Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যাটসারিডাফোবিয়া: তেলাপোকা ভীতির খুঁটিনাটি

তেলাপোকা ভয় পাওয়া খুব সাধারণ একটি বিষয়। পৃথিবীতে যত প্রজাতির তেলাপোকা রয়েছে, তার মাত্র এক শতাংশই মানুষের সঙ্গে বসবাস করে। এরা সরাসরি কোনো রোগ বিস্তার করে না বা মানুষের খুব বড় ধরনের কোনো ক্ষতিও করে না। তা সত্ত্বেও মানুষ সচরাচর যেসব ফোবিয়া বা ভীতিতে ভুগে থাকে, তেলাপোকা-ভীতি বা ক্যাটসারিডাফোবিয়া তার মধ্যে অন্যতম। পূর্বে এটিকে এনটোমোফোবিয়া বা পোকামাকড়-ভীতির মধ্যেই ধরা হতো। পরবর্তীতে এটিকে আলাদা করে ‘ক্যাটসারিডাফোবিয়া’ নাম দেওয়া হয়

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং এর ইকোলজি বিষয়ের অধ্যাপক জেফ্রি লকউড তেলাপোকা-ভীতি প্রসঙ্গে বলেন, “ভয় ও বিরক্তি মানুষের দুটি সার্বজনীন নেতিবাচক আবেগ। এর একটি তাৎক্ষণিক বিপদ নির্দেশ করে আর অপরটি রোগবালাই বা দূষণের সম্ভাবনার সংকেত দেয়।” তার মতে, তেলাপোকা মানুষের মনে বিরক্তি ও ভয়- দুটি অনুভূতিকেই সক্রিয় করে তোলে। এর শরীরের তৈলাক্ত, চটচটে ভাব, রাতের আঁধারে গায়ের ওপর হেঁটে বেড়ানো কিংবা ভুলবশত পায়ের নিচে চাপা পড়ার ফলে বেরিয়ে আসা ইউরিক অ্যাসিডের দুর্গন্ধ স্বাভাবিকভাবেই বিরক্তি জাগায়। অপরদিকে হরর ছবির ভূতুড়ে কোনো চরিত্রের মতো দ্রুততার সঙ্গে উড়ে বেড়ানো, মানুষেরই ঘরে গোপনে বাস করে হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেওয়া কিংবা তার অদ্ভুতুড়ে পা ও অ্যান্টেনার গঠন মানুষের মনে রহস্য ও ভয়ের অনুভূতি তৈরি করে। তেলাপোকার প্রতি মানুষের মনে ভয়মিশ্রিত ঘৃণার এটিই হয়তো মূল কারণ। তবে এটি কেবল স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়া, কোনো ফোবিয়া নয়।

তেলাপোকার পা আর অ্যান্টেনার অদ্ভুতুড়ে গঠন মনে ভয় জাগিয়ে তোলে; Source: nocookie.net

তেলাপোকা-ভীতি বা ‘ক্যাটসারিডাফোবিয়া’ শব্দটি সেক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যাবে, যখন একজন ব্যক্তি তেলাপোকার প্রতি দীর্ঘদিন ধরে অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক ধরনের ভয় পোষণ করে, এবং এই ভয়ের ফলে তার মারাত্মক শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারেন যে, তেলাপোকা মোটামুটি নিরীহ ধরণের প্রাণী এবং এটি মানুষের জন্য বড় কোনো হুমকি বয়ে নিয়ে আসে না। এমনকি তারা তাদের এই ভীতি নিয়ে বিব্রতও বোধ করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাদের মনে উদ্ভূত ভয় এবং উদ্বেগ এড়িয়ে যেতে পারেন না

ক্যাটসারিডাফোবিয়ার কারণ

  • বিবর্তনগত কারণ: রাতে বা অন্ধকার পরিবেশে এটি বেরিয়ে এসে শরীরের ওপর হেঁটে বেড়ালে স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের শিরশিরে অনুভূতি হয়, যার ফলে আমরা ভয় বা বিরক্তি অনুভব করি। এই অনুভূতিটি বিবর্তনগতভাবে আমাদের মধ্যে এসেছে। প্রাগৈতিহাসিক কালে আমাদের পূর্বপুরুষগণ যখন গুহায় বাস করতেন, তখন তাদেরকে সবসময় এ জাতীয় পোকামাকড়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হতো। সেই থেকেই মানুষের মনে কীটপতঙ্গের প্রতি একধরনের আতঙ্ক জন্ম নিয়েছে
  • শৈশবের নেতিবাচক স্মৃতি: সাধারণত উষ্ণ ও অন্ধকার জায়গায় তেলাপোকা লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। ছোটবেলায় যাদেরকে এমন অন্ধকার ঘর বা আলমারির ভেতর বন্দী করে রেখে শাস্তি দেওয়া হয় যেখানে তেলাপোকার বসবাস রয়েছে, তাদের মনে বড় হওয়ার পরেও সেটির বিরূপ প্রভাব থেকে যায় এবং সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ তাদের মনে তেলাপোকা-ভীতি তৈরি হতে পারে।
  • আশেপাশের বড়দেরকে তেলাপোকা ভয় পেতে দেখলে অনেক সময় ছোটরাও তেলাপোকাকে ভয় পেতে শুরু করে।
  • তেলাপোকা নিজে সরাসরি কোনো রোগের জন্যে দায়ী না হলেও এটি বিভিন্ন রোগের বিস্তারে সাহায্য করতে পারে। এই ক্ষতিকারক প্রভাবের কারণেও মানুষের মনে তেলাপোকা নিয়ে শংকা জাগতে পারে।
  • তেলাপোকার পচা-বাসী খাবার খাওয়ার নোংরা স্বভাব কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার অকল্পনীয় ক্ষমতাও মানুষের মনে ভয়ের উদ্রেক করতে পারে।

উষ্ণ, অন্ধকার পরিবেশে দল বেঁধে তেলাপোকা অবস্থান করে; Source: jtspest.com

তেলাপোকা কীভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে?

খাদ্যদ্রব্য ঢেকে না রাখলে তেলাপোকা তাতে আক্রমণ করে। খাওয়ার সময় এরা মুখ থেকে লালা এবং হজমে সহায়ক তরল পদার্থ উদগিরণ করে। ফলে তেলাপোকার অন্ত্রে বসবাসকারী জীবাণুসমূহ খাবারের সঙ্গে মিশে যায়। Pseudomonas aeruginosa নামক ব্যাকটেরিয়া তেলাপোকার অন্ত্রে ব্যাপকভাবে বংশবিস্তার করতে সক্ষম। এই ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে মূত্রনালীর সংক্রমণ, হজমে গোলযোগ এবং রক্তদূষণ ঘটাতে পারে। এছাড়া খাদ্যে বিষক্রিয়া ও টাইফয়েড রোগের জন্যে দায়ী Salmonella ব্যাকটেরিয়াও তেলাপোকার মাধ্যমে ছড়াতে পারে

তেলাপোকা সর্বভুক প্রাণী। গাছ ও প্রাণীর মৃতদেহ, বিষ্ঠা, সাবান, আঠা, কাগজ, চামড়া, চুল ইত্যাদি এমন কিছু হয়তো নেই, যা তারা খায় না। ফলে এরা শুধু খাবারে মুখ দিলেই নয়, খাবারের ওপর মল ত্যাগ করলেও খাবার দূষিত হতে পারে। সাধারণভাবে তেলাপোকার কামড়ানোর প্রবণতা কম, তবে হাত-পায়ের আঙুল বা নরম চামড়ায় এটি কামড় দিতে পারে। এছাড়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ব্যক্তির নাক বা কানের ফুটো দিয়ে ছোট আকৃতির তেলাপোকা ঢুকে যেতে পারে। তেলাপোকার লালা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জেন রয়েছে, যা মানুষের শরীরে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং যার ফলে হাঁপানি রোগীদের হাঁপানির আক্রমণের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।

খাদ্যদ্রব্য ঢেকে না রাখলে তেলাপোকা তাতে আক্রমণ করে দূষিত করে তুলতে পারে; Source: sorensonpestcontrol.com

কখন বুঝবেন, ক্যাটসারিডাফোবিয়ায় ভুগছেন?

এই ফোবিয়ার লক্ষণগুলো একেকজনের ব্যক্তিত্ব ও মানসিক অবস্থা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখা দিতে পারে। কারো হয়তো সামনাসামনি তেলাপোকা দেখলে ভয় হয়, আবার কেউ হয়তো তেলাপোকার ছবিও দেখলে ভয় পান। খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে ক্যাটসারিডাফোবিয়ার লক্ষণ হচ্ছে, তেলাপোকাকে প্রচণ্ড ভয় পাওয়া এবং তেলাপোকা আছে, এমন কোনো পরিবেশে থাকতে উদ্বেগ বা অস্বস্তি বোধ করা।

এছাড়া যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে, তা হলো-

  • তেলাপোকা দেখলে ভয়ে স্থির হয়ে যাওয়া, নড়াচড়া করতে না পারা।
  • চিৎকার-চেঁচামেচি বা কান্না করা।
  • অনেক সময় ‘অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে’র অংশ হিসেবে ক্যাটসারিডাফোবিয়া দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ব্যক্তির মধ্যে তেলাপোকা দূর করার জন্যে ঘরের ভেতর বারবার কীটনাশক স্প্রে করা, কার্পেট ঝাড়া ও মোছা, রান্নাঘর ও স্নানঘর পরিস্কার করার অস্বাভাবিক প্রবণতা দেখা দেয়।
  • অতিরিক্ত ভয় বা উদ্বেগের কারণে প্যানিক অ্যাটাক হওয়া, যার লক্ষণসমূহ হচ্ছে- মাথা ঝিমঝিম করা, হাঁটু অবশ বোধ হওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট হওয়া, দুর্বল বোধ করা, বুকে ব্যথা হওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

ক্যাটসারিডোফোবিক ব্যক্তির আশেপাশে তেলাপোকা থাকলে তিনি উদ্বিগ্ন বোধ করেন; Source: Zwei-tan – DeviantArt

কীভাবে তেলাপোকা-ভীতি কাটিয়ে ওঠা যায়?

যেকোনো ভীতি দূর করতে হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে প্রথমেই সেই ভয়ের মুখোমুখি হওয়ার মতো সাহস অর্জন করতে হবে। তিনি নিজে ভয় কাটিয়ে উঠতে ইচ্ছুক হলে একজন থেরাপিস্ট বা বিশ্বস্ত কোনো বন্ধু তাকে এ ব্যাপারে সহায়তা করতে পারেন। তেলাপোকা ভীতি সারাতে মনোচিকিৎসা অনেকাংশেই সফল হয়। চিকিৎসার অংশ হিসেবে বিভিন্ন থেরাপির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তবে সকল রকমের চিকিৎসা কেবলমাত্র চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানেই করতে হবে।

  • সিস্টেমিক ডিসেনসিটাইজেশন: এই থেরাপির ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে তার ভয়ের সম্মুখীন করা হয়। তেলাপোকার ছবি দেখানো থেকে শুরু করে দূর থেকে জীবন্ত তেলাপোকা দেখা, মৃত তেলাপোকা স্পর্শ করা, তেলাপোকার সাথে একা একটি ঘরে থাকা, জীবন্ত তেলাপোকা স্পর্শ করা- এসবের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে তেলাপোকার সঙ্গে অভ্যস্ত করে তোলা হয়।
  • কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি: এই থেরাপি ভয়ের সেই নির্দিষ্ট বস্তুটির (অর্থাৎ তেলাপোকা) ব্যাপারে আক্রান্ত ব্যক্তির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণার পরিবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে ভয় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।
  • নিউরো-লিংগুইস্টিক প্রোগ্রামিং: এ পদ্ধতিতে প্রথমে ভয়ের প্রকৃত কারণ সনাক্ত করা হয় এবং পরে সাইকোথেরাপি, আত্মউন্নয়ন, শিথিলায়ন প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়।
  • ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি থেরাপি: এই পদ্ধতিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ভার্চুয়াল পর্দায় তার ভয়ের সম্মুখীন করে ভয় কাটানোর চেষ্টা করা হয়।
  • তেলাপোকার উপস্থিতিতে যাদের তীব্র ভয় এবং প্যানিক অ্যাটাক দেখা দেয়, তাদের চিকিৎসায় ঔষধও প্রয়োগ করতে হতে পারে।

ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি থেরাপির মাধ্যমে ভার্চুয়াল পরিবেশে তেলাপোকা-ভীতি কাটানো হয়; Source: International Society for Presence Research

কারো তেলাপোকা-ভীতি থাকুক বা না থাকুক, বাড়িতে তেলাপোকা থাকা মোটেও ভাল কোনো ব্যাপার নয়। তাই ঘরে তেলাপোকার আনাগোনা বন্ধ করতে নিচের উপায়গুলো অবলম্বন করা যেতে পারে

  • ঘর সবসময় পরিস্কার রাখুন। তেলাপোকারা দল বেঁধে ঘরের অন্ধকার, স্যাঁতসেতে ও উষ্ণ কোণে লুকিয়ে থাকে। রান্নাঘর, শৌচাগার এবং খাওয়ার ঘরেই এদের বেশি দেখা যায়। এরা বিশেষত উচ্ছিষ্ট, তৈলাক্ত খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই চুলার আশপাশের অংশ, খাওয়ার টেবিল ও ঘরের মেঝে সবসময় মুছে পরিস্কার রাখুন। রাতে ঘুমানোর আগে সিংকে জমা হওয়া নোংরা তৈজসপত্র ধুয়ে ফেলুন। ময়লার ঝুড়ি সবসময় ঢেকে রাখুন এবং প্রতি রাতে তা খালি করে ফেলুন। সপ্তাহে অন্তত একবার রেফ্রিজারেটর পরিষ্কার করুন।
  • খাবারের দূষণ এড়াতে হলে খোলা অবস্থায় খাবার ফেলে রাখবেন না।
  • দেয়ালে তৈরি হওয়া ছিদ্র বা ফাটলের মধ্য দিয়ে সহজেই ঘরে তেলাপোকা প্রবেশ করতে পারে। তাই যেকোনো ছিদ্র বা চিড় চোখে পড়ামাত্রই তা বন্ধ করে দিন।
  • পুরনো খবরের কাগজ, বই ও ম্যাগাজিনের স্তূপ খোলামেলা জায়গায় সংরক্ষণ করুন।
  • ভেজা, স্যাঁতসেতে পরিবেশ তেলাপোকার বেশ পছন্দ। সুতরাং তেলাপোকা থেকে রেহাই পেতে বাড়ির পানি প্রবাহের পথে কোনো ত্রুটি থাকলে তা সারিয়ে নিন। সিংকে পানি জমিয়ে রাখবেন না এবং ঘরের ভেতর টবে গাছ থাকলে তাতে অতিরিক্ত পানি দেবেন না।
  • গরম পরিবেশে তেলাপোকারা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে, তাই ঘরবাড়ি যথাসম্ভব ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করুন।
  • বাজারে তেলাপোকা নিধনের জন্যে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক পাওয়া যায়, সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। ঘরের ভেতর বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করতে না চাইলে সরাসরি তেলাপোকার গায়ে সাবান-পানির মিশ্রণ তৈরি করে তা স্প্রে করলেও পোকা মারা যাবে। এছাড়া তিন ভাগ বোরিক অ্যাসিড ও এক ভাগ গুঁড়ো চিনির মিশ্রণ তৈরি করে তেলাপোকার চলাচলের জায়গায় টোপ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন।

ফিচার ইমেজ: Getty Images; Illustration by Marisa Gertz for TIME

Related Articles