![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/11/crow-and-owl.jpg?w=1200)
মাঝে মাঝে খবরে আসে, সমুদ্র উপকূলে কয়েকটি তিমি এসে আটকা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। অনেক সময় জীবিত অবস্থায় তাদের সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবু তারা আবার ফিরে আসে! কীসের টানে তারা অমোঘ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়?
নিজে বাসা তৈরি না করে তঞ্চকের মত অন্য পাখির বাসায় কেন ডিম পাড়ে কোকিল পাখি? বিড়ালের শিকার ধরার পর তাকে মেরে ফেলার আগে কিছুক্ষণ চোর-পুলিশ খেলার মানে কি?
শুধু তিমি, কোকিল আর বিড়ালই নয়, বরং আরো অনেক প্রাণির মধ্যে দেখা গেছে এমন কিছু আচরণ। আপাতদৃষ্টিতে এই আচরণের পেছনে কোনো ব্যাখ্যা নেই। সেসব প্রাণীর কথা এবং তাদের এই অদ্ভুতুড়ে আচরণ নিয়েই আজকের আয়োজন।
নিঃসঙ্গ পিঁপড়ের মৃত্যুযাত্রা
পিঁপড়া একটি সামাজিক প্রাণী- এ কথা পাঠ্যবইয়ের পাতায় সবাই কমবেশি পড়েছি। কিন্তু কতটা সামাজিক সে ব্যাপারে কারো ধারণা আছে?
একেকটি সুপার কলোনিতে ৩০ কোটি কর্মী পিঁপড়ে আর দশ লাখ রাণী পিঁপড়ে নির্বিঘ্নে থাকতে পারে। এদের কেউ যদি কোনোভাবে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে কি হয়? স্রেফ মারা যায় সেই হতভাগ্য পিঁপড়ে।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/11/120711fireant_s.jpg)
ছুতার পিঁপড়ে; Source: arstechnica.com
একটি পরীক্ষায় ছুতার পিঁপড়ে প্রজাতির কয়েকটিকে দলচ্যুত করে রাখা হয়। দেখা গেলো তাদের হাবভাব আমুল বদলে গিয়েছে, অনবরত দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। যেন বাবার সাথে মেলা দেখতে এসে কোনো শিশু হারিয়ে গিয়েছে। আর খাবার? এমন নয় যে, সে একা একা খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না। দলচ্যুত পিঁপড়েকে রীতিমত মহার্ঘ আহার দিয়ে রাখা হয়েছে। ফলাফল আরো হতবুদ্ধিকর! স্বাভাবিকভাবে একটি পিঁপড়ে যতটুকু খায়, ঠিক সেই পরিমাণই খাবার গ্রহণ করে সে। কিন্তু তার বেশিরভাগই পাকস্থলী পর্যন্ত পৌছায় না। পিঁপড়ের শরীরে পাকস্থলীর আগে একটি ক্রপ এরিয়া আছে। এখানে তারা নিজের প্রয়োজন মেটার পর অবশিষ্ট খাবার সঞ্চয় করে রাখে অপরাপর সঙ্গীদের জন্য।
কিন্তু নিঃসঙ্গ পিঁপড়ে তার আত্মীকৃত খাদ্যের পুরোটাই রেখে দেয় ক্রপ এরিয়াতে। শরীরভর্তি খাবার নিয়ে উপবাস করে সে; যেন গভীর শোক পালন করছে। কলোনিবাসী পিপড়ে যেখানে দুই মাসের বেশি সময় বাঁচে, সেখানে নিঃসঙ্গ থেকে ছয় দিনের ভেতরে মারা যায়।
গোটা পরীক্ষাটি করা হয় University of Lausanne Switzerland এর গবেষকদের তত্ত্বাবধায়নে। কিন্তু গবেষক দল পিঁপড়েদের এহেন আচরণের পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বের করতে পারেন নি।
ব্যাপারটি দেখে মনে হয়, আত্মীয়স্বজন হারিয়ে তারা হতাশাগ্রস্থ অথবা বিষাদে নিমগ্ন। কিন্তু সত্যি কি তার এই অনুভব ক্ষমতা আছে? কেন সে খাদ্য গ্রহণ করে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ক্রপ এরিয়াতে ফেলে রাখে? কেনই বা অবিরাম ছোটাছুটি করতে থাকে? সঠিক উত্তর মেলেনি এখনও।
কোকিলের বাড়ি ফেরা
পরিযায়ী পাখিরা প্রতিকূল আবহাওয়ায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমায়। সেখানে খেয়েদেয়ে ডিম পাড়ে। তারপর বাচ্চা বড় করে অনুকূল আবহাওয়ায় আবার প্রত্যাবর্তন করে পুরাতন পথে। বাচ্চারা তাদের মাকে অনুসরণ করেই পৌছে যায় অদেখা মাতুলালয়ে। কিন্তু কোকিল পাখির ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/11/cuckoo_0-701x467.jpg)
ঠিকই বাড়ি ফিরে আসে কোকিলেরা; Source: hbw.com
প্রতি বছর আফ্রিকা থেকে বসন্তকালে কোকিলেরা ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমায়। মা কোকিলেরা অন্য কোনো পাখির বাসায় সুযোগ বুঝে ডিম পেড়ে নিজের পথ ধরে। সেই ডিম ফুটে একসময় কোকিলের বাচ্চা বের হয়। আস্তে আস্তে একসময় বড় হয়ে ওঠে তারা। কিন্তু ততদিনে সেসব দেশে শীতের প্রকোপ আরম্ভ হয়েছে। খাদ্যবিহীন, আশ্রয়বিহীন সেই শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য সদ্য যৌবনে পা দেওয়া কোকিলেরা ডানা মেলে। তারপর পৌঁছে যায় ঠিক সেখানে যেখান থেকে তাদের মায়েরা একদিন যাত্রা আরম্ভ করেছিলো। এই দীর্ঘপথ তারা একাকী উড়ে কীভাবে পৌছে যায় সেই ঠিকানায় যে ঠিকানা তার কাছে অপরিচিত? সমস্ত পথ সে একা চলে। এই দীর্ঘ সময়ে না তার মা তাকে পথ দেখায়, না কোনো সঙ্গীসাথী।
কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা কয়েকটি ডিমকে পরীক্ষামূলকভাবে ডেনমার্ক থেকে স্পেনে নিয়ে সেখানে তাদের পরিস্ফুটনের ব্যবস্থা করলেন। তারপর জিপিএস ট্র্যাকার লাগিয়ে দেওয়া হলো তাদের পায়ে। তবু দেখা গেলো ঠিকঠাক তারা আফ্রিকায় গিয়ে পৌছেছে। কীভাবে পৌঁছায় ওরা? কোথায় যেতে হবে কে বলে দেয়?
কেউ কেউ বলেন, তারা শুধু বাতাসকে অনুসরণ করে। শীতল বাতাসকে পেছনে ফেলে উষ্ণ বাতাসের সন্ধানে ডানা ঝাপটায়। এভাবেই পৌছে যায় আফ্রিকায়। কিন্তু তাহলে তো কয়েকটির দক্ষিণ আফ্রিকায় বা নিদেনপক্ষে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তেমনটি তো হয় না! তাহলে?
উত্তর মেলেনি আজও!
গরু যখন কম্পাস
খোলা ময়দানে আমরা কমবেশি সবাই গরুকে ঘাস খেতে দেখেছি। এ আর এমন কি? কিন্তু এর ভেতরে এক আশ্চর্য ব্যাপার রয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা উত্তর-দক্ষিণমুখী হয়ে ঘাস গলাধঃকরণ করছে। ব্যাপারটা একটু অবাক হওয়ার মতই বৈকি!
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/11/Cows.jpg)
চৌম্বকক্ষেত্র টের পায় গরুতে! Source: mirror.co.uk
বুদ্ধিশুদ্ধি ওদের না থাকতে পারে, কিন্তু ওদের একটি অনুভূতি শক্তি খুব তীক্ষ্ণ। ওরা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে শনাক্ত করতে পারে। তাই সেই বরাবর সটান দাঁড়িয়ে ঘাস খায়। অন্যান্য স্তন্যপায়ী, যেমন হরিণের ভেতরেও এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করা যায়।
পরিযায়ী পাখিরা নাহয় তাদের দিক ঠিক করার জন্য পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র কাজে লাগায়। কিন্তু এই সকল স্তন্যপায়ী প্রাণী যাদের বিস্তৃতি সর্বোচ্চ কয়েক মাইল, তারা এই চৌম্বকক্ষেত্র কোন কাজে লাগায় তা ঠিক জানা যায়নি।
প্রাণীরা ভূমিকম্প টের পায় কীভাবে?
প্রাণীরা ভূমিকম্প আগে থেকে টের পায়- বহু চর্চিত একটি কথা। সেই প্রাচীন গ্রীস থেকে আজকের আধুনিক সময়ে কথাটি বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। বিজ্ঞানীরা এর কারণও বের করেছেন। ভূমিকম্পে দুই ধরনের তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। একটি অপেক্ষাকৃত বড় তরঙ্গ যাকে বলা হয় এস-তরঙ্গ, অপরটি ক্ষুদ্র পি-তরঙ্গ। আমরা এস-তরঙ্গ অনুভব করতে পারি, কিন্তু পি টাইপ তরঙ্গ অনুধাবন করা আমাদের ক্ষমতার বাইরে। অপরদিকে নিম্নস্তরের প্রাণীরা পি-টাইপ তরঙ্গ অনুভব করতে পারে। পি-টাইপ তরঙ্গ সাধারণত বড় তরঙ্গগুলোর ৫-৭ সেকেন্ড আগে আসে। সুতরাং আপনি যদি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বসবাস করেন আর আপনার পোষা প্রাণী আচমকা ছোটাছুটি শুরু করে দেয়, তাহলে তখনই সচেতন হোন।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/11/AnimalsDisasters-COVER-1-701x394.jpg)
প্রাণীরা ভূমিকম্প আগেভাগেই টের পায়; source: storypick.com
এ তো গেলো কয়েক সেকেন্ডের কথা। এমন কিছু ঘটনাপ্রবাহ জানা গেছে যাতে প্রমাণিত হয়, এই সকল ঘটনা ঘটার কয়েক ঘন্টা এমনকি কয়েকদিন আগেও প্রাণীকূল টের পেয়েছে ভূমিকম্পের ইশারা। সবচেয়ে পুরনো ঘটনার আভাষ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। তখন এক বিশাল ভূমিকম্প পুরো গ্রিসকে নাড়া দিয়ে গিয়েছিলো। সাপ, ইঁদুর এবং শতপদীরা এই দুর্যোগ আঘাত হানার বহু পূর্বেই এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু কীভাবে টের পেয়েছিলো তারা?
উত্তর মেলেনি।
কাকের প্রতিশোধ
কাককে অতিশয় চালাক প্রাণী বলেই আমরা জানি। সেই যে গল্প আছে না, একবার এক কাকের খুব তেষ্টা পেয়েছিলো। তারপর কীভাবে সে কলসিতে নুড়ি ফেলে জলপান করলো! স্বয়ং ঈশপ সাহেবও কাকের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গল্প লিখে রেখে গেছেন। প্রফেসর শংকুও কাকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তার পোষা কাকের গল্পটা পড়েছেন হয়তো!
কাকের একটা ব্যাপার আছে। কেউ যদি কাককে ধরে বন্দী করে রাখে তাহলে কিন্তু কাক ঠিক তাকে চিনে রাখবে। তারপরে যদি ছাড়া পায় কখনো, তাহলে ঠিকই তক্কে তক্কে থাকবে এবং সুযোগ পেলে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আঁচড়িয়ে, ঠোকর দিয়ে একেবারে শেষ করে ছাড়বে। এমনকি কয়েকমাস পর হলেও ঠিকই মনে রাখে!
মানুষের মতো অসম প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর প্রতিশোধ নিতে চাওয়া খুব বুদ্ধিমান কাজ নয়। তবু এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কেন? কে জানে?