপ্রক্রিয়া শুরু। মিশরীয় পুরাণে নু ছিল সেই সৃষ্টিপূর্ব স্থবির অবস্থা। সৃষ্টিতত্ত্বে পানির প্রসঙ্গ তাই সম্ভাবনা অর্থেই আসে। আর প্লাবনের পানি এসেছে মানুষের বাড়াবাড়ির কারণে বিশ্বব্যবস্থাকে আদিম অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। সৃষ্টিকে পরিচ্ছন্ন করে পুনরায় সৃষ্টির প্রস্তুতি এটি। এ ধরনের প্রায় সব মিথেই একজন নায়ক থাকে। বিশেষ অনুসারী বা পরিশুদ্ধ পুরুষদের বাঁচানোর জন্য তার প্রচেষ্টা টিকে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্মে।
সুমেরিয় সৃষ্টিতত্ত্ব
আধুনিক পণ্ডিতেরা সুমেরিয় মহাপ্লাবনের পুরাণকে আখ্যা দেন এরিদু জেনেসিস নামে। ১৮৯৩ সালে নিপপুর নগরের ধ্বংসস্তূপে আবিষ্কৃত হওয়া এই ফলক এখন অব্দি উদ্ধারকৃত সবচেয়ে পুরাতন মেসোপটেমিয় নিদর্শন। কেন্দ্রীয় চরিত্র সুরুপপাক নগরের যাজক রাজা জিশুদ্র। সুরুপপাক শব্দের অর্থ ‘দীর্ঘ দিনের জীবন’।
১৭৯২-১৭৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বিখ্যাত রাজা হাম্মুরাবির উত্থানের যুগ অব্দি এই ধর্মবিশ্বাসই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। দেবতা আন, এনলিল, এনকি এবং নিনহুরসাগ পৃথিবী সৃষ্টি করেন। বসবাসযোগ্য পৃথিবীতে তৈরি করেন মানুষ এবং নানা ধরনের প্রাণী। প্রতিষ্ঠা করেন নগর ও বন্দর। প্রতিষ্ঠিত প্রথম নগরী এরিদু। কিন্তু মানুষ শীঘ্রই অপরাধ, অন্যায় আর কোলাহলে নোংরা করে তুললো পৃথিবী। শান্তি আর বিশ্রামের স্বার্থেই দেবতা এনলিল দুনিয়া থেকে কিছু মানুষ কমানোর ইচ্ছা করলেন। একের পর এক পাঠালেন খরা আর মহামারী। প্রতিবার জ্ঞানের দেবতা এনকি বাঁচিয়ে দেন। এনলিল এবার মহাপ্লাবনের পরিকল্পনা করলেন। তার আগেই অন্য দেবতাদের থেকে ওয়াদা নেওয়া হয়েছিল; কেউ কারো কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। সুতরাং ভিন্ন পথে হাঁটলেন এনকি। সরাসরি মানুষকে না সাহায্য করে দেয়ালের আড়াল থেকে উপায় বাতলে দিলেন। অন্যপাশ থেকে শুনলো যাজক রাজা জিশুদ্র।
পরিকল্পনা অনুসারে একটা লম্বা নৌকা তৈরি করলো জিশুদ্র। তাতে উঠালো মানুষ আর পশুপাখি। যথা সময়ে প্লাবন এলো। সাত দিন সাত রাত ধরে অঝোর বৃষ্টি। তামাম পৃথিবী তলিয়ে গেল পানির নিচে। আকাশ শান্ত হলে জিশুদ্র নৌকা থেকে নেমে কোরবানি করলো সূর্যদেবতা উতু শামাশের উদ্দেশ্যে। আন আর এনলিল নিজেদের হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত হলেন। মানবজাতি রক্ষার জন্য জিশুদ্রকে দেয়া হয় দিলমুন নামের স্বর্গে।
আত্রাহাসিস আখ্যান
আক্কাদিয় মহাকাব্য আত্রাহাসিস লেখা হয় খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তদশ শতকের দিকে। তখন হাম্মুরাবির বংশধর আমি-সাদুকা (১৬৪৬-১৬২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ক্ষমতায় আসীন। আত্রাহাসিস শব্দের অর্থ প্রগাঢ় জ্ঞানী।
পৃথিবী সৃষ্টির বহু পর। প্রবীণ দেবতারা প্রায়শ নানা ফরমায়েশে পৃথিবীতে ব্যস্ত রাখতেন নবীন দেবতাদের। তাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদী খনন শেষ হলে নবীনরা আর মানতে পারল না। জ্ঞানের দেবতা এনকি দুনিয়ার কাজ করার জন্য নতুন কাউকে সৃষ্টির পরামর্শ দিলো। দেবতা গেশতুও সে নিমিত্তে উৎসর্গ করলো নিজের জীবন। দেবী নিন্তু মৃতের রক্ত, মাংশের সাথে মাটি মিশিয়ে তৈরি করলো সাতজন পুরুষ এবং সাতজন নারী। দেবতারা কিছুটা আয়েশি জীবন পেলো সত্য। কিন্তু খুব শীঘ্রই কোলাহল, বিবাদ আর অনাচারে ভরে উঠলো পৃথিবীর মাটি। দেবরাজ এনলিল সিদ্ধান্ত নিলো কিছু মানুষকে ছাটাই করার।
খরা, মহামারি এবং দুর্ভিক্ষের পরিকল্পনা হলো। প্রত্যেকবার এনলিল দুর্ভাগ্য নির্ধারণ করে; আর জ্ঞানের দেবতা এনকি বের হবার রাস্তা বলে দেয় মানুষকে। এনলিল দেবতালয়ে মানবজাতির জন্য মহাপ্লাবন প্রেরণে সিদ্ধান্ত পাশ করায়। প্রত্যক্ষভাবে না জড়িয়ে এনকি সতর্ক করে দেয় প্রিয় ভক্ত আত্রাহাসিসকে। প্লাবন শুরু হলো বুনো জন্তুর মতো। চারিদিক নিঃসীম অন্ধকারে ঢেকে গেলো সব। মানুষের দুরবস্থায় দেবতারা অব্দি কেঁদে উঠলেন। কিন্তু পরিস্থিতি শোধরানোর কোনো উপায় নেই। হঠাৎ দেখা গেলো নৌকা। মানুষ আর প্রাণীদের নিয়ে নোঙর করলো আত্রাহাসিস। বলি দিলো দেবতাদের উদ্দেশ্যে। উল্লসিত দেবতারা সাদরে বরণ করলো মানব জাতির বাঁচার প্রচেষ্টা। আত্রাহাসিস স্বর্গে গেলো। দুনিয়ায় নতুন করে আবাদ শুরু করলো মানুষ।
গিলগামেশ মহাকাব্য
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দেরও আগে লিখিত হয়েছে গিলগামেশ মহাকাব্য। কাহিনী আবর্তিত হয়েছে রাজা গিলগামেশকে কেন্দ্র করে। সুমেরিয় রাজাদের তালিকায় তাকে উরুকের রাজা হিসেবে বর্ণনা করা আছে। রাজত্ব করেছে ১২৬ বছর। জ্ঞান, শক্তি আর আধিপত্যে গিলগামেশ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অথচ সময়ের ব্যবধানে অত্যাচারী হয়ে ওঠে। প্রজাদের প্রার্থনার জবাবেই দেবতারা গিলগামেশের সাথে দেখা করিয়ে দিলো এনকিদুর। কিন্তু একবারের বেশি সংঘাত হলো না। পরস্পর পরিণত হয় বন্ধুতে। পরবর্তীতে দুর্ঘটনায় মারা যায় এনকিদু। শোকে মূহ্যমান গিলগামেশ অমরত্বের উপায় খুঁজতে থাকে। সেই উপলক্ষ্যেই দেখা উতনা পিশতিমের সাথে।
উতনা পিশতিম থাকতো ইউফ্রেটিসের তীরে সুরুপপাক নগরীতে। দেবতা আনু, এনকি, এনলিল মানুষের পাপে ক্রুদ্ধ। জারি করা হলো মহাপ্রলয়। দেবতা ইয়া সেই খবর আগেই জানিয়ে দিলো উতনা পিশতিমের কাছে। তামাম পৃথিবী ডুবে যাচ্ছে। উতনা পিশতিম ইয়ার নির্দেশে তৈরি করলো বিশাল নৌকা। উঠালো প্রিয় মানুষ, পশুপাখি আর সব ধরনের জীবন্ত প্রজাতি। বাকি দুনিয়া লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল ঝড় আর প্লাবনে। ঢেকে দিলো প্রবল অন্ধকার। দীর্ঘদিন পর পরিবেশ শান্ত হলে নৌকা এক পাহাড়ে নোঙর করলো।
নৌকা থেকে নেমে দেবতাদের উদ্দেশ্যে কোরবানি করলো উতনা পিশতিম। মৃত্যুকে জয় করার সক্ষমতায় স্ত্রীসহ তাকে রাখা হলো অনেক দূরে দুই নদীর মোহনায়। গিলগামেশের সাথে সেখানেই তার দেখা হয়।
আব্রাহামিক ঐতিহ্য
বাইবেল অনুসারে নোয়াহ সৎকর্মশীল নবী। দুনিয়ায় মানুষের মধ্যে অত্যাচার এবং অনাচার বৃদ্ধি পেলে এলোহেম নোয়াহকে একটা নৌকা তৈরির নির্দেশনা দেন। সিদ্ধান্ত নেন সকল কিছু ধ্বংস করার (জেনেসিস: ৬:৫-৭)। সময়মতো স্ত্রী-পুত্র এবং ঈশ্বরের অনুসারীদের নৌকায় উঠালেন নোয়াহ। তুললেন সকল জীবিত প্রাণীদের এক জোড়া করে।
প্রতিশ্রুত মুহূর্ত এলো। ভূপৃষ্ঠ ভেদ করে উঠলো পানি; ঝরলো আকাশ থেকে। ডুবে গেলো পৃথিবীর সবচেয়ে উচু পর্বতও। নৌকায় আশ্রয় না পাওয়া প্রত্যেকটা প্রাণী জীবনের ইতি ঘটেছে। পানি কমতে শুরু করে দেড়শো দিন পর থেকে। নোয়াহ তার নৌকা নোঙর করলো আরারাত পর্বতে। ভূমির অবস্থা জানতে একটা ঘুঘু ছেড়ে দিলো। প্রথম দফায় ব্যর্থ হয়ে ফিরলেও সাতদিন পর শুকনো মাটির সন্ধান দিতে পারলো ঘুঘুটা। পৃথিবী আবাদের জন্য নৌকা থেকে নামলেন নোয়াহ। নামলো সকল জীবিত প্রাণী। ঈশ্বর নিজে প্রতিশ্রুতি দিলেন দ্বিতীয় দফায় আর প্লাবন না দিতে (জেনেসিস ৮:২০-২২)।
ওল্ড টেস্টামেন্টের বিবৃতির বাইরে এসে খ্রিষ্টধর্মেও নোয়ার মহাপ্লাবনকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তার প্রমাণ গসপেল অভ ম্যাথু ২৪:৩৭-৩৯ এবং গসপেল অভ লুক ১৭:২৬-২৭ এর বয়ান। খ্রিষ্টধর্মের কোনো কোনো পণ্ডিত নোয়াহর নৌকাকে খ্রিষ্টের মাধ্যমে প্রতীকায়িত করেন। যীশুই পরকালীন মুক্তির মাধ্যম। অবশ্য কেউ কেউ প্লাবনের পানিকে ব্যাপ্টিজমের সাথে তুলনা করেন। মহাপ্লাবনের পর যেমন পৃথিবী নতুন করে জন্ম নিলো; অনুরূপ ব্যাপ্টিজমের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি নতুন করে জন্ম নেয়।
নুহ (আ.)-কে প্রভাবশালী নবী (আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত বা নির্বাচিত বিশেষ ব্যক্তি) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে কোরানের ৩:৩৩, ১৭:৩, ৩৭: ৭৫-৭৯ আয়াতের মতো বহু জায়গায়। আছে নুহ নামে এক স্বতন্ত্র সূরা। আল্লাহর একত্ববাদের প্রচারক নুহের সময় মানুষ অতিমাত্রায় অবাধ্য আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হয়ে ওঠে। একটা শিক্ষা দেবার সিদ্ধান্ত নেন আল্লাহ। নুহকে আদেশ দেয়া হয় বিশাল নৌকা বানানোর। সম্প্রদায়ের নেতারা কাণ্ড দেখে বিদ্রুপ করতে থাকে। তবুও অটল থাকলেন নুহ (আ.)। সমস্ত প্রাণীর এক জোড়া করে উঠালেন নৌকায়। শুরু হলো মহাপ্লাবন। নুহের পুত্র সহ সকল অস্বীকারকারী মৃত্যুবরণ করলো ডুবে। চল্লিশ দিন পরে জুদি পর্বতে নোঙর করলো নৌকা।
ভারতীয় পুরাণ
শতপথ ব্রাহ্মণ, পুরাণ এবং মহাভারতে মহাপ্লাবনের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে প্রাচীন ভারতীয় ধর্মের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে। একটা বড় মাছ একবার এক ছোট মাছকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত হয়। মনু ছোট মাছটাকে কেবল রক্ষাই করলো না; বিশালাকার হওয়া অব্দি দেখভাল করলো। ঠিক তখনই মাছটা আবির্ভূত হলো বিষ্ণুর রূপে।
সময়ের ব্যবধানে সমাগত হলো মহাপ্লাবন। বিষ্ণু মনুকে আগে থেকে জানিয়ে দিলেন সম্ভাব্য বিপদ। পরামর্শ দিলেন বিশালাকার নৌকা প্রস্তুতির। নৌকা প্রস্তুত করলো মনু। নিজের পরিবার এবং বিখ্যাত সাত ঋষিকে নিয়ে ভাসলেন নৌকায়। বেঁচে থাকলো নতুন করে পৃথিবীকে আবাদ করার জন্য। মানব বলতেই মূলত মনুর বংশধরকে বুঝায়।
এই মিথকে আক্ষরিক কিংবা রূপক হিসেবে পাঠ করা যায়। বড় মাছের ছোট মাছ খেয়ে ফেলার অর্থ সমাজের ক্ষমতাশালীর দ্বারা দুর্বলদের উপর জুলুম। মনু এমন এক রাজা; যিনি দুর্বলদের অধিকার নিশ্চিত করেছিল। পরিণামে দেবতা বিষ্ণু তাকে পরবর্তী পৃথিবীর বিশৃঙ্খলা থেকে উদ্ধার পাবার পথ বাতলে দেন।
চীনা উপকথা
কুন উ উপকথা নামে পরিচিত চৈনিক মহাপ্লাবনের বয়ান অনেক দিক থেকেই বিশেষত্বপূর্ণ। অন্যান্য সংস্কৃতিতে বন্যাকে দেবতা বা পরম স্রষ্টার ক্রোধ হিসেবে পাওয়া গেলেও চীনা উপকথায় প্রাকৃতিক ঘটনা হিসাবেই বর্ণিত। ঘটনার আমেজও অনেক বেশি ইহলৌকিক।
সম্রাট ইয়াও এর আমলে ঘটে মহাপ্লাবন। উপায় না দেখে চার পর্বতের কাছে উপদেশ চায় সম্রাট। তারাই জ্ঞানী কুনের খবর দেয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কুনকে দায়িত্ব দেয়া হলো। দায়িত্ব পেয়ে এক ফন্দি আটলো কুন। পরম দেবতার কাছে থেকে শিরাং অপহরণ করতে হবে। শিরাং হলো নিজে থেকে বৃদ্ধি হতে থাকা মাটি। ক্রমে সেই মাটি দিয়ে নির্মিত হতে লাগলো বাঁধ। তারপরেও বন্যায় উপরে গেলো সব। নয় বছর পর লজ্জায় সরে দাঁড়ালেন সম্রাট ইয়াও। চার পর্বতের উপদেশে সহসম্রাটের দায়িত্ব দেয়া হলো শুন-এর উপর। কুন তখনো ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আরো চার বছর পরও দেখা গেলো, পানি কমার নাম নেই।
কুনের ব্যর্থতায় শুন বিরক্ত হলেন। তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে নিয়োগ দিলেন তারই পুত্র উ কে। নতুন বুদ্ধি উদ্ভাবন করলো উ। শুরু করলো পানি নিষ্কাশনের জন্য খাল তৈরি। নদীগুলোর পথ ঘুরিয়ে দিলো সমুদ্রের দিকে। পিতার কাছে অসম্ভব কাজটা তার কাছে এসে সম্ভব হলো। একটু ভিন্ন সংস্করণে পাওয়া অন্য মিথগুলোর সিদ্ধান্তও মোটামুটি এক।
গ্রীক বিবরণী
জিউসকে না জানিয়ে স্বর্গ থেকে আগুন আনার দায়ে ককেশাসের পর্বতে প্রমিথিউসকে বেঁধে রাখা হয়। প্রতিদিন বিশাল এক ঈগল তার বুকে বসে কলিজা ঠুকরে খেতো। রাতের অবসরে গজিয়ে উঠা কলিজার নিয়তিতে পরের দিন ঈগলের নিষ্ঠুর ঠোকর। এভাবে চলতে থাকে হেরাক্লিসের আগমন অব্দি। সেই বীর তাকে মুক্ত করে।
প্রমিথিউসের পুত্র ডিউক্যালিয়ন এবং পুত্রবধু পিরহা। পিরহা আবার প্রমিথিউসের ভাই এপিম্যাথিউস এবং প্যান্ডোরার কন্যা। ব্রোঞ্জ যুগে জিউস মানুষের কর্মে বিরক্ত হয়ে ধ্বংস করে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। পুত্র ডিউক্যালিয়নকে একটা নৌকা তৈরির নির্দেশনা দেয় প্রমিথিউস। যথাসময়ে মহাপ্লাবন শুরু হলো। আকাশ ভেঙে পড়লো বৃষ্টি। ধ্বংস হলো মানুষ আর জীবিত সকল সত্তা। নয় রাত নয় দিন ভাসতে ভাসতে নৌকা গিয়ে পৌঁছালো পার্নাসাসে। কোনো বর্ণনায় অবশ্য থেসালির ওথ্রিস পর্বতের কথা আছে। যাহোক, ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে। ডিউক্যালিয়ন মাটিতে নেমে জিউসের উদ্দেশ্যে কোরবানি করলো। জিউসও স্বীকৃতি দিলো তাদের।
জিউসের আদেশে তারা দুজনেই পেছনে পাথর ছুড়ে মারে। ডিউক্যালিয়নের ছুড়ে মারা পাথরেরা পুরুষ আর পিরহার ছুড়ে মারা পাথরেরা নারীতে রূপান্তরিত হলো। এজন্যই মানুষকে রূপকভাবে লায়স বা পাথর বলা হয়। পিরহা আর ডিউক্যালিয়নেরও সন্তান ছিল। প্রথম কন্যা হেলেনের নাম অনুসারেই গ্রীকদের ‘হেলেনীয়’ অভিধা দেয়া হয়ে থাকে।
আইরিশ কিংবদন্তী
লেবর গ্যাবালা অনুসারে, আয়ারল্যান্ডে প্রথম পা রাখে কাসিয়্যার। নোয়াহর পুত্র বিথ আর বিথের কন্যা এই ক্যাসিয়্যার। মহাপ্লাবনের আগে তাদের পশ্চিম দিকে পালিয়ে যাবার উপদেশ দেয়া হয়। তিনটা নৌকা প্রস্তুত করে রওনা হলেও পথিমধ্যে দুইটা হারিয়ে যায়। মহাপ্লাবনের চল্লিশ দিন পূর্বে ক্যাসিয়্যার আর তার লোকজন পৌছায় আয়ারল্যান্ডের মাটিতে। ক্যাসিয়্যার বাদে আরো ঊনপঞ্চাশ জন নারী এবং তিনজন পুরুষ। নারীরা বিভাজিত হয়ে পুরুষদের সাথে মিলিত হয়। ঠিক তখনই হানা দিলো দুর্ভাগ্য।
মহাপ্লাবন শেষে কেবল ফিনটান বেঁচে রইলো। প্রথমে স্যামন, তারপর ঈগল এবং সবিশেষ বাজপাখি হয়ে টিকে রইলো প্লাবন পরবর্তী ৫৫০০ বছর। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার মানুষে পরিণত হলেন। তাকে দিয়ে শুরু হলো আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস। অন্য একটি ভার্সন পাওয়া যায় বর্ণনার। তাতে তিন জোড়া দেব-দেবীকে পুর্বসূরী ধরে পরবর্তী ক্রম টানা হয়েছে। ক্যাসিয়্যারের সাথে নয়জন আদি মাতা দেখা যায়। ব্রিটনদের আদি মাতা আলবা, স্পেনিশদের এসপা, জার্মানদের জার্মান, গথদের গথিয়াম, থ্রেসিয়ানদের ট্রেইগি… এভাবে। আলোচনায় যেন আয়ারল্যান্ড নিজেই এক বিশাল পৃথিবী।
মেসো-আমেরিকার উপকথা
মেক্সিকোর আদিবাসী টিয়াপানেক এবং হুয়াক্সটেকদের মধ্যে প্রচলিত উপকথা অনুসারে, এক ব্যক্তি ও একটি কুকুর ছাড়া সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় মহাপ্লাবনে। একদিন ব্যক্তিটি বাড়ি ফিরে এসে দেখে কুকুরটি সুন্দরী তরুণীতে পরিণত হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের থেকেই পৃথিবী নতুন করে জনপূর্ণ হয়ে ওঠে। এজটেক এবং টটোনাক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। মহাপ্লাবনে সব চূর্ণ হয়ে গেলেও এক নারী এবং পুরুষ গর্তে ঢুকে প্রাণে বেঁচে যায়। পানি কমতে শুরু করলে খাবার উদ্দেশ্যে মাছ রান্না করে তারা। আগুনের ধোঁয়া আকাশে গেলে দেবতারা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।
মায়া পুরাণের বর্ণনায়, মানুষ সৃষ্টির আগে দেবতারা আরো তিন দফায় উপাসক তৈরি করেছিলেন। কেবল মানুষই সঠিক উপায়ে আহুতি দিয়েছে। পূর্ববর্তী তিনটা প্রজন্মকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তন্মধ্যে তৃতীয় জাতিটিকে নির্মূল করা হয় মহাপ্লাবনের মাধ্যমে। কেবল বেঁচে থাকে চারজন; যারা পরে পৃথিবীর চার কোনা ধারণ করে আছে। যাহোক, মেসো-আমেরিকার উপকথাগুলোতেও প্রায়শ মহাপ্লাবনের কারণ হিসেবে দেখা যায় মানুষের অনাচার আর বিশৃঙ্খলা। পুরাতন পৃথিবীকে ভেঙে নতুন করে সৃষ্টির প্রচেষ্টা।
পরিশেষ
আফ্রিকা থেকে হোমো সেপিয়েন্সের ছড়িয়ে পড়ার অনেক পর স্থায়ী সভ্যতার পত্তন ঘটেছে মেসোপটেমিয়ায়। তাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিসের উপকূলে মানববসতি যথেষ্ট উন্নত ছিল; তা হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। নুহের জন্ম এবং ধর্ম প্রচার সেখানেই। তার পরবর্তী প্রজন্ম নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে বলেই সাক্ষ্য দেয় বাইবেল। মহাপ্লাবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা প্রজন্মান্তরে মৌখিক ভাবে টিকে থাকা অসম্ভব কিছু না। মূল কাঠামো ঠিক রেখে ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। যেমন, বহু পরে ইবরাহিম মেসোপটেমিয়া ছেড়ে ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীর কেনানে চলে গেলেন। সেখানে ইহুদিদের যোগাযোগ হলো মিশর, ফিনিশীয়, গ্রীক এবং উপকূলের অন্যান্য সভ্যতার সাথে। বাইবেলেই সলোমনের সাথে ফিনিশীয় রাজার যোগাযোগ বিবৃত হয়েছে। এভাবে পুরাণের প্রবাহ খুব সম্ভব।
আবার, মেসোপটেমিয় ভাষায় দুটি শব্দ এরেবু অর্থ পশ্চিম এবং আসু অর্থ পূর্ব। এই এরেবু থেকে বর্তমান ইউরোপ এবং আসু থেকে বর্তমান এশিয়া শব্দের আগমন অসম্ভব না। নুহের যামানা ইবরাহিমের বহু আগে। তাই মানব সভ্যতার ভিত্তিভূমি হিসেবে মেসোপটেমিয়া থেকে পূর্ব ও পশ্চিমে প্লাবনের সংস্কৃতি বাণিজ্যিক যোগাযোগের মাধ্যমেও ছড়িয়ে যেতে পারে। আবার প্রত্যেকটা জাতি প্রায় কাছাকাছি অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠার কারণে একধরনের মিথ জন্ম নিতে পারে। এই সাদৃশ্যের পেছনে কারণ যা-ই থাক; একটা কথা উপলব্ধি করার মতো। ‘ডিভাইন কনশাসনেস একটা সমুদ্রের মতো। ভারত থেকেই কেউ ঝাঁপ দিক কিংবা পশ্চিম আফ্রিকা থেকে; তাদের হাতে একই প্রকার মুক্তা উঠে আসবে। সত্যের পথ নির্ভর করে স্থান, কাল এবং জ্ঞানের উপর। উৎস চিরকাল এক’।