Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুশিমা থেকে আফগানিস্তান: গ্রেট গেম, স্নায়ুযুদ্ধ এবং রুশ–পশ্চিমা প্রক্সি যুদ্ধ

১৯০৫ সালে সুশিমার নৌযুদ্ধে জাপানি নৌবাহিনীর নিকট রুশ নৌবাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর ব্রিটেন জাপানি সম্মিলিত নৌবহরের কমান্ডার–ইন–চিফ মার্শাল–অ্যাডমিরাল তোগো হেইহাচিরোকে কিংবদন্তী ব্রিটিশ নৌসেনাপতি ভাইস–অ্যাডমিরাল হোরেশিও নেলসনের একগুচ্ছ চুল উপহার হিসেবে প্রদান করে। এই ঘটনার প্রায় আট দশক পরে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার ও বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুলকে বার্লিন প্রাচীরের বিশাল একটি টুকরো উপহার হিসেবে প্রদান করে।

আপাতদৃষ্টিতে ঘটনা দুটি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন সময়ে এবং ভিন্ন কর্মকের দ্বারা সংঘটিত এই ঘটনা দুটির মধ্যে আদৌ কোনো সম্পর্ক থাকা সম্ভব কি? একজন জাপানি নৌসেনাপতিকে একগুচ্ছ চুল উপহার দেয়া বা একজন পাকিস্তানি স্পাইমাস্টারকে একটি কংক্রিটের তৈরি দেয়ালের টুকরো উপহার দেয়ারই বা তাৎপর্য কী? ইতিহাসের ভিন্ন দুই সময়ে আগত একজন জাপানি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী নৌ কর্মকর্তা এবং একজন পাকিস্তান বৃহত্তর ইসলামি জাতীয়তাবাদী ও রক্ষণশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তার মধ্যে ঠিক কেমন সংযোগ থাকা সম্ভব? এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দুটি ছোট্ট শব্দগুচ্ছের মধ্যে নিহিত রয়েছে, আর সেটি হলো প্রক্সি যুদ্ধ (proxy war) এবং বৈশ্বিক আধিপত্য (global hegemony)।

এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে দুটি বিষয় স্পষ্ট করে নেয়া প্রয়োজন। প্রথমত, খুবই সাধারণ ভাষায় প্রক্সি যুদ্ধ বলতে এমন কোনো যুদ্ধকে বোঝানো হয়, যখন একটি রাষ্ট্র তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রকে শায়েস্তা করার জন্য নিজে ঐ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে তৃতীয় কোনো রাষ্ট্র/অরাষ্ট্রীয় কর্মককে দিয়ে ঐ প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করায়। এর চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে ভারতে বিদ্যমান কাশ্মিরি বিচ্ছিন্নতাবাদী/স্বাধীনতাকামী আন্দোলন এবং পাকিস্তানে বিদ্যমান বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী/স্বাধীনতাকামী আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের চরম শত্রু, এবং বেশ কয়েকবার একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।

কিন্তু বর্তমানে ভার‍ত ও পাকিস্তান উভয়ের কাছেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, এবং এজন্য বর্তমানে রাষ্ট্র দুটির কেউই একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক নয়। সুতরাং পাকিস্তান ভারতের জম্মু ও কাশ্মির ইউনিয়ন অঞ্চলে সক্রিয় কাশ্মিরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করছে এবং এর ফলে এখন পর্যন্ত হাজার হাজার ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছে। অনুরূপভাবে, ভারত পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশে সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করছে এবং এর ফলে এখন পর্যন্ত হাজার হাজার পাকিস্তানি নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছে। এক্ষেত্রে কাশ্মিরি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাকিস্তানের ‘প্রক্সি’ হিসেবে এবং বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের ‘প্রক্সি’ হিসেবে কাজ করছে।

১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ রাষ্ট্রনায়ক উইনস্টন চার্চিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির ফুল্টনে প্রদত্ত একটি ভাষণে ইংরেজিভাষী অ্যাংলো–স্যাক্সন রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে একটি সোভিয়েতবিরোধী জোট গঠনের আহ্বান জানান; Source: englishradio.cz

দ্বিতীয়ত, আপাতদৃষ্টিতে স্বৈরতান্ত্রিক, রুশ জাতীয়তাবাদী ও অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মীয় রুশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে একদলীয়, আন্তর্জাতিকতাবাদী ও কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো সাদৃশ্য নেই, এবং কার্যত রুশ সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে সেই ধ্বংসস্তূপের ওপরে বলশেভিকরা সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের সিংহভাগ ভূমির ওপরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এবং সোভিয়েত সরকারের আপত্তি ও রুশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাদের মৌলিক পার্থক্য সত্ত্বেও বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে বসবাসকারী অ–রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদী/স্বাধীনতাকামীরা (ও রুশ জাতীয়তাবাদীরা) সোভিয়েত ইউনিয়নকে রুশ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবেই বিবেচনা করত। সুতরাং আইনত না হলেও কার্যত রুশ সাম্রাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।

অনুরূপভাবে, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুটি ভিন্ন রাষ্ট্র। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ, ব্রিটেন থেকে আগত অভিবাসীদের হাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে, এবং ব্রিটেনের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও প্রধানত ইংরেজিভাষী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ব্রিটেন ছিল বিশ্বের পরাশক্তি (superpower), এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি হিসেবে ব্রিটেনকে প্রতিস্থাপিত করে। বর্তমানেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মধ্যে একটি ‘বিশেষ সম্পর্ক’ (special relationship) বিদ্যমান। সুতরাং ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তর অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্বের (Anglo-Saxon World) অংশ এবং তাদের মধ্যে স্থায়ী সংযোগ রয়েছে।

আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসকে যদি একটি ‘পাখির চোখের দৃষ্টি’তে (bird’s eye view) দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে, নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহের (Napoleonic Wars) পর থেকে অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্ব বৈশ্বিক আধিপত্য অর্জনের জন্য রুশ বিশ্বের (Russian World) সঙ্গে তীব্র এক ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নকে পরাজিত করার জন্য ব্রিটেন ও রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর সাম্রাজ্য দুইটি প্রায় এক শতাব্দীব্যাপী স্থায়ী ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। উত্তর, মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরোপ, পশ্চিম, মধ্য, পূর্ব উত্তর ও দক্ষিণ এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকা জুড়ে তাদের এই প্রতিযোগিতা বিস্তৃতি লাভ করেছিল। ব্রিটেনে এই প্রতিযোগিতা পরিচিত ছিল ‘গ্রেট গেম’ (Great Game) নামে, আর রাশিয়ায় এটি পরিচিতি হয়েছিল ‘টুর্নামেন্ট অফ শ্যাডোজ’ (Tournament of Shadows) নামে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রুশ বিশ্ব বলতে কেবল বর্তমান রুশ জাতিকে বোঝানো হয় না। রুশ বিশ্ব বলতে রুশ (‘বৃহৎ রুশ’), ইউক্রেনীয় (‘ক্ষুদ্র রুশ’) ও বেলারুশীয় (‘শ্বেত রুশ’) জাতিত্রয় এবং তৎসংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোকে বোঝানো হয়ে থাকে। জার চতুর্থ ইভানের সময় থেকেই রাশিয়া ছিল একটি অতি বৃহৎ রাষ্ট্র, কিন্তু এই রাষ্ট্রটির একটি মারাত্মক ঘাটতি ছিল। সেটি হলো– বৃহৎ এই রাষ্ট্রটির খোলা সমুদ্রে সরাসরি প্রবেশাধিকার (direct access to the open seas) ছিল না এবং উল্লেখযোগ্য কোনো উষ্ণ জলীয় বন্দর (warm water port) ছিল না। এর ফলে রুশ বিশ্বের জন্য সামুদ্রিক বাণিজ্য পরিচালনা ও বৃহৎ নৌবাহিনী গঠন ছিল খুবই কঠিন কাজ, এবং সাম্রাজ্যবাদের সেই যুগে নৌশক্তি ছাড়া প্রথম শ্রেণীর শক্তিতে পরিণত হওয়া ছিল অসম্ভব।

মানচিত্রে ঊনবিংশ শতাব্দীর রুশ তুর্কিস্তান। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রুশরা মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে আফগানিস্তানের সীমান্তে উপস্থিত হয়; Source: Wikimedia Commons

এজন্য রাশিয়া উষ্ণ জলীয় বন্দরের (অর্থাৎ যে বন্দর বছরের ১২ মাসই ব্যবহারোপযোগী থাকে এবং কখনো বরফে জমে যায় না) খোঁজে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করে। ফলে রাশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত ওসমানীয় সাম্রাজ্য, ইরান ও আফগানিস্তান রুশ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। কিন্তু ব্রিটেন এই অঞ্চলগুলোতে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে আগ্রহী ছিল, রাশিয়ার একটি বৃহৎ নৌশক্তি ও শিল্পায়িত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না এবং তাদের আশঙ্কা ছিল, এই অঞ্চলগুলো দখলের পর রাশিয়া ব্রিটিশ ‘মুকুটের রত্ন’ (jewel in the crown) ভারতবর্ষের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। এজন্য ব্রিটেন প্রাচ্য ও দক্ষিণ গোলার্ধে রুশ সম্প্রসারণ প্রতিহত করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে।

রুশ সম্প্রসারণ প্রতিহত করার জন্য ব্রিটেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রুশ সম্প্রসারণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে এবং প্রাচ্য ও দক্ষিণ গোলার্ধের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে রুশবিরোধী ‘প্রতিবন্ধক’ (bulwark) হিসেবে গড়ে তোলে। ব্রিটিশরা যেভাবে মুঘল, মারাঠা, শিখ ও বিভিন্ন আফ্রিকান রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দিয়েছিল, সেভাবে রাশিয়াকে সরাসরি আক্রমণ করে রুশ রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেয়া ব্রিটেনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহের পর ব্রিটেন কেবল একবারই রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, এবং সেটি হচ্ছে ক্রিমিয়ান যুদ্ধ (১৮৫৩–১৮৫৬)। এই যুদ্ধে ব্রিটেন ফ্রান্স, ওসমানীয় সাম্রাজ্য ও সার্ডিনিয়ার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে এবং অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ও সুইডেনের সঙ্গে পরোক্ষ আঁতাত করে একাকী রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে, কিন্তু এরপরও রাশিয়াকে ধ্বংস করা বা গুরুতরভাবে দুর্বল করে ফেলা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি।

এজন্য ব্রিটেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে, এবং ইউরোপ, প্রাচ্য ও দক্ষিণ গোলার্ধের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘প্রক্সি’ হিসেবে ব্যবহার করে। ব্রিটিশরা রাশিয়াকে আক্রমণ করার জন্য ইরানকে উৎসাহিত করে, রুশ সম্প্রসারণ প্রতিরোধের জন্য ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ‘রক্ষাকর্তা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়, রুশরা যাতে মধ্য এশিয়ায় অগ্রসর হতে না পারে, সেজন্য বুখারা ও খিভার ওপর আক্রমণ চালাতে আফগানিস্তানকে প্ররোচনা দান করে, এবং রুশ রাষ্ট্রদূত গ্রহণ করায় আফগানিস্তানের ওপর আক্রমণ চালায়। ব্রিটেন রাশিয়ার অভ্যন্তরে পোলিশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযোগিতা করে, বলকান অঞ্চলে রুশ প্রভাব হ্রাসের উদ্দেশ্যে বুলগেরিয়াকে দ্বিখণ্ডিত করে এবং রুশ সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে রুশ সরকারবিরোধীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।

অনুরূপভাবে, রাশিয়াও সীমিত মাত্রায় ব্রিটেনের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ পরিচালনা করে। উদাহরণস্বরূপ, তারা ব্রিটিশ–সমর্থিত আফগানিস্তানের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য ইরানকে প্ররোচিত করে এবং বোয়ের যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বোয়ের প্রজাতন্ত্রগুলোকে সহায়তা প্রদান করে। কিন্তু রুশদের ব্রিটিশবিরোধী প্রক্সি যুদ্ধের তীব্রতা ও ব্যাপকতার মাত্রা ছিল ব্রিটিশদের রুশবিরোধী প্রক্সি যুদ্ধের চেয়ে বহুলাংশে কম।

একটি চিত্রকর্মে ১৮৬৩–১৮৬৪ সালের পোলিশ বিদ্রোহের সময় একদল পোলিশ বিদ্রোহী। এসময় ব্রিটেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পোলিশ বিদ্রোহীদের সহায়তা করেছিল; Source: Wikimedia Commons

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ব্রিটেন পূর্ব এশিয়ায় রুশ সম্প্রসারণ প্রতিহত করার জন্য পূর্ব এশীয় রাষ্ট্র জাপানকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের (১৮৫৬–৬০) পর থেকে রাশিয়া দূরপ্রাচ্যে ব্যাপক হারে প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করে। তারা চীনের কাছ থেকে দূরপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়, কোরিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে এবং উত্তর–পূর্ব চীনকে কার্যত একটি রুশ উপনিবেশে পরিণত করে। সর্বোপরি, উত্তর–পূর্ব চীন বা অভ্যন্তরীণ মাঞ্চুরিয়ায় রুশরা ‘পোর্ট আর্থার’ নৌঘাঁটি ও সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলে, এবং এর মধ্য দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে একটি উষ্ণজলীয় বন্দর লাভ করে।

পূর্ব এশিয়ায় রুশ সম্প্রসারণকে ব্রিটেন নিজের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে, এবং জাপান নিজেও এতদঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে আগ্রহী ছিল। এজন্য জাপানের আধুনিকায়ন ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ব্রিটেন ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। ১৯০২ সালে ব্রিটেন ও জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে একটি মৈত্রীচুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে বিরোধ ক্রমশ তীব্রতর রূপ ধারণ করতে থাকে, এবং অবশেষে ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাপান যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতিরেকেই পোর্ট আর্থারে রুশ নৌবহরের ওপর আক্রমণ চালায়। এর মধ্য দিয়ে রুশ–জাপানি যুদ্ধ (১৯০৪–০৫) আরম্ভ হয়।

এই যুদ্ধ ছিল রাশিয়ার জন্য চরম বিপর্যয়কর। আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়া ছিল জনবল, অর্থবল ও অস্ত্রবলের দিক থেকে জাপানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, কিন্তু তাদের বেশকিছু গুরুতর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ছিল। রুশ হৃদভূমি থেকে সুদূর উত্তর–পূর্ব চীনে সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র সরবরাহ ছিল রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত কঠিন, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ, জাপানি সামরিক কর্মকর্তাদের রণনৈপুণ্য ও সৃজনশীলতা ছিল রুশ সামরিক কর্মকর্তাদের তুলনায় বেশি, জাপানি সৈন্যরা ছিল তাদের রুশ প্রতিপক্ষের তুলনায় বেশি মনোবলসম্পন্ন, এবং জাপানি সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধজাহাজগুলো ছিল রুশদের তুলনায় গুণগতভাবে উন্নততর। এর ফলে জলে ও স্থলে প্রতিটি খণ্ডযুদ্ধে রুশরা জাপানিদের কাছে পরাজিত হয়।

জাপানিরা পোর্ট আর্থার ও রুশ–নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয় এবং ১৯০৫ সালের ২৭–২৮ মে সুশিমার নৌযুদ্ধে অ্যাডমিরাল তোগো হেইহাচিরোর নেতৃত্বাধীন জাপানি সম্মিলিত নৌবহর রুশ বাল্টিক নৌবহরকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। এরপর জাপানিরা রাশিয়ার শাখালিন দ্বীপ দখল করে নিলে রাশিয়া যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় এবং ১৯০৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পোর্টসমাউথের সন্ধির মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই চুক্তি অনুযায়ী, রাশিয়া পোর্ট আর্থারসহ দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া জাপানের নিকট হস্তান্তর করে, কোরিয়ায় জাপানি আধিপত্য স্বীকার করে নেয় এবং জাপানকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের পরিবর্তে দক্ষিণ শাখালিন জাপানের নিকট হস্তান্তর করে।

সুশিমার নৌযুদ্ধে রুশ বাল্টিক নৌবহরের ফ্ল্যাগশিপ ‘ক্নিয়াজ সুভোরভ’ ডুবে যায় এবং ২০ জন আহত কর্মকর্তা ছাড়া জাহাজের সকল নাবিকের সলিলসমাধি ঘটে; Source: Wikimedia Commons

রুশ–জাপানি যুদ্ধের ফলে রাশিয়া বিস্তীর্ণ অঞ্চল হারায়, পূর্ব এশিয়ায় তাদের একমাত্র উষ্ণ জলীয় বন্দরটি হাতছাড়া হয়ে যায়, হাজার হাজার সৈন্য হতাহত হয়, বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপচয় ঘটে এবং বাল্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরদ্বয় ধ্বংস হয়ে যায়। একটি তুলামূলকভাবে ক্ষুদ্র, কম জনবহুল ও কম সম্পদশালী এশীয় রাষ্ট্রের নিকট বৃহৎ রাশিয়ার পরাজয় বিশ্বব্যাপী তাদের মর্যাদা হ্রাস করে এবং রুশ জনসাধারণকে তীব্রভাবে অসন্তুষ্ট করে তোলে। এই পরাজয়কে রুশ জনগণ রোমানভ রাজবংশের অযোগ্যতা ও অকর্মণ্যতার ফল হিসেবে বিবেচনা করে, এবং তাদের এই অসন্তোষ ছিল ১৯০৫–১৯০৭ সালের রুশ বিপ্লবের একটি অন্যতম কারণ। তদুপরি, রাশিয়ার এই পরাজয় রাশিয়ার অভ্যন্তরে সক্রিয় অ–রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎসাহিত করে এবং পোলিশ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জাপানি সহায়তায় রুশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন মতাদর্শের রুশ বিপ্লবীরা রোমানভদের এই পরাজয়ে উল্লসিত হয় এবং এককালীন ‘অপরাজেয়’ রোমানভদের পরাজিত করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতে থাকে। অনুরূপভাবে, রাশিয়ার এই শোচনীয় পরাজয় ইউরোপের জার্মানিক রাষ্ট্রগুলোকে (জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি) অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং তারা রাশিয়াকে অবজ্ঞাপূর্বক দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপে রুশবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। সর্বোপরি, জাপানের নিকট পরাজয়ের পর রাশিয়া ১৯০৭ সালে ব্রিটেনের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছে, ইরান ও মধ্য এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বলয় সুনির্দিষ্ট করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে গ্রেট গেম/টুর্নামেন্ট অফ শ্যাডোজের আপাতদৃষ্টিতে অবসান ঘটায়। ইতিহাসবিদদের মতে, রুশ–জাপানি যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় ছিল ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব এবং রোমানভ রাজবংশের পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরোক্ষ কারণ।

স্বভাবতই রুশ–জাপানি যুদ্ধ এবং বিশেষ করে সুশিমার নৌযুদ্ধ ছিল ব্রিটেনের রুশবিরোধী প্রক্সি যুদ্ধের একটি বিরাট সাফল্য। জাপানের সশস্ত্রবাহিনী, বিশেষত নৌবাহিনী, গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্রিটেনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। রুশ–জাপানি যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জাপানিদেরকে বিভিন্নভাবে সহায়তা প্রদান করে, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য জাপানকে মোটা অঙ্কের ঋণ প্রদান করে, এবং রুশ বাল্টিক নৌবহরের প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছানোর পথে যথাসম্ভব প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এজন্য রুশ–জাপানি যুদ্ধে জাপানের পাশাপাশি ব্রিটেনও বিরাট একটি বিজয় অর্জন করে।

রুশ–জাপানি যুদ্ধের পর ব্রিটেন জাপানি সম্মিলিত নৌবহরের কমান্ডার–ইন–চিফ মার্শাল–অ্যাডমিরাল তোগো হেইহাচিরোকে কিংবদন্তী ব্রিটিশ ভাইস–অ্যাডমিরাল হোরেশিও নেলসনের একগুচ্ছ চুল উপহার হিসেবে প্রদান করে। অ্যাডমিরাল নেলসনকে ব্রিটিশ ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নৌসেনাপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮০৫ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফ্রান্স ও স্পেনের যৌথ নৌবহর যখন ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ড আক্রমণের প্রক্রিয়ায় ছিল, সেসময় নেলসনের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ নৌবহর ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে সম্মিলিত ফরাসি ও স্পেনীয় নৌবহরকে পরাজিত করে। এর ফলে নেপোলিয়নের ব্রিটেন জয়ের পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে নেলসন ব্রিটেনকে রক্ষা করেন, কিন্তু যুদ্ধ চলাকালে তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিটিশ ইতিহাসে তিনি একজন কিংবদন্তী হয়ে আছেন।

‘প্রাচ্যের নেলসন’ খ্যাত রুশ–জাপানি যুদ্ধের বিজয়ী নৌসেনাপতি জাপানি অ্যাডমিরাল তোগো হেইহাচিরো ব্রিটেনে প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন; Source: National Diet Library/HistoryNet

সুশিমার নৌযুদ্ধের পূর্বে রুশ নৌবাহিনী ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নৌবাহিনী, কিন্তু এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তাদের নৌশক্তি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং এর মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার ব্রিটেনকে প্রতিস্থাপন করার সম্ভাবনাও বিলীন হয়ে যায়। ফলে পশ্চিমা বিশ্বে এই যুদ্ধটি ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধের সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং অ্যাডমিরাল তোগো ‘প্রাচ্যের নেলসন’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। তাকে অ্যাডমিরাল নেলসনের চুলের গুচ্ছ উপহার হিসেবে প্রদান ছিল একটি প্রতীকী ঘটনা, যার মধ্য দিয়ে রুশ–জাপানি যুদ্ধে ব্রিটিশ ‘প্রক্সি’ জাপানের নিকট রাশিয়ার পরাজয় যে প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ রুশবিরোধী প্রক্সি যুদ্ধেরই বিজয়, এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

রুশ বিপ্লবের পর বৈশ্বিক আধিপত্যের জন্য অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্বের সঙ্গে রুশ বিশ্বের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ভিন্ন রূপ ধারণ করে। রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় রোমানভ রাজবংশ ও পশ্চিমাপন্থী সমাজতন্ত্রী সরকারের পতন ঘটে, এবং পশ্চিমাবিরোধী বলশেভিকরা রুশ সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপরে সোভিয়েত রাষ্ট্র গড়ে তোলে। ক্ষয়িষ্ণু ও মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া রোমানভ রাজবংশের স্থলে নতুন উদ্যমে ভরপুর বলশেভিকদের উত্থানের ফলে অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্বের সঙ্গে রুশ বিশ্বের দ্বন্দ্ব একটি নতুন মাত্রায় পৌঁছে যায়। রুশ গৃহযুদ্ধ (১৯১৭–১৯২৩) চলাকালে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলো বলশেভিকদের ক্ষমতাচ্যুত করা ও রাশিয়াকে স্থায়ীভাবে দুর্বল করে রাখার উদ্দেশ্যে রাশিয়া আক্রমণ করে এবং বলশেভিকবিরোধী ‘শ্বেত ফৌজ’ ও বিভিন্ন অ–রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিজস্ব প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করে। রুশ গৃহযুদ্ধের ফলে নবগঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমি হারায়, কিন্তু শ্বেত ফৌজ পরাজিত হয় ও অ্যাংলো–স্যাক্সন জোটের উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

এরপর আরম্ভ হয় অ্যাংলো–স্যাক্সন (বা পশ্চিমা) বিশ্বের সঙ্গে রুশ (বা সোভিয়েত) বিশ্বের তীব্র প্রক্সি যুদ্ধ। ব্রিটিশরা মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েতবিরোধী ‘বাসমাখি’ দলগুলোকে সহায়তা করে, সোভিয়েত/কমিউনিস্ট সম্প্রসারণ রোধের জন্য বিভিন্ন এশীয় ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করে, এবং ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত/কমিউনিস্টদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান ও এশিয়ায় জাপানি সম্প্রসারণবাদকে মৌন সমর্থন জানায়। নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিবাদী ইতালি ও উগ্র জাতীয়তাবাদী জাপানকে তারা সোভিয়েতবিরোধী প্রক্সি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিপুল বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে তাদের সামরিকায়নে সহায়তা করে।

অনুরূপভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নও অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্ব ও তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রক্সি যুদ্ধ চালাতে শুরু করে। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য রাষ্ট্রের কমিউনিস্ট দলগুলোকে তারা নিজেদের প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। তারা ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আফগানিস্তান ও তুরস্ককে সহায়তা করে, ব্রিটেনের অভ্যন্তরে আইরিশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করে, ব্রিটিশ–শাসিত ভারতবর্ষের বিপ্লবীদের সমর্থন প্রদান করে এবং সকল ধরনের পশ্চিমাবিরোধী বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়।

১৯১৯ সালের তৃতীয় ইঙ্গ–আফগান যুদ্ধের পর আফগান শান্তি প্রতিনিধিদল ব্রিটিশ–শাসিত ভারতবর্ষে প্রবেশ করছে। এই যুদ্ধে সোভিয়েতরা আফগানদের সহায়তা করেছিল; Source: Afghanistan Analysts Network

এমতাবস্থায় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলে অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্বের হিসেবে গন্ডগোল দেখা দেয়, কারণ যাদেরকে তারা সোভিয়েতবিরোধী প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, সেই জার্মানি, ইতালি ও জাপান প্রথমে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ আরম্ভ করে। পরবর্তীতে জার্মানি ও ইতালি সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপরেও আক্রমণ চালায়, এবং এর ফলে অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্ব ও রুশ/সোভিয়েত বিশ্ব একটি ক্ষণস্থায়ী মৈত্রীতে আবদ্ধ হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে এই মৈত্রীতে ফাটল ধরতে শুরু করে, এবং বিশ্বযুদ্ধ শেষে অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্ব ও রুশ/সোভিয়েত বিশ্বের মধ্যে খোলাখুলিভাবেই স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসে। অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্বের কর্তৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হস্তান্তরিত হয়, এবং ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অনুসারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিশ্বযুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি পূর্ণ পরাশক্তি হিসেবে ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি অসম্পূর্ণ পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়, এবং বিশ্বব্যাপী নিজ নিজ রাজনৈতিক মতবাদ (যথাক্রমে উদার গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ/সমাজতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য তারা একে অপরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। দুই পরাশক্তির উভয়েই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হওয়ায় উভয়ের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ ছিল প্রায় অবাস্তব, ফলে স্নায়ুযুদ্ধ হয়ে ওঠে প্রক্সি যুদ্ধের স্বর্ণযুগ। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মার্কিন ও সোভিয়েতরা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাষ্ট্রগুলোতে বিদ্যমান প্রায় প্রতিটি সরকারবিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে সহায়তা করতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিনিরা সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সরকারবিরোধী রাজনীতিবিদ এবং ইউক্রেনীয়, লাতভীয়, লিথুয়ানীয়, এস্তোনীয় ও অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করে, পোলিশ, হাঙ্গেরীয় ও চেকোস্লোভাক কমিউনিজম–বিরোধী দলগুলোকে সহায়তা করে, এবং সোভিয়েত সম্প্রসারণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রাষ্ট্রকে (যেমন: তুরস্ক, ইরান, পশ্চিম জার্মানি, জাপান, চীন প্রভৃতি) প্রক্সি হিসেবে গড়ে তোলে। মার্কিন প্রক্সি ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধে সোভিয়েত প্রক্সি মিসর ও সিরিয়াকে পরাজিত করে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮৩ সালে সোভিয়েত প্রক্সি গ্রেনাডার ওপর আক্রমণ চালায়।

অনুরূপভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও মার্কিনিদের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে বিভিন্ন সমমনা দলকে সহায়তা প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, সোভিয়েতরা গোপনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও শান্তি আন্দোলনে অর্থায়ন করে, মার্কিন প্রক্সি পর্তুগালের বিরুদ্ধে অ্যাঙ্গোলান, মোজাম্বিকান ও গিনিবিসাউয়ের স্বাধীনতা আন্দোলকে সমর্থন করে এবং ল্যাটিন আমেরিকাব্যাপী কমিউনিস্ট গেরিলাদের সহায়তা প্রদান করে। সোভিয়েত প্রক্সি কিউবা ও অ্যাঙ্গোলা ১৯৮০–এর দশকে মার্কিন প্রক্সি দক্ষিণ আফ্রিকাকে পরাজিত করে, এবং সোভিয়েত সহায়তায় সোভিয়েত প্রক্সি উত্তর ভিয়েতনাম খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই পরাজিত করে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় একদল ভিয়েত কং গেরিলা নৌকাযোগে নদী অতিক্রম করছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিয়েত কংকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করত; Source: Wikimedia Commons

স্নায়ুযুদ্ধ একটি আদর্শিক দ্বন্দ্ব ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে এটি ছিল একটি তীব্র ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। সোভিয়েত ইউনিয়নেরও প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের মতো কোনো উষ্ণ জলীয় বন্দর ছিল না, এবং ১৯৭৯ সালে আফগান গৃহযুদ্ধে সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপকে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা দেখেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক একটি উষ্ণ জলীয় বন্দর লাভের প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে। তাদের এই ধারণা নিতান্ত অমূলক ছিল না, কারণ আফগানিস্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের বালুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশদ্বয়ের ওপর কোনোক্রমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আরব সাগরের উষ্ণ জলীয় বন্দরগুলো পেয়ে যেত। অনুরূপভাবে, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতরা ইরানের দিকে অগ্রসর হলে পারস্য উপসাগরের উষ্ণ জলীয় বন্দরগুলো তাদের হস্তগত হতো। অবশ্য আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণের পশ্চাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের আরো বিভিন্ন কারণ ছিল, কিন্তু এই কারণটি ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ।

বলাই বাহুল্য, ব্রিটেন যেভাবে রাশিয়া কর্তৃক উষ্ণ জলীয় বন্দর লাভের সম্ভাবনাকে ভীতির দৃষ্টিতে দেখত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক উষ্ণ জলীয় বন্দর লাভের (এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে বিপুল তেলভাণ্ডারের ওপর সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার) সম্ভাবনা একইরকম ভীতির দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সোভিয়েত সম্প্রসারণ প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং আফগানিস্তানে সক্রিয় বিভিন্ন সোভিয়েতবিরোধী মিলিট্যান্ট/বিদ্রোহী গ্রুপকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মিত্র রাষ্ট্রও (যেমন: ব্রিটেন, ফ্রান্স, সৌদি আরব, মিসর, ইসরায়েল, তুরস্ক, চীন প্রভৃতি) আফগান মিলিট্যান্টদের সহায়তা করে। আফগানিস্তান স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র, চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত খুবই ক্ষুদ্র এবং এসময় ইরানি সরকার ছিল তীব্রভাবে মার্কিনবিরোধী, ফলে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের মাধ্যম ছিল পাকিস্তান।

মার্কিন মিত্র পাকিস্তান আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতিকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করত, এবং আফগান মিলিট্যান্টদের সহায়তা করার মাধ্যমে তারা ১৯৭১ সালের ভারতীয়–পাকিস্তানি যুদ্ধে ভারতের প্রতি সোভিয়েত সমর্থনের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। পাকিস্তান ছিল আফগান মিলিট্যান্টদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল, এবং সোভিয়েত ও আফগান সরকারি বাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনার পর মিলিট্যান্টরা নিরাপদে পাকিস্তানে পালিয়ে আসতে পারত। তারা পাকিস্তানের মাটিতে প্রশিক্ষণ লাভ করত এবং সেখান থেকে আফগানিস্তানে আক্রমণ পরিচালনা করত। কখনো কখনো পাকিস্তানি সেনা ও বিমানবাহিনী সরাসরি আফগান ও সোভিয়েত সৈন্যদের সংঘর্ষে লিপ্ত হত।

আফগানিস্তানে প্রেরিত সোভিয়েত সৈন্যরা মূলত পশ্চিম ইউরোপ বা উত্তর চীনের সমভূমিতে যুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ লাভ করেছিল, এবং আফগানিস্তানের পার্বত্য ভূমিতে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা ছিল প্রায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। সম্মুখযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সোভিয়েত সৈন্যরা আফগান গেরিলাদের মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি। তাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল অপ্রতুল, এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধের অনুপযোগী। তদুপরি, সামগ্রিকভাবে সোভিয়েত সৈন্যবাহিনী ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপেক্ষাকৃত কম মনোবলসম্পন্ন। স্থানীয় জনসাধারণ ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সোভিয়েত ও আফগান সরকারি বাহিনীর প্রতি বিরূপ এবং মিলিট্যান্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এবং সোভিয়েতদের সহযোগী আফগান সরকারি বাহিনী ছিল মনোবলহীন, অদক্ষ ও অবিশ্বস্ত।

আফগানিস্তান ত্যাগের সময় একটি সোভিয়েত টি–৬২ ট্যাঙ্ক; Source: Wikimedia Commons

এজন্য বিপুল পরিমাণ অস্ত্রবল সত্ত্বেও আফগান মিলিট্যান্টদের নির্মূল করা সোভিয়েতদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, এবং এটি ছিল তাদের জন্য একটি বিরাট রাজনৈতিক ব্যর্থতা। প্রায় ৯ বছরব্যাপী আফগান যুদ্ধে আফগান মিলিট্যান্টরা একটি ক্ষুদ্র সোভিয়েত ঘাঁটিও দখল করতে পারেনি, এবং সেদিক থেকে এই যুদ্ধটি একটি অচলাবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে সোভিয়েতরা ১৯৮৭ সালে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে, এবং ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সমস্ত সোভিয়েত সৈন্য আফগানিস্তান ত্যাগ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথমবারের মতো সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনী কোনো শত্রুকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর এর প্রভাব ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম দেশটির অভ্যন্তরে বিরাট এক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং জাতিগত সংঘাত দেখা দেয়। কিন্তু সোভিয়েত সরকার এগুলো দমনের জন্য সশস্ত্রবাহিনীকে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে। অনুরূপভাবে, পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত মিত্ররাষ্ট্রগুলোতেও বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েতপন্থী সরকারগুলোর পতন ঘটে, কিন্তু এই সরকারগুলোকে রক্ষার জন্য সোভিয়েতরা কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি।

সোভিয়েত সরকারের এই সিদ্ধান্তের পশ্চাতে নানাবিধ কারণ ছিল, কিন্তু এগুলোর মধ্যে একটি কারণ ছিল আফগানিস্তানে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ জুড়ে আফগানিস্তানের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর কোনো আগ্রহ তাদের ছিল না, এবং এজন্য তারা এই সঙ্কটগুলোতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকে। এমতাবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটে, এবং ১৯৯১ সাল নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙে পড়ে। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পশ্চাতে আফগান যুদ্ধে তাদের পরাজয়ের পরোক্ষ ভূমিকা ছিল।

আফগান যুদ্ধে সোভিয়েতদের ব্যর্থতার পশ্চাতে পাকিস্তানিদের, বিশেষত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টার–সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’–এর (আইএসআই) তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র আফগান মিলিট্যান্টদের উদ্দেশ্যে যে সহায়তা প্রেরণ করেছিল, সেগুলোর পুরোটাই আইএসআই–এর হাত হয়ে আফগান মিলিট্যান্টদের কাছে পৌঁছাত। আফগান মিলিট্যান্টদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ প্রদান, বিভিন্ন আফগান মিলিট্যান্ট গ্রুপের মধ্যে মধ্যস্থতা ও সমন্বয় সাধন এবং আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা প্রভৃতি কাজ আইএসআই দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে। এর মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ব্যর্থতার ক্ষেত্রে তারা একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

আইএসআই–এর প্রাক্তন মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুল ছিলেন একজন ব্রিটিশ–প্রশিক্ষিত সামরিক কর্মকর্তা; Source: Daily Times

আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের সময় আইএসআই–এর মহাপরিচালক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুল। আফগানিস্তানে তাঁর সংস্থার সাফল্যের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে বার্লিন প্রাচীরের একটি বড় টুকরো উপহার হিসেবে প্রদান করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর ‘প্রথম আঘাত’ হানার কারণে তাকে এই উপহার প্রদান করা হয়।

জেনারেল গুলকে প্রদত্ত উপহারের প্রতীকী তাৎপর্য অপরিসীম। ১৯৬১ সালে সোভিয়েত–সমর্থিত পূর্ব জার্মানি কর্তৃক নির্মিত বার্লিন প্রাচীর বার্লিন শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছিল। কমিউনিস্ট–শাসিত পূর্ব জার্মানির অধীনে ছিল পূর্ব বার্লিন, আর মার্কিন–সমর্থিত পশ্চিম জার্মানির অধীনে ছিল পশ্চিম বার্লিন। বার্লিন প্রাচীর ছিল কমিউনিস্ট বিশ্ব এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের মধ্যে বিরাজমান বিভাজনের প্রতীক। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে জার্মানরা এই প্রাচীর ভেঙে ফেলে এবং পূর্ব জার্মানিতে কমিউনিজমের পতন ঘটে। এর অল্পদিনের মধ্যেই দুই জার্মানি একত্রিত হয়। বার্লিন প্রাচীরের পতন ছিল স্নায়ুযুদ্ধের অবসান এবং স্নায়ুযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের বিজয়ের প্রতীকস্বরূপ।

আর স্নায়ুযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজয়ের অন্যতম একটি কারণ ছিল আফগানিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে মার্কিন–প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আফগান মিলিট্যান্টদের নিকট সোভিয়েত কমিউনিজমের পরাজয়। আর তাদের এই পরাজয়ে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল মার্কিন প্রক্সি পাকিস্তান। এজন্যই বার্লিন প্রাচীরের একটি টুকরো হামিদ গুলকে উপহার দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তাদের বিজয়কে উদযাপন করেছে।

বিংশ শতাব্দীতে অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্বের প্রক্সিরা পরপর দুই বার রুশ বিশ্ব কর্তৃক উষ্ণ জলীয় বন্দর লাভের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। ১৯০৫ সালে অ্যাডমিরাল তোগো রুশ নৌবহরকে বিধ্বস্ত করে পূর্ব এশিয়ায় রুশদের উষ্ণ জলীয় বন্দর লাভের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন। আর ১৯৮৯ সালে জেনারেল গুল আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতদের সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য করে দক্ষিণ/পশ্চিম এশিয়ায় তাদের উষ্ণ জলীয় বন্দর লাভের স্বপ্নকে বিলীন করে দিয়েছেন। তোগোর সাফল্য রুশ সাম্রাজ্যের পতনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আর গুলের সাফল্য সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে রুশ বিশ্ব দারুণভাবে সংকীর্ণ ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। পূর্ব, পশ্চিম বা দক্ষিণ এশিয়ায় ভৌগোলিক সম্প্রসারণের মাধ্যমে উষ্ণ জলীয় বন্দর হস্তগত করা আর মস্কোর পক্ষে সম্ভব নয়। অর্থাৎ, ষোড়শ শতাব্দীতে জার চতুর্থ ইভানের সময় থেকে রুশ বিশ্বের অধিপতিরা উষ্ণ জলীয় বন্দর অধিকারের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, বিংশ শতাব্দীতে সুশিমা প্রণালী থেকে পার্বত্য আফগানিস্তানে অ্যাংলো–স্যাক্সন বিশ্ব কর্তৃক পরিচালিত প্রক্সি যুদ্ধের ফলে রুশ বিশ্বের সেই প্রকল্প পরিত্যক্ত হয়েছে।

Related Articles