ভারতের অধরা গুপ্তধনগুলোর কাহিনী

হয়তো কখনো সফল হয়েছে, আবার অনেকের কপালে জুটেছে ব্যর্থতার তিলক। তারপরও মানুষ থেমে থাকেনি। একসময় এই ভারতীয় উপমাহদেশের অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, পরগণা বিভিন্ন রাজা-মহারাজার অধীনে ছিল। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এবং নানা উপায়ে তারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তাদের এই বিশাল সম্পদ বিভিন্ন কারণে লুকিয়ে রাখা হতো তাদের তৈরি বিভিন্ন গোপন স্থানে। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর অনেক সম্পদের হদিশ পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি। 

ভারতবর্ষ যখন ইংরেজদের অধীনে চলে আসে, তারাও বেরিয়ে পড়েছিল সেসব গুপ্তধনের সন্ধানে। কখনো সরকারি তত্ত্বাবধানে, আবার কখনো ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলে এসব অভিযান। এসব লুকায়িত সম্পদের কিছু কিছু উদ্ধার হলেও অনেক গুপ্তধনের হদিশ সেই সময়ে আর পাওয়া যায়নি। এমনকি ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও তা মরীচিকা হয়েই রয়ে যায়। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তেমনি কিছু খুঁজে না পাওয়া গুপ্তধনের সন্ধানে আজকের এই আয়োজন।

সুলতান মহম্মদ কুলি কুতুব শাহের খাজানা

ভারতীয় ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে হায়দ্রাবাদ শহরের নাম। শহরের দর্শনীয় এক স্থাপত্য চারমিনার টানেল। শোনা যায়, ১৫৯৩ সালে মহম্মদ কুলি কুতুব শাহের তত্ত্বাবধানে মিনারটি নির্মিত হয়। পুরো স্থাপনা জুড়ে দেখা যায় পারস্য স্থাপত্যের ছোঁয়া। ৫৬ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট চারমিনারের উত্তর দিকে রয়েছে চার কামান বা খিলান। চারমিনারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো মিনারের নিচে নির্মিত এক সুড়ঙ্গ।

হায়দ্রাবাদ শহরের দর্শনীয় এক স্থাপত্য চারমিনার টানেল; Image Source: factsofworld4u.blogspot.com

একসময় নাকি এই সুরঙ্গ দিয়ে গোলকুন্ডা দুর্গে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কোনোরকম বিপদ আসলে যাতে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়া যায়, সেজন্যই এই টানেলটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে টানেলটি যে কারণে সবচেয়ে আলোচনার বিষয় হয়ে আছে তা হলো, টানেলে থাকা কোনো এক গোপন কক্ষে নাকি লুকিয়ে রাখা ছিল প্রচুর ধনসম্পদ, যার সন্ধান আজপর্যন্ত কেউ পায়নি। 

জয়পুরের রাজা, মান সিংহের লুন্ঠিত সম্পদ

জয়পুরের রাজা মানসিংহ ছিলেন মোঘল সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি। সম্রাট আকবর ১৫৮০ সালে আফগানিস্তানে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য মানসিংহকে দায়িত্ব দেন। মানসিংহ আফগানদের পরাজিত করে আফগানিস্তানকে মোঘল সাম্রাজ্যের অধিকারে নিয়ে আসেন। 

জয়পুরের রাজা মানসিংহের জয়গড় দুর্গ; Image Source: thepalaceonwheels.org

আফগানিস্তান দখল করে মানসিংহ আফগানদের কাছ থেকে এবং আফগান রাজকোষ থেকে প্রচুর ধনরত্ন নিজের অধিকারে নিয়ে নেন। সেই লুন্ঠন করা সম্পদের পুরোটাই মোঘল রাজকোষে জমা করা হয়নি বলে ধারণা করা হয়। এই লুট করা সম্পদের এক বিপুল অংশ তিনি তার জয়গড় দুর্গে লুকিয়ে রাখেন বলে অনেক গবেষকই অনুমান করেন। কিন্তু সেই লুকনো সম্পদের এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সম্রাট নাদির শাহের লুট করা ধনসম্পত্তি

পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ৫০,০০০ সৈন্য নিয়ে ভারত আক্রমণ করেন। নাদির শাহ ভারতবর্ষ দখলের পর তার সেনাবাহিনী বিশ থেকে ত্রিশ হাজারের মতো নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। লুট করে নেয় প্রচুর ধনসম্পত্তি। বলা হয়ে থাকে, এই লুটপাটের পরিমাণ এত বিশাল ছিল যে, নাদির শাহ ও তার সৈন্যরা যখন লুটের মালামাল নিয়ে ফিরছিলো তখন প্রায় ১৫০ মাইল দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়।

পারস্য সম্রাট নাদির শাহ; Image Source: wikimedia commons

কী ছিল না লুট করা মালামালের তালিকায়? জাহাঙ্গীরের ময়ূর সিংহাসন থেকে শুরু করে রাজকোষের সব সম্পদ। প্রচুর মণিমুক্তো সহ রাজকীয় সোনাদানা যার মূল্য সেই সময়ের হিসেবে ভারতীয় টাকায় কোটি টাকার সমান। তবে অদৃষ্টের পরিহাস, ১৭৪৭ সালে নাদির শাহ যখন নিজ দেশে ফিরছিলেন, যাত্রাপথে এক তাবুতে অবস্থাকালীন সময়ে তাকে হত্যা করা হয়। তাকে যে হত্যা করে, সেই হত্যাকারী আহমদ শাহ যাত্রাপথে অসুস্থ হয়ে মারা যান। অনেকেই মনে করেন, নাদির শাহের মৃত্যুর পূর্বে আহমদ শাহ সম্রাটের খাজানা কোথায় লুকানো আছে তার হদিশ পেয়েছিলেন।

নাদির শাহের লুন্ঠিত ধন-সম্পদের অধিকাংশেরেই সন্ধান পাওয়া যায়নি; Image Source: ahistoryofmystery.com

কিন্তু পথে আহমদ শাহের মৃত্যু হওয়ায় সেই লুট করা সম্পদ কোথায় লুকানো আছে তা আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অনেকেই অনুমান করেন, হিন্দুকুশ পর্বতমালার কোনো এক সুরঙ্গে নাদির শাহের সেই খাজানা লুকানো আছে। তবে কিছু ধনরত্ন, যেমন ময়ূর সিংহাসন (যা বর্তমানে ইরানে রয়েছে) এবং কোহিনুর হিরে (যা ইংল্যান্ডের রানির মুকুটে শোভা পাচ্ছে) উদ্ধার করা সম্ভব হলেও লুন্ঠিত অনেক সম্পদের খোঁজ আজও মেলেনি।

হায়দ্রাবাদের শেষ নিজাম মীর ওসমান আলীর গুপ্তধন

অবিভক্ত ভারতের হায়দ্রাবাদ নামক বিশাল রাজ্যের শেষ নিজাম ছিলেন মীর ওসমান আলী। ২০০৮ সালের ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক প্রচ্ছদে এই নিজামকে বিশ্বের সর্বকালের সেরা ধনীদের মধ্যে পঞ্চম স্থান দিয়েছে। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২১০.৮ বিলিয়ন ডলার। টাইম ম্যাগাজিন তাকে ১৯৩৭ সালে তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

হায়দ্রাবাদের শেষ নিজাম মীর ওসমান আলী; Image Source: whatsuplife.in

১৯১১ সালে মীর ওসমান আলী ক্ষমতার মসনদে আরোহন করেন। এ সময় রাজকোষ প্রায় শূন্য হতে চলেছিল। সাম্রাজ্যের পূর্বতন নিজাম মীর ওসমান আলীর পিতার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য রাজকোষের এই করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। মীর ওসমান আলী ক্ষমতা গ্রহণের পরেই রাজ্যের আর্থিক অবস্থা ফিরতে থাকে। তার ৩৭ বছরের শাসনামলে রাজকোষ ফুলে ফেঁপে ওঠে। তার ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। কিন্ত মৃত্যুর পর তার বিশাল সম্পদের কিছু অংশই খুঁজে পাওয়া যায়।

কোথি প্রাসাদেই নিজাম তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছিলেন; Image Source: journeyplanner.in

অনুমান করা হয় যে, তার এই বিশাল সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে কোথি প্রাসাদে। নিজাম তার এই প্রাসাদে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। সেই কোথি প্রাসাদের কোনো এক গুপ্ত কুঠুরিতেই সেই লুকানো সম্পদ রয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস। তার সম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৭৩টি জমকালো রুবি, হীরা, প্রবাল, মুক্তো, নীলকান্তমণি দিয়ে তৈরি বিখ্যাত নিজাম জুয়েলারি, স্বর্ণ ও রুপা যুক্ত বিভিন্ন দামী পাথর। আজও অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজামের সেই লুকানো সম্পদ।  

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের খাজানা

দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন, তখন ইংরেজরা সম্রাটকে দিল্লি থেকে নির্বাসনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরাজিত সম্রাট ইংরেজ সরকারকে অনুরোধ জানান, তাকে যেন দিল্লি থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে রাজস্থানের আলওয়ার দুর্গে পাঠানো হয়।

রাজস্থানের আলওয়ার দুর্গ; Image Source: in.musafir.com

ইংরেজ সরকার সম্রাটের অনুরোধের মান্যতা দিয়ে তাকে আলওয়ার দুর্গে নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কিংবদন্তী রয়েছে যে, সম্রাট এখানে থাকাকালীন সময়ে তার প্রচুর ধনরত্ন দুর্গের কোনো গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই সম্পদের কিছু অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হলেও, এখনো খাজানার এক বৃহদাংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। 

কৃষ্ণা নদীর নীচের হীরার খনি

অন্ধ্রপ্রদেশ হীরার জন্য বিখ্যাত। বিশ্বের বিখ্যাত দশটি হীরার সাতটি পাওয়া গিয়েছিল এখানেরই বিভিন্ন খনিতে। একসময় এই অঞ্চল ছিল গোলকুন্ডা শাহির অন্তর্ভুক্ত। কৃষ্ণা নদীর অববাহিকার কোনো এক স্থানে বিশ্বখ্যাত গোলকুন্ডার হীরক খনিগুলো ছিল।

কৃষ্ণা নদীর নীচে হারিয়ে যাওয়া হীরার খনি; Image Source: in.musafir.com

কোহিনুর, হোপ ডায়মন্ডের মতো বিখ্যাত হীরাগুলো পাওয়া গিয়েছিল কৃষ্ণা নদীর তীরের কোনো এক খনি থেকে। কিন্তু নদী তার দিক পরিবর্তন করায় খনিগুলো নদীগর্ভে হারিয়ে যায়। তারপর বিভিন্ন সময়ে নানা স্থানে খননকার্য চালালেও সেই হীরার খনিগুলোর সন্ধান আর পাওয়া যায়নি।

ফিচার ইমেজ- hightime1311.co

Related Articles

Exit mobile version