সিরিয়ার ইদলিবে সম্ভবত সংঘটিত হতে যাচ্ছে গত সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি। সেখানে অবরুদ্ধ প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের শেষ আশা ছিল গতকাল শুক্রবার ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সম্মেলনটি। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের দেওয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর তাদের সে আশা ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। গত সপ্তাহ থেকেই ইদলিবে সিরিয়া এবং রাশিয়ার যুদ্ধবিমান আক্রমণ শুরু করেছে। তেহরান সম্মেলন কার্যত ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে অনেকেই আশঙ্কা করছে, অচিরেই হয়তো ইদলিবে পূর্ণমাত্রার একটি সামরিক অভিযান শুরু হবে, যার ভয়াবহতা হয়তো আলেপ্পোর যুদ্ধকেও ছাড়িয়ে যাবে।
ইদলিব কেন গুরুত্বপূর্ণ?
২০১৫ সালে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর থেকেই বাশার আল-আসাদ ধীরে ধীরে প্রায় সমগ্র সিরিয়াতে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। গত বছরের জুলাই মাসে আস্তানা সম্মেলনে ইরান, রাশিয়া ও তুরস্ক যে চারটি ডি-এস্কেলেশন জোনের ব্যাপারে একমত হয়েছিল, একে একে সেগুলোর তিনটিও দখল করে ফেলার পর এই মুহূর্তে ইদলিবই হচ্ছে বাশার আল-আসাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা সিরিয়ার একমাত্র উল্লেখযোগ্য এলাকা। এর বাইরেও অবশ্য কুর্দিদের হাতে বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণ আছে, কিন্তু সেগুলো ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব পাশে অবস্থিত হওয়ায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকায় আপাতত সিরিয়ার সরকারের পক্ষে সেখানে অভিযান চালানো সম্ভব না। ইদলিবের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারার পরেই কেবল বাশারের পক্ষে কুর্দিদের দখলে থাকা এলাকার দিকে নজর দেওয়া সম্ভব হবে।
সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত ইদলিব আরেকটি কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘এম ফাইভ’ হাইওয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পড়েছে ইদলিবের উপর। জর্ডান থেকে সিরিয়ার ভেতর দিয়ে তুরস্ক পর্যন্ত যাওয়া এই হাইওয়েটির একমাত্র ইদলিবের অংশটিই এখন পর্যন্ত আসাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এছাড়াও তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় সময়ের সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী কুর্দি প্রধান আফরিনের মতো ইদলিবেও তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর তাই যত দ্রুত সম্ভব, যেকোনো উপায়ে এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া আসাদ সরকারের জন্য এবং সেই সাথে তার পৃষ্ঠপোষক ইরান ও রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইদলিবে কাদের বসবাস?
ইদলিবের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। কিন্তু এদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে শরণার্থী হিসেবে গত কয়েক বছরে ইদলিবে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এদের অধিকাংশই বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদেরকে সমর্থন দেওয়া সাধারণ জনগণ, যারা গ্রেপ্তার এবং হয়রানির শিকার হওয়ার ভয়ে আসাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় না গিয়ে একের পর এক বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা হয়ে শেষপর্যন্ত বিদ্রোহীদের দখলে থাকা সর্বশেষ এলাকা ইদলিবে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আবার এদের মধ্যে অনেকেই আছে, যারা নিজেরা কিংবা যাদের পরিবারের কোনো সদস্য আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশে নিয়েছিল, পরবর্তীতে শহরের পতনের পর কোনো সমঝোতার আওতায় আসাদের সেনাবাহিনী তাদেরকে ইদলিবে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
তবে এদের মধ্যে সাধারণ বিদ্রোহীদের পাশাপাশি বিভিন্ন জিহাদী সংগঠন, এমনকি আল-ক্বায়েদা এবং আইএস সদস্যদের পরিবারও আছে। বিশেষ করে ইদলিবের নিয়ন্ত্রণে যে প্রায় ৬০,০০০ সশস্ত্র বিদ্রোহী যোদ্ধা আছে বলে ধারণা করা হয়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রুপটি হচ্ছে হাইআত তাহরির আল-শাম, যারা মূলত আল-ক্বায়েদার সিরীয় শাখা আল-নুসরা ফ্রন্টের বিবর্তিত রূপ। এদের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১২ হাজার হলেও এরাই ইদলিবের সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রুপ এবং ইদলিবের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা এরা নিয়ন্ত্রণ করে। জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্র আরো আগে থেকেই এদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল, অতি সম্প্রতি তুরস্কও এদেরকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করেছে।
ডি-এস্কেলেশন জোন কেন কাজ করছে না?
Turkey, Iran and Russia joint statement following Tehran summit.
No mention of ceasefire in Idlib, there is also no mention of any tangible mechanism to prevent bloodshed in the area
Via @asliatbas pic.twitter.com/k2VJlkTAGO— Ragıp Soylu (@ragipsoylu) September 7, 2018
কাজাখস্থানে অনুষ্ঠিত আস্তানা সম্মেলনে ইরান, রাশিয়া এবং তুরস্কের প্রতিনিধিরা একমত হয়েছিলেন যে, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা চারটি এলাকায় সংঘর্ষ বন্ধ থাকবে। বিদ্রোহীরাও কোনো আক্রমণ করবে না, সরকার পক্ষ কিংবা রাশিয়া বা ইরানও কোনো বিমান হামলা বা ক্ষেপনাস্ত্র আক্রমণ করবে না। এই চারটি এলাকা ছিল উত্তর হোমস, পূর্ব ঘুতা, দেরা ও কুনিয়েত্রা এবং ইদলিব। কিন্তু সিরিয়া ও রাশিয়া একে একে চারটি এলাকাতেই তীব্র আক্রমণ করে সেগুলো দখল করে নিয়েছে। বাকি আছে শুধু ইদলিব। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আসাদের সেনাবাহিনী এবং ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী ইদলিবের চারপাশে সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করছে। শুরু হয়েছে বিমান হামলাও।
বাশার আল-আসাদ স্বাভাবিকভাবেই সিরিয়ার প্রতিটি ইঞ্চি মাটি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে বদ্ধ পরিকর। সেই সাথে তার প্রধান সহযোগী রাষ্ট্র ইরান এবং রাশিয়াও। কিন্তু তারপরেও ইরান এবং রাশিয়া তুরস্কের সাথে আস্তানা সম্মেলনে একমত হয়েছিল এই কারণে যে, সে সময় সবেমাত্র মার্কিন সমর্থন পাওয়া কুর্দিরা বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গী সংগঠন আইএসকে পরাজিত করে সেসব এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছিল। কাজেই সে সময় রাশিয়াও চেয়েছিল সাধারণ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ স্থগিত রেখে আইএসের উপর আক্রমণ করে কিছু এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। পরবর্তীতে আইএস প্রায় সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হওয়ায় রাশিয়া পুনরায় বিদ্রোহীদের দখলে থাকা এলাকাগুলো মুক্ত করার ব্যাপারে আসাদের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে শুরু করে, ফলে ডি-এস্কেলেশন জোনের ধারণাটি অর্থহীন হয়ে পড়ে।
কী ঘটতে পারে ইদলিবে?
The Latest: Witnesses say warplanes strike Syria’s Idlib. https://t.co/AmJh74blc8
— The Associated Press (@AP) September 7, 2018
তেহরান সম্মেলনের আগে আশা করা হচ্ছিলো, প্রধানত তুরস্ক এবং রাশিয়া যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে একটি সমঝোতায় আসতে পারবে। কিন্তু সম্মেলনে সেরকম আশাব্যঞ্জক কিছু ঘটেনি। তুরস্ক হয়তো তারপরেও চেষ্টা করে যাবে যেন আলেপ্পো বা পূর্ব ঘুতার মতো ইদলিবে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ করা না হয়, সে ব্যাপারে রাশিয়াকে রাজি করাতে। কারণ এই যুদ্ধে তুরস্কেরই সবচেয়ে বড় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদিও এই মুহূর্তে তুরস্ক সীমান্ত বন্ধ করে রেখেছে, কিন্তু পূর্বের মতো ভয়াবহ আক্রমণ শুরু হলে শেষপর্যন্ত বিপুল সংখ্যক ইদলিববাসী অন্য কোনো কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে সীমান্ত সংলগ্ন তুরস্কের দিকেই যাত্রা করবে।
রাজনৈতিক সমঝোতা, কিংবা বেসামরিক জনগণ যারা বেরিয়ে যেতে ইচ্ছুক, তাদেরকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়েই যদি আক্রমণ শুরু করা হয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী এই যুদ্ধে অন্তত আট লাখ মানুষ গৃহহীন হতে পারে। প্রায় অবরুদ্ধ শহরটি এমনিতেই খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকটে ভুগছে। নতুন করে আক্রমণে সরাসরি মৃত্যু ছাড়াও পুষ্টিকর খাদ্য এবং জরুরি চিকিৎসার অভাবে প্রচুর মানুষ মারা যেতে পারে।
People in the #Idlib region are preparing for an expected strike.
Millions of civilians could soon be caught in the crossfire, as Bashar Assad’s regime is preparing to retake control of Syria’s last rebel stronghold. pic.twitter.com/BWeK7CHDNR— DW News (@dwnews) September 7, 2018
এর আগে অন্যান্য শহরে সিরিয়া এবং তাকে সহায়তাকারী রাশিয়া ও ইরান ইচ্ছাকৃতভাবে স্কুল, হাসপাতাল ও বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস করেছিল। ইদলিবেও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না। জানুয়ারি মাসে ইদলিবের মা’আরাত আন্-নোমানের একমাত্র মাতৃসদন হাসপাতালটিও বিমান হামলায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও সিরিয়া অস্বীকার করলেও জাতিসংঘ এবং রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সংগঠন (OPCW) এর তদন্তে এর আগে সিরিয়াতে বিদ্রোহীদের উপর একাধিকবার রাসায়নিক গ্যাস আক্রমণের পেছনে সিরিয়ারস সরকারই দায়ী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর দক্ষিণ ইদলিবে সারিন গ্যাস প্রয়োগের ঘটনাও আছে, যেখানে অন্তত ৮০ জন নিহত হয়েছিল। এবারও আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিদ্রোহীদের পরাজয় ত্বরান্বিত করার জন্য তাদের উপর রাসায়নিক হামলা করা হতে পারে।
ইদলিবে যদি শুধু সাধারণ বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর অবস্থান হতো, তাহলেও হয়তো তুরস্ক আলোচনার মাধ্যমে রাশিয়া এবং ইরানের সাথে একটা সমঝোতায় যেতে পারত, যেন আক্রমণটা সীমিত হয়। কিন্তু হাইআত তাহরির শামের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে এবং তাদের আত্মসমর্পণ কিংবা বিলুপ্তির সম্ভাবনা না থাকার কারণে এর সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরেও তুরস্ক অতীতে তাহরির শামের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিলেও গত সপ্তাহে তাদেরকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করার মধ্য দিয়ে হয়তো রাশিয়াকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে ইদলিবকে মুক্ত করার নামে সিরিয়া, রাশিয়া এবং ইরান এখন সম্ভবত আগের মতোই পূর্ণশক্তিতে ইদলিব আক্রমণ করবে, যার মূল্য দিতে হবে সন্ত্রাসী নয় এরকম লক্ষ লক্ষ মানুষকেও।
আরও পড়ুন:
ইদলিবের ‘বিদ্রোহী’রা আসলে কারা?
Featured Image Source: Mohamed al-Bakour/ AFP