ইংল্যান্ডের পাশে অবস্থিত প্রায় ৮৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের ছোট একটি দ্বীপ রাষ্ট্র আয়ারল্যান্ড। শুনতে অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু পুরো আয়ারল্যান্ডে কোনো সাপ নেই। ব্যক্তিগতভাবে কিছু শৌখিন ব্যক্তির সংগ্রহে বা চিড়িয়াখানায় অবশ্যই অল্প কিছু সাপ আছে, কিন্তু পুরো আয়ারল্যান্ডের বনে-জঙ্গলে কোথাও কোনো সাপ নেই। আইরিশ রূপকথা অনুযায়ী, আয়ারল্যান্ডে সাপ না থাকার কারণ হচ্ছে, সেইন্ট প্যাট্রিক নামে এক ধর্মপ্রচারক মন্ত্রের জোরে সকল সাপকে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন এবং সাপের হাত থেকে আয়ারল্যান্ডকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু আসলেই কি তাই?
সেইন্ট প্যাট্রিকের জন্ম হয়েছিল আনুমানিক ৩৮৫ খ্রিস্টাব্দে, উত্তর ইংল্যান্ড অথবা দক্ষিণ স্কটল্যান্ডের কোনো স্থানে। সে সময় এই অঞ্চলের অধিবাসীরা মূর্তিপূজক ছিল। ১৬ বছর বয়সে প্যাট্রিক ডাকাতদলের হাতে অপহৃত হন। তারা তাকে আয়ারল্যান্ডে নিয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত দাস হিসেবে কাজে লাগায়। এই সময় তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন।
প্রায় ছয় বছর দাস হিসেবে বন্দী থাকার পর প্যাট্রিক ফ্রান্সে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি একটি আশ্রমে পড়াশোনা করেন এবং এরপর আয়ারল্যান্ডে ফিরে এসে সেখানকার অধিবাসীদেরকে মূর্তিপূজা থেকে খ্রিস্টধর্মের প্রতি আহ্বান জানাতে থাকেন। তার পূর্ব নাম ছিল মেউইন সুকাট। আয়ারল্যান্ডে আসার পর তিনি খ্রিস্টান নাম প্যাট্রিসিয়াস গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে প্যাট্রিক হিসেবে পরিচিত হন।
সেইন্ট প্যাট্রিক ছিলেন আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আয়ারল্যান্ডের বিশপ হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পুরো আয়ারল্যান্ড জুড়ে অনেক আশ্রম, গির্জা এবং বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি মিশনারী কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং আয়ারল্যান্ডবাসীকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন।
আইরিশ উপকথা অনুযায়ী, আয়ারল্যান্ডে ধর্ম প্রচারের এক পর্যায়ে সেইন্ট প্যাট্রিক ৪০ দিনের জন্য এক পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছিলেন ধ্যান এবং উপবাস পালন করার জন্য। সে সময় তাকে কিছু সাপ আক্রমণ করলে তিনি আয়ারল্যান্ডের সকল সাপকে তাড়িয়ে সমুদ্রে নিয়ে যান এবং আয়ারল্যান্ডকে সাপমুক্ত করেন। সেই থেকে আয়ারল্যান্ডে আর কোনো সাপ আসতে পারেনি।
আইরিশ এই উপকথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও সম্ভবত এটি শুধুই উপকথা। সাপকে সব সময়ই অশুভ শক্তির প্রতীক এবং মূর্তি পূজক বা শয়তানের উপাসকদের সাথে সম্পর্কিত করা হতো। তার সাথে হযরত মুসা (আ) এর ৪০ দিনের বনবাসের কাহিনীর পরিবর্তিত রূপ মিশ্রিত হয়েই সম্ভবত এই উপকথাটি তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই ঘটনার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের মতে, সেইন্ট প্যাট্রিকের পক্ষে সাপ নির্বাসিত করা সম্ভবই ছিল না। কারণ আয়ারল্যান্ডে কোনোকালেই সাপ ছিল না।
ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আয়ারল্যান্ডের প্রাকৃতিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষক নাইজেল মোনাগান জানান, আয়ারল্যান্ডে কখনোই কোনো সাপের ফসিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এ অঞ্চলে কোনো সাপ ছিল না।
বিশ্বের সব দেশেই কমবেশি সাপ আছে। কিন্তু তাহলে আয়ারল্যান্ডে কেন সাপ নেই? এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, আয়ারল্যান্ড একটি দ্বীপ। কাছাকাছি স্থলভূমির সাথে আইরিশ সমুদ্রের উপর দিয়ে এর দূরত্ব সর্বনিম্ন ৭০ কিলোমিটার। কোনো সাপের পক্ষে এতো দূরের পথ সাঁতরে পাড়ি দেওয়া সম্ভব না। সামুদ্রিক সাপের কথা অবশ্য ভিন্ন, তারা দীর্ঘসময় পানিতে থাকতে পারে এবং দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে পারে। কিন্তু সামুদ্রিক সাপের বসবাস উষ্ণ জলবায়ুর অঞ্চলগুলোতে। আয়ারল্যান্ডের বরফ-শীতল আটলান্টিক মহাসাগর তাদের বসবাসের জন্য উপযোগী না।
এ হিসেবে অবশ্য এই এলাকার কোনো দ্বীপেই সাপ থাকার কথা ছিল না। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের নিকটবর্তী ইংল্যান্ডেই প্রচুর সাপ আছে, এবং ইংল্যান্ডও একটি দ্বীপ-রাষ্ট্র। প্রশ্ন উঠতে পারে, পাশাপাশি দুটো দ্বীপের মধ্যে একটিতে সাপ আছে, অন্যটিতে নেই কেন?
এর উত্তর নিহিত আছে আয়ারল্যান্ডের সৃষ্টির ইতিহাসে। এক সময় আয়ারল্যান্ড বা ইংল্যান্ড কোনো দেশেই কোনো সাপ ছিল না। বরফ যুগে এই দ্বীপগুলো সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর বসবাসের জন্য উপযোগী ছিল না। কারণ শীতল রক্ত বিশিষ্ট সরীসৃপ শ্রেণীর প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য আশেপাশের পরিবেশ থেকে তাপ শোষণ করতে হয়।
আজ থেকে প্রায় ১০,০০০ বছর আগে যখন সর্বশেষ বরফ যুগের অবসান হতে থাকে এবং বরফ গলতে শুরু করে, তখন প্রথম দিকে আয়ারল্যান্ডের সাথে ইংল্যান্ডের এবং ইংল্যান্ডের সাথে ইউরোপের যাতায়াতের স্থলপথ বিদ্যমান ছিল। বরফের আচ্ছাদনে তৈরি এসব সরু সেতুবন্ধনের মতো স্থলভাগের উপর দিয়েই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করা যেত। কিন্তু পৃথিবী যত উষ্ণ হতে থাকে, এসব বরফের সংযোগপথ ততোই গলতে থাকে এবং একসময় সমুদ্রে বিলীন হয়ে আয়ারল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করে।
আয়ারল্যান্ডের সাথে ইংল্যান্ডের সংযোগ পথটি সমুদ্রের বুকে বিলীন হয় আজ থেকে প্রায় ৮,৫০০ বছর আগে। ততদিনে বাদামী ভালুক, বন্য শূকর, এবং বন বিড়াল সহ বেশ কিছু প্রাণী আয়ারল্যান্ডে স্থান করে নিলেও সরীসৃপরা তখনও সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। সেই তুলনায় ইংল্যান্ডের সাথে ইউরোপের সংযোগ পথটি আরও বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। আয়ারল্যান্ড বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হওয়ার আরও ২,০০০ বছর পরে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৬,০০০ বছর আগে ইংল্যান্ডের সাথে ইউরোপের সংযোগ পথ সমুদ্রে ডুবে গিয়ে ইংল্যান্ডকে দ্বীপে পরিণত করে।
ততোদিনে অন্যান্য অনেক প্রাণীর সাথে সাথে সাপের অন্তত তিনটি প্রজাতি ইংল্যান্ডের মাটিতে নিজেদের আবাসভূমি তৈরি করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন প্রাণী ইউরোপ থেকে আয়ারল্যান্ডের তুলনায় ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য অন্তত ২,০০০ বছর বেশি সময় পেয়েছিল।
লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির হেলথ সায়েন্স সেন্টারের পরিচালক মার্ক রায়্যান বলেন, আয়ারল্যান্ডে কোনো সাপ নেই, তার কারণ আবহাওয়া তাদের উপযোগী না হওয়ায় তারা সেখানে পৌঁছতে পারেনি, সময় তাদের পক্ষে ছিল না। একই কারণে শুধু আয়ারল্যান্ড একা না, বিশ্বের আরও কয়েকটি দ্বীপ রাষ্ট্র, যেমন নিউজিল্যান্ড, আইসল্যান্ড, গ্রীনল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকাতেও কোনো সাপ নেই।
শুধু সাপ না, বরফ যুগের পর আয়ারল্যান্ডে কোনো সরীসৃপই প্রবেশ করতে পারেনি, শুধুমাত্র টিকটিকি বাদে। নাইজেল মোনাগানের মতে, আজ থেকে ১০,০০০ বছর পূর্বে প্রবেশ করা এই টিকটিকিগুলোই একমাত্র সরীসৃপ, যা প্রাকৃতিকভাবে আয়ারল্যান্ডে প্রবেশ করতে পেরেছিল।
তবে আগে ছিল না বলেই যে ভবিষ্যতে আয়ারল্যান্ডে কখনও সাপের আবির্ভাব ঘটবে না, সেটা নিশ্চিত করা বলা যায় না। নব্বইয়ের দশক থেকে অনেক আইরিশ শৌখিন ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে আনা সাপের চাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর খরচ পোষাতে না পেরে তাদের অনেকে সেসব সাপ বনে-জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন। এসব সাপ হয়তো বংশবিস্তার করে এক সময় আয়ারল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করতে পারে।
তবে গবেষক মোনাগানের মতে, সেটা আয়ারল্যান্ডের জন্য খুবই বিপজ্জনক হবে। তিনি বলেন, আয়ারল্যান্ডের মতো বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে বাহির থেকে আনা কোনো নতুন প্রজাতির প্রাণীকে জোর করে বংশ বিস্তার করানোর চেষ্টা কখনোই ঝুঁকিমুক্ত হয় না। এর ফলে দ্বীপটির অন্যান্য কীটপতঙ্গ এবং গাছপালা অস্তিত্বের সংকটে পড়তে পারে।
পিটসবার্গ চিড়িয়াখানার পরিচালক হেনরি ক্যাসপারজিক বলেন, বাহির থেকে আনা সাপের কোনো প্রজাতি যদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আয়ারল্যান্ডের অবস্থা গুয়াম দ্বীপের মতো হয়ে উঠতে পারে। গুয়াম দ্বীপে বাদামী গেছো সাপ এত বেশি বংশ বিস্তার করে যে, সেখানকার ছোট ছোট পাখির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে হেলিকপ্টার থেকে হাজার হাজার বিষ মাখানো ব্যাঙ নিক্ষেপ করে, যেগুলো খেলে সাপগুলো বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করবে।
কাজেই সেইন্ট প্যাট্রিকের আয়ারল্যান্ড থেকে মন্ত্রবলে সাপ নিষিদ্ধ করার কাহিনী যদি সত্য না-ও হয়, তবুও দ্বীপ রাষ্ট্রের নিজেদের স্বার্থেই হয়তো সাপ নিষিদ্ধ করে রাখা মঙ্গলজনক হবে।