ভৌগলিকভাবে আয়তনে রাশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ, ৬৬ লক্ষ বর্গ মাইলের এই দেশে রয়েছে এগারোটি ভিন্ন ভিন্ন টাইম জোন। ভৌগলিক আয়তনের মতো এর পাহাড়-পর্বত, বন, লেক আর নদীর আকারও বিশাল। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের সাথে রাশিয়ার ভৌগলিক সংযোগ আছে, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষেরই পূর্ব-পশ্চিমে কিংবা উত্তর-দক্ষিণে রয়েছে রাশিয়া। বিশাল এই দেশের জনসংখ্যা অবশ্য তুলনামূলকাভবে কম, মাত্র পনেরো কোটি। রাশিয়ানদের সাথে সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য থাকা বেশ কিছু মানুষ আবার ছড়িয়ে আছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রিপাবলিকে।
বিশাল এই দেশে দীর্ঘ সময় ধরে ছিল জারের শাসন। জারের পতনের পর আসে আরো কর্তৃত্ববাদী কমিউনিস্টরা। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর রাশিয়াতে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রায়ন ঘটলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসেনি। শাসকেরা রয়ে গেছেন জার আর কমিউনিস্টদের মতোই কর্তৃত্ববাদী।
রাশিয়ার ভূরাজনীতিতে ইউক্রেন
বর্তমানে রাশিয়া বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর একটি। অন্যতম শক্তিশালী আর দক্ষ সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি রাশিয়ার রয়েছে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত। এ কারণে মনে হতেই পারে, রাশিয়াতে সামরিক আক্রমণ চালানোর সম্ভাবনা নেই। পৃথিবীর কোনো দেশই রাশিয়ার প্রতিকূল পরিবেশ আর সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি হতে চাইবে না। কিন্তু রাশিয়ানরা নিজেদের নিরাপত্তার ধারণাকে এভাবে দেখে না, এবং তাদের ভিন্নমতের পেছনে রয়েছে যৌক্তিক কারণ।
রাশিয়ানরা গত কয়েক শতাব্দী ধরে প্রতি তেত্রিশ বছর অন্তর অন্তর যুদ্ধ করছে ইউরোপীয়দের সাথে। ইউরোপীয়দের আক্রমণগুলো এসেছে ইউক্রেন আর জর্জিয়ার সমতল ভূমি হয়ে। ১৬০৫ সালে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি হয়ে পোলিশরা আক্রমণ করে রাশিয়াতে, ১৭০৮ সালে সুইসরা আক্রমণ করে দ্বাদশ চার্লসের অধীনে। নেপোলিয়নের অধীনে থাকা ফ্রান্স রাশিয়াকে আক্রমণ করে ১৮১২ সালে, ক্রিমিয়াকে কেন্দ্র করে চার বছরের যুদ্ধ শুরু হয় ১৮৫৩ সালে। গত শতাব্দীর দুই বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া আক্রমণের শিকার হয়েছে জার্মানির দ্বারা।
ফলে, যেকোনো অবস্থায় ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ হারানো মস্কো প্রশাসনের জন্য সতর্কবার্তা, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি চিরস্থায়ী চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেনকে নিজেদের বলয়ে রাখার জন্য তাই সম্ভাব্য সবকিছুই করবে রাশিয়া। ভূরাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই পরাশক্তিরা নিরাপত্তার সংকটে পড়লে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে, ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও রাশিয়া এর ব্যতিক্রম কাজ করেনি।
উষ্ণ পানির বন্দরের প্রয়োজনীয়তা
রাশিয়ার বিশাল ভৌগলিক আয়তন থাকলেও সারা বছর ধরে উষ্ণ থাকে, এমন বন্দর রাশিয়ান ফেডারেশনের ছিল না। রাশিয়ার বাণিজ্যিক আর সামরিক জলযানগুলো বসফরাস প্রণালী থেকে আরব সাগরে আসে। সেখান থেকে ভূমধ্যসাগরে। ভূমধ্যসাগর থেকে জলযানগুলো জিব্রাল্টার প্রণালীর মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরে যায়, কিংবা সুয়েজ খাল হয়ে ভারত মহাসাগরে আসে।
একটি উষ্ণ পানির বন্দরের চাহিদা থেকেই ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে, পরবর্তীতে ক্রিমিয়াকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয় রাশিয়া। বর্তমানে রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণের ক্ষেত্রে ক্রিমিয়ার সংকটের লিগ্যাসিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গত বছর ক্রিমিয়াকে পুনর্দখলের জন্য ডিক্রি জারি করেছেন, হুমকি দিয়েছেন সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের। অন্যদিকে, রাশিয়ার ব্ল্যাক সি ফ্লিটের জন্য ক্রিমিয়া ধরে রাখার পাশাপাশি ক্রিমিয়ার সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করার মতো ভূমি দখল করার চেষ্টা করেছে যুদ্ধের শুরু থেকেই, সম্প্রতি সেই প্রচেষ্টা দেখেছে সফলতার মুখ।
ন্যাটোর সম্প্রসারণবাদ ও নিরাপত্তা ঝুঁকি
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে সামষ্টিক নিরাপত্তার ধারণাকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ন্যাটো, দ্বিমেরুর বিশ্বে এটি ছিল গণতান্ত্রিক বিশ্বের দেশগুলোর সম্মিলিত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পরে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, প্রশ্ন ওঠে ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা নিয়েও। সেই সময় পেরিয়ে ন্যাটো টিকে যায়, শুরু হয় নতুন করে ন্যাটোর সম্প্রসারণ। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি পর বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে এসে ন্যাটোতে যুক্ত হয় পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক আর হাঙ্গেরি। ২০০৪-০৯ সালের মধ্যে ন্যাটতে যুক্ত হয় আরো নয়টি দেশ। বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটিভা, লুথেনিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, আলবেনিয়ার পাশাপাশি ন্যাটোতে যুক্ত হয় ক্রোয়েশিয়া। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে মন্টিনিগ্রো আর উত্তর মেসিডোনিয়া।
ইউক্রেনও একই প্রক্রিয়ায় ন্যাটোতে যুক্ত হতে চেয়েছে। রাশিয়ার মতো বিশাল দেশের পাশে থেকে সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখা আর নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ নিয়ে খুঁজেছে নির্ভরযোগ্য মিত্রকে। কিন্তু, যতদিন পর্যন্ত ন্যাটোর সদস্য হতে না পারছে, ততদিন পর্যন্ত মস্কো খুবই নিকটে, ওয়াশিংটন ডিসি অনেক দূরে। চলমান সংকটে রাশিয়ার অন্যতম লক্ষ্য ন্যাটোর সম্প্রসারণবাদ আটকিয়ে নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা।
ইউক্রেনের কৃষিখাত
ভূরাজনীতিবিদ ফ্রেডরিখ রাজেলের অর্গানিক স্টেট থিওরি অনুযায়ী, রাষ্ট্র হচ্ছে একটি বায়োলজিক্যাল অর্গান, যেটি ক্রমাগত সম্প্রসারণ আর সংকোচনের মধ্য দিয়ে টিকে থাকে। শক্তিশালী রাষ্ট্র সম্প্রসারণবাদের মাধ্যমে দুর্বল রাষ্ট্রকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। সম্প্রসারণবাদের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখে নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত ভূমি আর পর্যাপ্ত সম্পদ নিশ্চিতের ধারণা।
রাশিয়ার বিশাল ভূমি থাকলেও তীব্র শীত আর সূর্যালোকের স্বল্পতার কারণে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ তুলনামূলক কম। যেসব অঞ্চলে চাষাবাদ করা যায়, সেসব অঞ্চলেও কৃষিকাজের মৌসুম অত্যন্ত স্বল্প, নেই কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য সাশ্রয়ী পরিবহন লাইন। অন্যদিকে, ইউক্রেনের ভূমি তুলনামূলকভাবে সমতল, এখনকার ভূমি উর্বর আর প্রয়োজনীয় সূর্যালোকের উপস্থিতি আছে। ফলে, জারদের আমল থেকেই রাশিয়ার খাদ্যশস্যের অন্যতম উৎস ইউক্রেন। ইউক্রেনে উৎপাদিত শস্যের রপ্তানি আয় যোগ হয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা পূর্ব ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ সূর্যমুখী উৎপাদিত হয়। সূর্যমুখীর বীজ রপ্তানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে।
শরণার্থী সংকট
ভূরাজনীতিবিদ ফ্রেডরিখ রাজেলের আরেকটি থিওরি হচ্ছে লেবেনস্রাউম। এই থিওরি অনুযায়ী, রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য ‘লিভিং স্পেস’-এর ব্যবস্থা করে, নাগরিকদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক স্বাধীনতা এনে দিতে চায়। এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকে রাষ্ট্রের সম্মান অর্জন বা রক্ষার প্রচেষ্টা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আর ভৌগলিক বাস্তবতা।
রাশিয়া আর ইউক্রেনের মানুষদের মধ্যে রয়েছে আত্মীয়তার সম্পর্ক, রয়েছে পারিবারিক আত্মীয়। কিয়েভকে বলা হয় রাশিয়ার সকল শহরের মাতা, রয়েছে গভীর সাংস্কৃতিক যোগাযোগ। কিন্তু, সম্প্রতি ইউক্রেনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করে দুটি প্রধান গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে ভাষার ভিত্তিতে। ইউক্রেনের ৪৪ মিলিয়ন নাগরিকের মধ্যে ৮ মিলিয়ন নাগরিক কথা বলে রুশ ভাষায়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী এই কমিউনিউনিটির সাথে গভীর রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রয়েছে রাশিয়ার মানুষদের। ২০১৩ সালের রাজনৈতিক সংকটের পর এই রাজনৈতিক গ্রুপ ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নিজেদেরকে বহিরাগত মনে করতে বাধ্য হয়, রাজনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি শুরু হয় ভাষাকেন্দ্রিক বৈষম্য।
ফলে, ইউক্রেনের ৮ মিলিয়ন রুশভাষীর রাজনৈতিক পীঠস্থান হয়ে ওঠে রাশিয়া, রুশভাষী ইউক্রেনীয়রা সমর্থন প্রত্যাহার করতে থাকে কিয়েভ প্রশাসনের প্রতি। দুটি মিনস্ক চুক্তি হলেও, দনবাস অঞ্চলে সামরিক সংঘাতের ঘটনা কমেনি, চলতে থাকে হতাহতের ঘটনা। ফলে, এই অঞ্চল থেকে প্রায় ছয়-সাত লাখ রুশভাষী ইউক্রেনীয় আশ্রয় নেয় রাশিয়াতে। সমগোত্রীয় মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য রাশিয়াকে তাই জড়াতে হয় এই যুদ্ধে। ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণেও যুদ্ধ শুরুর এই কারণ দেখান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
অন্যদিকে, রুশভাষী ইউক্রেনীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবাদকে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই ইতিবাচকভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই কিয়েভ প্রশাসনের জন্য। ফলে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে ক্রমাগত কঠোর অবস্থানে গেছে ইউক্রেন, সংঘাতের মাধ্যমে চেয়েছে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে। ফলে, ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধের ক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের ‘লিভিং স্পেসের’ ধারণা ভূমিকা রেখেছে।