Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জোভেনেল ময়েস: হাইতিয়ানদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে এসে ক্ষমতার লোভে পড়া রাষ্ট্রপতি

পুরো পৃথিবী যখন কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় বেসামাল এবং ভ্যাকসিন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখন ক্যারিবিয়ান দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে ঘটে গেল সবথেকে আলোচিত ঘটনা। দেশটির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়েসকে তারই ব্যক্তিগত বাসভবনে হত্যা করে একদল অজ্ঞাত সন্ত্রাসী। এই হত্যাকাণ্ড ঘটে স্থানীয় সময় বুধবার রাত ১টার সময়। তখন তিনি ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন তার স্ত্রী মার্টিন ময়েস। প্রেসিডেন্ট ঘটনাস্থলে নিহত হলেও মার্টিন ময়েসকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়। এই ঘটনার ৬ ঘন্টা পর দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্লড জোসেফ নিজেকে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারপ্রধান ঘোষণা করে ঘটনার সত্যতা প্রকাশ করেন। সেসময় রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সসহ পুরো দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন তিনি। সেই সাথে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের খুঁজতে পুলিশি অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দেন।

জোভেনেল ময়েস হত্যাকাণ্ডের পেছনে সরাসরি কোন গোষ্ঠী বা দেশ জড়িত ঐ বিষয়টি এখনও খোলাসা করতে পারেনি হাইতির নিরাপত্তাবাহিনী। তবে ঘটনার পরদিন বৃহস্পতিবার দেশটির পুলিশপ্রধান লিওন চার্লস প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ডে ২৮ জন জড়িত থাকতে পারে বলে দাবি করেন। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী জড়িতদের মধ্যে ২৬ জন কলম্বিয়ান এবং ২ জন হাইতি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। সন্দেহভাজন ১৭ জনকে গ্রেফতারের দাবি করেন পুলিশপ্রধান লিওন চার্লস। এছাড়াও আরো ৩ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে বলেও জানান। বাকি ৮ জন এখনও পলাতক রয়েছে।

Image Source: Joseph Odelyn/Associated Press

 

প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়েস খুন হওয়ার পর তার রাজনৈতিক জীবন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সামনে বার বার আলোচিত হচ্ছে। এছাড়াও আলোচনা হচ্ছে তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে দেশটির বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে। কারণ প্রেসিডেন্ট ময়েস চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি দাবি করেন তার সরকারকে উৎখাতের পাশাপাশি তাকে হত্যার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি তখন সন্দেহভাজন হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতাদের দিকে আঙুল তোলেন। যদিও বিরোধীরা তার এমন দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন হাইতির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে খুব ভালো ছিল তা কিন্তু নয়। বরঞ্চ গত কয়েকদিনে তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, নির্বাচন পেছানোর মতো গুরুতর অভিযোগ বার বার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

হাইতিতে ময়েস বিরোধীরা তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চেয়েছিল ঠিকই, তবে তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল কিনা সে বিষয়ে যৌক্তিক কোনো প্রমাণ আজ অবধি পাওয়া যায়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি যখন হুমকি পেয়েছেন বলে দাবি করেন তখন আন্তর্জাতিক মহলে তার বক্তব্যকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ ঠিকই প্রাণ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়েস। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশটির সার্বিক পরিস্থিতি আরো সংকটময় করে তুলেছে সন্ত্রাসীরা। যদিও ময়েসের বিরুদ্ধে পাওয়া অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, অপশাসন, দুর্নীতির সকল অভিযোগ মিথ্যা নয়। আর তাই ময়েসের রাজনৈতিক উত্থান, নির্বাচনে জয় পাওয়া কিংবা ক্ষমতায় থাকাকালীন সফলতা এবং ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনার সময় এসেছে। সেই সাথে আলোচনা করা দরকার অপরাধ দমন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তার প্রশাসনিক ব্যর্থতার যে দাবি উঠেছে সে সম্পর্কে।

দ্য ব্যানানা ম্যান

এটা ঠিক যে প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়েস প্রশাসনের কার্যকলাপ নিয়ে বিগত বছরগুলোতে কম বিতর্ক হয়নি। সকল বিতর্কের মূলে ছিল নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করার কারণটি। এই ক্ষেত্রে দেশটির বিরোধী দলের ভাষ্য ছিল প্রেসিডেন্ট ময়েস অবৈধভাবে দেশ পরিচালনা করছেন। নিয়মানুযায়ী গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু তিনি পদত্যাগ না করায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে গোটা হাইতিতে ব্যাপক বিক্ষোভ-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বিরোধীরা যখন তার ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন তিনি ডিক্রি দিয়ে দেশ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি শেষমেশ তিনি সংবিধানের পরিবর্তন এনে আরেক মেয়াদে দেশ পরিচালনার পায়তারা করছিলেন বলেও অভিযোগ এসেছে বিরোধী শিবির থেকে।

ভাষণ দিচ্ছেন জোভেনেল ময়েস; Image Source: WorldPoliticsreview.com

 

২০১৫ সালে হাইতির জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মিশেল মার্টেলি। যদিও তিনি পদত্যাগ করেন ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে। ২০১৫ সালে বাতিলকৃত নির্বাচন পুনরায় অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে। ঐ নির্বাচনে জোভেনেল ময়েস ৫৫.৬ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। যদিও ঐ নির্বাচনে দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৮.১ শতাংশ নাগরিক অংশগ্রহণ করেন। নভেম্বরে নির্বাচিত হলেও জোভেনেল ময়েস আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় বসেন পরের বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি। এদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সহিংসতার মুখে প্রেসিডেন্ট ময়েস জানান, তিনি যেহেতু এক বছর পর ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন সেহেতু তিনি আরো এক বছর ক্ষমতায় থাকতে চান।

অথচ ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগেও খুব একটা পরিচিত ছিলেন না এই জোভেনেল ময়েস। তিনি ছিলেন দেশটির উত্তরাঞ্চলের একজন সফল ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারী। যখন দেশের মানুষ অসম রাজনীতি এবং মারাত্মক দারিদ্র্যতার মধ্যে জীবনযাপন করছিল, তখন তিনি হাইতির নাগরিকদের কাছে এই অচলাবস্থা মোকাবেলা করার সংকল্প করেন। তার অতীতের সেবামূলক কাজগুলো খতিয়ে দেখলে নিরাপদ পানি বণ্টন, জ্বালানী খাতে উন্নয়ন এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মতো প্রশংসনীয় উদ্যোগ পাওয়া যায়। নির্বাচনের প্রচারণায় তিনি এসব খাতে ব্যাপক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। আর এমন সেবামূলক কাজের জন্য তিনি জনসাধারণের নিকট ‘দ্য ব্যানানা ম্যান’ হিসেবে পরিচিতি পান। যদিও ব্যবসায়ী ময়েসের তুলনায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে জোভেনেল ময়েসের সুখ্যাতির চেয়ে কুখ্যাতিই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ময়েসের নির্বাচনী প্রচারণা; Image Source: WorldPoliticsreview.com

 

ময়েস হত্যাকাণ্ডের একদিন পর হত্যাকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির আমেরিকান পরিচালক এরিকা গুয়েভারা রোজাস বলেন,

হাইতির নাগরিকেরা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দীর্ঘকালীন দায়মুক্তির অভাবে ভুগছেন। এই ঘটনা হাইতিয়ান কর্তৃপক্ষ ছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যারা দীর্ঘকালীন দায়মুক্তি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং মানবাধিকার রক্ষাকারীদের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করে এমন গুরুতর সংকটের পথকে প্রশস্ত করেছে তাদের জন্য জাগ্রত আহ্বান।

বিতর্কিত শাসনামল

প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়েস ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রক্ষমতায় বসলেও ২০২০ সালের শুরুতে তিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান। এছাড়াও নিয়মানুযায়ী ২০২০ সালে দেশটিতে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে তিনি ডিক্রি আরোপ করে ১ বছরের জন্য ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করেন। সেক্ষেত্রে তার ব্যাখ্যা ছিল তিনি মূল সময়ের থেকেও ১ বছর পরে ক্ষমতায় বসেছেন। মূলত ২০১৯ সালের শেষেদিকে শুরু হওয়া সহিংসতা রুখতে তিনি এই পন্থা অবলম্বন করেছেন বলে নিজে দাবি করেন।

হাইতিতে সহিংসতার ছবি; Image Source: DW

 

রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি মানবাধিকার সংগঠন সমূহের কাছ থেকে ব্যাপক নিন্দিত হন। মূলত তার গৃহীত ডিক্রি সমূহের কারণে তিনি অবৈধভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে অপসারণ করে পুনরায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে অন্য আরেকজন বিচারপতি নিয়োগ দেন। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি অপসরাণ এবং পুনরায় নিয়োগের কাজটি ছিল একেবারেই সংবিধান বহির্ভূত। যদিও শুধুমাত্র এখানেই থেমে থাকেনি ক্ষমতায় বসে তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড।

চলতি বছরের শুরুতে প্রেসিডেন্ট ময়েস ঘোষণা করেন, তিনি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি অবধি দায়িত্বপালন করতে চান। সেক্ষেত্রে এর আগে কোনো নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেননি তিনি। এতে করে হাইতির মানবাধিকার সংগঠন এবং বিরোধী দলের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। যেহেতু কোনোপ্রকার নির্বাচনের নিশ্চয়তা প্রেসিডেন্ট ময়েস দেননি, সেহেতু বিরোধীরা ধরেই নিয়েছেন তিনি ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান। রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে ময়েস বিরোধী বিক্ষোভের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তখন ঘটা করে প্রচার হলেও অজানা কারণে প্রতিবেশী, ক্ষমতাধর দেশসমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। ততদিনে বিরোধীরা ময়েসকে স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যায়িত করে।

হাইতিতে সহিংসতা; Image Source: DW

 

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ প্রেসিডেন্ট ময়েস যখন আরো এক বছর ক্ষমতায় থাকবেন বলে ঘোষণা দেন, তখন দেশটির সুপ্রিম কোর্টের আদেশে প্রায় ২৪ জনকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের অভিযোগ আনা হয়। আর এই ঘটনা নিশ্চিত করেন হাইতির কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা। প্রেসিডেন্ট ময়েস মূলত এই ঘটনাকে সেদিনের বক্তব্যে তাকে হত্যার ব্যর্থ অভ্যুত্থান হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও সেদিন তার শেষ কথাটা ছিল এমন, “আপনারা ধরে নিন এটি আমার ক্ষমতায় আরোহনের শেষ বছরের প্রথম দিন।”

সহিংসতা বৃদ্ধি

হাইতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দেশটিতে খুব অল্প সময় শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল। এছাড়া শত বছর ধরে সেখানে চলছে সহিংসতা, হত্যা, দুর্নীতি, অরাজকতা এবং ক্ষমতার লড়াই। প্রেসিডেন্ট ময়েসের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান যে দুটো অভিযোগ এসেছিল সেগুলোর মধ্যে দুর্নীতি এবং সহিংসতা সৃষ্টি ছিল অন্যতম। তার রাজনৈতিক দলের কর্মীরা প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে সংঘবদ্ধ সহিংসতা সৃষ্টি করেছিল। খুন এবং ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো তারা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত করে। ২০১৯ সালের পর সহিংসতা দিন দিন তীব্রতর হয়ে ওঠে, যার চূড়ান্ত রূপ দেখা দেয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। আর দীর্ঘদিনের এই সহিংসতা এখনও বিরাজমান।

প্রেসিডেন্ট ময়েস বিরোধী আন্দোলন; Image Source: AP – Dieu Nalio Chery

 

গত মাসে হাইতির রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে সহিংসতার কারণে কয়েক হাজার নারী এবং শিশু বাস্তুচ্যুত হন। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে জাতিসংঘের শিশু অধিকার বিষয়ক কমিটি সতর্কবার্তা পাঠিয়ে জানায় রাজধানীতে নিরাপদ খাবার পানি এবং ব্যবহার্য জিনিসের সংকট বেড়েই চলেছে। অথচ প্রেসিডেন্ট ময়েসের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য নিরাপদ পানি এবং খাদ্য সরবরাহ করার কথা ছিল। যারা তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে বলেছেন বা আন্দোলন করেছেন তাদের দমন করা হয়েছে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে।

প্রেসিডেন্ট ময়েস খুন হওয়ার সপ্তাহখানেক আগেও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে ঘটেছিল এক মর্মান্তিক ঘটনা। সেদিন রাতভর গোলাগুলিতে নিহত হন সাংবাদিক চার্লস এবং রাজনীতি কর্মী অ্যান্টিয়েট ডুক্লেয়ার। এই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে দেশটিতে চলমান সহিংসতা এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়। হাইতিতে চলমান সহিংসতা নিয়ে তখন মুখ খোলে জাতিসংঘের মানবিক বিষয় সম্পর্কিত সমন্বয় সংস্থা (ওসিএইচএ)। সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তারা দেখছেন গ্যাং পার্টি এবং অঞ্চলগত বিরোধ সমূহকে।

পোর্ট-অ-প্রিন্সে নারী এবং শিশুদের অবস্থা; Image Source: EDUARDO MUNOZ/ REUTERS

 

শুধুমাত্র সহিংসতায় থেমে থাকেনি প্রেসিডেন্ট ময়েসের শাসনামল। একইসাথে বেড়েছিল মুক্তিপণের উদ্দেশ্যে অপহরণের মতো ঘটনা। আর এসব কার্যকলাপে জড়িত রয়েছে হাইতির সশস্ত্র দলগুলো। আল জাজিরার তথ্যানুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে ৭ জন ক্যাথলিক ধর্মযাজকসহ সর্বমোট ১০ জনকে অপহরণ করা হয়েছিল। এগুলো ছিল শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা প্রমাণ। প্রেসিডেন্ট ময়েসের শাসনামলে এরকম হাজারো খুন এবং অপহরণের ঘটনা রয়েছে যেগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে কখনোই আসেনি।

তবে সাম্প্রতিককালে প্রেসিডেন্ট ময়েসের ছত্রছায়ায় হাইতির সার্বিক পরিস্থিতি যে খুবই সংকটপূর্ণ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় দেশটির ‘ন্যাশনাল হিউমেন রাইটস ডিফেন্স নেটওয়ার্ক’ এর বিবৃতিতে। তাদের বক্তব্য ছিল,

মানুষকে জীবিত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, যানবাহন ছিনতাইয়ের পাশাপাশি নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। অথচ কর্তৃপক্ষের নীরবতায় এই সংকটময় অবস্থা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মানুষ নিজের জীবন সুরক্ষা এবং সম্পত্তি নিরাপদে রাখার জন্য নিরুপায় হয়ে ছুটছে। কর্তৃপক্ষের নীরবতাই এজন্য দায়ী।

হাইতির বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কী?

প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়েস নিহত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু দেশকে অচলাবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে তিনি চিরবিদায় নেননি। কারণ দেশটির অর্ন্তবর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়া জোসেফ হলেন ময়েসের দলেরই নেতা। গত এপ্রিলে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তাকে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট ময়েস। প্রায় ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটিতে ময়েস ছিলেন বৈধভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। যে দেশটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিবেশী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিকের সাথে সীমান্ত, দ্বীপ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রয়েছে।

ক্লড জোসেফ এবং জোভেনেল ময়েস; Image Source: VOA news

 

যদিও প্রধানমন্ত্রী জোসেফড অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে ক্ষমতা নিজের হাতে নেয়ার বিষয়টি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। দেশটির ১৯৮৭ সালের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান নিহত হলে সুপ্রিম কোর্ট দেশের অর্ন্তবর্তীকালীন ক্ষমতার অধিকারী হবেন। আবার সংবিধানের কোনো কোনো অংশের মতে প্রধানমন্ত্রী বা দেশের সংসদের উচিত একজন অর্ন্তবর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গত মাসে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে এখনো কাউকে আর সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়নি।

যদিও এখানে আরো জটিলতা তৈরি হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ক্লড জোসেফের বৈধতা নিয়ে। কারণ প্রেসিডেন্ট ময়েস গত সপ্তাহে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অ্যারিয়েল হেনরিকে নিয়োগ প্রদান করেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য হেনরি শপথ গ্রহণের আগেই মৃত্যুবরণ করেন প্রেসিডেন্ট ময়েস। ক্লড জোসেফ নিজেকে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে অধ্যাদেশ জারি করলেও সেটি মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন হেনরি। তার মতে, হাইতির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বৈধতা পাওয়ার কথা তার। আর এ কারণে জোসেফকে আলোচনায় বসতে আহ্বান জানিয়েছেন হেনরি।

প্রেসিডেন্ট ময়েসের বিরোধী কর্মী; Image Source: apnews

 

অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিক ইতোমধ্যেই হাইতির সঙ্গে সবরকম সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে। মূলত সন্ত্রাসী হামলা এবং হাইতিতে কোভিড-১৯ এর ব্যাপক সংক্রমণ যাতে সেখানে ছড়াতে না পারে সে কারণেই এমন উদ্যোগ বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। এছাড়াও গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে হাইতি সংকট নিয়ে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী ক্লড জোসেফ ইতোমধ্যেই জরুরি অবস্থা জারি করার কারণে বেশ কিছু নাগরিক সুবিধা স্থগিত করেছেন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সাময়িক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে কোনোপ্রকার আন্দোলন, সহিংসতা যাতে না ঘটে সে বিষয়ের উপর জোর দেন। তাই বলা যায়, হাইতির এই রাজনৈতিক সংকট খুব সহজেই মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।

This article written about Haitian President Jovenel Moise who served as president for more than four years amid increasing political instability and surging gang violence in Haiti. He was killed in the early hours of Wednesday at his private home in the capital, Port-au-Prince.

Feature Image Source: VOA.com

Related Articles