![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/bee.jpg?w=1200)
গণিত মানেই কঠিন কঠিন সব সমীকরণ আর প্রাণহীন শুষ্ক বিষয়! এমন ধারণা আমরা অনেকেই পোষণ করি। গণিতের সৌন্দর্য খোঁজা তো দূরে থাক, কখনো কি প্রকৃতিতে গণিতকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি? না, করিনি। আমাদের চারপাশে এমন অনেক জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যাদের মাঝে লুকিয়ে থাকা কত না গণিতের সৌন্দর্য। সেটা হতে পারে গাছের পাতায়, পানির ফোঁটায়, শামুকের খোলসে, মৌচাকে, মাকড়শার জালে কিংবা চোখের সামনে কোনো ফাটলে। গণিত লুকিয়ে আছে কিছু মানুষের মুখমণ্ডলের গঠনে। চলুন, আজ আপনাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসি গণিতের সৌন্দর্যের জগতে।
সূর্যমুখীর বীজের প্যাটার্ন
সূর্যমুখীর বীজ একটি বিশেষ প্যাটার্নে বিন্যস্ত থাকে। একে ফিবোনাক্কি ধারা বা ক্রম বলে। ধারাটি এরকম: ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪…। অর্থাৎ এই ধারার কোনো একটি পদ তার পূর্বের দুইটি পদের যোগফলের সমান। ধারাটি শুধুমাত্র সূর্যমুখীর বীজে পাওয়া যায় তা নয়। এমন অনেক উদ্ভিদের মাঝেই এই ধারায় বীজের বিন্যাস দেখা যায়। ছবিতে লক্ষ করুন, কী দেখতে পাচ্ছেন?
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/sunflower-701x342.png)
সূর্যমুখীর বীজে সোনালী অনুপাত। ছবিসূত্র: pinterest.com
একটু খেয়াল করলে বীজের বিন্যাসে দুই ধরনের স্পাইরাল দেখতে পাবেন। এক ধরনের স্পাইরাল ঘড়ির কাঁটার দিকে, অন্যটি ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে। সূর্যমুখীর বীজগুলো একটি অপরটির সাথে ১৩৭.৫ ডিগ্রী কোণ করে অবস্থান করে। এই ১৩৭.৫ ডিগ্রীকে বলা হয় গোল্ডেন অ্যাঙ্গেল।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/golden-angle-701x526.jpg)
গোল্ডেন অ্যাঙ্গেল। ছবিসূত্র: gofiguremath.org
পাঠক ভাবছেন, ফিবোনাক্কি ধারার সাথে গোল্ডেন অ্যাঙ্গেলের সম্পর্ক কী? এ দুয়ের মধ্যে খুবই অবিচ্ছেদ্য একটি সম্পর্ক রয়েছে। ফিবোনাক্কি ধারার প্রতিটি পদকে তার আগের (বা পরের) পদ দিয়ে ভাগ করলে যে অনুপাত পাওয়া যায় তাকে ফিবোনাক্কি অনুপাত বলে। যেমন-
1/1 = 1
2/1 =2
3/2 = 1.5
5/3 =1.67
8/5 = 1.6
13/5 = 1.625
21/13 = 1.615384615
……………………………………..
……………………………………..
144/233 = 0.6180257511
233/377 = 0.6180371353
সোনালী অনুপাত (Golden Ratio) বলে একটি অনুপাত রয়েছে, যার মান 1.618033989 অথবা 0.618033989। ফিবোনাক্কি অনুপাতগুলোর মান গোল্ডেন রেশিওর প্রায় সমান। আর 0. 618033989 টি টার্ন 222.5 ডিগ্রীর সমান তাই বাকিটুকু 137.5 ডিগ্রী। 137.5 ডিগ্রীকে ‘গোল্ডেন অ্যাঙ্গেল’ বলে।
পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, সূর্যমুখী গোল্ডেন রেশিও জানলো কীভাবে কিংবা বীজগুলোকে স্পাইরালে কেন সাজিয়ে রাখে? আসলে সূর্যমুখী সোনালী অনুপাত এবং স্পাইরাল কী, তা জানে না। বিষয়টা হলো স্পাইরালে সবচেয়ে কম শক্তি খরচ করে সূর্যমুখী তার বীজগুলোকে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখতে পারে। সরলরৈখিক বিন্যাসে অনেক জায়গা খরচ হয় বলে স্পাইরাল সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। এর জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচনই (Natural Selection) দায়ী। শুধু সূর্যমুখী নয়, ফাইলোট্যাক্সিস (Phyllotaxis), লাল বাঁধাকপি ( Red Cabbage ), আনারস এবং সালাক ফলেও বিভিন্ন ধরনের স্পাইরাল রয়েছে। তবে সব সূর্যমুখীতে অবশ্য সোনালী অনুপাত পাওয়া যায় না।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/Aloe_polyphylla_1-701x597.jpg)
ফাইলোট্যাক্সিসের অসাধারণ ছবিটি তুলেছেন Stone Shebs
শামুকের খোলস
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/Nautillus-shell.png)
শামুকের খোলসের অভ্যন্তরীণ গঠন। ছবিসূত্র: yogaengineer.com
শামুকের খোলসের মাঝেও ফিবোনাক্কি স্পাইরাল রয়েছে। ফিবোনাক্কি স্পাইরাল অনেকটা গোল্ডেন স্পাইরালের মতো দেখতে বলে, অনেকে মনে করেন শামুকের খোলসেও বুঝি সোনালী অনুপাত বিদ্যমান। তবে প্রকৃতিতে অল্প সংখ্যক শামুকের খোলসে ফিবোনাক্কি স্পাইরাল দেখা যায়। বাকি সব শামুকে লগারিদমিক স্পাইরাল দেখা যায়। ফিবোনাক্কি স্পাইরাল, গোল্ডেন স্পাইরাল এরা সবই একেক ধরনের লগারিদমিক স্পাইরাল।
আচ্ছা, শামুকের মতো বুদ্ধিহীন প্রাণী নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য কীভাবে এই পন্থা অবলম্বন করলো? এই প্রশ্নের উত্তর ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ সবচেয়ে সুন্দরভাবে দিতে পারবে। লগারিদমিক স্পাইরালে বৃদ্ধি (Accretional Growth) শামুকের আকারে প্রতিসাম্যতাকে ঠিক রাখে। লগারিদমিক স্পাইরালবিশিষ্ট শামুকগুলো অন্য শামুকগুলোর তুলনায় বেশিদিন বেঁচে ছিল এবং প্রজননক্ষম সন্তান জন্ম দিতে পেরেছিল। সময়ের ব্যবধানে অন্য ধরনের শামুকগুলো হারিয়ে যায়। তাই আজ আমরা শুধুমাত্র লগারিদমিক স্পাইরালবিশিষ্ট শামুক দেখতে পাই।
রোমানেস্কো ব্রকলি
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/romanesco-broccli.png)
রোমানেস্কো ব্রকলিতে ফ্র্যাক্টাল গঠন। ছবিসূত্র: rennashesso.wordpress.com
রোমানেস্কো ব্রকলি ফ্র্যাক্টাল গঠনের অন্যতম উদাহরণ। ফ্র্যাক্টাল হলো এক ধরনের জ্যামিতিক গঠন, যা নিজেই নিজের প্রতিসম (Self-Similar)। কী! খুব ভারি কথা বলে ফেলেছি? ছবি দেখলেই বুঝবেন ফ্র্যাক্টাল জিনিসটা কেমন।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/fractals-701x394.jpg)
একটি ফ্র্যাক্টাল গঠন। ছবিসূত্র: spaceghetto.net
এই ফ্র্যাক্টাল গঠনটি কেওস থিওরি থেকেও পাওয়া যায়। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই প্রকৃতিতে এধরনের ফ্র্যাক্টাল আমরা অহরহ দেখতে পাবো। যেমন- ফার্নের পাতায়, আঞ্জেলিকা ফুলের গাছের বিন্যাসে কিংবা তুষারে (Snow)। রোমানেস্কো ব্রকলির ছবিটি খেয়াল করুন। ছোটো-বড় বেশ কিছু পাহাড়সদৃশ গঠন দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই। এই পাহাড়গুলোকে জীববিজ্ঞানীরা ফ্লোরেট বলেন। প্রত্যেকটা ফ্লোরেট দেখতে একই এবং এরা একই লগারিদমিক স্পাইরালবিশিষ্ট। আপনি যদি কোনো একটা ফ্লোরেটকে কেটে নেন, তাহলে দেখবেন সেটাও আলাদা একটা সম্পূর্ণ ব্রকলি। সূর্যমুখী ফুলের বীজের বিন্যাসের লগারিদমিক স্পাইরালের মতো এরাও ফিবোনক্কি ধারা মেনে একটি সম্পূর্ণ ব্রকলি সৃষ্টি করে।
মৌচাকে গণিত
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/Honeycomb.png)
ষড়ভুজাকৃতির মৌচাক। ছবিসূত্র: kenyonbee.com
ছোটবেলায় আমরা সবাই পড়েছি, মৌমাছিরা পরিশ্রমী। এখন আমরা দেখবো মৌমাছিরা শুধু পরিশ্রমীই না, তারা বেশ বুদ্ধিমানও। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে জমা করে এবং সেখান থেকে মোম তৈরি হয়। এই মধু সংগ্রহ করে রাখা এবং নিজেদের থাকার জন্য তারা বেশ সুন্দর করে একটি ঘর তৈরি করে, সেটা হলো মৌচাক। খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন, মৌচাকে প্রতিটা খোপ ষড়ভুজাকৃতির (Hexagonal)। কেন গোলাকার নয়? কেন-ই বা বর্গাকার, রম্বসাকার কিংবা পঞ্চভুজাকৃতি নয়? কারণ, ষড়ভুজ হলো সবচেয়ে স্থিতিশীল এবং কম জায়গা দখলকারী আকৃতি। একটি তলে আপনি যতগুলো ষড়ভুজ স্থান দিতে পারবেন, বৃত্ত স্থান দিতে পারবেন তার চেয়ে কম সংখ্যক। একই তলে এভাবে ষড়ভুজ আঁকার পদ্ধতিকে ওয়ালপেপার প্রতিসমতা (Wallpaper Symmetry) বলে। এই সহজ বুদ্ধির বিষয়টি আমাদের বের করতে বহুদিন লাগলেও, মৌমাছিরা সেই আদিকাল থেকে এভাবে মৌচাক তৈরি করতে অভ্যস্ত।
ষড়ভুজ সবচেয়ে বেশি স্থিতিশীল হওয়ায়, মৌমাছিরা সবচেয়ে কম শক্তি খরচ করে খোপের দেয়াল (Cell) মোম দিয়ে তৈরি করতে পারে। সাধারণত মৌচাকের দেয়ালগুলোর পুরুত্ব প্রায় ০.০৫ মিলিমিটার হয়। প্রতিটা খোপ তার নিজের ওজনের প্রায় ২৫ গুণ পরিমাণ মধু ধরে রাখতে পারে। মোটামুটি ১০০ গ্রাম ওজনের একেকটা মৌচাক থেকে প্রায় ৪ কেজি মধু পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, ১ গ্রাম মোম তৈরি করতে মৌমাছি বেচারাকে ৬ -৭ গ্রাম মধু আহরণ করতে হয়। কী বুঝলেন পাঠক? মৌমাছিকে শুধু পরিশ্রমী না বলে বুদ্ধিমানও বলা উচিত।
মানব মুখমণ্ডলে গণিত
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/Anjelina-jolie.png)
হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। ছবিসূত্র: pinterest.com
পূর্বেই সোনালী অনুপাতের কথা বলেছি। এই ‘গোল্ডেন রেশিও’ কিন্তু কিছু মানুষের মুখমণ্ডলেও বিদ্যমান। মানুষের মুখে সোনালী অনুপাতের মাপজোখটা অনেকটা এরকম-
- মাথার সর্বোচ্চ বিন্দু থেকে থুতনি পর্যন্ত দূরত্ব বনাম মুখের প্রস্থ
- চোখের লেভেল থেকে থুতুনির লেভেল বনাম মুখের প্রস্থ
- নাকের গোড়া থেকে নাকের ডগা পর্যন্ত দূরত্ব বনাম নাকের ডগা থেকে ঠোঁট পর্যন্ত দূরত্ব
- ………………… ইত্যাদি ইত্যাদি।
শরীরকেন্দ্রিক এমন অনেক মাপজোখ আছে, যা দিয়ে আপনি কতটা সুন্দর কিংবা আপনার চেহারা সোনালী অনুপাতের কতটা কাছাকাছি তা নির্ণয় করতে পারবেন। দেখুন না হলিউড তারকাদের সৌন্দর্যের নম্বর-
- Beyonce Knowles- 7.28
- John Mayer- 6.42
- Kate Upton- 7.46
- Lena Dunham- 6.82
- Miley Cyrus- 7.36
- George Clooney- 6.77
- Angelina Jolie- 7.13
- Ryan Gosling- 7.3
- Ben Affleck- 6.55
- Brad Pitt- 9.67
আমরা যারা সাধারণ মানুষ কিংবা তারকা, যাদের চেহারা সোনালী অনুপাতের ধারে কাছেও নেই, তারা কি কুৎসিত? অথবা আপনি যখন কাউকে পছন্দ করেন, ভালোবাসেন, কখনো কি আগে থেকে হিসাব করে নেন, তার চেহারা সোনালী অনুপাতের কিনা? আসলে তা নয়। সোনালী অনুপাত নেই এমন অনেক মানুষকে আমাদের ভালো লাগে। আর এই পৃথিবীর সব মানুষই সুন্দর। দৈহিক সৌন্দর্যে বড় না হয়ে মানসিক সৌন্দর্যে বড় হওয়াটাই জরুরি।
এবার কিছু প্রাচীন স্থাপত্য ও শিল্পকলায় ফিরে যাই।
গ্রীসের পার্থেনন মন্দির
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/The_Parthenon_in_Athens-701x493.jpg)
১৯৭৮ সালে স্টিভ সোয়েনির তোলা ছবি, গ্রীসের পার্থেনন মন্দির। ছবিসূত্র: Wikimedia Commons
একটা সময় ধারণা করা হতো, গ্রীসের পার্থেনন মন্দিরটি সোনালী অনুপাত মেনে তৈরি করা হয়েছে। কিছু ছবি দেখলে অবশ্য তা-ই মনে হয়। কিন্তু আসল ঘটনা হলো- পার্থেননের দৈর্ঘ্য ৬৯.৫১৫১ মিটার আর প্রস্থ হলো ৩০.৮৭৫ মিটার। অর্থাৎ দৈর্ঘ্য-প্রস্থের অনুপাত ২.২৫ঃ১, যা সোনালী অনুপাতের ধারেকাছেও না।
ভিট্রুভিয়ান ম্যান
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/07/Da_Vinci_Vitruve_Luc_Viatour-701x953.jpg)
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ভিট্রুভিয়ান ম্যান। ছবিসূত্র: Luc Viatour/www.Lucnix.be
অনেকে মনে করেন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তার ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ সোনালী অনুপাত মেনে এঁকেছিলেন। বিষয়টা আসলে তা না, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি রোমান স্থপতি মারকাস ভিট্রুভিয়াসের তত্ত্ব অনুসারে এঁকেছিলেন ছবিটি। আর ভিট্রুভিয়াস তার তত্ত্বে সোনালী অনুপাতের কথা উল্লেখ করেননি। ভিট্রুভিয়াসের তত্ত্ব থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবদেহের বিভিন্ন অংশের দৈর্ঘ্যের অনুপাত হলো, 1:3, 1:4, 1:6, 1:8, 1:10। এর সাথে কোনো দিক থেকেই ফিবোনাক্কি অনুপাত কিংবা সোনালী অনুপাতের কোনো মিল নেই। তবে সেজন্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান কিন্তু দেখতে কুৎসিত হয়ে যায়নি।
গণিতের সৌন্দর্য অনুসন্ধান আজ এতটুকুই।
Featured image: mathmunch.org