কত সুন্দর আমাদের এ পৃথিবী। ভোরের রক্তিম সূর্যোদয়, সুবিশাল নীল আকাশের কাব্যময়তা, সবুজ বনানীর সতেজতা, সমুদ্রের মায়াবী নীল জলরাশির মুগ্ধতা, পর্বতের গাম্ভীর্য, পাখির কলরব, বৃষ্টিমুখর কোনো সন্ধ্যা কিংবা বাহারী ফুলের অপরুপ সৌন্দর্যে আমাদের চোখে অপার মুগ্ধতার ঘোর লাগে। আর রাতের তারাভরা আকাশ, জোনাকির মিটিমিটি আলো, পূর্ণিমার বাধভাঙা জ্যোৎস্না কিংবা চোখধাঁধানো আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া রাতের শহর দেখে বুকে হাজারো স্বপ্ন জাগে, জীবনটাকে ভীষণ ভালবাসতে ইচ্ছা করে।
সুস্বাদু খাবারের মোহনীয় স্বাদ এবং প্রিয়জনের স্নেহের ছোঁয়া ও অবারিত ভালবাসায় সিক্ত হয়ে আমাদের এই মায়াময় পৃথিবীতে অনন্তকাল বাঁচতে ইচ্ছা করে৷ কিন্তু আমাদের এই ইচ্ছাপূরণের পথে একটাই বাধা- মৃত্যু! তাই মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই মৃত্যুকে জয় করে অমরত্ব অর্জনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছে। মধ্যযুগের অ্যালকেমিস্টদের এলিক্সির অফ লাইফের সন্ধানে সারাজীবন ব্যয় করা এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই অত্যাধুনিক যুগেও বিজ্ঞানীরা অমর হওয়ার নানা উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা নিরলসভাবেই করে যাচ্ছেন। অমরত্ব অর্জনের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কেউ কি পেরেছেন অমর হতে বা খুঁজে পেয়েছেন অমরত্ব অর্জনের উপায়?
আমরা এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে কোনোরকম আলোচনায় না গিয়ে চলুন ছোট্ট একটি কল্পবিজ্ঞানের জগত থেকে ঘুরে আসি।
আপনি অশীতিপর বৃদ্ধ। শরীরের চামড়া ঝুলে পড়েছে। চোখেও বিশেষ দেখতে পান না। শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগে। একদিন আপনার বৃদ্ধ বয়সের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আপনার এক পুরনো শত্রুর কোনো বংশধর গভীর রাতে আপনাকে আক্রমণ করে বসল। শত্রুর মোকাবেলা করতে গিয়ে হঠাতই আপনি আবিষ্কার করলেন, আপনি হয়ে গেছেন কমবয়সী, তাজাপ্রাণ এক যুবক। তারপর শক্তিশালী আপনি অনায়াসে কুপোকাত করে ফেললেন শত্রুকে । অবিশ্বাস্য, তাই না?
এ পর্যায়ে আপনার জন্য সুখবর হচ্ছে, আপনি, এই মাটির পৃথিবীতেই মধ্যবয়স্ক অবস্থা থেকে যুবক বা কিশোর হতে পারবেন। কিন্তু খারাপ খবর হচ্ছে- সেজন্য আপনাকে জেলিফিশ হতে হবে!
নাহ, গুল মারছি না। পৃথিবীতে সত্যিই একধরনের জেলিফিশ আছে, যারা জৈবিকভাবে প্রায় অমর। Turritopsis dohrnii নামের এই জেলিফিশ পাওয়া যায় ভূমধ্যসাগর এবং জাপানের আশেপাশের সাগরে।
১৮৮০ এর দশকে প্রথম আবিষ্কার হলেও এরা যে অমর এটা প্রমাণিত হয় প্রায় একশ’ বছর পর. ১৯৯০ এর দশকে। এরা এদের জীবনচক্রের প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বা যৌন দশায় পৌঁছানোর পর বিশেষ কিছু উদ্দীপনায় প্রভাবিত হয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক বা অযৌন দশায় ফিরে যেতে পারে। অন্যান্য প্রজাতির জেলিফিশের জীবনকাল যেখানে নির্দিষ্ট, সেখানে এরা প্রায় অনন্ত জীবনের অধিকারী। এখন আপনার প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে তা সম্ভব, তাই তো?
সেজন্য আমাদের সাধারণ জেলিফিশ ও অমর জেলিফিশের জীবনচক্রের দিকে একটু তাকাতে হবে। প্রথমেই একটি সাধারণ জেলিফিশের জীবনচক্র সম্পর্কে ধারণা নেয়া যাক।
বেশিরভাগ হাইড্রোজোয়ার মতো জেলিফিশের জীবন শুরু হয় লার্ভা হিসেবে। প্রথমে সাগরের তলায় পুরুষ জেলিফিশ স্পার্ম ছাড়ে। সেখান থেকে কিছু স্পার্ম (শুক্রাণু) স্ত্রী জেলিফিশের দেহে প্রবেশ করে। তারপর ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন হয়। এর কিছু পরেই জন্ম হয় মুক্তভাবে সাঁতার কাটতে সক্ষম জেলিফিশ লার্ভার, যাকে বলা হয় প্লানুলা। প্লানুলা সাঁতরে সাগরের আরও গভীরে ডুবতে থাকে এবং একসময় সাগরতলে পৌঁছে যায় এবং কোনো পাথরের গায়ে আশ্রয় খুঁজে নেয়। এরপর প্লানুলার আকার-আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে বহু শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট পলিপে (অযৌন দশা) রুপ নেয়।
পলিপ থেকে জন্ম হয় ছোট ছাতার মতো শরীর আর অনেকগুলো কর্ষিকাযুক্ত পূর্ণাঙ্গ জেলিফিশের। সপ্তাহখানেক পর এই জেলিফিশগুলো যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। তারা পুরুষ বা মহিলা জেলিফিশে পরিণত হয়। এই দশাকে বলা হয় মেডুসা বা যৌন দশা। তখন এদের আকার হয় ৫ মি.মি. এর মতো। এদের স্বচ্ছ শরীরের ভেতর দিয়ে লাল পাকস্থলী দেখা যায়। এরা প্ল্যাংকটন, ছোট মলাস্ক, লার্ভা, মাছের ডিম প্রভৃতি খেয়ে জীবনধারণ করে। পরিপক্ক মেডুসারা একসময় আবারও যৌন প্রজননের মাধ্যমে এই চক্রের পুনরাবৃত্তি করে এবং প্রজনন শেষে একসময় মারা যায়।
এবার অমর জেলিফিশের জীবনচক্রের দিকে তাকানো যাক।
অমর জেলিফিশ অর্থাৎ T. dohrnii ও যৌন প্রজনন করে। এরাও সাধারণ জেলিফিশের মতো প্রথমে লার্ভা, তারপর পলিপ ও সবশেষে মেডুসা দশায় পদার্পণ করে। মেডুসা দশায় এদের আকার হয় মাত্র ৪.৫ মি.মি.। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, T. dohrnii মেডুসা দশা থেকে পলিপ দশায় ফিরে আসতে পারে।
যৌনভাবে অপরিপক্ক মেডুসা বা পরিপক্ক মেডুসা দুই অবস্থা থেকেই এরা পলিপ হতে পারে। অনেকটা পূর্ণবয়স্ক প্রজাপতি থেকে আবার শুয়োপোকা হয়ে যাওয়া বা মুরগির ছানা থেকে ডিম হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার আর কী!
T. dohrnii এ যে প্রক্রিয়ায় এ পরিবর্তন হয়, তাকে বলে ট্রান্সডিফরেন্সিয়েন। এ প্রক্রিয়ায় একটি পরিণত কোষ আরেকটি পরিণত কোষে রুপান্তরিত হতে পারে। এভাবে মেডুসা থেকে পলিপ হতে গেলে জেলিফিশের শরীর আর কর্ষিকা দুটোই সংকুচিত হয়ে বলের মতো হয়ে যায়। তারপর সাগরের তলদেশে আস্তানা গাড়ে এবং স্বাভাবিক পলিপের মতোই মেডুসার জন্ম দিতে পারে। সাধারণ কোনো পরিস্থিতিতে কিন্তু এই রুপান্তর হয় না। যখন মেডুসা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রতিকূল হলে, খাবারের অভাবে পড়লে বা এরকম কোনো বিপদে পড়লেই কেবল এই রুপান্তর সম্ভব। অসংখ্যবার তারা এভাবে রুপান্তরিত হতে পারে। তাহলে, কোনোভাবেই কি এদের মৃত্যু হয় না?
অবশ্যই হয়। যখন অন্য কোনো শিকারী প্রাণীর শিকার হয় বা রোগবালাইয়ে পড়ে, তখন এদের অমর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
T. dohrnii বনাম T. nutricula
Turritopsis গণের তিনটি প্রজাতিকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল তারা অমর কি না তা জানতে। এরা হলো- T. dohrnii, T. nutricula এবং T. rubra। এদের মধ্যে ল্যাবরেটরিতে কেবল T. dohrnii এর জীবনচক্রের পর্যবেক্ষণ একে অমর বলে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ তবে দীর্ঘদিন ধরে T. dohrnii কে T. nutricula বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।
নিউট্রিকুলা ক্যারিবিয়ান সাগর ও উত্তর মহাসাগরে দেখা যায়। কিন্তু এরা কখনো জৈবিকভাবে অমর প্রমাণিত হয়নি। তাই বলা যায়, জেলিফিশের শুধু একটি প্রজাতি T. dohrnii-ই জৈবিকভাবে অমর।
অমর জেলিফিশের এই রহস্যময় ও অদ্ভুত জীবনচক্র নিয়ে গবেষণা স্টেম সেল গবেষণায় নতুন দ্বার উন্মুক্ত করবে বলে অনেক বিজ্ঞানী আশা করেন। এতে ক্ষতিগ্রস্থ কোষকে প্রতিস্থাপন করা সহজ হবে। হয়তো এই গবেষণা মানুষকে দীর্ঘজীবন উপহার দিতে সক্ষম হবে। তবে হতাশার ব্যাপার হচ্ছে, অমর প্রজাতির জেলিফিশ ল্যাবরেটরিতে চাষ করা বেশ দুরুহ ব্যাপার। এরপরও জাপানের কিয়েটো ইউনিভার্সিটির সেটো মেরিন বায়োলজি ল্যাবরেটরিতে প্রফেসর শিন কুবুটা এই জেলিফিশের চাষ করছেন এবং এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বেশিরভাগ মেরিন বায়োলজিস্ট এটা স্বীকার করতে অস্বস্তিবোধ করেন যে, Turritopsis গবেষণা ওষুধশিল্পে বিপ্লব আনবে বা চিকিৎসাশাস্ত্রে বড় কোনো পরিবর্তন আনবে। প্রফেসর কুবুটা তাদের এই ধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিশ্বাস করেন, জেলিফিশ নিয়ে গবেষণা তাৎপর্যপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পথ দেখাবে এবং ক্যান্সার ও ক্ষতের চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করবে।