রহস্যময় এই পৃথিবী। রহস্য সেখানে আরও নিগূঢ় হয়, যেখানে মানুষের সীমাবদ্ধতা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মানুষের সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে গেছে কিছু প্রাণী। প্রাণীদের আশ্চর্য কিছু ক্ষমতা যুগের পর যুগ ভাবিয়ে তুলেছে মানুষকে। গবেষকরা নিবিড় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন সেসব নিয়ে, রহস্য ভেদ করা গেলে হয়তো তা ব্যবহার করা যাবে মানব জাতির কল্যাণে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভূমিকম্পের একেবারে সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া আজও সম্ভব হয়নি মানুষের পক্ষে। কিন্তু একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমিকম্পের আভাস বেশ আগে থেকেই বুঝতে পারে ব্যাঙ।
২০০৯ সালে ইতালিতে একটি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের বেশ কয়েক দিন আগেই লা’কুইলার একটি পুকুরের প্রায় ৯৬টি ব্যাঙের সবগুলো পুকুর ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় মাত্র তিন দিনে। এক্ষেত্রে মনে করা হয়, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নির্ণয়ে ব্যাঙের এই আশ্চর্য আচরণ দারুণ সহায়তা করবে। কীভাবে ব্যাঙ বুঝতে পারে যে ভূমিকম্প হতে পারে, তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। ব্যাঙের মতো আরও অনেক প্রাণী রয়েছে, যারা তাদের রহস্যময় ও অসাধারণ আচরণ দিয়ে আমাদের অবাক করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
ইঁদুর
ভূমি মাইন ও পুঁতে রাখা বিস্ফোরকের বিস্ফোরণে ২০১৩ সালে গোটা পৃথিবীতে নিহত হয়েছে প্রায় ৩,৩০৮ জন, ২০১২ সালেই এই সংখ্যাটা ছিল প্রায় ৪,৩২৫। এই নিহতের সংখ্যা কমে আসার পেছনে অবদান রয়েছে আফ্রিকান বড় ইঁদুরগুলোর। আফ্রিকান এই বড় ইঁদুরগুলোর দৃষ্টিশক্তি খুবই বাজে, এই জন্যই হয়তো তাদের ঘ্রাণশক্তি খুবই তীব্র। এই তীব্র ঘ্রাণশক্তির দরুন ইঁদুরগুলো খুঁজে বের করতে পারে বিস্ফোরক টিএনটি। মাত্র নয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ইঁদুরগুলো মাত্র ২০ মিনিটে ২০০ বর্গ মিটার এলাকায় অনুসন্ধান চালাতে সক্ষম!
এই কাজটুকু করতে একজন মানুষের লাগবে আনুমানিক ৪ দিন এবং সেইসাথে রয়েছে জীবনের ও পঙ্গুত্ব বরণের ঝুঁকি। কিন্তু ইঁদুরগুলো অতটা ভারী নয়, যতটা ওজনে একটি মাইন বিস্ফোরিত হতে পারে। ১৯৯৭ সাল থেকে ভূমি মাইন অপসারণে এই ইঁদুরগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, তানজানিয়া এবং কম্বোডিয়ায় প্রায় ১৩,২০০টি মাইন অপসারণ করতে সাহায্য করে তীব্র ঘ্রাণশক্তির এই ইঁদুরগুলো।
মৌমাছি
বিস্ফোরক শনাক্তকরণে কুকুরের ব্যবহার অনেক পুরনো, একই ভূমিকায় কাজ করতে পারে ইঁদুরও। কিন্তু মৌমাছি প্রাণী জগতের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, যারা ঘ্রাণশক্তি ব্যবহার করে বিস্ফোরক বা বোমা শনাক্ত করতে সক্ষম। মৌমাছি শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার দূর থেকে টিএনটি শনাক্ত করতে পারে।
একদল ক্রোয়েশিয়ান গবেষক মাইন শনাক্ত করার জন্যে মৌমাছিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে ক্রোয়েশিয়ান গবেষকরা নব্বই দশকে যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধে পুঁতে রাখা মাইন শনাক্ত করতে মৌমাছি ব্যবহার করে আসছে। এমনকি মাইন শনাক্তকরণে প্রশিক্ষিত মৌমাছিরা নিজেরাই প্রাকৃতিকভাবেই অন্য মৌমাছিদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে।
ভ্রমর
মধু সংগ্রহের জন্য ফুল নির্বাচনে ভ্রমর যতগুলো পন্থা অবলম্বন করে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অসাধারণ হচ্ছে বিভবের (Voltage) ব্যবহার। আশেপাশের তড়িৎক্ষেত্র ব্যবহার করে ভ্রমর তন্ন তন্ন করে ফুল খুঁজে বেড়ায়। বাতাসে উড়ে বেড়ানোর সময় ভ্রমর সামান্য ধনাত্মক চার্জ উৎপন্ন করে। এক্ষেত্রে ভ্রমরকে সাহায্য করে এটির পায়ে থাকা লোমগুলো। ভ্রমরের ধনাত্মক চার্জ স্বভাবতই আকর্ষণ করে ফুলে থাকা ঋণাত্মক চার্জগুলোকে।
যদি কোনো ফুলে অন্য একটি ভ্রমর আগেই ভ্রমণ করে যায়, তাহলে ফুলে থাকা চার্জে পরিবর্তন আসে। যা থেকে অন্য ভ্রমরগুলো বুঝতে পারে যে, এই ফুলে আগেই কোনো একটি ভ্রমর বসেছিল।
সাপ
রাতের অন্ধকারে দেখার জন্য একধরনের ভাইপার, অজগর ও বোড়া সাপের রয়েছে বিশেষ রকমের প্রোটিন চ্যানেল, যা তাদের রাতের অন্ধকারে দেখতে সাহায্য করে। এই সাপদের মুখে থাকা গর্তে একটি বিশেষ ঝিল্লী থাকে, যা প্রায় এক মিটার দূরেরও কোনো উষ্ণ বস্তু থেকে নির্গত অবলোহিত বিকিরণ নির্ণয় করতে পারে। এই অবলোহিত বিকিরণের সাহায্য নিয়ে সাপগুলো শিকারি কিংবা শিকারের একটি আকার বা ‘ছবি’ দেখতে সক্ষম, যেমনটা ঠিক ইনফ্রারেড ক্যামেরায় দেখা যায়।
ঝিল্লীগুলো অবলোহিত বিকিরণে উত্তপ্ত হয়ে যখন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পৌছায়, তখন তড়িৎ সংকেতের মাধ্যমে সাপের স্নায়ু কোষে গিয়ে পৌছায়। ঝিল্লী সম্বলিত এই গর্তগুলো এতটাই সংবেদনশীল যে, এগুলো সামান্য থেকে শুরু করে হাজার ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রার পার্থক্য করতে পারে।
পাখি
শীতকালে অতিথি পাখির বিশাল সমারোহ দেখা যায় আমাদের এই বাংলাদেশে, যাদের বিশাল একটি অংশ আসে উত্তর গোলার্ধের ঠাণ্ডা অঞ্চলগুলো থেকে। প্রায় হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পাখিগুলো এই দেশে পৌঁছায়, মাতৃভূমিতে শীত কমে গেলে আবার ফিরে যায়। কখনো কি ভেবে দেখেছেন যে, কোনো মানচিত্র বা ভৌগোলিক জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এত দূরের পথ নির্ভুলভাবে পাড়ি দিচ্ছে পাখিগুলো?
দীর্ঘ গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি ও দিক অনুভব করতে পারে। দিক নির্ণয় করে, নির্ভুল পাড়ি দিতে পাখিরা তাদের এই দক্ষতাকে কাজে লাগায়। তাদের এই ক্ষমতার উৎস যে কোষ, তা নিহিত রয়েছে কানে গভীরে। এটিই পাখিদের দিক নির্ণায়ক যন্ত্র হিসেবে হিসেবে কাজ করে।
রক্তখেকো বাদুড়
রক্তখেকো বাদুড়েরা একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী, যারা রক্ত পান করে বেঁচে থাকে। সাধারণত এই বাদুড়েরা বড় পাখির রক্তের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু দেখা গেছে এরা অনেক সময় মানুষের রক্তও পান করে। আপনার চায়ের কাপ কিংবা কফির মগ কতটা গরম যে প্রোটিনের কল্যাণে আপনি বুঝতে পারেন, ঠিক সেই প্রোটিন রয়েছে রক্তখেকো বাদুড়ের নাকে।
এই TRPV1 প্রোটিনের সাহায্যে বাদুড়গুলো অনায়াসে খুঁজে বের করতে পারে, কোথায় রয়েছে গরম রক্তের চলাচল অর্থাৎ শিরা-উপশিরা। খাবারের সন্ধানে তাই এদের বারবার আক্রমণ করে মোক্ষম জায়গা খুঁজে বের করতে হয় না, চামড়ার উপর থেকেই তারা অনুধাবন করতে পারে ঠিক কোথায় তাদের কামড় বসাতে হবে।
হাতি
হাতিরা হুটহাট তাদের স্বাভাবিক চলার পথ পরিবর্তন করে এবং পাড়ি জমায় বৃষ্টি হতে পারে এমন অঞ্চলে। হাতিদের এই আচরণ একটি লম্বা সময় ভাবিয়েছে গবেষকদের। হাতিরা প্রায় ২৮০ কিলোমিটার দূর থেকেই বুঝতে পারে কোথায় ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। একেবারে নিশ্চিত করে না বলা গেলেও, গবেষকদের ধারণা, ঝড়বৃষ্টির প্রক্রিয়াটি একধরনের নিম্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এই তরঙ্গ বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিতে সক্ষম, যা হাতিরা ধরতে পারে।
কম্পাঙ্কের মাত্রা মানুষের শ্রবণ শক্তির বাইরে হওয়ায় সাধারণত আমরা তা শুনতে পাই না। প্রায় একই ধরনের কম্পাঙ্ক উৎপন্ন হয় বজ্রপাতের বেলায়ও। যোগাযোগের ব্যাপারেও হাতিরা নিম্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ব্যবহার করে, শুঁড় ও পায়ের সাহায্যে এসব কম্পাঙ্ক হাতিরা প্রায় ১০ মাইল দূর থেকে নির্ণয় করতে পারে। তরঙ্গ কম্পাঙ্কের পার্থক্য থেকেই হাতিরা বুঝতে পারে তার দিকে চিৎকার করা ব্যক্তিটি অচেনা কেউ, শত্রু, নাকি বন্ধু।
ফিচার ইমেজ: globalgiving.org