২০১৬ সাধারণ নির্বাচনের আগে থেকেই বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিলো। শুরুর দিকে অভিযোগগুলোকে বিরোধী দলের রাজনৈতিক প্রচার বলে মনে হলেও যতই সময় গড়াচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি অভিযোগেরই কিছু না কিছু ভিত্তি রয়েছে। কিন্তু এসব অভিযোগের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা তার পরিবারকে কি জেলে যেতে হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম অভিযোগ উত্থাপিত হয় ২০১৬ প্রেসিডেনশিয়াল প্রাইমারি ইলেকশনের পর ও জেনারেল ইলেকশানের পূর্বে। প্রাইমারি ইলেকশন হচ্ছে মনোনয়নের জন্য একই দলের প্রার্থীদের মধ্যে লড়াই। এই লড়াইয়ে জয়ী হয়ে যারা দলীয় মনোনয়ন পান, তারা সাধারণ নির্বাচনে বিরোধীদলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। যেমন- ২০১৬ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীদের মধ্যে প্রাথমিক নির্বাচনে লড়াই শেষে মনোনয়ন পান ডোনাল্ড ট্রাম্প। অন্যদিকে, ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীদের মধ্যে প্রাথমিক নির্বাচনের লড়াইয়ে হিলারি ক্লিনটন জয়ী হয়ে দলীয় মনোনয়ন পান। তারপর এ দুজন সাধারণ নির্বাচনে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
রাশিয়ান আঁতাত
ট্রাম্পের ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো সাধারণ নির্বাচনের ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য রাশিয়ার সাথে গোপনে যোগাযোগ স্থাপন করার। সে সময় ট্রাম্প প্রকাশ্যেও রাশিয়াকে আহ্বান করেছিলেন হিলারি ক্লিনটনের নিখোঁজ ইমেলগুলো খুঁজে বের করায় সাহায্য করতে। জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য বিদেশি শক্তির সাথে আঁতাতের অভিযোগ অস্বীকার করে আসলেও এফবিআই-এর তদন্তে ট্রাম্প টাওয়ারে রাশিয়ান কর্মকর্তাদের সাথে ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের লোকজনের গোপনে মিটিং করার তথ্য পাওয়া যায়। সেই মিটিংয়ে কী আলোচনা হয়েছিলো, সেই আলোচনা আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কি না- এসব বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে এফবিআই-এর তদন্ত চলছে।
আমেরিকান সাধারণ বা জাতীয় নির্বাচনে রাশিয়ান হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রয়েছে সেটি হচ্ছে, নির্বাচনের আগে ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের সাথে পরামর্শ করে রাশিয়া আমেরিকান ভোটারদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে টার্গেটেড অ্যাডভার্টাইজমেন্ট চালায়। যেমন- গান বা বন্দুক এনথুজিয়াস্টদের ভয় দেখানো হয় যে, সরকার তাদের বন্দুক ছিনিয়ে নিতে আসছে। মাইনরিটি ভোটার, যেমন কৃষ্ণাঙ্গদের এই বলে ভোটপ্রদানে নিরুৎসাহিত করা হয় যে, তাদের ভোট কোনো পার্থক্য তৈরি করতে পারবে না।
রাশিয়ান কল্যুশান ও এ অভিযোগের কয়েকটি দিক রয়েছে – আঁতাত (collusion), মিথ্যা স্বাক্ষ্য (perjury), ব্যক্তিস্বার্থ (personal interest) ইত্যাদি। কল্যুশানের প্রমাণ পাওয়া গেলে এটি একাই অপরাধ তো বটেই, আবার কংগ্রেস কিংবা তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে আঁতাতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলে তখন পারজুরি বা শপথের অধীনে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেয়ার ঝামেলায় পড়তে হবে। এই দুটোই ইম্পিচেবল ও ক্রিমিনাল অফেন্স (felony)।
ইম্পিচমেন্ট হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়নের প্রক্রিয়া। সাধারণত কংগ্রেস বা সংসদের নিম্নকক্ষ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করে থাকে। তবে উচ্চকক্ষ বা সিনেট চাইলে অভিযুক্তকে খালাস (aquittal) করতে পারে। নিম্নকক্ষ ইম্পিচ করলেও সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট না দিলে প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে অপসারণ করা যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টকে ইম্পিচ করার দুটি নজির রয়েছে। তবে কোনোক্ষেত্রেই সিনেট থেকে শেষ পর্যন্ত ইম্পিচমেন্ট বিল পাশ হয়নি। ফলশ্রুতিতে, অভিযুক্ত প্রেসিডেন্টরা তাদের মেয়াদ পূর্ণ করে অফিস ত্যাগ করেন। এ ব্যাপারটি যারা জানেন না, তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইম্পিচমেন্টের সম্ভাবনা বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে থাকেন। জেনে রাখা ভালো, বর্তমান সিনেটে ১০০ জন সদস্যের মধ্যে ৫১ জন যেহেতু রিপাবলিকান মেম্বার, তাই কংগ্রেস থেকে ইম্পিচড হলেও সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট, অর্থাৎ ৭৫টি ‘হ্যাঁ’ ভোট পেয়ে চূড়ান্তভাবে ইম্পিচড হয়ে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ট্রাম্পের বিতাড়িত হবার সম্ভাবনা শূন্য। তাই কংগ্রেস কর্তৃক ইম্পিচড হলেও মেয়াদ শেষ করেই হয়তো তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
রাশিয়ান আঁতাতের ব্যাপারে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য বিগত এক বছর ধরে এফবিআই চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু ট্রাম্প এফবিআইকে সাক্ষাৎকারের জন্য তারিখ দিচ্ছেন না। ট্রাম্প অ্যাটর্নিদের আশংকা, এফবিআইয়ের মুখোমুখি হলে ট্রাম্প হড় হড় করে অনেক কিছু বলে দেবেন, যা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। যদিও ট্রাম্পের দাবি, এফবিআইকে মোকাবেলা করা তার জন্য বড় কোনো ব্যাপার নয়। তবু অ্যাটর্নিদের পিড়াপিড়িতে এফবিআইয়ের মুখোমুখি হবার আগে ট্রাম্প নিজের অ্যাটর্নিদের কাছে কয়েকটি পরীক্ষামূলক টেস্টিফাই করেন ও প্রতিটি পরীক্ষায় বাজেভাবে অকৃতকার্য হন। তাই এখন তিনি নিজেও আর এফবিআইয়ের কাছে সাক্ষ্য দিতে রাজি নন।
কিন্তু কেউ কি চাইলেই এভাবে প্রসিকিউটরদের তলব প্রত্যাখ্যান করতে পারেন? না। কিন্তু ট্রাম্প পারেন। কারণ তিনি প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট চাইলে রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততা দেখিয়ে এ ধরনের বাড়তি সুবিধা নিতে পারেন।
বিচারকার্যে বাধাপ্রধান
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ বিচারকার্যে বাধা প্রদানের। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর রাশিয়ান আঁতাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া তদন্ত অল্প দিনেই অনেক দূর এগিয়ে যাবার পর ট্রাম্প তার এক্সিকিউটিভ বা নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করে তদন্ত প্রধান এফবিআই প্রধান জেমস কোমিকে বরখাস্ত করেন। যেহেতু এফবিআই একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, ফলশ্রুতিতে এফবিআইয়ের তদন্ত বাধাগ্রস্ত করা ট্রাম্পের পক্ষে সম্ভব নয়, বরং সেই চেষ্টা করলেও তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই ট্রাম্প অন্য পথে ঘুরে এসে, সরাসরি তদন্তে বাধা না দিয়ে, কোমিকেই বরখাস্ত করে দেন। যদিও এটি দিবালোকের মতোই স্পষ্ট যে, ট্রাম্প প্রকৃতপক্ষে তদন্তে বাধাপ্রদান করার উদ্দেশ্যেই কোমিকে বরখাস্ত করেন। প্রমাণিত হলে এটিও হবে ফেলনি ও ইম্পিচেবল অফেন্স।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প এভাবে তদন্ত কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করতে পারেন কি না? উত্তর একইসাথে হ্যাঁ ও না।
ট্রাম্প যদি তদন্ত বন্ধ বা বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোমিকে বরখাস্ত করে থাকেন, তাহলে তা অবস্ট্রাকশান অব জাস্টিস হিসেবে বিবেচিত হবে, যা অপরাধ। কিন্তু ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি তদন্ত করার কারণে কোমিকে বরখাস্ত করেননি। কোমি নির্বাচনের আগে যে প্রক্রিয়ায় হিলারি ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছেন, তার ভিত্তিতে ট্রাম্প তাকে বরখাস্ত করেছেন। ট্রাম্পের দাবি মতে, এই বরখাস্তের সাথে তার তদন্তের কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও সবাই জানে, এটি সত্য কথা নয় ও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তদন্ত করছিলেন বলেই তিনি কোমিকে বরখাস্ত করেছেন। কিন্তু এই দাবিকে আইনী ভিত্তি দিতে হলে ট্রাম্প যে মিথ্যা বলছেন এটি তো প্রমাণ করতে হবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যে ট্রাম্প নিজেই বেফাঁস হয়ে স্বীকার করে বসেন যে, তিনি “উইচ হান্ট” চালানোর কারণেই কোমিকে বরখাস্ত করেন! এ কথা স্বীকার করার পর এখন তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অবস্ট্রাকশান অব জাস্টিস বা বিচারকার্যে বাধা প্রদানের অভিযোগ অনেকটাই প্রমাণিত হয়ে গেছে বলা যায়।
ট্রাম্পের এ ধরনের উদ্ভট কর্মকান্ডের কারণে তার ব্যক্তিগত আইনজ্ঞরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তাকে কোনোমতেই এফবিআই প্রসিকিউটরদের মুখোমুখি পড়া যাবে না। নিজস্ব আইনজীবীদের কাছে কয়েকটি মক টেস্টে ফেল করার পর ট্রাম্প নিজেও বাস্তবতার গভীরতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। সুতরাং তিনি নিজেই আর এফবিআই-এর মুখোমুখি হতে রাজি নন। তবে টেইক হোম এক্সাম হলে তিনি দিতে রাজি আছেন।
এফবিআই ট্রাম্পের সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। তারা ট্রাম্পকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে দেন। ট্রাম্পের আইনজীবীরা সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর করেন। কোমিকে বরখাস্ত করার পর নতুন এফবিআই প্রধান রবার্ট মালার খাতা দেখা শেষে আবার ট্রাম্পকে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য ডাকছেন। এদিকে ট্রাম্পের আইনজীবীরা কোনোভাবেই ট্রাম্পকে মালারের সামনে পাঠাবে না। এই করতে করতে কেটে গেছে এক বছর। এখনো ট্রাম্প এফবিআই-এর কাছ থেকে পালিয়ে চলেছেন। তবে নতুন এফবিআই প্রধান এসেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রাখায় ট্রাম্প অন্তত এটা বুঝতে পেরেছেন যে, আমেরিকার মতো দেশে, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন ও স্বতন্ত্র, তিনি এফবিআই-এর তদন্তকে থামিয়ে রাখতে পারবেন না।
রাশিয়া সফর
সাধারণ নির্বাচন নিয়ে রাশিয়ার সাথে ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের আঁতাত নিয়ে যখন তদন্ত চলছে, তখন নতুন করে ঝামেলা পাকায় ট্রাম্পের রাশিয়া সফর। গত বছর রাশিয়ার হেলসিঙ্কি সফরে গিয়ে ট্রাম্প ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সম্পূর্ণ গোপন পরিবেশে মিটিং করেন। সেই মিটিংয়ে শুধুমাত্র ট্রাম্প, পুতিন ও ট্রাম্পের দোভাষী ম্যারিনা গ্রোস ছাড়া কেউ উপস্থিত ছিলো না। প্রেসিডেন্ট তো দূরের কথা, আমেরিকার ইতিহাসে কোনো আমেরিকান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রাশিয়ান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে এরকম একাকী মিটিং করার কোনো নজির নেই। পাশাপাশি সেই মিটিংয়ে কী আলোচনা হয়েছে সেই নিয়েও বোদ্ধা মহলে রয়েছে বিস্তর জিজ্ঞাসা।
রাশিয়া সফরের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পুতিনের সাথে ট্রাম্প চারবার সাক্ষাৎ করেছেন। প্রতিবারই তিনি বৈঠকের কোনো ধরনের রেকর্ড রাখেননি। ট্রাম্প চাইলেই এরকম করতে পারেন কি না সে বিষয় নিয়েও আইনী আলোচনা রয়েছে।
গত মাসে ওয়াশিংটন পোস্ট দাবি করে, রাশিয়া সফরে পুতিনের সাথে মিটিং শেষে ট্রাম্প দোভাষীর কাছ থেকে নোটগুলো রেখে দেন। তার মানে, ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে কী আলাপ হয়েছে এ ব্যাপারে আর কোনো রেকর্ড কারো কাছে নেই। কেন ট্রাম্প এরকম করছেন, তিনি কী লুকাতে চাইছেন- এসব নিয়ে প্রশ্ন দিন দিন বাড়ছেই। আমেরিকান রাজনৈতিক অঙ্গন ও মিডিয়া এখন খোলাখুলি ট্রাম্পকে রাশিয়ান এজেন্ট/অপারেটিভ বলে অভিযুক্ত করতে শুরু করেছে। এমনকি এফবিআই এ বিষয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গোপন তদন্তও করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের দৃষ্ঠান্ত বিরল।
অনেকদিন ধরে কথা হচ্ছিল, ট্রাম্প-পুতিনের মিটিংয়ের একমাত্র স্বাক্ষী সেই দোভাষী ভদ্রমহিলাকে কংগ্রেস হয়তো সাপিনা করবে (সাপিনা হচ্ছে শপথের অধীনে জেরা করতে ডাকা)। ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টের পর এ আলোচনা এখন নতুন করে হাওয়া পেয়েছে। এখন মনে করা হচ্ছে, অনুবাদক ম্যারিনা গ্রোসকে কংগ্রেস জিজ্ঞাসাবাদ করতে ডাকবে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে কাজ করার অভিযোগ কেন উঠছে- এ ব্যাপারে কয়েকটি থিওরি রয়েছে। প্রথম থিওরি হচ্ছে, রাশিয়া ট্রাম্পকে নির্বাচনে জয়ী হতে সাহায্য করেছে। এ অভিযোগটি একসময় অনুমানের পর্যায়ে থাকলেও এখন এটি অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত। এ কাজের জন্য ট্রাম্পকে জেলে যেতে হবে কি না তা নির্ভর করে ট্রাম্প নিজে আঁতাতের সাথে জড়িত ছিলেন কি না বা এই আঁতাত তার জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে কি না তার উপর।
এফবিআই তদন্তে রাশিয়া আঁতাতের সাথে ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের যাদের সংযোগ পাওয়া গেছে, তারা যখন আঁতাত বিষয়ক আলাপ করছিলো, সেখানে ট্রাম্প উপস্থিত ছিলেন কি না তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এমন একটি দৃষ্টান্তও যদি পাওয়া যায়, যেখানে ট্রাম্পের উপস্থিতিতে আঁতাত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তার মানে ট্রাম্প এই আঁতাতের ব্যাপারে অবগত ছিলেন ও এর অংশ ছিলেন। ট্রাম্পকে ইনডাইট বা দোষী সাব্যস্ত করতে এটুকু প্রমাণই যথেষ্ট। যদিও এখন পর্যন্ত ট্রাম্প আঁতাতে জড়িত থাকার ব্যাপার দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করছেন। কিন্তু প্রমাণ ও লক্ষণ ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ট্রাম্প রাশিয়া দ্বারা কম্প্রোমাইজড হবার ব্যাপারে আরেকটি শক্ত ও সম্ভাব্য থিওরি হচ্ছে ট্রাম্পের ব্যাপারে রাশিয়ার কাছে কম্প্রোমাইজিং কোনো ম্যাটেরিয়াল রয়েছে, যা দিয়ে রাশিয়া ট্রাম্পকে ব্ল্যাকমেইল করছে। কথিত আছে, প্রেসিডেন্ট হবার পূর্বে ট্রাম্প বিভিন্ন সময় ব্যবসার কাজে যখন রাশিয়া গিয়েছিলেন তখন তিনি হোটেলে দেহব্যবসায়ী নারী এনে নানা অশালীন কর্মকান্ড করেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘গোল্ডেন শাওয়ার’। গোল্ডেন শাওয়ারের ক্ষেত্রে একজন লোক উলঙ্গ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকেন ও পতিতারা তার গায়ে প্রস্রাব করেন। ধারণা করা হয়, ট্রাম্প ভবিষ্যতে প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন ভেবে (ট্রাম্প ভবিষ্যতে নির্বাচন করতে পারেন এই আলোচনা আমেরিকায় অনেক আগে থেকেই চালু ছিলো) রাশিয়া গোপনে ট্রাম্পের গোল্ডেন শাওয়ারের মূহুর্ত ভিডিও করে রাখে ও সেটি দিয়ে এখন ট্রাম্পকে ব্ল্যাকমেইল করছে। এই অভিযোগ কতটুকু সত্য সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে মন্তব্য করা কঠিন। তবে সাধারণ ধারণা, ঘটনা সত্যি।
ট্রাম্প রাশিয়া দ্বারা কম্প্রোমাইজড হবার পক্ষে সর্বশেষ থিওরি, রাশিয়াতে ট্রাম্পের রিয়েল এস্টেট বিজনেস থাকায় বিভিন্ন ন্যাশানাল পলিসিতে তিনি রাশিয়াকে ফেভার করছেন। একই অভিযোগ সৌদি আরবের প্রতি তার আচরণের বেলায়ও রয়েছে। খাশোগজি হত্যাকান্ডের পর সৌদি আরবের ব্যাপারে ট্রাম্পের নমনীয় মনোভাবের পেছনে অনেকে সৌদি আরবে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ব্যবসা থাকাকে দায়ী করেন। ট্রাম্প নিজেও বিভিন্ন সময় বেফাঁস কথাবার্তা বলে এমন দাবির স্বপক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন।
নির্বাচন জালিয়াতি
আমেরিকার নির্বাচনে খরচ চালানোর জন্য ক্যাম্পেইনগুলোকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা অর্থসাহায্য বা ডোনেশন দিয়ে থাকে। এই ডোনেশন লেনদেনের ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, প্রাথমিক নির্বাচন ও সাধারণ নির্বাচন মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২৭,০০০ + ২৭,০০০ = ৫৪,০০০ ডলার ইন-কাইন্ড ডোনেশান লেনদেন করা যাবে। একজনের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি ডোনেশান লেনদেন করা অবৈধ। অন্যদিকে, নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো তথ্য গোপন করার প্রচেষ্টাও নির্বাচনী আইনে অবৈধ। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে দুটি অভিযোগই রয়েছে।
স্টর্মি ড্যানিয়েলস নামের এক পর্ণ তারকার সাথে ট্রাম্পের শারীরিক সম্পর্ক থাকার তথ্য গোপন রাখতে নির্বাচনের আগে ট্রাম্প ক্যাম্পেইন স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য ১,৩০,০০০ ডলার হাশ মানি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। যদিও লেনদেনটি তার আইনজীবী মাইকেল কোয়েন সম্পন্ন করেন। তবে এ ঘটনার সাথে ট্রাম্পের যোগসাজশ পাওয়া গেলে তাকেও জেলের ঘানি টানতে হবে। ট্রাম্প যদিও এ ধরনের লেনদেন সম্পর্কে অবগত থাকার কথা অস্বীকার করে আসছেন। আবার হুটহাট স্বীকারও করে ফেলছেন!
এ বিষয়ে তদন্তের স্বার্থে এফবিআই গত বছর মাইকেল কোয়েনের অফিসে হানা দেয়। তারপরই থলের অনেকগুলো বিড়াল বেরিয়ে আসে। এমনিতে মাইকেল কোয়েন জীবনভর ট্রাম্পের বিশ্বস্ত চরের ভূমিকা পালন করলেও এফবিআইয়ের হাতে ধরা পড়ার পর তথ্য দিতে শুরু করলে ট্রাম্প তাকে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেন। এরপর মাইকেল কোয়েন এফবিআইয়ের কাছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সবকিছু বলে দেয়ার ঘোষণা দেন। পাশাপাশি, তিনি কংগ্রেসের সামনে পাবলিকলি সাক্ষ্য দেয়ারও সিদ্ধান্ত নেন। মাত্র কিছুদিন আগে, ২৭ ফেব্রুয়ারি, কোয়েন কংগ্রেসের সামনে পাবলিকলি স্বাক্ষ্য প্রদান করেন।
শুনানীতে অবশ্য কোয়েন রাশিয়া আঁতাত সম্পর্কিত তেমন কোনো তথ্য দেননি। যদিও এক ফাঁকে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছেলে এরিক ট্রাম্প তার বাবার কানে কানে কোনো এক মিটিং নির্ধারণ করার বিষয়ে জানিয়েছিলো, যা কোয়েন শুনতে পেয়েছেন। কোয়েনসহ সবার ধারণা, মিটিংটি ছিলো নির্বাচনের পূর্বে রাশিয়ানদের সহায়তা চাওয়ার মিটিং। কোয়েনের দাবি সত্যি প্রমাণিত হলে রাশিয়া আঁতাতের সাথে যুক্ত থাকা বা ট্রাম্পের গোচরে রাশিয়ান আঁতাত সংঘঠিত হবার অভিযোগে ট্রাম্প, তার ছেলে ও তার ক্যাম্পেইনের সকলেই ফেঁসে যাবে।
মাইকেল কোয়েনের শুনানীতে উঠে আসা অভিযোগগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে, সেখানে ট্রাম্প আর্থিক জালিয়াতির সাথে জড়িত থাকার স্বপক্ষে কিছু তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। রাশিয়া আঁতাত ধরনের অপরাধ প্রমাণ করা অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি বিষয় হলেও আর্থিক জালিয়াতি প্রমাণ করা পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজগুলোর একটি। সুতরাং ট্রাম্প এমন কিছুর সাথে জড়িত থাকলে আজ হোক, কাল হোক সেটা প্রমাণ হবেই।
যেহেতু, প্রথমত, নির্বাচনের ফলাফল প্রভবিত করতে পারে এমন বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখার জন্য টাকা দেয়া অবৈধ, এবং দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে ৫৪,০০০ ডলারের বেশি ইন-কাইন্ড ডোনেশন নেয়া অবৈধ, তাই এ কাজটি ট্রাম্পকে অনেকটাই ঘুরিয়ে-পেচিয়ে করতে হয়।
প্রথমত, কোয়েন স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে হাশ মানির ১,৩০,০০০ ডলার দিয়ে দেন। তারপর বিভিন্ন সময় একে একে ১৩টি চেকের মাধ্যমে ট্রাম্প কোয়েনকে এই টাকা ফেরত দেন। সেসব চেকের একটিতে ট্রাম্প জুনিয়র ও একটিতে ট্রাম্পের নিজের স্বাক্ষর রয়েছে। কংগ্রেসের কাছে শুনানীতে কোয়েন এই চেকগুলোর দুটো কপি উপস্থাপন করেন, যেগুলোতে ট্রাম্প ও তার ছেলের স্বাক্ষর রয়েছে। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, এই ১,৩০,০০০ ডলার ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনাটি ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ থেকে বা নির্বাচিত অবস্থায় করেছেন, যা সরকারি অফিসের অপব্যবহার ও ইম্পিচেবল অফেন্স বটে।
ব্যাংক জালিয়াতি
নির্বাচনে হাশ মানি পরিশোধ করা যেহেতু অপরাধ, এবং এই অর্থের পরিমাণ ৫৪,০০০ ডলারের বেশি হওয়া যেহেতু আরেকটি অপরাধ, ফলশ্রুতিতে কোয়েনকে হাশ মানির ১,৩০,০০০ ডলার ফিরিয়ে দেয়ার কথা যেহেতু স্বীকার করা যাবে না, তাই ব্যাংক চেকের মেমোতে ট্রাম্প উল্লেখ করেন, মাইকেল কোয়েনকে এই টাকা আইনী সহায়তার ফি হিসেবে দেয়া হচ্ছে। তবে এখন কোয়েন স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন, এই টাকা আইনী সহায়তার ফি নয়, বরং স্টর্মি ড্যানিয়েলসের মুখ বন্ধ রাখার জন্য দেয়া হয়। এ অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে, হাশ মানি পরিশোধ করার পাশাপাশি লেনদেনের প্রকৃত কারণ গোপন করার কারণে ট্রাম্প ফাইন্যান্স ফ্রড ক্রাইমের মধ্যেও পড়ে যাবেন।
অন্যদিকে, অন্য আরেকটি চেকে যেহেতু ট্রাম্পের ছেলে এরিকের স্বাক্ষর রয়েছে, সেহেতু তাকেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হবে। যদিও ট্রাম্প চাইলে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতাবলে এরিককে ক্ষমা করে দিতে পারেন। সমস্যা হচ্ছে, এরিক যে স্টেটের ব্যাংকে চেকটি স্বাক্ষর করেছেন, সেই স্টেট নিউ ইয়র্কের আইন অনুযায়ী, কেউ স্টেট ক্রাইম করলে তাকে প্রেসিডেন্টও ক্ষমা করতে পারেন না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, রাশিয়ান আঁতাতের সাথে যোগসাজশ প্রমাণ করা সম্ভব না হলেও নির্বাচন ও আর্থিক জালিয়াতির সাথে জড়িত থাকার অপরাধে ট্রাম্প ও তার ছেলে এরিককে হয়তো জেলে যেতে হবেই।
মিথ্যা স্বাক্ষ্য
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত যতগুলো অভিযোগ উপরে আলোচনা করা হয়েছে, প্রত্যাশিতভাবেই এর সবকিছু পাবলিকলি ও তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে ট্রাম্প অস্বীকার করেছেন। বিপদ হচ্ছে, এই অস্বীকার করার সময় যদি তিনি কোনো মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকেন বা যেকোনো ধরনের মিথ্যা বলে থাকেন, যা খুব সম্ভবত তিনি অসংখ্যবার বলেছেন, তাহলে তাকে পারজুরি বা লাইং আন্ডার ওথ অপরাধের কারণেও অভিযুক্ত হতে হবে, যা ফেলনি ও বড় ধরনের অপরাধ। মোট কথা, উত্থাপিত প্রতিটি অভিযোগ শাখের করাতের মতোই ট্রাম্পকে আসতেও কাটছে, যেতেও কাটছে!
বিবিধ
এসব অভিযোগের বাইরেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ট্যাক্স ও ইন্সুরেন্স জালিয়াতি, অর্থাৎ সুবিধামতো সম্পদ বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানোর, অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে স্বাক্ষীকে প্রভাবিত করা বা উইটনেস টেম্পারিংয়ের অভিযোগ। রয়েছে মাইকেল কোয়েনকে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দিতে নির্দেশনা দেয়ার অভিযোগ। এমনকি বিভিন্ন সময় তিনি তদন্ত বিষয়ে যেসব অসত্য তথ্য দিয়েছেন, অসত্য বক্তব্য (false statement) হিসেবে সেগুলোকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
শেষ কথা
ট্রাম্পের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে যারা জড়িত ছিলেন ও ট্রাম্পের হয়ে বিভিন্ন সময় যারা কাজ করেছেন, তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে নানা সময় নানা ধরনের অভিযোগ এসেছে ও সেসব অভিযোগের তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র মাইকেল ফ্লিন, রজার স্টোন ও মাইকেল কোয়েনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেলে যেতে হয়েছে। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে ইনডাইট বা দোষী সাব্যস্ত করা যায় না বিধায় ট্রাম্প যতদিন প্রেসিডেন্ট থাকবেন ততদিন হয়তো তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে না, তবে গদি ছাড়ামাত্রই যে আইন তীব্রগতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দিকে ধেয়ে আসবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।