রাষ্ট্রব্যবস্থার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের রাষ্ট্রকাঠামো অধিকাংশ সময় পার করেছে অনির্বাচিত শাসকের শাসনে। যুগে যুগে রাষ্ট্রকাঠামোতে দেখা গেছে স্বৈরশাসকের শাসন, অর্থ আর ক্ষমতাই ছিল যাদের চরম লক্ষ্য। স্বৈরশাসকেরা ভয় সৃষ্টি করেছেন জনগণের মাঝে, ধর্মকে ব্যবহার করেছেন ক্ষমতার স্বার্থে, সমাজের অভ্যন্তরে গোয়ান্দা লাগিয়ে আর নজরদারির ব্যবস্থা করে শাসনকে টিকিয়ে রেখেছেন যুগের পর যুগ ধরে।
আধুনিক যুগে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতায় আসার কৌশলে পরিবর্তন এসেছে, পরিবর্তন এসেছে টিকে থাকার কৌশলেও। অতীতে স্বৈরশাসকেরা রাজাকে হত্যা করে, যুদ্ধ জয় করে ক্ষমতায় আসতো, আধুনিক যুগে স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় আসছেন সামরিক বাহিনী থেকে, কিছু কিছু দেশে রয়েছে একদলীয় স্বৈরশাসন। আবার অনেক দেশেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসক ক্ষমতায় এসে হয়েছেন এবং হচ্ছেন স্বৈরাচারী।
তবুও, ইতিহাসে বারবারই আবির্ভাব হয়েছে মুক্তিকামী মানুষের। স্বৈরশাসকের অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বারবার স্লোগান ধরেছে স্বাধীনচেতারা। অনেক সময়ই এসব আন্দোলন আর বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে, পড়তে হয়েছে আরো কঠোর নিপীড়নের মুখে।
স্বৈরশাসকের পতন ও পরবর্তী রাজনৈতিক কাঠামো
এরিস্টটলের মতে, রাজনৈতিক বিপ্লব দুই ধরনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে হতে পারে । প্রথমত, পুরোপুরি বদল আনা রাজনৈতিক কাঠামোতে। যেমন অর্থনৈতিক সংস্কার করা, যার উদ্দেশ্য থাকে সামাজিক কাঠামো সংস্কারেরও। দ্বিতীয়ত, বর্তমান কাঠামোর সংস্কার করে তা জনবান্ধব করা। যুগে যুগে মানুষ পুরোপুরি কাঠামো পরিবর্তন কিংবা সংস্কারের জন্যই আন্দোলন-বিপ্লবে জড়িয়েছে। পতন ঘটিয়েছে স্বৈরশাসকের, অবসান ঘটাতে চেয়েছে কতিপয়তন্ত্রের। কিন্তু এই পতনগুলো কি পেরেছিল বিপ্লবের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হতে? যে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন করেছে বিপ্লবীরা, তার কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে?
বাস্তবতা উঠে এসেছে জর্জ ওরওয়েলের স্যাটেয়ার ধাঁচের উপন্যাস ‘এনিম্যাল ফার্ম’-এ। সেখানে সকল পশু একসাথে খামারির বিরুদ্ধে বিদ্রোহীর ফলাফল হিসেবে তারা পায় আরো কঠোর স্বৈরশাসক, উপন্যাসে যার নাম ‘নেপোলিয়ন’। এখানে সাম্প্রতিক সময়কালে স্বৈরশাসকের পতন আর পতনের পরে সেই রাষ্ট্রকাঠামোতে কী হয়েছে, তা দেখার চেষ্টা করব।
নতুন স্বৈরশাসক
স্বৈরশাসকেরা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তারা কাঠামো থেকে সরিয়ে দেন নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার মতো সকল মানুষকে, নিষ্ক্রিয় করে দেন স্বাধীনচেতা আর বুদ্ধিজীবীদের। সিভিল সোসাইটিকে পরিণত করেন অকার্যকর অংশ হিসেবে, সমাজ পরিবর্তনে তাদের ভূমিকা হয়ে পড়ে সীমাবদ্ধ। ফলে যখন একজন স্বৈরশাসকের পতন হয়, তখন নেতৃত্ব গ্রহণ করার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব দেশে থাকে না, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা হয়ে পড়ে টালমাটাল। এই নেতৃত্ব শূন্যতার সুযোগে আবির্ভাব ঘটে নতুন স্বৈরশাসকের।
দীর্ঘকাল সামরিক শাসনে থাকার পরে আরব বসন্তের প্রভাবে মিসরে পতন ঘটে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের। শাসনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনের এক বছরের মধ্যেই পুনরায় ফিরে সামরিক শাসন, ক্ষমতা দখল করে মিসরের সেনাবাহিনী। এরপর গণতন্ত্রকামীদের নির্বিচারে হত্যা করেছে সামরিক বাহিনী, এখনো লঙ্ঘন করছে মানবাধিকার, বিঘ্নিত হচ্ছে জীবনের নিরাপত্তা আর নাগরিক অধিকার।
খেলাধুলাসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের কাছে খুবই পরিচিত একটি দেশ জিম্বাবুয়ে। জিম্বাবুয়েতে ১৯৮০ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা রবার্ট মুগাবে পরবর্তীতে পরিণত হন স্বৈরশাসকে, যার ৩৭ বছরের শাসনের অবসান ঘটে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এই স্বৈরশাসকের পতনের পর আবির্ভাব ঘটেছে নতুন স্বৈরশাসক এমারসনের। সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ এই শাসনামলেও অব্যাহত থাকায় নিশ্চিত হয়েছে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। ফলে দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না দেশটি।
বিতর্কিত শাসন আর গণহত্যার কারণে কুখ্যাত হয়ে আছেন উগান্ডার শাসক ইদি আমিন দাদা। তানজানিয়া যুদ্ধের পর এই শাসকের আগমন ঘটলেও দেশটিতে আসেনি সুশাসন, উত্থান ঘটেনি গণতন্ত্রের। জেনারেল বাজিলিও ওলেরা আর জেলারেল টিটো অকেলোর শাসনের পরে ক্ষমতায় আসেন ইউরৌ মিসৌরি। লাগামহীন দুর্নীতি, দারিদ্রতা আর কর্মসংস্থানের অভাবের পরেও ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে আছে এই স্বৈরশাসক।
সুখবর নেই সদ্য স্বৈরাচারের অবসান ঘটানো আফ্রিকার দেশ সুদানেও। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে গণ আন্দোলনের মুখে ওমর-আল-বশিরের পতন হলেও গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে পারেনি সেখানে। এখনো চলছে স্বৈরশাসন। একই ফলাফল এসেছে একই সময়ে স্বৈরশাসকের পতন ঘটানো দেশ আলজেরিয়া থেকেও। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ২০ বছরের বুতেফ্লিকা শাসনের পতনের সাথে সাথেই ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী, শাসক হন সেনাপ্রধান আহমেদ গাইদ সালেহ। তার মৃত্যুর পর নতুন শাসক হিসেবে আসেন আরেক সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, সাইদ চ্যাংগ্রিলা।
গৃহযুদ্ধ
স্বৈরশাসকের পতনের পর ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়। সুষ্ঠু কাঠামো না থাকায় পতনের পর উঠে আসে না গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব, শাসনক্ষমতা নিয়ে প্রতিযোগিতা তৈরি হয় একসময় স্বৈরশাসকের ছায়াতলে থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে। অনেক সময়ই সেই প্রতিযোগিতা চলে যায় সশস্ত্র সংঘাতের দিকে, দেশে জন্ম দেয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের। আট মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর অন্তহীন গৃহযুদ্ধের দিকে চলে গেছে লিবিয়া। জন্ম নিয়েছে দুইটি প্রশাসনের, ফয়েজের ট্রিপলি প্রশাসন আর হাফতারের তরবুক প্রশাসন। দুজনেই একসময় অংশ ছিলেন গাদ্দাফি প্রশাসনের।
তেল সমৃদ্ধ দেশ হওয়ায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ফ্রান্সের মতো বড় বড় শক্তিগুলো। আছে আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক, সৌদি আরব, আরব আমিরাতের প্রভাবও। তৈরি হয়েছে বিশাল অস্ত্রের বাজার। আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার বাসনায় উন্মুখ সৌদি আরবের অর্থ আর অস্ত্র সহযোগিতা পাচ্ছেন জেনারেল হাফতার।
বিপরীত মেরুতে আছে তুরস্ক। পরাশক্তিগুলোর মদদ নিশ্চিত করছে, দুই পক্ষের এই সশস্ত্র সংঘাত খুব দ্রুত শেষ হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। একসময় আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে ভালো জীবনমানের সাথে বিনামূল্যে শিক্ষা, চিকিৎসা সুবিধা উপভোগ করা লিবিয়া এখন চিকিৎসা সুবিধার সঙ্কটে আছে, অর্থনীতি পিছিয়েছে বিশ বছর। একই অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, জনগণকে নিয়ে গেছে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে।
দুর্ভিক্ষ
স্বৈরতন্ত্র গঠিত হয় কতিপয়তন্ত্র আর গণতন্ত্রের খারাপ দিকগুলোর সমন্বয়ে। ফলে শাসক কিংবা শাসকের আশেপাশে থাকা অভিজাত শ্রেণি, সবারই মূল লক্ষ্য থাকে অর্থ আর সম্পদ। ফলে দীর্ঘদিন স্বৈরশাসন চললে দেশের অধিকাংশ সম্পদ পুঞ্জিভূত হয় কতিপয় সুবিধাভোগীর কাছে। স্বৈরশাসকের পতনের পর স্বৈরশাসকের সাথে সাথে এরাও বিলীন হয়ে যায় প্রেক্ষাপট থেকে, সাথে নিয়ে যায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ। ফলে স্বৈরশাসকের পতনের পরে তৈরি হয় দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা, যার শিকার হয় জনগণের বড় একটা অংশ।
আরব বসন্তের মাধ্যমে ইয়েমেনে অবসান হয় দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক আলি আব্দুল্লাহ সালেহ-এর শাসনের। এরপর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আরো অস্থিতিশীল হয়েছে, ইরান সমর্থিত হুতিদের সাথে যুদ্ধ চলছে সৌদি সমর্থিত ইয়েমেন সরকারের। এই জায়গাটিও হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের ছায়াযুদ্ধের ক্ষেত্র।
এরই মধ্যে ১ লাখ ইয়েমেনি এই যুদ্ধে মারা গেছে, তার চেয়েও বেশি মরেছে অপুষ্টিতে আর রোগে ভোগে। গৃহহীন হয়েছে ৩০ লক্ষ মানুষ, সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে উৎপাদন ব্যবস্থা। ৩৩ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, ২ কোটি মানুষ আছে খাদ্য সঙ্কটে। এরসাথে যুক্ত হয়েছে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি, বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি।
দূর্বল গণতন্ত্র
অনেকসময় অব্যাহত জনআন্দোলন আর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা অসামরিক নেতৃত্বের কাছে হস্তান্তর করেছে। গণতান্ত্রিক সরকারকে সামনে রেখে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র চালায় তারা, প্রকৃত ক্ষমতা রয়ে যায় তাদের হাতেই। ফলে, সেই দেশগুলোতে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, নিশ্চিত হয় না মানবাধিকার।
দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ২০১৬ সালে। দূর্বল সংবিধান বানিয়ে পার্লামেন্টে এক-চতুর্থাংশ আসন রেখেছে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে, নৃগোষ্ঠীগুলোর সাথে সংঘাত লাগিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। স্টেট কাউন্সিলর কিংবা রাষ্ট্রপতি হয়ে আছেন সেনাবাহিনীর পুতুল হিসেবে।
একই অবস্থা বিরাজ করছে পাকিস্তানেও। সেনাবাহিনীর ডিপ স্টেট সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোন সরকার ক্ষমতায় আসবে, নির্বাচনে জিতিয়ে আনছে তাদের। সরকারের পলিসিতে আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সেনাবাহিনীর ইচ্ছাই শেষ কথা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও একইরকম নিয়ন্ত্রণ। ফলে, এখানে সামরিক শাসন অবসান হলেও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
যুগে যুগে মুক্তিকামী বিপ্লবীরা এভাবেই ব্যর্থ হয়, ধূলিসাৎ হয় সফলতার স্বপ্ন। তবে বর্তমান সময়ে পাল্টেছে বিপ্লবের ধরন, বাড়ছে রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও। উজ্জ্বল আগামী আর পরিবর্তনের স্বপ্নে জেগে উঠা আঠারোর তরুণেরা হয়তো একসময় সফল হবে, আদায় করে নেবে নিজেদের অধিকার। আগামীর বিশ্ব হয়তো তাদের হাতেই।