মরুভূমি এক অদ্ভুত জায়গা, আর ততটাই অদ্ভুত সেখানকার উদ্ভিদকূল। চারদিকে যতদূর চোখ যাবে, দেখা যাবে শুধু ধূসর বালু। তবে মাঝে-মধ্যে চোখে পড়বে অদ্ভুত সব আকৃতির উদ্ভিদ, যেগুলোর সাথে আমরা সচরাচর পরিচিত নই। এসব উদ্ভিদ মরুভূমির তীব্র দাবদাহে টিকে থাকবার জন্য পাতার বদলে কণ্টক জন্মায়। এদের দৈহিক গঠন এমন যে, তা সবসময়ই ভবিষ্যতের জন্য পানি জমা করে রাখতে পারে। এদের অধিকাংশের মূলই মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত যায়, কেননা মরুভূমিতে সহজেই পানি পাওয়া সম্ভব না। এরকমই ১০টি অদ্ভুত আর বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
১. ওয়েলউইটসিয়া মিরাবিলিস
মরুভূমির অদ্ভুত উদ্ভিদগুলোর মাঝে সম্ভবত সবচেয়ে অন্যরকম দেখতে উদ্ভিদটি হলো ওয়েলউইটসিয়া মিরাবিলিস। দূর থেকে দেখলে মনে হতে পারে, কিছু ছেঁড়া কাপড় মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আরেকটু কাছে গেলে মনে হবে বুঝি কাণ্ডবিহীন একটি উদ্ভিদ, যার রয়েছে এলোমেলো অসংখ্য পাতা। তবে একেবারে নিকটে পৌঁছুলে দেখবেন, কাণ্ড এর নেই ঠিকই, তবে পাতা অনেক নয়, কেবল দুটি। এ দুটি পাতার বৃন্ত থেকেই ক্রমাগত নতুন নতুন উপপত্রক জন্মাতে থাকে।
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘায়ু উদ্ভিদগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ওয়েলউইটসিয়া সর্বোচ্চ ১৫০০ বছর বাঁচতে পারে! এর জৈবিক গঠনপ্রকৃতি এমন যে, এটি দুর্গম স্থানে সর্বোচ্চ প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে সক্ষম। আর এর শেকড় তো পানির খোঁজে এতটাই গভীরে যায় যে পানি যদি পৃথিবীর কেন্দ্রেও থাকে, তাহলে সেটি সেখানেই পৌঁছে যাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি জুরাসিক যুগে আবির্ভুত হয়। নামিবিয়ার মরুভূমিতে এই উদ্ভিদ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
২. ব্যারেল ক্যাকটাস
আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মরুভূমিগুলোতে অদ্ভুত সুন্দর এই ব্যারেল ক্যাকটাসগুলো প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। সৌন্দর্যের পাশাপাশি এটি বিপদজনকও বটে। এর ফাঁপা নলাকার শরীর জুড়ে আছে ৪ ইঞ্চি লম্বা মোটা কণ্টক, যা একে পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। আমেরিকান মরুভূমিগুলোতে যে সকল ক্যাকটাস পাওয়া যায়, ব্যারেল ক্যাকটাস তন্মধ্যে সবচেয়ে বড়। অগভীর শেকড়বিশিষ্ট এ উদ্ভিদ ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটি হলো, ব্যারেল ক্যাকটাসকে মাটি থেকে তুলে রেখে দিলেও তা অনধিক ৬ বছর বাঁচতে পারে! কেননা, এটি এর দেহের ওজনের চেয়ে অধিক পানি সেখানে জমা করে রাখে, যা ধীরে ধীরে ব্যবহার করে। তবে নির্বিঘ্নে মাটিতেই থাকতে দিলে একেকটি ব্যারেল ক্যাকটাস প্রাকৃতিক সব প্রতিকূলতা জয় করে দেড়শো’ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
৩. বেসবল প্ল্যান্ট
দেখতে হুবহু বেসবলের মতো এই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইউফোরবিয়া ওবেসা’। এর এমন চেহারাই এর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের তালিকার সবচেয়ে দুর্ভাগা এ উদ্ভিদ পাওয়া যায় কেবল নার্সারি আর বোটানিক্যাল গার্ডেনগুলোতে। অতিমাত্রায় সংগ্রহের কারণে প্রকৃতিতে এটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে! সবুজ রঙের এই উদ্ভিদগুলোর ব্যাস ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর ফুলের রঙ হলুদাভ সবুজ, যেগুলোকে সিয়াথিয়া বলে। ব্যারেল ক্যাকটাসের মতো মাটির সংস্পর্শ ছাড়া ৬ বছর বেঁচে থাকতে না পারলেও, এটিও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য দেহে অনেক পানি জমা করে রাখে।
৪. হিডনোরা আফ্রিকানা
দূর থেকে দেখে অনেকে কৃষ্ণচূড়াও মনে করতে পারে। তবে কাছে গেলে নতুন কোনো প্রজাতির ফাঙ্গাস মনে হতে পারে হিডনোরা আফ্রিকানাকে। আফ্রিকার মরুভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এই উদ্ভিদের কোনো পাতা নেই। যা আছে, তা হলো এর গাঢ় বাদামী রঙের কাণ্ড। তবে এর লাল বা কমলা রঙের জন্য মৌসুমী ফুলের সময়ে এটি দেখতে সুন্দর লাগে। ফুলগুলো দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে ভ্রমর এই উদ্ভিদের পরাগায়নে সহায়তা করে। যখন ফুল থাকে না, তখন একে ছত্রাক ভেবে ভুল করেন অধিকাংশই।
শুধুমাত্র কাণ্ড নির্ভর এই উদ্ভিদের শেকড় বেশ গভীরে পৌঁছে। তথাপি, প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য প্রচুর পরিমাণ পানি জমা করে রাখে কাণ্ডের ভেতর। এই কাণ্ডের আবার অর্ধেকের বেশি অংশই মাটির নিচে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, মরুভূমিতে অনেকেই ভুল করে হিডনোরার ফলকে আলু মনে করে খেয়ে ফেলেন। অবশ্য দেখতে আলুর মতো ফলটির স্বাদও প্রায় একই রকম এবং জন্মায়ও মাটির নিচেই।
৫. সিলভার টর্চ ক্যাকটাস
আর্জেন্টিনা আর বলিভিয়ার উঁচু পর্বতাঞ্চলীয় মরুভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এই সিলভার টর্চ ক্যাকটাস। এটি ক্যাকটাসিয়া গোত্রের একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। এর দেহাবয়ব অসংখ্য উলের মতো সূক্ষ্ম তন্তুসমৃদ্ধ বিধায় একে ‘উলি টর্চ’ ক্যাকটাসও বলা হয়। এর সরু, খাড়া, সবুজাভ ধূসর কাণ্ড ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হলেও সেগুলোর ব্যাস সর্বোচ্চ ৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। মজার ব্যাপার হলো, এটি প্রচুর সূর্যালোক পছন্দ করলেও অধিক তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে না।
বলিভিয়ান মরুভূমিগুলোর এমন সব স্থানেই এই সিলভার টর্চ ক্যাকটাস জন্মায়, যেখানে পর্যাপ্ত সূর্যালোক থাকলেও তাপমাত্রা অত বেশি নয়, আবার গ্রীষ্মকালে প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয়। পর্যাপ্ত পানি আছে, এমন অঞ্চলে জন্মায় বলে এর দেহে অন্যান্য মরু উদ্ভিদের মতো পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা বিবর্তিত হয়নি। এর সবচেয়ে অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যটি হলো, এটি অধিক তাপমাত্রা সইতে না পারলেও, শূন্যের ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারে! ফ্রান্সে এই উদ্ভিদের চাষাবাদও করা হয়, কেননা এর মূল থেকে বার্গান্ডি নামক একপ্রকার মদ তৈরি করা হয়।
৬. জাম্পিং কোলা
জাম্পিং কোলা নামক এ উদ্ভিদটি ‘টেডি বিয়ার কোলা’ নামেও পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মরুভূমিগুলোতে এই ক্যাকটাস উদ্ভিদটি অহরহই দেখা যায়। একে সহজেই চেনা যায় এর দেহের গঠন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখে। প্রধান কাণ্ড থেকে অসংখ্য ছোটবড় শাখা কাণ্ড বের হয়, যেগুলো অত্যন্ত ঘন, তীক্ষ্ণ কাঁটায় পরিপূর্ণ। এত বেশি কাঁটার কারণে এর দেহকাণ্ড দেখতে মোলায়েম মনে হয়। তবে প্রতিরক্ষার পাশাপাশি এর কাঁটাগুলো আরো একটি জরুরি কাজও করে, আর তা হলো পানি সংগ্রহ।
এমনকি পাতাবিহীন এ উদ্ভিদের পাতার কাজও করে এই কণ্টকগুলোই। প্রচণ্ড রোদে উদ্ভিদটির দেহ তাপমাত্রা সহনশীল পর্যায়ে ধরে রাখে এরা। প্রতিটি অ্যারিওলেই ৬-১২টি করে কাঁটা জন্মায়। জাম্পিং কোলা উদ্ভিদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জন্মায় না। যেখানেই এদের জন্ম হয়, একত্রে একাধিক উদ্ভিদের জন্ম হয় এবং ছোটখাট একটি ঘন জঙ্গলের মতো হয়ে যায়। মে মাসে এই গাছে ফুল ধরে।
৭. বাওবাব গাছ
আফ্রিকা, আরব আর অস্ট্রেলিয় মরুভূমিগুলোতে প্রচুর পরিমাণে জন্মায় এই অদ্ভুত গাছগুলো, যদিও এদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্য পাওয়া গেছে মাদাগাস্কারেই। কেবল মরুউদ্ভিদ নয়, সমগ্র উদ্ভিদকূলের মধ্যেই সবচেয় বেশি পরিমাণ পানি ধারণ করতে পারতে এই বাওবাব গাছগুলো। এই গাছের মোটা গুঁড়িগুলো ১-১.২ লক্ষ লিটার পর্যন্ত পানি জমা করে রাখতে পারে! দেহে পর্যাপ্ত পানি ধারণ করে রাখা যায় বলে এই উদ্ভিদগুলো সাধারণত কম বৃষ্টি হয় এরকম শুষ্ক, উত্তপ্ত স্থানে জন্মাতে পছন্দ করে।
বাওবাব পৃথিবীর প্রাচীনতম ‘অ্যাঞ্জিওস্পার্ম’ উদ্ভিদের একটি। অ্যাঞ্জিওস্পার্ম বলতে বোঝায় যেসকল উদ্ভিদ বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। দেহে কোনো ‘গ্রোথ রিং’ তৈরি হয় না বলে রেডিওকার্বন পদ্ধতিতে এর বয়স নির্ধারণ করা কষ্টসাধ্য। তবে বাওবাব গাছ দীর্ঘায়ু হয়ে থাকে, সাধারণ ১ হাজার বছরের মতো বেঁচে থাকে সহজেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া একটি নমুনার বয়স তো ৬ হাজার বছর নির্ণীত হয়েছে।
৮. উলেমি পাইন
উলেমি পাইন উদ্ভিদকে বলা হয় ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’। এটি পৃথিবীর বিরলতম উদ্ভিদগুলোর একটি, যা কেবল অস্ট্রেলীয় মরুভূমিগুলোতেই প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। এটি জিমনোস্পার্ম গোত্রের একটি উদ্ভিদ, যার জন্ম ২০ কোটি বছর আগে। এই গোত্রের যে অল্প কয়েকটি সদস্য আজ অবধি টিকে আছে, উলেমি পাইন তাদের অন্যতম। এর রয়েছে প্রতিকূল তাপমাত্রায় বেঁচে থাকার এক অসীম ক্ষমতা।
৫০/৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি যেমন অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারে, তেমনি মাইনাস ১০/১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাও এর স্বাভাবিক বেঁচে থাকায় কোনো প্রভাব ফেলে না। এর কোনো পাতা নেই, আছে পাতা সদৃশ একপ্রকার কাণ্ড। এর কাণ্ডগুলো পানি জমা করে প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য। প্রতিটি উদ্ভিদেই পুরুষ এবং নারী শঙ্কু থাকে।
৯. ডেজার্ট আয়রনউড
বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ডেজার্ট আয়রনউড দেখতে অনেকটা মটর গাছের মতো মনে হয়। এটি গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ হলেও এর দেহাবয়ব বৃক্ষের মতো। উত্তর আমেরিকার সনোরান মরুভূমিতেই কেবল এটি প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। এটি অত্যন্ত ধীর গতিতে বড় হয় এবং ১০০/২০০ বছরে মাত্র ২৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে আর বৃদ্ধি পায় না। এর নীল এবং ধূসর রঙের পাতাগুলো একে দেখতে আকর্ষণীয় করে তোলে।
মরুভূমিতে ডেজার্ট আয়রনউড পথভ্রষ্ট পথচারীর জন্য প্রবল স্বস্তি বয়ে আনে। কেননা, একটি প্রাপ্তবয়স্ক ডেজার্ট আয়রনউড এর নিকটবর্তী তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো হ্রাস করতে সক্ষম! প্রচণ্ড গরমে যখন পানির সংকট দেখা দেয়, তখন এই উদ্ভিদ এর অধিকাংশ পাতা ঝরিয়ে ফেলে। পরের মৌসুমে পানি পেলে আবার নতুন পাতার সৃষ্টি হয়। দীর্ঘায়ু এই উদ্ভিদ সর্বোচ্চ ১,৫০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
১০. সাগুয়ারো ক্যাকটাস
ক্যাকটাস উদ্ভিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা হলো সাগুয়ারো ক্যাকটাস। এটি দেখতেও কখনো কখনো বৃক্ষের মতো লাগে। মূল দেহকাণ্ড থেকে অনেকসময় কোনো শাখা-প্রশাখা সৃষ্টিই হয় না। ফলে একে দেখতে একটি বড়সড় খুঁটির মতো মনে হয়। আবার যেগুলোর গায়ে শাখা জন্মায়, সেগুলোও জন্মাতে ৭০-১০০ বছর সময় নেয়। এই উদ্ভিদগুলো সর্বোচ্চ ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। আমেরিকার অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে এটি প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়।
এর মোটা, পুরু কাণ্ড যখনই বৃষ্টি হয়, তখনই প্রচুর পরিমাণে পানি শোষণ করে নেয়। একেকটি ক্যাকটাস যত লম্বা হয়, তাদের মূল মাটির তত গভীরে প্রবেশ করে। সাগুয়ারো একটি অ্যাঞ্জিওস্পার্ম উদ্ভিদ। মে-জুন মাসে এর ফুল ফোটে। সাগুয়ারো ফুল অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের রাষ্ট্রীয় ফুল। বন্য প্রাণীর আক্রমণ কিংবা পানির অভাবে শুকিয়ে যাওয়া ছাড়া এই উদ্ভিদগুলো মোটামুটি ২০০ বছরের মতো বেঁচে থাকতে পারে।