Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া পশুপাখিদের সন্ধানে

বিজ্ঞান ও উন্নত প্রযুক্তির আশীর্বাদে বিজ্ঞানীরা হাজারো অজানাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসলেও এখনো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ এক দিকে পরাজয়ের হার যেন মেনেই নিয়েছে। কী সেই পরাজয়? উন্নত প্রযুক্তি এখনও আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি কিভাবে জানা যেতে পারে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস।

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে একবার প্রায় ধরেই নেয়া হয়েছিল যে, অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্পেরও পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। ১৯৭৫ সাল, থরথর করে কেঁপে ওঠা পৃথিবীতে কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল বাড়ি-ঘর। কিন্তু অবাক হওয়ার মতই ঘটনা! একজনেরও মৃত্যু হয়নি সেদিন ৭.৩ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে। হ্যাঁ, আমি চীনের হাইচেং প্রদেশের কথাই বলছি। কী এমন ঘটেছিল সে সময় যা একটি প্রাণও অকালে ঝরে যেতে দেয়নি?

রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ।

১৯৭৬ সাল, চীনেরই তাংশাং প্রদেশে আবারও ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প। কিন্তু হায় অদৃষ্ট! সেই বার আর রক্ষা করা গেলো না। সে ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ।

ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত জীবন

স্বয়ং বিধাতা এই একটিমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগকে পদদলিত করার ক্ষমতা মনুষ্যকূলকে আজ পর্যন্ত দিলেন না। একই দেশে একটি প্রদেশে ভূমিকম্প এতগুলো প্রাণ কেড়ে নিল, আবার সেই দেশেরই অন্য প্রদেশে প্রাণহানির কোনো খবর নেই! এটা কিভাবে সম্ভব? তা হলে কি বিজ্ঞানীরা কোনো পূর্বাভাস দিয়েছিলেন?

১৯৭৬ সালে ভূমিকম্প কবলিত অংশ

১৯৭৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় চীনের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা সমুদ্র তীরবর্তী হাইচেং শহরটি ফাঁকা করে দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ করেন। লোকজন সরিয়ে নেয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সত্যি সত্যিই এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে পুরো শহরটি তছনছ হয়ে যায়। রক্ষা পায় নিরাপদে সরিয়ে নেয়া লোকের প্রাণ। চীনের বিশেষজ্ঞরা এই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন যাবৎ ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা মৃদু ভূ-কম্পন এবং পানির স্তরের তারতম্য দেখে। তাছাড়া সে সময় তারা পশুপাখির মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেছিলেন। হাইচেং শহরের রাস্তায় হঠাৎ অসংখ্য সাপ ও ইঁদুর দেখে বিষয়টিকে তারা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরের বছর সেই পূর্বাভাস আর দিতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা।

হাইচেং শহরের ভূমিকম্পের আভাস দিয়েছিল সাপেরা

পায়ের তলায় মাটি যখন বার বার কেঁপে উঠে, ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়, গাছপালা-জীব জন্তুও রেহাই পায় না, তখন সেই কম্পনকে আমরা ভূমিকম্প বলি। বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল ( খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২ ) বলেছিলেন, ভূপৃষ্ঠের নীচে জমে থাকা গ্যাস বেরিয়ে আসার জন্য শিলাস্তরে ক্রমাগত তা আঘাত করে বলেই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। আরেক গ্রীক মনীষী লুক্রেটিয়ার বিশ্বাস করতেন, ভূগর্ভের কোনো গুহা যখন কোনো দুর্যোগে ভেঙ্গে পড়ে, তখনই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

ভূমিকম্পে সৃষ্ট ফাটলের দৃশ্য

আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ দিন ধরে নানা গবেষণা শেষে ভূমিকম্প সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছেন। ভূত্বকের শিলাস্তরে নানা সময়ে বিভিন্ন ধরণের চাপ তৈরি হয়। তার প্রভাবে ভূত্বকের শিলাস্তূপ একে অপরের গা ঘেঁষে বিপরীত দিকে নড়াচড়া করতে থাকে। চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকলে শিলাস্তূপের দেয়ালে বিপুল বেগে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ফলে একসময় শিলাস্তর ভেঙ্গে পড়ে। এই ভাঙনের ফলেই ভূমিকম্প হয়। এ কারণে ১৯৬০ সালে সানফ্রান্সিসকোয় যে ভূমিকম্প হয়েছিল, তাতে শহরের চেহারাটাই বদলে গিয়েছিল।

১৯৬০ সালের সানফ্রান্সিসকোর ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত হওয়া শহর

১৯৬৬ সালে রাশিয়ার ভূবিজ্ঞানীরা একবার তাসখন্দ ভূমিকম্প সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পেরেছিলেন। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস সম্পর্কে প্রথম সফল গবেষণা করেছিলেন চীনের বিজ্ঞানী জান হেন (৭৮-১৩৯ খ্রিস্টাব্দে)। তার তৈরি পদ্ধতিটি ছিল বিচিত্র ধরণের। বিশেষভাবে তৈরি এক পাত্রের মধ্যে তিনি রাখেন একটি ঝুলন্ত পেন্ডুলাম। তার সঙ্গে কোণাকুণি জুড়ে দেওয়া হয় আটটি কপিকল। প্রতিটি কপিকলের বাইরের দিকে শেষ প্রান্তে লাগানো হয় আটটি খেলনা ড্রাগন। সমস্ত ড্রাগনের হাঁ করা মুখে দেওয়া হয় একটি করে বল। ভূমিকম্পের সময় মাটি কেঁপে উঠলেই কপিকলের টানে ড্রাগনের মুখ খুলে বলগুলো পড়ে যায় নীচে রাখা আটটি ব্যাঙের মুখে। ড্রাগনের মুখ থেকে ব্যাঙের মুখে বল পড়ে যাওয়া ভূমিকম্পের ইঙ্গিত। দু’হাজার বছর আগে এই যন্ত্রের সাহায্যে বহু দূরের ভূমিকম্পের আভাস মিলতো।

বেশ কিছু প্রাণীর হঠাৎ করেই ব্যবহারের পরিবর্তন দেখেও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস মিলতে পারে। প্রাচীন জাপানী জেলেরা মনে করতো সমুদ্রের মাঝখানে একসাথে উড়ুক্কু মাছ চোখে পড়লে কয়েকদিনের মধ্যেই কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। তারা ভূমিকম্পের ভয়ে তখন তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসতো। গত কুড়ি বছরের মধ্যে এভাবে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া গিয়েছে।

জাপানী জেলেরা উড়ুক্কু মাছ দেখলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়েল আসন্ন বলে বুঝে নেয়

১৮৫৫ সালে টোকিও শহরের কয়েকটি জায়গায় দেখা গেলো হঠাৎ করেই হাঁস-মুরগী ডিম দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার পর আর খাঁচায় ঢুকতে চাইতো না। তাদের হাবে-ভাবে এমন ছটফটানির চিহ্ন ফুটে উঠতো যে, বোঝা যেতো প্রাণীগুলো সেখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে। এর সাতদিনের পর শহরের ঠিক সে জায়গাতেই আঘাত হেনেছিল অনেক বড় মাপের ভূমিকম্প।

ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা উড়ে বেরাচ্ছে। এই দৃশ্য ইতালির জেনোয়া শহরের অতি পরিচিত দৃশ্য। ১৮৫৭ সালে ভূমিকম্পের ঠিক কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই পায়রাশূন্য হয়ে গেলো শহরে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আগামী বিপদের ইঙ্গিত পেয়েই তারা দল বেঁধে দূরের নিরাপদ এলাকায় চলে গিয়েছিল। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস অনুভব করার ক্ষমতা সরীসৃপদেরও আছে। তাই কোনো এলাকায় ভূমিকম্পের ঠিক আগে সাপেদেরও দল বেঁধে গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের লক্ষণ বুঝতে পারে পায়রার দল

১৮৯৬ সালে চীনের তিয়েনসিনে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়। তার মাত্র চারদিন আগে সেখানকার চিড়িয়াখানায় খাঁচার ভিতর থাকা বড় প্রাণীগুলো প্রচন্ড চিৎকার আর দাপাদাপি করতে থাকে। পাখিরাও অস্থির হয়ে ওঠে। গোল্ডেন উইং ওয়ার্ব্লার নামের পাখিদের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করেছিলেন বিজ্ঞানীরা যে তারাও ভূমিকম্পের আভাস টের পেয়ে তাদের আবাসস্থল পরিবর্তন করে নিরাপদ অবস্থানে চলে যায়।

গোল্ডেন উইং ওয়ার্ব্লার পাখি

১৯৫৫ সালে সাবেক যুগোশ্লাভাকিয়ায় এবং ১৯৭৬ সালে ইতালির মধ্য অঞ্চলে ভূমিকম্পের আগে বেশ কিছু প্রাণীর অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গিয়েছিল। এরপর নব্বইয়ের দশকে চীনের বেইজিংয়ে আবারও ইঁদুর, বিড়াল সব ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। কুকুর চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে থাকে।

ভূমিকম্পের পূর্বেই কুকুরের গতিবিধি পরিবর্তন দেখা যায়

এছাড়া গরু, মহিষ, ছাগল, ঘোড়া সব লাফালাফি করতে থাকে। সেসময় প্রায় ত্রিশ ঘণ্টা পরেই সেখানে একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘঠিত হয়৷

ভূমিকম্প ঘটার আগে থেকেই আঁচ করতে পারে গরুও

ক্যালিফোর্নিয়ার ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রাণীদের অনুরূপ আচরণ লক্ষ্য করেছেন। ২০০৪ সালে সুনামির আঘাতে শ্রীলঙ্কায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। বেঁচে গিয়েছিল সমুদ্রের ধার ঘেঁষে গড়ে উঠা ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কের সব প্রাণী। তারা ভূমিকম্পের আগাম আভাস বুঝতে পেরে আশ্রয় নিয়েছিল পাহাড়ের উপর। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে রেইস্ট কোস্ট অঞ্চলে ৫.৮ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয় তা ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি বুঝতে পেরেছিল। কারণ ভূমিকম্পের আভাস পেয়ে নদীতে সাঁতার কাটতে থাকা ৬৪টি ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি একসাথে উড়ে গাছে আশ্রয় নেয়।

ফ্ল্যামিঙ্গো পাখিও ভূমিকম্পের আভাস পায়

২০০৬ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি ঘটার আগে সমুদ্রের গভীর থেকে প্রচুর মাছ উপকূলে এসে জেলেদের জালে ধরা পড়ে। কুনোব্যাঙ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পায়- এ রকম ইঙ্গিত পাওয়ার পর যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিদ ড. রাচেল গ্রান্ট কুনোব্যাঙের এই অদ্ভুত আচরণ নিয়ে গবেষণা করেন। ইতালির সান রাফিনো লেককে গবেষণার স্থান হিসেবে তিনি নির্বাচন করেন, যেখানে প্রায়ই ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। তার এই গবেষণাকালীন সময়টিতে ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল সেখানে ৬.৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। ড. গ্রান্ট জানান, ভূমিকম্প আঘাত হানার পাঁচ দিন আগেই সেখানকার প্রায় ৯৬ শতাংশ ব্যাঙ তাদের প্রজননক্ষেত্র ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে চলে যায়। ভূমিকম্পের পর ব্যাঙগুলো পুনরায় তাদের আবাসস্থলে ফিরে আসে।

ভূমিকম্পের পূর্বেই ব্যাঙের গতিবিধির অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষণীয়

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভূমিকম্পের ঠিক আগে ভূস্তরে অল্প দৈর্ঘ্যের শব্দ তরঙ্গ তৈরি হয়। ভূপৃষ্ঠের উপর ছড়িয়ে পড়ে বৈদ্যুতিক শক্তি বা চার্জ। আর ভূত্বকের ফাটল তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে রেডন নামে এক ধরণের তেজস্ক্রিয় গ্যাস। ভূগর্ভে এই সময় এক প্রকার শব্দও সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি চুম্বকত্বও সৃষ্টি হয়। বিশেষ ধরণের এই শব্দ ধরতে পারে প্রকৃতি প্রদত্ত ক্ষমতা আছে এমন কিছু প্রাণীর। আর বায়ুমন্ডলে সামান্য রেডন গ্যাসের উপস্থিতিও কুকুর, বিড়ালসহ আরও কিছু প্রাণীর বুঝে নিতে কোনো অসুবিধে হয় না।

বায়ুমন্ডলে সামান্য রেডন গ্যাসের উপস্থিতিও বিড়াল বুঝতে পারে

বিজ্ঞানীরা সকলেই একমত যে, প্রাণীরা মানুষের আগেই পরিবেশের পরিবর্তন অনুভব করতে পারে। তারা ভূমিকম্প ও প্রাণীর আচরণের মাঝে যোগসূত্র তৈরি করতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে কিছু কিছু বিজ্ঞানী হাল ছেড়ে দিয়ে অনেক হতাশার বাণীও দিয়ে গিয়েছেন। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ভূকম্পবিদ রবার্ট জে. গেলার একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেন, “ভূমিকম্পের সৃষ্টি ও এর বিকাশের প্রভাব এতো অগণিত ও জটিল যে, এগুলো নির্ণয় ও বিশ্লেষণ করা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়।

তথ্যসূত্র

১) seeker.com/chinese-zoo-animals-monitored-for-earthquake-prediction-1769997970.html

২) time.com/3770676/animals-may-predict-earthquakes/

৩) bbc.co.uk/nature/15945014

৪) rense.com/general61/use.htm

৫) theweathernetwork.com/news/articles/five-animals-who-can-supposedly-predict-earthquakes/52620

Related Articles