
মহাসাগরের বিশাল জলরাশিতে বসবাসরত ২ লক্ষ ২৮ হাজার ৪৫০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রাণীদের কোনো কোনোটি খুবই ধীর গতিতে চলাফেরা করে, আবার কোনোকোনোটি খুব দ্রুতগতিতে ছুটতে পারে। এরকম কিছু দ্রুতগতির মাছ সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে এই লেখায়।
সেইল ফিশ
সেইল ফিশকে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরে পাওয়া যায়। মাছটির পিঠের বিশাল পাখনা দেখতে নৌকার সেইল বা পালের মতো হওয়ায় একে সেইল ফিশ বলা হয়। সেইল ফিশ ১০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরে প্রাপ্ত সেইল ফিশ ১০০ কিলোগ্রাম ও আটলান্টিক মহাসাগরে প্রাপ্ত প্রজাতি ৬০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। এরা সাধারণত উষ্ণ জলজ পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। এরা দলবদ্ধভাবে খাবার সংগ্রহ করে। এই মাছ উড়ন্ত মাছ, টুনা মাছ, ম্যাকরল ইত্যাদি শিকার করে খায়। সেইল ফিশ ঘন্টায় ৬৮ মাইল বা ১০৯.৪ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটিই হচ্ছে সমুদ্রের সবচেয়ে দ্রুত গতিতে ছুটতে সক্ষম মাছ।

দ্রুতগতি সম্পন্ন সেইল ফিশ © Marc Montocchio
মারলিন
সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ছুটে চলার গতিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্ট্রিপড মারলিন। মাছটির পূর্বের বৈজ্ঞানিক নাম ছিল Tetrapturus audax। বর্তমান বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Kajikia audax।মারলিন ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। অনেকের মতে, মারলিনের গতিই সবচেয়ে বেশি আর তা হচ্ছে ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার!

গতিতে দ্বিতীয় মারলিন; Source: bojenyns.wordpress.com
সেইল ফিশের মতো এদেরও বর্শার ন্যায় ঠোঁট আছে, যা দিয়ে সহজেই শিকারের শরীর বিদ্ধ করতে পারে। মারলিনের চারটি ভিন্ন জাত রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে ব্লু মারলিন, ব্লাক মারলিন, হোয়াইট মারলিন এবং স্ট্রিপড বা ডোরাকাটা মারলিন। নামের ভিন্নতা থাকলেও এদের বর্ণ ও আচরণে তেমন পার্থক্য নেই। তাই স্বল্প অভিজ্ঞদের প্রথম দর্শনে এদের মাঝে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
মারলিনকে আটলান্টিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের উষ্ণ জলে পাওয়া যায়। এরা একাকী চলাফেরা করতে পছন্দ করলেও ডিম ছাড়ার সময় দলবদ্ধ হয়। সাধারণত এরা ২৬০ কিলোগ্রাম ওজন পর্যন্ত হতে পারলেও সচরাচর ৩০-১২০ কিলোগ্রাম ওজন পর্যন্ত পাওয়া যায়।
ওয়াহু
সামুদ্রিক মাছের মধ্যে আরেক গতি দানব হচ্ছে ওয়াহু। মাছটি ঘন্টায় ৭৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বেগে ছুটতে পারে। এই গতি ১০০ কিলোমিটার পর্যন্তও বৃদ্ধি পেতে পারে। মাছটিকে সারাবিশ্বের ক্রান্তীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে পাওয়া যায়। Acanthocybium solandri হচ্ছে মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম।

গতিদানব ওয়াহু; Source: sportfishingincabo.com
International Game Fish Association এর তথ্যমতে, সর্বোচ্চ ওজনের ওয়াহু মাছটি ছিল ৭১.৯ কিলোগ্রাম। তবে এই মাছটি ৯১ কিলোগ্রাম ওজন পর্যন্ত হয় বলে অনেকে দাবী করেন। মাছটির ক্ষুরের ন্যায় ধারালো দাঁত রয়েছে। ওয়াহু আক্রমণাত্মক স্বভাবের মাছ।
দক্ষিণাঞ্চলীয় নীল পাখনাওয়ালা টুনা মাছ
দক্ষিণাঞ্চলীয় নীল পাখনাওয়ালা টুনা মাছকে আটলান্টিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে দেখা মেলে। এই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Thunnus maccoyii। খাবার সংগ্রহের জন্য এরা সুযোগসন্ধানী আচরণ করে। অর্থাৎ প্রাপ্ত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এরা সাধারণত বিভিন্ন ধরনের মাছ, ক্রাস্টেসিয়ান, সেফালোপডস, সাল্পস এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করে খায়।

টুনা মাছ; Source: oreilleverte.com
এই টুনা মাছ ১৫৮-২০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজন বিশিষ্ট হতে পারে। টুনা মাছ অবিরতভাবে সমুদ্রে ঘোরাফেরা করে। এ সময় তাদের গতি থাকে মাত্র ২-৩ কিলোমিটার/ঘণ্টা। তবে মাছটি প্রতি ঘন্টায় ৭০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে।
জাপানের সাশিমি বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে মাছটির। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ব্যাপকহারে এই মাছ ধরা হত। মাছ ধরা, অল্প ডিমপাড়া, দীর্ঘদিন ধরে বাচ্চা মাছগুলো মারা যাওয়াসহ নানাবিধ কারণে এই মাছ বর্তমানে মারাত্মকভাবে বিলুপ্তির পথে রয়েছে।
নীল হাঙ্গর
সকল হাঙ্গর প্রজাতির মধ্যে নীল হাঙ্গর হচ্ছে দেখতে সবচেয়ে সুন্দর। হাঙ্গরটির বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Prionace glauca। শারীরিক গঠনের জন্য এই হাঙ্গরকে সহজেই সনাক্ত করা যায়। এরা ১৩ ফুট লম্বা ও ২০৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজন বিশিষ্ট হতে পারে। এই হাঙ্গর ঘন্টায় ৩৯.৪ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। তবে এই বেগ বেড়ে ৬৯ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

সুন্দর চেহারার নীল হাঙ্গর; Source: planetdeadly.com
বিশ্বের সকল মহাসাগরেই এই হাঙ্গর বিচরণ করে। এরা পানির ১,৩১২ ফুট গভীরে পর্যন্ত চলে যায়। এরা ছোট ছোট দলে বিভিক্ত হয়ে থাকে। এই দলের একটা অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে পুরুষ ও স্ত্রী হাঙ্গরের স্বতন্ত্র দল হয়। এই হাঙ্গর প্রজাতিটি মানুষের কোনো ক্ষতি না করলেও মানুষ কর্তৃক প্রতিনিয়ত ক্ষতির শিকার হচ্ছে। মানুষ মূলত এদের পাখনা, ত্বক, লেজ, মাংস, দাঁত, চোয়াল ইত্যাদির জন্যই শিকার করে থাকে।
তরোয়াল মাছ
সামুদ্রিক মাছের মধ্যে গতিশীলতায় স্থান করে নেয়া আরেকটি মাছ হচ্ছে তরোয়াল মাছ। Xiphias gladius হচ্ছে মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম। এই মাছটিকে উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বিচরণ করতে দেখা যায়।

দ্রুতবেগে শিকারকে মুখের ভিতর নিচ্ছে © P. deOliveira
তরোয়াল মাছ লম্বা, আঁইশবিহীন ও পিঠে লম্বা পাখনাযুক্ত। এদের নাকটি বর্ধিত হয়ে তরোয়ালের ন্যায় গঠন হয়েছ, যা দ্বারা এরা শিকারের শরীর কেটে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলতে পারে। এরা লম্বায় ১৭৭ ইঞ্চি ও ৬৫০ কিলোগ্রাম ওজন পর্যন্ত হতে পারে। তরোয়াল মাছ ঘন্টায় ৬৪ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। তবে এই বেগ বৃদ্ধি পেয়ে ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
এই মাছের উপরের চোয়ালের প্রায় অর্ধেক জুড়ে তৈল নিঃস্রাবী গ্রন্থি থাকে। গ্রন্থির থেকে কৈশিক নালীর মাধ্যমে মাছের মাথার দিকে তেল পৌঁছায়। এই তেল মাছ চলার সময় পানি প্রবাহের ফলে ত্বকে লেগে ত্বককে পিচ্ছিল করে। এভাবে এরা দ্রুতগতিতে ছুটে কর্মতৎপর স্কুইড ও মাছ শিকার করে।
চার পাখার উড়ন্ত মাছ
সমুদ্রের আরেক গতিশীল ও বিস্ময়কর প্রজাতির মাছ হচ্ছে ফ্লাইং ফিশ বা উড়ন্ত মাছ। Exocoetidae গোত্রের এই মাছের ৪০টি প্রজাতির কথা জানা যায়। এদের বক্ষ ও শ্রোণীদেশীয় পাখনাগুলো পাখার ন্যায় বর্ধিত হয়েছে। এজন্য এদের চার পাখার উড়ন্ত মাছ বলা হয়। পাখনাগুলোর সাহায্যে এরা উড়তে পারে।

বাতাসে ভেসে বেড়ানো উড়ন্ত মাছ © Hiroya minakuchi
এরা টর্পেডোর (Torpedo) মতো শারীরিক গঠনের কারণে পানির নিচ থেকে পর্যাপ্ত গতি অর্জন করে পানির উপরে ওঠে। পরবর্তীতে পাখনা উড়ন্ত মাছকে বাতাসে উড়ে চলতে সহায়তা করে। এই মাছ সাধারণত ৬৫৫ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। তবে সর্বোচ্চ উড়ে চলার দূরত্ব জানা যায় ১,৩১২ ফুট। পানির নিচ থেকে উঠে ওড়ার জন্য উড়ন্ত মাছ ঘন্টায় ৩৭ মাইল বা ৫৯ কিলোমিটার বেগে ছুটে থাকে।
ফিচার ইমেজ – mexican-fish.com