বিশাল ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে দানবাকৃতির এক সরীসৃপ, নিঃশ্বাসে আগুন ছড়িয়ে। হাউজ অব দ্য ড্রাগন, অ্যা গেম অফ থ্রোন্স, হ্যারি পটার, নাকি দ্য হবিট? জনপ্রিয় ফ্যান্টাসিনির্ভর সিনেমা, সিরিজ, বই অথবা ভিডিও গেমে ড্রাগনের অহরহ আসা যাওয়া। উপকথার কাল্পনিক অগ্নিশ্বাসী উড়ুক্কু দানবীয় সরীসৃপ এই ড্রাগন। প্রাচীন প্রতিটি সভ্যতার উপকথাতেই কোনো না কোনো দানবীয় অতিপ্রাকৃতিক সরীসৃপের দেখা মেলে। এদের ভিতর কিছু বিষয়ে মিল থাকলেও সব দানবীয় সরীসৃপ কিন্তু ড্রাগন নয়! আবার আচরণ, বসবাসের অঞ্চল, শারীরিক গঠন, আর গল্পে উপযোগীতা হিসেবে ড্রাগনের ভিতরেও রয়েছে নানা রকমভেদ। ভাবছেন, কল্পনার প্রাণীর আবার অ্যানাটমিক রকমভেদ কীসের? যদি বলি আপনার প্রিয় শো গেম অফ থ্রোন্সে দেখা ড্রাগনগুলো আদতে ড্রাগনই নয়, উইভার্ন? চমকে গেলেন তো? তাহলে বরং জেনে নেয়া যাক আমাদের উপকথায় বর্ণনা করা ড্রাগনদের ভেতর শারীরিক গঠনের ভিত্তিতে করা শ্রেনীবিন্যাস।
১) ক্লাসিক ইউরোপিয়ান ড্রাগন (Draco Occidentalis Magnus)
ড্রাগন বললে প্রথমেই ক্লাসিক ইউরোপিয়ান ড্রাগনের অবয়ব কল্পনায় আসে। এই ড্রাগনেরা যেমন বিশালদেহী, তেমনি শক্তিশালী, মূলত সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং শক্তিশালী স্থলজ জীব। অন্তত পনেরো মিটার দীর্ঘ এবং পাঁচ মিটার উচ্চতার এই সরীসৃপ চার পায়ে ভর দিয়ে সিংহের মতো দাঁড়াতে পারে, আবার অতিকায় চামড়ার তৈরি ডানা মেলে উড়তেও পারে। এদের নিঃশ্বাসে আছে আগুনের হল্কা। এছাড়াও এদের অনেকের হিপ্নোটিজম, টেলিপ্যাথির মতো জাদুকরী ক্ষমতা থাকে বলে অনেক উপকথায় প্রমাণ মেলে। সাধারণত বড় পর্বতশ্রেণীতে, গুহায় কিংবা পরিত্যাক্ত দুর্গে এদের বসবাস। ইউরোপীয় গল্পে অনেক সময় ড্রাগনকে দামী বস্তু, যেমন- সোনা, হীরে, জহরত সংগ্রহ করে জমিয়ে রাখতে দেখা গেছে। মোটাদাগে ইউরোপীয় ড্রাগনদের হিংস্র, প্রতিশোধপরায়ণ, বিধ্বংসীরূপেই বেশি কল্পনা করা হয়। ইউরোপীয় ফ্যান্টাসি বই, যেমন- দ্য হবিট, হ্যারি পটার, ক্রনিকলস অব নার্নিয়ার ফিল্ম অ্যাডাপ্টেশনে ক্লাসিক ইউরোপীয় ড্রাগন দেখা যায়।
২) উইভার্ন (Draco Africanus)
উইভার্ন ড্রাগনেরই একটি দোপেয়ে সংস্করণ। মূলত সতেরো শতকের দিকে এসে দ্বিপদী আর চতুষ্পদী ড্রাগনকে আলাদা করতেই উইভার্ন শব্দটির উদ্ভব হয়। এর পেছনের দিকে এক জোড়া বলিষ্ঠ পা থাকলেও সামনের দুই পায়ের বদলে রয়েছে বাদুরের মতো নখরযুক্ত চামড়ার ডানা। মাথার আকারে ড্রাগনের সাথে মিল আছে, তবে এক বা দুই জোড়া শিং এদের ক্লাসিক ড্রাগন থেকে আলাদা করেছে। এদের লেজের শেষ অংশে বিষাক্ত কাঁটা থাকতে পারে, বিষ থাকতে পারে দাঁতেও। হিংস্র, নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর বলে দুর্নাম থাকা এই ড্রাগনের নিঃশ্বাসে আগুন থাকতে পারে, অনেকের আবার মুখনিঃসৃত তরলে থাকে গরল। তীক্ষ্ণদৃষ্টির এই দানব পাহাড়ে বাস করে, আর খাদ্য হিসেবে পছন্দ গবাদিপশু। তবে উইভার্নের আক্রমণ থেকে গ্রামবাসীর গবাদিপশু রক্ষা করতে আসা সাহসী যোদ্ধাকেও খাদ্য হিসেবে গ্রহণে এদের আপত্তি থাকে না। বেশিরভাগ ফিল্ম মিডিয়াতে ড্রাগন হিসেবে উইভার্নকেই দেখানো হয়।
৩) উইর্ম
উইর্ম বা ওয়ার্ম মূলত জার্মানিক ড্রাগন। এদের পা বা পাখা থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে। এদের সারা দেহ আঁশে ঢাকা থাকে। এদের অনেকের চোখে সম্মোহনী ক্ষমতা থাকে, দাতে থাকে বিষ, মুখনিঃসৃত তরলে এসিড। বাসিলিস্ক, নর্স মিথোলজির জরমুনগান্ড্র ইত্যাদি মূলত উইর্ম গোত্রের ড্রাগন।
৪) লিন্ডওয়ার্ম (Draco Serpentalis)
ডানাবিহীন এই সরীসৃপের একজোড়া পা আছে। উচ্চতায় ১-৩ মিটারের উপরে না গেলেও দৈর্ঘ্যে পনেরো মিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে এই দোপেয়ে সর্পিল দানব। হলুদ, সবুজ বা কমলা রঙের এই প্রাণীর গায়ের রঙ নির্ভর করে এর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর। এর রয়েছে অসাধারণ ঘ্রাণশক্তি। মজার ব্যাপার হলো মার্কো পোলো নিজে মধ্য এশিয়ায় এই ধরনের দানব দেখতে পেয়েছেন বলে জনশ্রুতি আছে।
৫) এম্ফিথিয়ার
এম্ফিথিয়ার যেন লিন্ডওয়ার্মের ঠিক উল্টো, সর্পিল দেহে কোনো পা নেই, কিন্তু রয়েছে বিশাল রঙিন দুই পাখা। এটি একমাত্র ড্রাগন যার পাখায় চামড়ার বদলে রঙিন পালক রয়েছে। এর মুখের আদলেও মিল রয়েছে পাখির সাথে। মায়া সভ্যতার দেবতা কোয়াটজেলকোটল কিন্তু শারীরিক গড়নের দিক থেকে একধরনের এম্ফিথিয়ার।
৬) ড্রেক
সাহিত্যে বা মিডিয়ায় ড্রেক শব্দটি ড্রাগনের প্রতিশব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ড্রেক বলতে মূলত ডানাবিহীন চারপেয়ে ড্রাগনকে বোঝায়। এদের অনেকের নিঃশ্বাসে আগুন থাকে, অনেকের আবার বরফ। ডানা নেই বলে এরা উড়তে পারে না।
এছাড়াও, এশিয়ান উপকথায় জ্ঞানী প্রকৃতিদেবতা হিসেবে ড্রাগনের দেখা মেলে, যাদের দেহের গড়ন কিছুটা সর্পিল, সাধারণত চারটি পা থাকে, ডানা থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে। চীনা, জাপানী, তিব্বতী বা ভুটানী এসব ড্রাগনের থাকে আগুন বা বরফ অথবা বজ্রের শক্তি, আর থাকে ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমানের জ্ঞান। ইউরোপীয় ড্রাগনেরা শত্রু হলেও এশিয়ার ড্রাগনেরা কিন্তু মানবসভ্যতার পরম বন্ধু!