রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটলকে। রাষ্ট্রকে ব্যাখ্যা, শাসনকাঠামোকে ব্যাখ্যার মতো কিছু মৌলিক কাজ রয়েছে তার রাজনৈতিক দর্শনে। শাসনতন্ত্র মানুষের অংশগ্রহণের উপর ভিত্তি করে অ্যারিস্টটল শাসনতন্ত্রের ছয়টি ধরন আলোচনা করেছেন।
একব্যক্তি-শাসন যখন সকলের মঙ্গলের জন্য পরিচালিত হয়, তখন তাকে রাজতন্ত্র বলে। এই কাঠামোতে রাজা অত্যন্ত ধনী হন, অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যবান হন, ফলে তার বৈষয়িক কোনো চাহিদা থাকে না বললেই চলে। বিপরীতক্রমে, একই ব্যক্তি যখন কেবলমাত্র নিজের কল্যাণের জন্য, অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য শাসনতন্ত্র পরিচালনা করেন, তখন সেই শাসনকে বলে স্বৈরতন্ত্র।
যখন কতিপয় অর্থনৈতিকভাবে সামর্থবান বা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অগ্রসর মানুষ সকলের মঙ্গলের জন্য শাসনতন্ত্র পরিচালনা করেন, তখন সেই শাসনব্যবস্থাকে বলে অভিজাততন্ত্র। অভিজাততন্ত্রে শাসকেরা দ্রুত নাগরিকদের মতামত অনুধাবন করতে পারেন, সকলের মঙ্গলসাধন শাসনের উদ্দেশ্য থাকায় খুব দ্রুতই নাগরিকদের সুবিধা-অসুবিধাযায়ী শাসনতন্ত্রের দৈনন্দিন প্রথাগুলোতে পরিবর্তন আনতে পারেন। এর বিপরীত ঘরানার শাসন হলো কতিপয়তন্ত্র। কতিপয়তন্ত্র অল্প কিছু মানুষের গ্রুপ কাজ করে কেবল নিজেদের কল্যাণের জন্য, শাসনতন্ত্রকে পরিচালনা করে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ সামনে রেখে।
বহু মানুষ যখন শাসনতন্ত্রে যুক্ত হয় এবং রাজনৈতিক সত্ত্বার সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করে, তখন সেই শাসনকে বলা হয় পলিটি। পলিটির বিকৃত রূপ গণতন্ত্র।
অভিজাততন্ত্র কী?
ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি, কিছু মানুষ, যারা অর্থনৈতিকভাবে সামর্থবান বা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমাজের অন্যদের চেয়ে অগ্রসর, তারা সকলের মঙ্গলের জন্য যে শাসনতন্ত্রে কাজ করেন, সেটাকে অভিজাততন্ত্র বলে। এর বাইরেও অভিজাততন্ত্রের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
প্রথমত, অভিজাততন্ত্রে সকল ক্ষমতা গুটিকয়েক মানুষের কাছে থাকে। রাষ্ট্রের সকলের মঙ্গলের দায়িত্ব থাকে তাদের হাতে, তাদের চিন্তার মধ্যে। তবে অল্প কিছু মানুষ একসাথে হয়ে কীভাবে শাসনতন্ত্র চালাবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অ্যারিস্টটলের দর্শনে উঠে আসেনি। এই প্রক্রিয়ার একটি কাছাকাছি কাঠামোর চর্চা রয়েছে সুইজারল্যান্ডে, যেখানে কয়েকজনের একটি কমিটি রাষ্ট্রের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, একজন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেই অভিজাতদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে। সুইজারল্যান্ডে অভিজাত বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবেই অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যবানদের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এগিয়ে থাকা গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, অভিজাততন্ত্রে যে কতিপয় শাসক রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করেন, রাষ্ট্রের দৈনিক কাজগুলো সম্পাদন করেন, তারা সাধারণত উত্তরাধিকারসূত্রে নির্বাচিত হন। অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে এই প্রক্রিয়ায় উত্তরাধিকার দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে যারা শাসনতন্ত্রের অংশ হন, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সাধারণভাবে একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হন না, একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের সুযোগও সাধারণত নেই।
তৃতীয়ত, যেহেতু অল্প কিছু মানুষের হাতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা পূঞ্জীভূত থাকে, ফলে বিভিন্ন সময়ই তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় না। আবার, কতিপয় ব্যক্তিকে শাসনের ব্যাপারে জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে পারলে তারা খুব সহজেই নৈতিক বিচ্যুতির দিকে যেতে পারে।
অভিজাততন্ত্রের উত্থান
অভিজাততন্ত্রে যেসব মানুষ শাসনে অংশ নেন, তারা সাধারণত রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচিত অভিজাত অংশ থেকে উঠে আসেন, কিংবা সামাজিকভাবে অভিজাত শ্রেণির অংশ হন। অ্যারিস্টটলের দর্শন থেকে আমরা অভিজাত শ্রেণির শাসক হিসেবে উত্থানের দুটি পদ্ধতি বা চিত্র পাই।
প্রথমত, অভিজাততন্ত্রের উত্থান সামরিক সংঘাত, যুদ্ধ বিগ্রহের ঘটনা থেকে হতে পারে। যুদ্ধের সময়, অন্য অঞ্চলের সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে যেসব সামরিক অধিনায়ক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করেন, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তারাই শাসনের মূল কেন্দ্রে চলে আসেন। আবার, অভ্যন্তরীণ সংঘাত বা প্রতিক্রিয়াশীল দুই পক্ষের সংঘাত রুখে দেওয়ার ক্ষমতা থেকেও সামরিক অধিনায়কেরা ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসতে পারেন। প্রাথমিকভাবে, এই প্রক্রিয়াতেই সামরিক বাহিনীর যোদ্ধাদের মধ্য থেকে, সামরিক বাহিনীর অধিনায়কদের মধ্য থেকে অভিজাততন্ত্রের শাসক উঠে আসে, যারা সাধারণত ‘ওয়ারলর্ড’ হিসেবে পরিচিত।
দ্বিতীয়ত, একটা দীর্ঘ সময় ধরে মানবজাতির অর্থনীতি ছিল কৃষিকেন্দ্রিক, ভূমি ছিল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির মূল প্রাণকেন্দ্র। এই অর্থনৈতিক কাঠামোতে, যার নিয়ন্ত্রণে অধিক জমি থাকত, সে অধিক ফসল উৎপাদনে সক্ষম হতো এবং অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেত। জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়ে স্থানীয়ভাবে অপ্রতিদ্বন্দ্বীর পর্যায়ে চলে গেলে সেই জায়গায় সামন্তবাদ তৈরি করতেন জমির মালিক সেই কৃষক। সামন্তবাদী সেই কৃষক একসময় ঢুকে পড়তেন ক্ষমতার অন্দরমহলে, হয়ে যেতেন রাষ্ট্রের অভিজাততন্ত্রের অংশ।
অভিজাততন্ত্র ও কতিপয়তন্ত্রের পার্থক্য
অভিজাততন্ত্র ও কতিপয়তন্ত্র, উভয় শাসনব্যবস্থাতেই রাষ্ট্র কতিপয় মানুষের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই সাদৃশ্য সত্ত্বেও অভিজাততন্ত্র যেখানে অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিকোণে শাসনতন্ত্রের শুদ্ধরুপ, কতিপয়তন্ত্র সেখানে শাসনতন্ত্রের বিকৃত রূপ। বেশ কিছু পার্থক্যের অ্যারিস্টটলের দর্শনে এই পার্থক্য উঠে এসেছে।
প্রথমত, অভিজাততন্ত্র সকলের মঙ্গলের জন্য শাসন, কতিপয়তন্ত্রে কেবল অল্প কিছু মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য রাষ্ট্র বা শাসনতন্ত্র কাজ করে। ফলে, অভিজাততন্ত্রে যেখানে রাষ্ট্রীয় সুবিধা সকলের কাছে পৌঁছায়, কতিপয়তন্ত্রে সেখানে রাষ্ট্রীয় সুবিধা কয়েকজন মানুষের জন্যই বরাদ্দ থাকে।
দ্বিতীয়ত, অভিজাততন্ত্রে শাসক হিসেবে আসেন আদর্শবান মানুষেরা, যাদের মূল লক্ষ্য থাকে সকলের সামষ্টিক প্রবৃদ্ধি। অন্যদিকে কতিপয়তন্ত্রে শাসক আসেন ব্যবসায়ী শ্রেণি থেকে, যেখানে শাসকেরা রাষ্ট্রকে ব্যবসায়ী মডেলে পরিচালনা করতে চান বা পরিচালনা করেন। এর ফলে, অভিজাততন্ত্রে যেখানে সকল মানুষের জন্য একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকে, কতিপয়তন্ত্রের কাঠামোতে রাষ্ট্র প্রাথমিক দায়িত্বগুলো পালনে ব্যর্থ হয়।
তৃতীয়ত, অ্যারিস্টটলের শাসনতন্ত্রে সবচেয়ে বিশুদ্ধ শাসনতন্ত্র হচ্ছে রাজতন্ত্র, সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হচ্ছে স্বৈরতন্ত্র। অভিজাততন্ত্র একটি শাসনতন্ত্রকে রাজতন্ত্রের বিশুদ্ধ রূপের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে, অন্যদিকে কতিপয়তন্ত্র একটি শাসনতন্ত্র নিয়ে যেতে পারে স্বৈরতন্ত্রের মতো নিপীড়ক একটি কাঠামোতে। অভিজাততন্ত্রে যেহেতু একদল বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর মানুষ সমন্বিতভাবে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করেন, ফলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সুযোগ ব্যয় সবচেয়ে কমে আসে, সিদ্ধান্তও হয় নাগরিকদের সর্বোত্তম সুবিধা দিতে। ফলে, নাগরিকদের উপর করের বোঝা কমে আসে।
অন্যদিকে, কতিপয়তন্ত্রে রাষ্ট্র কয়েকটি স্বার্থগোষ্ঠীর স্বার্থকে মাথায় রেখে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নীতি গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্র সংরক্ষণবাদের দোহাই দিয়ে ওষুধের মতো একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানি নিষিদ্ধ করল। সাধারণ নাগরিকদের তখন ওষুধ ছাড়াই রোগমুক্তির প্রার্থনা করতে হবে। অন্যদিকে, এই ওষুধ কতিপয় স্বার্থগোষ্ঠীকে নিম্নমানের ওষুধ অধিক দামে বিক্রি করার এবং বিপুল মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দেবে।
আবার, রাষ্ট্র হয়তো একটি অঞ্চলে মহাসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিল বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে। কিন্তু দেখা গেল, মহাসড়কের প্রস্তাবিত এলাকাটি প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং সেখানে জনমানবের বসতি প্রায় নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রের কাঠামো বুঝতে পারছে, এর অর্থনৈতিক কোনো উপযোগ নেই, কিন্তু স্বার্থগোষ্ঠীর চাপের কারণে প্রকল্প অনুমোদন করতে হচ্ছে। একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও। অনেক দেশেই বিদ্যুৎ জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে গত কয়েক দশকে, যেগুলোর ব্যবহারিক গুরুত্ব নেই বললেই চলে। কতিপয়তন্ত্রের এই কাঠামো নাগরিকদের উপর করের বোঝা বাড়িয়ে দেয়।
অভিজাততন্ত্র কেন নয়?
মানবসভ্যতার একটা বড় অংশই কেটেছে রাজাদের শাসনের অধীনে। রাজারা সাধারণত রাজপরিবারের সামগ্রিক স্বার্থ চিন্তা করে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করতেন, রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রভাব থাকত অভিজাত পরিবারগুলোর স্বার্থও। কিন্তু, অভিজাত পরিবারগুলো, যেগুলো পাশ্চাত্যে সামন্ত পরিবার নামে পরিচিত, প্রাচ্যে পরিচিত জমিদার পরিবার নামে, প্রায় কখনোই সামগ্রিক স্বার্থের কথা চিন্তা করে কাজ করেনি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিপ্রদাস’-এর মতো জমিদারের উপস্থিতি কেবল উপন্যাসেই সম্ভব হয়েছে, বাস্তবের জমিদাররা বিশুদ্ধতা, সামগ্রিক কল্যাণের চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন ব্যক্তিস্বার্থকেই। অর্থাৎ, অভিজাততন্ত্রের প্রয়োগ ঘটাতে গেলেই সেটি সাধারণত কতিপয়তন্ত্রে পর্যবসিত হয়।
অভিজাতদের এই প্রবণতা মানুষের স্বাভাবিক চরিত্রেরই অংশ। ফলে, পৃথিবীর প্রায় কোথাও রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে অভিজাততন্ত্রের বিকাশ না ঘটলেও, অভিজাতরা সবসময়ই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশ হয়েছেন, রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন, নিজেদের স্বার্থকে সামনে রেখে প্রভাবিত করেছেন রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে।