Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইংরেজ গৃহযুদ্ধ: সংসদীয় শাসন ও ধর্মীয় স্বাধীনতার লড়াই

১৬৪২-৫১ সালের মধ্যে একের পর এক সংঘাত হয় স্টুয়ার্ড রাজবংশ আর পার্লামেন্টরিয়ানদের মধ্যে, যার অধিকাংশ সংঘাতই ছিল রক্তক্ষয়ী। ইতিহাসে পাতায় স্টুয়ার্ড রাজবংশ আর পার্লামেন্টপন্থীদের মধ্যে এই সময়কার সংঘাত পরিচিত ইংরেজ গৃহযুদ্ধ হিসেবে। এই সময়ের মধ্যে রাজার অনুগত রাজকীয় বাহিনীর সাথে প্রায় ছয়শোবার সশস্ত্র সংঘাতে জড়ায় পার্লামেন্টপন্থীরা, যাতে নিহতের সংখ্যা সামরিক যোদ্ধা আর বেসামরিক নাগরিক মিলিয়ে ছাড়িয়ে যায় দুই লাখ। মূলত, খ্রিষ্টান ধর্মের জটিল বিভাজন থেকে শুরু হয় ইংরেজদের গৃহযুদ্ধ, পরবর্তীতে যার সাথে যুক্ত হয় অর্থনৈতিক নীতি আর ধর্মীয় স্বাধীনতার ধারণাও। ইংরেজ রাজার সাথে মতের ভিন্নতা বাড়ছিল পার্লামেন্টরিয়ানদের, বাড়ছিল অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে মতপার্থক্য।

ইংরেজ গৃহযুদ্ধ; Image Source: history.com

গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজদের জনজীবন আমূল বদলে যায়, বদল আসে শাসনব্যবস্থা আর গভর্ন্যান্সেও। পার্লামেন্ট হস্তক্ষেপ করে রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতায়, কমে আসে রাজার রাজনৈতিক আর নির্বাহী ক্ষমতার পরিধি, ইংরেজরা সহনশীল হয়ে ওঠে ধর্মীয় ভিন্নতার প্রতি।

গৃহযুদ্ধের পটভূমি

স্টুয়ার্ড রাজবংশের পূর্বসূরি, টিউডর রাজবংশের আমলেই ইংরেজ সমাজে প্রকাশিত হতে থাকে ধর্মীয় আর সামাজিক নানা ইস্যু, বিভাজন তৈরি হয় রাজনৈতিক মতাদর্শের উপর ভিত্তি করেও। টিউডর রাজবংশের রাজারা ছিলেন কর্তৃত্ববাদী। কিন্তু জনসাধারণের মাঝে টিউডর রাজাদের জনপ্রিয়তা ছিল, প্রটেস্ট্যান্ট আর ক্যাথলিকদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনকেও রাজনৈতিকভাবে দমিয়ে রেখেছিলেন টিউডর শাসকেরা। ষষ্ঠ হেনরির মাধ্যমে শুরু হওয়া টিউডর রাজবংশের শাসনের সমাপ্তি ঘটে রানী এলিজাবেথের শাসনের মাধ্যমে, সমাপ্তি ঘটে প্রটেস্ট্যান্ট আর ক্যাথলিকদের ধর্মীয় বিভাজনের। রানী এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের রাজা হন প্রথম জেমস, যার পরে রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসেন রাজা প্রথম চার্লস। একজন ক্যাথলিক প্রিন্সেসকে বিয়ে করেন রাজা প্রথম চার্লস, যার মাধ্যমে সংকটের সূচনা হয়। পিউরিটানরা ভয় পাচ্ছিলেন, ক্যাথলিক রাজকুমারীকে বিয়ের মাধ্যমে ইংরেজ সমাজের উপর আবারও ক্যাথলিক ধর্মমত চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করতে পারেন রাজা।

রাজা স্কটল্যান্ডে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ধর্মীয় সংস্কার করতে। স্কটল্যান্ডের বেশিরভাগ মানুষ ছিল প্রেসবেটারিয়ান। ফলে, স্কটল্যান্ডের মানুষের উপর ক্যাথলিক ধর্মমত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা স্কটল্যান্ড আর রাজা প্রথম চার্লসের মধ্যে যুদ্ধের সূচনা ঘটায়, যে যুদ্ধে রাজা প্রথম চার্লসের অনুগত বাহিনী পরাজিত হয়। রাজা পুনরায় যুদ্ধ শুরু করতে চাইলেন, যুদ্ধের প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য আহবান করলেন পার্লামেন্ট অধিবেশন। কিন্তু, পার্লামেন্টরিয়ানরা রাজাকে যুদ্ধের জন্য অর্থ দিতে অস্বীকার করে, তিনটি রাজ্যেই যার ফলশ্রুতিতে শুরু হয় রাজনৈতিক উত্তেজনা। ক্যাথলিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা আয়ারল্যান্ডে ক্যাথলিকদের হাতে নিহত হয় কয়েকশো প্রটেস্ট্যান্ট। যারা লন্ডন ত্যাগ করে চলে যান উত্তর আয়ারল্যান্ডে, নিজের অনুগত বাহিনীকে নির্দেশ দেন যুদ্ধের প্রস্ততি নিতে। এর মাধ্যমে রাজা প্রথম চার্লসের হাত ধরেই শুরু হয় ইংরেজ গৃহযুদ্ধ।  

ইংরেজ গৃহযুদ্ধে কর্নওয়েল; Image Source: History In Numbers

ইংরেজ গৃহযুদ্ধের পর্যায়

১৬৪২ সাল থেকে শুরু হওয়া ইংরেজ গৃহযুদ্ধ চলে ১৬৫১ সাল পর্যন্ত, যার মধ্যে গৃহযুদ্ধকে ইতিহাসবিদেরা ভাগ করেছেন তিনটি ধাপে। গৃহযুদ্ধে একপক্ষে ছিল রাজার অনুগত রাজকীয় বাহিনী, যারা মিত্রতা তৈরি করে ক্যাথলিক আয়ারল্যান্ডের সাথে। অন্যদিকে, পার্লামেন্টেরিয়ানদের প্রতি অনুগত বাহিনী পরিচিতি পায় রাউন্ডহেড বাহিনী হিসেবে, যারা মিত্রতা তৈরি করে স্কটল্যান্ডের সাথে। গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে রাজার অনুগত বাহিনী সাফল্য পেলেও সময়ের সাথে পার্লামেন্টের প্রতি অনুগত বাহিনীর সাফল্যের পাল্লা ভারী হতে থাকে।

গৃহযুদ্ধের কারণ

তখনকার ইংরেজ সমাজ বিভিন্ন ইস্যুতে বিভাজিত ছিল, ছিল গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন। বিভাজনের মধ্যে থেকেই রাজনৈতিক মতভিন্নতা তৈরি হয়, যেখান থেকে একসময় তৈরি হয় সংঘাতের পরিবেশ। ইংরেজ গৃহযুদ্ধেও এমন কিছু কারণ রয়েছে।

প্রথমত, শাসনতন্ত্র নিয়ে তখনকার ইংল্যান্ডে দুটি প্রধান মত ছিল। রাজা প্রথম চার্লস মনে করতেন, রাজারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি; ইশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে রাজা শাসনতন্ত্র পরিচালনা করবেন, শাসনতন্ত্রের উপর থাকবে রাজার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। অর্থাৎ, রাজা প্রথম চার্লস চাচ্ছিলেন একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন, যেখানে তিনি অসীম ক্ষমতা উপভোগ করবেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে। অন্যদিকে, পার্লামেন্টের সদস্যরা টিউডর শাসনামলে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পোক্ত করেন; কর আদায়, অর্থনৈতিক নীতি আর রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এমপিরাও চাচ্ছিলেন পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব। গৃহযুদ্ধের ক্রিয়াশীল দুটি গ্রুপ এই ইস্যুতে প্রাথমিকভাবে বিভাজিত হয়।     

ইংরেজ গৃহযুদ্ধ; Image Source: History on the Net

দ্বিতীয়ত, সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ সমাজে ছিল গভীর ধর্মীয় বিভাজন। ইংরেজদের মধ্যে ছিল ক্যাথলিক খ্রিষ্টান, যারা নিজেদের পরিচয় দিত ওল্ড ফেইথের অনুসারী হিসেবে। নিউ ফেইথের অনুসারী ছিল প্রটেস্ট্যান্টরা, যারা মূলত যুদ্ধে জড়ায় ক্যাথলিকদের সাথে। এর পাশাপাশি ছিল প্রেসবেটারিয়ানরা আর পিউরিটানরা, যাদের ধর্মবিশ্বাস গৃহযুদ্ধে সরাসরি সংঘাতের সাথে জড়িত ছিল না। ধর্মের মাধ্যমেই গৃহযুদ্ধে বিবদমান পক্ষগুলো তাদের কার্যক্রমের পক্ষে যৌক্তিকতা তৈরি করে, সমর্থন উৎপাদন করে অপরপক্ষের মানুষকে হত্যা, খুন আর লুটপাট করার।

তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক নীতি, বিশেষ করে করনীতি আর রাষ্ট্রীয় সম্পদ বরাদ্দ দেওয়ার নীতি নির্ধারণও গৃহযুদ্ধ শুরুর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। রাজা নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ধর্মের নামে যুদ্ধ করছিলেন, নিজের অনুগত বাহিনীকে লেলিয়ে দিচ্ছিলেন নিজেরই প্রজাদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, পার্লামেন্টের সদস্যরা রাজার এসব ব্যয়বহুল যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য নাগরিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায়ের ব্যবস্থাকে সমর্থন করেননি, সমর্থন করেননি রাজার অজনপ্রিয় উদ্যোগগুলোও। প্রাচীনকাল থেকেই দেখা গেছে, কর আদায়ের উপায় শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। কর আদায়ে প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তা রাজতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়, শক্তিশালী করে অ্যাসেম্বলি কালচারকে।

ইংরেজ গৃহযুদ্ধ; Image Source: National Army Museam

গৃহযুদ্ধের প্রভাব

রক্তক্ষয়ী আর সংঘাতপ্রবণ ইংরেজ গৃহযুদ্ধ ব্রিটিশ সমাজের জন্য বহু রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে, নিয়ে আসে বহু দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন। গৃহযুদ্ধের পরবর্তী ব্রিটিশ সমাজে নতুন রাজনৈতিক দর্শনের বিকাশ ঘটে, ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতি সহনশীলতার নতুন সংস্কৃতি তৈরি হয়। পাশাপাশি, শাসনতন্ত্রে আসে স্থায়ী কিছু পরিবর্তন, যেটি রেজিমের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়।

প্রথমত, ইংরেজ গৃহযুদ্ধের পরে ইংল্যান্ড কার্যকরভাবেই একটি রিপাবলিকে পরিণত হয়। ইংল্যান্ডের রিপাবলিকে রাজার কোনো কর্তৃত্ব ছিল না, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারিত হতো পার্লামেন্টের মাধ্যমেই। গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পরই অলিভার ক্রমওয়েল রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটান, শুরু করেন ইংল্যান্ডের রিপাবলিকান রেজিম। গৃহযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়া অলিভার ক্রমওয়েলের হাত ধরেই গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী ইংল্যান্ডে তৈরি হয় সংবিধান, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আর সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর পার্লামেন্টকে দেওয়া হয় সর্বময় কর্তৃত্ব। ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র ফিরে আসে, আবারও শুরু হয় রাজতন্ত্র আর পার্লামেন্টের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। তবে, অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের পাশাপাশি শাসনতান্ত্রিক ইস্যুতে এরপর থেকে পার্লামেন্টই প্রাধান্য পেয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে বহু ধর্মীয় পরিচয়ের মানুষ ছিল, ধর্মীয় পরিচয়কে কেন্দ্র করে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী ইংল্যান্ডের সমাজ ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতি আগের চেয়ে বেশি সহনশীল হয়ে ওঠে, সকল ধর্মীয় পরিচয়ের মানুষের জন্য সমান রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। ধর্মীয় পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় বৈষম্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে, প্রত্যেকে পায় তার নিজের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। পরবর্তী সময়ে যেটি অধিকাংশ জাতিরাষ্ট্রের মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইংরেজ গৃহযুদ্ধের পরে পার্লামেন্ট; Image Source: Britain Megazine.

তৃতীয়ত, মানবসভ্যতার শুরু থেকেই রাজারা রাষ্ট্র শাসন করেছেন, রাজতন্ত্রই নির্ধারণ করেছে রাষ্ট্রের শাসক কে হবে। তবে, ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পর প্রথমবারের মতো রাজাহীন শাসনব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে ইউরোপ, যেটি পরবর্তীতে সাংবিধানিক শাসনতন্ত্রের আন্দোলনকে উৎসাহিত করে। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে সাংবিধানিক শাসনতন্ত্রের জন্য বেশ কয়েকটি বড় আন্দোলন হয়, একই ধরনের আন্দোলন এশিয়াতে হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। এই ধরনের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাজতন্ত্র শুরুতে পরিণত হয় সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে, পরবর্তীতে পরিণত হয় পরিপূর্ণ রিপাবলিকে।

গৃহযুদ্ধ ইংরেজদের জনজীবনে সীমাহীন দুর্ভোগ নিয়ে এসেছিল, নিয়ে এসেছিল নির্যাতন আর নিপীড়নের স্বাভাবিকতা। গৃহযুদ্ধের সময় ইংরেজদের বাধ্য করা হয় সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে, নিজের স্বদেশীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে। আট বছরের গৃহযুদ্ধে নিহত হয় ইংল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার সাড়ে ৪ শতাংশ। এরপরও, গৃহযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটিশ সমাজে মসৃণভাবেই চলেছে রাজনৈতিক, সামাজিক আর ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পুনর্মিলন, পার্লামেন্ট পায় রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতা।

This article is written in Bangla about the English Civil Wars. 

All the necessary links are hyperlinked inside. 

Feature Image: ThoughtCo.

Related Articles