দীর্ঘদিন ধরে সর্দিকাশির সাথে লড়াই করে যাচ্ছেন ভারতের আম আদমি পার্টি (আপ) এর প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। যে কারণে অধিকাংশ সময়ই তার গলায় মাফলার দেখা যায়। আর মাফলার থেকেই ভারতজুড়ে তিনি ‘মাফলারম্যান’ নামে পরিচিত। এই মাফলারম্যানের হাত ধরে বদলে যাচ্ছে ভারতের রাজধানী দিল্লির জনজীবন থেকে শুরু করে ভারতীয় রাজনীতির নানা হিসেবনিকেশ।
মাত্র নয় মাস আগেই ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির সাতটি আসনের সবগুলোতে জয় পেয়েছিল কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। লোকসভার এই ভূমিধ্বস বিজয় বিজেপিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল রাজ্য সরকারের ক্ষমতা দখলের। কিন্তু লোকসভার ফলাফলে ভড়কে গেলেও থমকে যাননি কেজরিওয়াল। দিল্লির মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। যার প্রতিদান তিনি পেয়েছেন ভোটের ময়দানে।
দিল্লির নির্বাচন ক্ষমতাসীন বিজেপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা কেন্দ্রে টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরই ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে মোদীর দল।
এরপর কর্ণাটকের উপনির্বাচনে ১৫ আসনের মধ্যে ১২টিতে জয় লাভ করে বিজেপি। কিন্তু এনআরসি ও সিএএ নিয়ে ভারতের রাজধানীতে যখন পুরোপুরি সরগরম তখনই রাজধানী দিল্লির রাজ্যসভা ভোট।
এই ভোটের ফলাফল জাতীয় রাজনীতির জন্য খুবই অর্থবহ ছিল। কারণ ভারতের সাধারণ মানুষ এনআরসি ও সিএএকে কতটুকু সমর্থন করছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ব্যালটের হিসেবে৷ কিন্তু ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ইভিএম খোলার পর থেকেই গেরুয়া শিবিরের দিল্লির মসনদ দখলের স্বপ্ন ফিকে হতে থাকে।
ভোটের পরপরই ভারতের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের বুথফেরত জরিপ বলছিল আবারো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লির ক্ষমতায় আসছে আম আদমি পার্টি। কিন্তু সেসবকে পাত্তা দেননি দিল্লির বিজেপি সভাপতি মনোজ তিওয়ারি। ভোট গণনা শুরু হওয়ার আগেও তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। এবং জোর গলায় বলেছিলেন, দিল্লিতে তারাই সরকার গঠন করছেন৷ কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে অভিনন্দন জানাতে হয়েছে তিওয়ারির।
কেজরিওয়ালের জয়ের কারণ
দিল্লির রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেস পুরোপুরি হিসাবের বাইরে চলে গেছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনের মতো এবারো তাদের ঝুলি শূন্য। এমনকি জামানত হারিয়েছেন তাদের সব প্রার্থী। ফলে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আম আদমি পার্টি ও বিজেপি।
লোকসভা নির্বাচনের মতো রাজ্যসভার নির্বাচনগুলোতেও বিজেপির আসল অস্ত্র ছিল জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মেরুকরণ। দিল্লির নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে তারা নতুন অস্ত্র হিসেবে দাঁড় করায় শাহীনবাগকে।
অপরদিকে কেজরিওয়ালের মূলশক্তি ছিল তার নেওয়া যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত। বিজেপি তাকে ধর্মীয় মেরুকরণ ও জাতীয়তাবাদের রাজনীতির ফাঁদে আটকানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি খুব কৌশলের সাথেই তা এড়িয়ে গেছেন৷ যার ফলে আম আদমি পার্টির ঝাড়ু-ঝড়ের সামনে উড়ে গেছে বিজেপির পদ্মফুল।
এরপরও প্রশ্ন থেকে যায় কেজরিওয়ালের হ্যাটট্রিকের পেছনে কোন কোন বিষয় বড় ভূমিকা পালন করেছে? চলুন সেসব সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর বেতন বৃদ্ধিতে লাগাম
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের টানা তৃতীয়বারের জয়ের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর বাড়তি বেতনের লাগাম টেনে ধরার সিদ্ধান্ত। আপ সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে দিল্লির অধিকাংশ পরিবার কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়েছেন।
দিল্লিতে আম আদমি পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে সরকারি সহায়তা না পাওয়া দুই শতাধিক বেসরকারি বিদ্যালয় প্রতিবছর নিজেদের ইচ্ছামতো বেতন বৃদ্ধি করত। কিন্তু কেজরিওয়ালের সরকার গত পাঁচ বছর তার লাগাম টেনে ধরতে অনেকটাই সফল হয়েছে। তারা বেসরকারি স্কুলগুলোকে অস্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধি করার কোনো সুযোগ দেয়নি।
বিষয়টি নিয়ে বিদ্যালয়গুলোর মালিকপক্ষ আদালতের শরণাপন্ন হয়। সেখানে একজন বিচারপতি রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তকে বাতিল ঘোষণা করে। দিল্লির সরকার তখন স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের অভিভাবকদের নিশ্চিন্ত করার জন্য আদালতের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে। এরপর আদালতের একটি বেঞ্চ পূর্বের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে।
এবারের নির্বাচনের আগে কেজরিওয়ালের প্রচারণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক ছিল তার সরকারের বিশেষ এই নীতি। নির্বাচনের আগে তিনি দিল্লির সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করে নিজের টুইটারের লেখেন,
যতদিন দিল্লিতে এই সৎ সরকার থাকবে, ততদিন অভিভাবকদের স্কুলের বেতন নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। কোনো বেসরকারি বিদ্যালয়কে ইচ্ছামতো বেতন বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে না। আগের পাঁচ বছরের মতো আগামীতেও এই বিষয়টি আমরা নিয়ন্ত্রণ করবো।
তবে কেজরিওয়ালের সরকার শুধু বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো বাড়তি বেতন নেওয়াই বন্ধ করেনি। সেই সাথে যারা অতিরিক্ত বেতন নিয়েছে, তাদের বাড়তি টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করেছে।
সরকারি বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন
দিল্লিতে বিগত পাঁচ বছরে আপ সরকার সরকারি বিদ্যালয়গুলোর নজিরবিহীন উন্নয়ন করেছে। বিদ্যালয়ের অবকাঠামো থেকে শুরু করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং স্কুলের সাথে অভিভাবকদের সম্পর্ক তৈরি, সবকিছুতেই ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে কেজরিওয়াল সরকার। যার পুরো কৃতিত্ব কেজরিওয়াল এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়ার।
দিল্লির সরকারি বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন সম্পর্কে কেজরিওয়াল বলেন,
আমাদের সরকারি বিদ্যালয়গুলো বেসরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে ভালো না হলেও অন্তত একেবারেই মন্দ নয় তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। গত সাড়ে তিন বছরে দিল্লির বাৎসরিক বাজেটের শতকরা ২৫ ভাগই শিক্ষার পেছনে ব্যয় করা হয়েছে। এই বাজেট আমরা যখন ক্ষমতায় আসি তার থেকে তিনগুণ বেশি। আমরা এই তহবিল থেকে আমাদের বিদ্যালয়ে বিশ্বমানের অবকাঠামো, স্মার্ট ক্লাসরুম, সুইমিং পুল, পাঠাগার, আধুনিক ডেস্ক এবং উন্নতমানে ল্যাব তৈরি করেছি।
আপ সরকার সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিশ্বমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। যার ফলে অনেক শিক্ষক কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং এনআইই সিঙ্গাপুর ছাড়াও আরো অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এর ফলে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তান বেসরকারি বিদ্যালয় থেকে এনে সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন।
দিল্লির শিক্ষাখাতে আরেকটি ইতিবাচক পরিবর্তন হলো অভিভাবক-শিক্ষক বৈঠক। আগে যারা দিল্লির মসনদে ছিলেন তারা এই বিষয়টিকে কাগজে-কলমে দেখিয়েছেন। কিন্তু আপ সরকার এর বাস্তবায়ন করেছেন। যার ফলে নিজের বাচ্চাদের পড়াশোনা অবস্থা সম্পর্কে অভিভাবকরা জানতে পারছেন। যা শিক্ষায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।
এসবের পাশাপাশি কেজরিওয়ালের সরকার দিল্লির ২০০ সরকারি বিদ্যালয়ে প্রায় ২০ হাজার নতুন শ্রেণিকক্ষ তৈরি করেছে। যেখানে বিগত সব সরকার মিলিয়ে সরকারি স্কুলগুলোতে ১৭ হাজার নতুন শ্রেণিকক্ষ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
বিনামূল্যে বিদ্যুৎ ও পানি
দিল্লি নির্বাচন বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে আপ সরকারের বিদ্যুৎ ও পানিতে ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত। গত বছরের ১ আগস্ট থেকে দিল্লির বাসিন্দাদের ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারে শতভাগ ভর্তুকি দেওয়ার ঘোষণা দেয় রাজ্য সরকার। এছাড়া যারা ২০১ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন তাদের জন্য বিলের প্রায় ৫০ ভাগ মওকুফ।
২০১৫ সালের নির্বাচনের আপের নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারা ক্ষমতায় গেলে প্রতি মাসে প্রত্যেক বাড়িতে কমপক্ষে ২০ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করবেন। ক্ষমতায় আসার পর তারা সেই প্রতিশ্রুতি শুধু পূরণই করেননি, সেই সাথে ২০ হাজার লিটার পানির জন্য সাধারণ জনগণকে কোনো অর্থ দিতে হচ্ছে না। তবে এর চেয়ে বাড়তি পানি খরচ করলে তাদের নির্দিষ্ট হারে কিছু বিল দিতে হবে।
আপ সরকারের জনবান্ধব এই নীতি দিল্লির মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে সাহায্য করেছে। যে কারণে তারা আরো একবার মাফলারম্যানের উপর ভরসা রেখেছেন।
মহল্লা ক্লিনিক
আপ সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই জনগণকে কম খরচে ভালো মানের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর এজন্য তিনি দিল্লির বিভিন্ন স্থানে এক হাজার সরকারি মহল্লা ক্লিনিক স্থাপনের ঘোষণা দেন। তবে এক হাজার না হলেও তিনি শেষ পর্যন্ত প্রায় তিন শতাধিক ক্লিনিক স্থাপন করতে পেরেছেন।
এসব ক্লিনিকে জ্বর, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের সমস্যা, ছোটখাটো আঘাত ও পোড়ার প্রাথমিক চিকিৎসাসহ আরো কিছু সেবা বিনামূল্যে দেওয়া হয়৷ সেই সাথে এসব রোগের ওষুধপত্রও বিনামূল্যে দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষ যাতে এসব ওষুধকে অবহেলা না করেন, তার জন্য বিশেষ কিছু কর্মী নিয়োগ করা আছে যারা সাধারণ মানুষকে মহল্লা ক্লিনিকের চিকিৎসা সম্পর্কে বোঝান।
বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধপত্র দেওয়ার পাশাপাশি মহল্লা ক্লিনিকগুলোতে প্রায় ২১২ রকমের পরীক্ষাও করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান পর্যন্ত কেজরিওয়াল সরকারের মহল্লা ক্লিনিকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
নারীদের জন্য বিনামূল্যে বাস সেবা
গত বছরের ২৯ অক্টোবর থেকে নারীদের জন্য বিনামূল্যে বাস সেবার পরিধি আরো বৃদ্ধি করে আপ সরকার। দিল্লি ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের মাধ্যমে তাদের শহরের বিভিন্ন স্থানে বিনামূল্যে যাতায়াতের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আর এজন্য বাসের কন্ডাকটর নারীদের দশ রুপির একটি গোলাপি রঙের বিশেষ টিকিট দিয়ে থাকেন। যার মাধ্যমে তারা বাসে যাতায়াত করতে পারেন।
নমনীয় হিন্দুত্ববাদ
২০১৫ সালে নির্বাচনের আগে দিল্লির জামা মসজিদের ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারি দিল্লির মুসলমানদের আম আদমি পার্টিকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। কেজরিওয়াল তখন তার সেই বক্তব্যের বিপরীতে জানিয়ে দেন, তারা সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী রাজনীতির বিপক্ষে।
আম আদমি পার্টি তাদের এই নীতি বরাবরই বজায় রেখেছেন। কেজরিওয়াল যেমন মুসলিমদের ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়েছেন, তেমনি বিভিন্ন পূজায়ও শামিল হয়েছেন। বিজেপির মতো কট্টরভাবে না হলেও হিন্দুত্ববাদকে কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছেন এই নেতা।
গত বছরের ১২ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী তীর্থ যাত্রা স্কিমের অধীনে একটি বিশেষ ট্রেন চালু করেছে দিল্লির রাজ্য সরকার। এই ট্রেনে করে ধর্মপ্রাণ হিন্দু নাগরিকরা দেশের পাঁচটি ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থানে ভ্রমণ করতে পারেন। এর জন্য সকল ব্যয় বহন করে রাজ্য সরকার।
এর পাশাপাশি অরবিন্দ কেজরিওয়াল নিজেকে একজন হনুমান ভক্ত হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে তিনি একটি হনুমান মন্দিরে পূজা দিতে যান এবং সেখানে হনুমান-চল্লিশা পাঠ করেন। ভোটের দিন তাকে কপালে তিলক নিয়ে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ঘুরতে দেখা গেছে।
এছাড়া তিনি রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য শাহীনবাগের আন্দোলনের প্রতি কোনো সমর্থন জানাননি এবং তিনি সেখানে একবারের জন্য যাননি। এরপর দিল্লির মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় অধিকাংশ ভোট আম আদমি পার্টি পেয়েছে, যে ভোটগুলো সাধারণত কংগ্রেস পেয়ে থাকে।
ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি
আগে অধিকাংশ সময়ই কেজরিওয়াল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের সমালোচনা করতেন। এবং একের পর এক ইস্যুতে মোদী-শাহ জুটির সাথে তর্কে জড়াতেন। একবার তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘পাগল ও কাপুরুষ’ বলেছিলেন, যা নিয়ে অনেকেই তার সমালোচনা করেছিলেন।
এছাড়া তিনি বিভিন্ন আন্দোলন দমনে কেন্দ্রীয় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপসমূহের কঠোর সমালোচনা করতেন। এমনকি তিনি পাক নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতের সেনাবাহিনীর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রমাণও চেয়েছিলেন! কিন্তু এবারের নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে কেজরিওয়াল সেখান থেকে পুরোপুরি ‘ইউটার্ন’ নিয়েছেন।
তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের নেওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকেন। বিপরীতে তিনি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন।
বিজেপি নেতা পরবেশ ভার্মা তাকে ‘সন্ত্রাসী’ বলার পর কেজরিওয়াল তার জবাব না দিয়ে বলেন, এতে তার বাবা-মা খুবই কষ্ট পেয়েছেন। তখন তিনি ভোটারদের বলেন, আপনারা সিদ্ধান্ত নিন আমি আপনাদের পরিবারের বড় সন্তান নাকি সন্ত্রাসী!
কেজরিওয়াল কী ভারতের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী?
দিল্লি বিধানসভার ভোট গণনার সময় আম আদমি পার্টির এক সমর্থকের হাতে একটি বিশেষ ব্যানার দেখে গেছে। যেখানে লেখা ছিল ‘২০২৪ সাল, মোদী বনাম কেজরিওয়াল’। এর অর্থ হচ্ছে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদে মোদী ও কেজরিওয়ালের লড়াই হতে হচ্ছে। কিন্তু ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কী সেটাই বলছে?
এবারের দিল্লি রাজ্য নির্বাচন যতটা না ছিল আপ বনাম বিজেপি, তার চেয়েও বেশি ছিল মোদী বনাম কেজরিওয়াল। কারণ অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন, এবার তারা কোনো মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করবেন না। এবারের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বেই দিল্লি নির্বাচনে বিজেপি লড়াই করবে।
সেই হিসেবে ভোটের ফলাফলে কেজরিওয়ালের কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। আম আদমি পার্টির ৬২ আসনের বিপরীতে বিজেপির জয় মাত্র আট আসনে। তবে আশার কথা হলো আগের চেয়ে বিজেপির আসন সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তা আম আদমি পার্টির ভূমিধ্বস জয়ের পেছনে কোনো বাধা হতে পারেনি।
কেজরিওয়ালের এই জয় ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে রাখবে। বর্তমানে ভারতের রাজনীতিতে বিরোধী শিবির থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন নেতাদের তালিকার প্রথম সারিতে রয়েছেন রাহুল গান্ধী, মারাঠা স্ট্রংম্যান শরদ পাওয়ার, অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও মমতা ব্যানার্জি।
এর মধ্যে রাহুল গান্ধী ইতোমধ্যে মোদীর কাছে হেরেছেন। তার ভাবমূর্তি মোদীকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো নয়। আর মমতা ব্যানার্জি ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তিনি এখনো পশ্চিমবঙ্গকে এমন অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেননি, যা তাকে পুরো ভারতের আস্থা অর্জনে সহায়তা করবে।
বাকি থাকলেন শরদ পাওয়ার ও কেজরিওয়াল। রাজনীতিতে পোড় খাওয়া মারাঠা স্ট্রংম্যান প্রধানমন্ত্রী পদে লড়ার যোগ্যতা রাখেন। ইতোমধ্যে তিনি মোদী-শাহ জুটিকে ঘোল খাইয়ে মহারাষ্ট্রে শিবসেনার সাথে সরকার গঠন করেছেন। কিন্তু পুরো ভারত তার কাজ দেখার সুযোগ এখনো পায়নি। মহারাষ্ট্রের উন্নয়ন যদি দিল্লিকে ছাপিয়ে যেতে পারে, তবেই তিনি কেজরিওয়ালকে পেছনে ফেলতে পারবেন।
অপরদিকে কেজরিওয়ালের উন্নয়ন সম্পর্কে পুরো ভারতবর্ষ ওয়াকিবহাল। প্রায় সব রাজ্যেই সাধারণ মানুষ আম আদমি পার্টির মতো সরকার চাচ্ছেন। কারণ তারা দিল্লির মানুষকে যে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তা ভারতের অন্য রাজ্যের মানুষ পাচ্ছে না বলা যায়।
তবে কেজরিওয়ালের দল শুধুমাত্র একটি আঞ্চলিক শক্তি। যেখানে বিজেপি ও কংগ্রেসের শক্তি সমগ্র ভারতে৷ এক্ষেত্রে কংগ্রেস যদি উদার হয় তাহলে কেজরিওয়ালের ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে লড়াই করা সম্ভব৷ কংগ্রেস যদি কেজরিওয়ালকে সেই সুযোগ দেয়, তাহলে তা তাদের জন্যই মঙ্গলজনক হবে। কেননা মোদীর জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মেরুকরণের সামনে তারা টিকতে পারছে না।
এখন ভারতের দুর্বল অর্থনীতিকে অস্ত্র হিসেবে তুলে ধরে ভারতের বিরোধী শিবির থেকে যদি কেজরিওয়ালের মতো একজন উন্নয়নের রূপকারকে প্রধানমন্ত্রী পদে দাঁড় করানো যায়, হয়তো তাহলেই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-বিরোধীদের একটা গতি হতে পারে! আর যদি সব কিছুর বদলে সেই রাহুল গান্ধীকেই আরো একবার মনোনয়ন দেয় কংগ্রেস, খুব সম্ভবত সেটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্তই হবে তাদের জন্য।
যেভাবে কেজরিওয়ালের রাজনীতিতে আগমন
১৯৬৮ সালের ১৬ আগস্ট, হরিয়ানার ভিবানীতে জন্মগ্রহণ করেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। বাবা গোবিন্দরাম ও মা গীতা দেবীর প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি। শৈশব কেটেছে সোনিপথ, হিসার ও গাজিয়াবাদ সহ আরো কিছু শহরে। হিসারের ক্যাম্পাস হাই স্কুল এবং সোনিপথের এক খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল থেকে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন কেজরিওয়াল।
বাবা গোবিন্দরাম ছিলেন একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পরবর্তীতে বাবার দেখানো পথ ধরে তিনিও প্রকৌশলী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে আইআইটি-জেইই পরীক্ষায় তিনি মেধাতালিকায় ৫৬৩তম স্থান অর্জন করেন। এরপর তিনি খড়গপুরের আইআইটিতে ভর্তি হন। ১৯৮৯ সালে সেখান থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নিয়ে টাটা স্টিলে যোগ দেন। তার প্রথম কর্মস্থল ছিল ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুর।
সাত বছর টাটা স্টিলে চাকরি করার পর সেখান থেকে ইস্তফা দেন। সিদ্ধান্ত নেন বদলে ফেলবেন ক্যারিয়ার। সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার মনঃস্থির করেন। পরীক্ষায় তিনি সফলও হন। ১৯৯৫ সালে ইন্ডিয়ান রেভেনিউ সার্ভিস বা আইআরএস-এ যোগদান করেন। কিন্তু কেজরিওয়ালের ক্যারিয়ারের এই অধ্যায় খুবই বিতর্কিত।
২০০০ সালের নভেম্বরে উচ্চশিক্ষা জন্য বেতন ভাতাসহ দুই বছরের ছুটি নেন। পরিকল্পনা করেছিলেন আর চাকরিতে ফিরবেন না। কিন্তু তেমন করলে তাকে সমুদয় বেতন সরকারকে ফেরত দিতে হবে, যা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ কারণে তিনি আবারো চাকরিতে যোগদান করেন।
কিন্তু চাকরির দ্বিতীয় পর্যায়ে তার কোনো পদমর্যাদা ছিল না। দেড় বছর তিনি কাজ ছাড়াই বেতন পান৷ এ কারণে তিনি পরে বেতনহীন দেড় বছরের জন্য ছুটির আবেদন করেন। মঞ্জুর হয় তার আবেদন। ২০০৬ সালে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। কিন্তু সরকার তার বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। যা পরবর্তীতে আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ২০১১ সালে কেজরিওয়াল বন্ধুদের কাছে থেকে ধার করে নয় লাখ রুপি সরকারকে ফেরত দিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটান।
কর্মজীবন থেকেই কেজরিওয়াল সমাজসেবার সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯৯ সালে আইআরএস-এ চাকরিরত অবস্থায় শুরু করেন ‘পরিবর্তন আন্দোলন’। সেই আন্দোলনে তার সহযোগী ছিলেন বর্তমান ডেপুটি মণীশ সিসৌদিয়া। পরে তারা দুজন মিলে ‘কবীর’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
কেজরিওয়াল নিজে আন্না হাজারের শিষ্য ছিলেন। ২০১১ সালে গুরু আন্না হাজারে ও কিরণ বেদীকে সাথে নিয়ে গঠন করেন ‘ইন্ডিয়া এগেইনস্ট করাপশন’ নামে এক সংগঠন৷ লোকপাল বিলের দাবিতে করা আন্না হাজারের অনশনের অন্যতম পরিচিত মুখ ছিলেন কেজরিওয়াল। সেখান থেকে ২০১২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আম আদমি পার্টি’।
২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কেজরিওয়ালের দল ২৮টি আসনে জয় লাভ করে। আর বিজেপির আসন সংখ্যা ছিল ৩১টি। পরবর্তীতে কংগ্রেসের আটজন বিধায়কের সমর্থন নিয়ে তিনি সরকার গঠন করে তিনি। কিন্তু তার সেই সরকারের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৪৯ দিন। ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন। পরের বছর একই দিন তিনি দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এবার তার দল ৭০ আসনের মধ্যে ৬৭টি আসনে জয় লাভ করে।
কেজরিওয়ালের সাফল্যের অন্যতম কাণ্ডারি তার স্ত্রী সুনীতা। ১৯৯৩ ব্যাচের আইআরএস এই কর্মকর্তার সাথে কেজরিওয়ালের বিয়ে হয় ১৯৯৫ সালে। তাদের হর্ষিতা নামে এক মেয়ে এবং পুলকিত নামে এক মেয়ে রয়েছে। ২০১৬ সালে কেজরিওয়ালের স্ত্রী চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নেন।
রাইট টু ইনফরমেশন আন্দোলনের জন্য ২০০৬ সালে এশিয়ার নোবেল খ্যাত ‘র্যামন ম্যাগসেসাই’ পুরস্কারে ভূষিত হন। মেধাবী, সৎ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি কেজরিওয়ালের হাত ধরে আধুনিক ও উন্নত ভারতের স্বপ্ন দেখছেন সাধারণ জনগণ। কেজরিওয়াল কি পারবেন দিল্লির পর কেন্দ্রের মসনদে বসতে? তিনি কি পারবেন ভারতের সকল দরিদ্র মানুষকে দিল্লির মতো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে? উত্তর জানতে অন্তত ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।