দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে পৃথিবীতে তিনটি প্রধান শাসনতান্ত্রিক মতবাদ ছিল- গণতন্ত্র, কমিউনিজম আর ফ্যাসিবাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হন জার্মানির ফ্যাসিস্ট নেতা অ্যাডলফ হিটলার, নিহত হন ইতালির ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী বেনিতো মুসোলিনি, শাসনতান্ত্রিক মতবাদ হিসেবে পতন ঘটে ফ্যাসিবাদের। ফলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী রাজনীতিতে শুরু হয় গণতন্ত্র আর কমিউনিজমের প্রভাব বিস্তারের লড়াই।
গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্বে আবির্ভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্ব দেয় কমিউনিস্টদের। পরবর্তী অর্ধশতাব্দীতে এই দুই অংশ একে অন্যের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে জড়িয়েছে, দুই দেশের স্পাইয়েরা মরণপণ লড়েছে একে অন্যকে বিপদে ফেলতে। মনস্তাত্ত্বিক এ যুদ্ধে এগিয়ে থাকতে দু’পক্ষ জড়ায় প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে, অর্ধশতাব্দীব্যাপী দুই অংশের মধ্যে চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা।
পাঁচ দশকের লড়াই সমাপ্ত হয় নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। রাশিয়াসহ অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশগুলো ধীরে ধীরে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে, গ্রহণ করে বাজার অর্থনীতিকে। কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সেভা গুনিস্কায়ের আধুনিক গণতন্ত্রের উপর ধারাবাহিক আলোচনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ঘটনা স্থান পেয়েছে একাদশতম ঢেউ হিসেবে, তার ‘ডেমোক্রেটিক ওয়েভস ইন হিস্ট্রিকাল পার্স্পেক্টিভ’ নিবন্ধে।
স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা
১৯১৭ সালে রাশিয়াতে দু’টি বিপ্লব হয়। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে শুরুতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয় রাশিয়া, পাল্টা বিপ্লব হয় অক্টোবরে। নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে লেনিনের সমর্থকেরা, রাশিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিজম। তখন থেকেই পাশ্চাত্যের সাথে আদর্শিক দ্বন্দ্ব শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়াকে মিত্রশক্তি সহযোগিতা করলেও, আদর্শিক দ্বন্দ্ব বজায় থাকে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতিতে। ফলে, সোভিয়েত ইউনিয়নের দিক থেকে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা ধরা হয় ১৯১৭ সালে, অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে।
আটলান্টিক রেভল্যুশনের পর থেকে পুরো ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে একের পর এক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গেছে ইউরোপ, রাজতন্ত্রকে হটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ফলে, রাশিয়াতে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই ইউরোপে এর একটি প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। স্নায়ুযুদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর পক্ষ থেকে কখন শুরু হলো, সে বিতর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য উত্তরটি হচ্ছে, ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের ওয়েস্ট-মিনিস্টার কলেজে দেওয়া বক্তব্যের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বিশ্ব জড়িয়ে পড়ে স্নায়ুযুদ্ধে।
স্নায়ুযুদ্ধের কারণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে, পরাশক্তি হিসেবে ছিল ইউরোপের কয়েকটি দেশ, প্রভাব বাড়ছিল আটলান্টিক পাড়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির মাধ্যমে একটি দ্বিমেরুর বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন আবির্ভূত হয় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে। অর্ধশতাব্দীব্যাপী এই দুই পরাশক্তির মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলে, যেটি পরিচিতি পায় স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে। দুই পরাশক্তির এই স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে কাজ করে অনেকগুলো প্রভাবক।
প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বন্দ্বের মূল কারণটা ছিল আদর্শিক। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে স্বাধীনতা অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্র, শাসনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করে গণতন্ত্রকে। এরপর নিরবিচ্ছিন্নভাবে গণতন্ত্র চর্চা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী হয়েছে গণতন্ত্রের ধারক হিসেবে। অন্যদিকে, ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নও চেষ্টা করে কমিউনিজমকে বিভিন্ন দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে। ফলে, আদর্শিকভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় গণতন্ত্র ও কমিউনিজম, শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ।
দ্বিতীয়ত, মানবসভ্যতার অন্যতম বিস্তৃত যুদ্ধ ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে জড়িয়ে পড়ে ত্রিশেরও অধিক দেশ। যুদ্ধে বিজয়ী হয় মিত্রশক্তি, যার নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধের পর বিজিত অংশগুলোর শাসনব্যবস্থা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন, দ্বন্দ্বের জন্য ভাগ করতে হয় অনেকগুলো বিজিত ভূমি। এ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ায়, আবির্ভূত হয় স্নায়ুযুদ্ধকে প্রভাবিত করার মতো কারণ হিসেবে।
তৃতীয়ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা অর্জন করে এশিয়াতে ইউরোপীয় উপনিবেশ শাসনে থাকা দেশগুলো, ধীরে ধীরে স্বাধীনতা অর্জন করে আফ্রিকা মহাদেশে থাকা উপনিবেশ দেশগুলোও। দেশগুলো পরিচিতি পায় তৃতীয় বিশ্ব হিসেবে। এই স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করাকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে জড়ায় দুই পরাশক্তি, দ্বন্দ্বে জড়ায় স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশগুলোর শাসনব্যবস্থা নিয়েও।
চতুর্থত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গবেষণায় প্রচুর বিনিয়োগ করা শুরু করে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো, আবিষ্কৃত হতে থাকে নতুন নতুন প্রযুক্তি। উদ্ভাবিত হতে থাকে নতুন নতুন অস্ত্র। আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তিগুলো পরীক্ষার নেশায় মেতে ওঠে দু’ পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, স্নায়ুযুদ্ধকে প্রভাবিত করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিজের দেশকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের জাতীয়তাবাদী নেশাও।
স্নায়ুযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়
অর্ধ-শতাব্দীব্যাপী চলা স্নায়ুযুদ্ধে দুই পরাশক্তি ক্রমাগত একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একে অন্যের বিরুদ্ধে জড়িয়েছে যুদ্ধে। স্নায়ুযুদ্ধকালীন এই রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে আলোচনার সুবিধার্থে বেশ কিছু পর্বে ভাগ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
প্রথম পর্যায়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আস্থার সংকট তৈরি হয় দুই পরাশক্তির মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করে পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, হাঙ্গেরির মতো পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে ট্রুম্যান ডকট্রিন, অর্থনৈতিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তুরস্ক, গ্রিসের মতো দেশগুলোতে।
দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলোকে। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো তৈরি করে, কোরিয়া যুদ্ধে পাঠায় আমেরিকান সেনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক সহযোগিতার চুক্তি করে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। বিপরীতে এ সময়টাতে শক্তিসাম্য আনতে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, সামরিক সহায়তা পাঠায় উত্তর কোরিয়াতে। দু’পক্ষই এই সময়টাতে জড়িয়ে পড়ে প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে।
পরবর্তী এক দশকে স্নায়ুযুদ্ধে দুই পক্ষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই তুঙ্গে পৌঁছায়, বিভিন্ন ফ্রন্টে একে অন্যের বিরুদ্ধে আবির্ভূত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। মার্শাল প্ল্যানের অধীনে ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়নকে রুখতে বিশ্বব্যাপী তিন হাজারের অধিক সামরিক বেইস স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। বিপরীতে, সমমনা দেশগুলোকে নিয়ে ওয়ারশ জোট গঠন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিভাজিত জার্মানিতে বার্লিন দেয়াল নির্মাণ করে। স্ট্যালিনের পর এ সময়ে সোভিয়েতের ক্ষমতায় আসেন ক্রুশ্চেভ। দু’ পক্ষ মুখোমুখি আবির্ভূত হয় সুয়েজ সংকটে, ১৯৬২ সালে জড়ায় কিউবা মিসাইল সংকটে। ষাটের দশকেই দু’ পক্ষ জড়ায় আরেকটি যুদ্ধে, ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজিত হওয়া স্নায়ুযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সত্তরের দশকেও আরেকটি পরাজয়ের মুখোমুখি হয় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তৎকালীন দক্ষিণ এশিয়াতে বিশ্বস্ত মিত্র ছিল পাকিস্তান। রাশিয়া-ভারতের সহযোগিতায় পাকিস্তানের পূর্ব অংশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপের প্রমাণ খুব কমই পাওয়া গেছে। তবুও, এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্নায়ুযুদ্ধকালে ইতিবাচক ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নেতিবাচক হয়ে আসে ভিয়েতনাম পরাজয়, যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হয় আফগানিস্তানেও। চীনের সাথে এ সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের দূরত্ব বাড়ে, সেটি কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়ন করে চীনের সাথে।
আশির দশকে পরিণতির দিকে যেতে থাকে স্নায়ুযুদ্ধ। কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলোতে ক্রমেই স্বৈরচারী হয়ে উঠছিল শাসকেরা, কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছিল বিরুদ্ধমতকে। অন্যদিকে, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য পাচ্ছিল ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলো, উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেখা পায় তৃতীয় বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলোও। দু’ অংশের পার্থক্যগুলো প্রশ্নবিদ্ধ করে কমিউনিজমের গ্রহণযোগ্যতাকে, নব্বই দশকের শুরুতেই পতন হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের, তার সাথে সমাপ্ত হয় স্নায়ুযুদ্ধ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে অধ্যাপক সেভা গুনিস্কায় চিহ্নিত করেছেন আধুনিক গণতন্ত্রের একাদশতম ঢেউ হিসেবে। আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের উপর অধ্যাপক সেভা গুনিস্কায়ের আলোচনা শুরু হয় আটলান্টিক রেভল্যুশনের মাধ্যমে। ধারাবাহিক আলোচনায় উঠে এসেছে ইউরোপের শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা অর্জন, এশিয়াতে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের আন্দোলনের ঘটনাগুলো। আলোচনায় এসেছে, দুই বিশ্বযুদ্ধ কীভাবে বদলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কীভাবে টিকে গেছে, শাসনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতন্ত্র। একাদশতম ঢেউ হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনও রেখেছে একইরকম ভূমিকা।
প্রথমত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে শাসনব্যবস্থা হিসেবে পতন ঘটে কমিউনিজমের, সমাপ্ত হয় অর্ধশতাব্দী জুড়ে চলা গণতান্ত্রিক বিশ্ব আর কমিউনিজমের আদর্শিক লড়াই। রাশিয়াসহ অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়া শুরু হয়। উদার গণতন্ত্রের চর্চা এসব দেশে মোটাদাগে এখনো শুরু না হলেও, এই আদর্শিক বিজয় গণতান্ত্রিক বিশ্বকে এগিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ত, মানবসভ্যতার শুরু থেকেই মানবজাতি শাসনব্যবস্থা নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে, জনমতের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন এসেছে শাসনব্যবস্থাতে। ধরে নেওয়া হয়, স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির সাথে সাথে মানুষের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্ব সমাপ্তি হয় এবং সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় গণতন্ত্র। এ ধারণাকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তিকে আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামো ব্যাখ্যা করেছেন ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ হিসেবে।
তৃতীয়ত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২টি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ত্রিশে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। স্নায়ুযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এ সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান পৃথিবীতে ১৩০ এর অধিক দেশ গণতান্ত্রিক। অর্থাৎ, স্নায়ুযুদ্ধ সমাপ্তির পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে বিশ্বব্যাপী। আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ নিশ্চয়তা পেয়েছে রাজনৈতিক অধিকারের, স্বীকৃত হয়েছে নাগরিক অধিকার, উন্মুক্ত রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশগুলোতে বেড়েছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ।
চতুর্থত, প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বিভিন্ন সময়ে উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্ব দানকারী যুক্তরাষ্ট্র আর কমিউনিস্ট বিশ্বের নেতৃত্ব দানকারী সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। চলেছে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, বারবার তৈরি হয়েছে যুদ্ধের সম্ভাবনা। পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা তৈরি করেছিল পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনাও। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে কমে আসে যুদ্ধের সম্ভাবনা, কমে যায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাও। ফলে, সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বেঁচে গেছে মানবসভ্যতা।
পঞ্চমত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতি দ্বিমেরু ব্যবস্থার তৈরি হয়, যে ব্যবস্থা টিকে ছিল প্রায় অর্ধশতাব্দী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে স্বাধীনতা পায় এর অধীনে থাকা উপনিবেশগুলো, রাশিয়ার প্রভাব কমে যায় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর উপরও। সামরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে রাশিয়া, বাজার কাঠামো ভেঙে যাওয়ায় দুর্বলতা আসে অর্থনৈতিকভাবেও। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরাশক্তি হিসেবে অনেকগুলো দেশ এরমধ্যে উঠে আসার চেষ্টা করেছে, তবে এখনো অক্ষুণ্ণ আছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব।
একাদশ পর্বের পরেও আধুনিক গণতন্ত্র আরো দু’টি ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে গেছে। সে পর্বগুলোতেও সংস্কারপন্থীরা চেয়েছেন শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন আনতে, রাজনৈতিক অধিকার চর্চা করতে, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা পেতে। সে আলোচনা থাকবে পরবর্তী পর্বগুলোতে।