Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নভজ্যোৎ সিধু পাক সেনাপ্রধানকে আলিঙ্গন করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হলো?

মাস ঘুরতে না ঘুরতেই ফের একটি আলিঙ্গন আর তার সঙ্গে সঙ্গে ফের একটি বিতর্ক। গত জুলাই মাসে ভারতের সংসদে বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আচমকা আলিঙ্গন করলে সেই নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় ভারতজুড়ে।

আর আগস্টে ফের একটি আলিঙ্গন- এবারে দেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে ‘চিরশত্রু’র দেশ পাকিস্তানে আর সেখানে সেদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে জড়িয়ে ধরে স্বদেশে প্রবলভাবে ধিকৃত হলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং বর্তমানে পাঞ্জাব রাজ্যের ক্যাবিনেট মন্ত্রী নভজ্যোৎ সিং সিধু। চুয়ান্ন বছর বয়সী এই রাজনীতিক সেখানে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের শপথ অনুষ্ঠানে। পাকিস্তানে যাওয়া তো বটেই, সেখানে বাজওয়াকে আলিঙ্গন করা ছাড়াও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের ‘রাষ্ট্রপতি’ মাসুদ খানের পাশে বসা নিয়েও সিধুকে আক্রমণ করে ভারতীয় জনতা পার্টি সহ বিভিন্ন বিরোধী দলও।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী এবং পাঞ্জাব রাজ্যের মন্ত্রী নভজ্যোৎ সিং সিধু; Source: Twitter handle of Navjot Singh Sidhu @sherryontopp

মোদীকে আলিঙ্গন করে রাহুল গান্ধীকে যেমন অভিযুক্ত করা হয় সংসদের শিষ্টাচার ভঙ্গে, তেমনি সিধুকে ধিক্কার জানানো হয় দেশের ‘অবমাননার’ জন্য। বলা হয়, যেখানে পাকিস্তানী সেনা প্রতিনিয়ত উগ্রবাদীদের ভারতে পাঠায় ধ্বংসলীলা চালাতে আর তা আটকাতে গিয়ে প্রাণ দেন অসংখ্য জওয়ান, তাদের প্রধানের সঙ্গে আলিঙ্গনবদ্ধ হন সিধু কোন স্পর্ধায়?

সিধু দেশে ফিরে নিজের কর্মের সাফাই দিয়েছেন যথারীতি। বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে শান্তিকে জায়গা দিতে গেলে কোথাও একটা শুরু করতে হবে। তিনি এও বলেন যে, জেনারেল বাজওয়া যখন তার সঙ্গে করমর্দন করে ডেরা বাবা নানক-করতারপুর করিডোর তৈরির কথা বলেন, তখন কি তিনি মুখ ফিরিয়ে থাকতেন? সামনের বছর শিখ গুরু নানক দেবের ৫৫০তম জন্মতিথি উপলক্ষ্যে পাকিস্তানে অবস্থিত করতারপুর সাহিব পুণ্যতীর্থ পর্যন্ত যাওয়া নিয়ে পাঞ্জাবে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট উদ্যোগ-উদ্দীপনা চোখে পড়ছে। সিধুর কথায়, শিখদের কাছে অত্যন্ত সংবেদনশীল এই বিষয়টি নিয়ে যখন পাকিস্তানী সেনাপ্রধান তার সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি কীভাবে তা উপেক্ষা করবেন?

উপেক্ষা করা যায় না, অবশ্যই যায় না। সিধু যদি অন্য দুই প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার এবং কপিলদেবের মতো পাকিস্তানে যাওয়াটাই বাতিল করতেন, তাহলে কিছু বলার থাকতো না। কিন্তু তিনি যখন একজন অতিথি হিসেবে গিয়ে পড়েছেনই, তখন সেখানে নিমন্ত্রণকর্তাদের সঙ্গে কিছু শিষ্টাচার অবশ্যই মেনে চলতে হয়। এমনকি, তিনি কোথায় বসবেন সেটাও তিনি নিজে নির্ধারণ করতে পারেন না।

সম্প্রতি পাকিস্তানে গিয়ে সেদেশের সেনা প্রধান জেনারেল বাজওয়াকে আলিঙ্গন করে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন সিধু; Source: Twitter

আর এখানেই বিজেপি এবং অন্যান্য দলগুলি তাদের তাস খেলেছে। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে ফের আরেকবার পাকিস্তানকে আক্রমণ করার এরকম সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার কথা তারা ভাবতেই পারেনি। কারণ, নির্বাচনে জেতার জন্য জাতীয়তাবাদের মতো আর কোনো ফলপ্রসূ হাতিয়ার নেই, হতে পারে না। আর সেই ব্রহ্মাস্ত্রের কেউ যদি বিরোধিতা করার চেষ্টা করে থাকে, তো পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।

বিজেপির সুরে গান ধরলেন পাঞ্জাবের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রীও; কী-ই বা আর করবেন?

এই সারসত্যটি বুঝেছেন বলে খোদ পাঞ্জাবের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংও সিধুকে ঠুকেছেন এই বলে যে, যেখানে পাকিস্তান নিয়মিত ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, এদেশের জওয়ানদের লক্ষ্য করছে, তাদের সেনাপ্রধানকে আলিঙ্গন করে প্রাক্তন ক্রিকেটার ঠিক কাজ করেননি। পাঞ্জাবে কংগ্রেস গত বছরেই ক্ষমতায় এসেছে আর আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে যেখানে যাতে তারা পা পিছলে না পড়ে সেটা সুনিশ্চিত করতে ক্যাপ্টেন সাহেবকে যে এমনতর কিছু বলতেই হতো, তাতে আর আশ্চর্যের কী! আর তাছাড়া, গতবছরই বিজেপি থেকে কংগ্রেসে পা রাখা সিধুকে রাজনৈতিকভাবে সমালোচনা করাও বিশেষ কঠিন কাজ নয় পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে, কারণ সিধু সেভাবে নিজেকে একজন একনিষ্ঠ দলীয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এখনও প্রতিপন্ন করতে পারেননি।

কিন্তু এই সমস্ত ব্যাপারটিতে যেটা ভাবায় তা হলো, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে অ-সরকারি সম্পর্কের আদান-প্রদানের রাস্তাটি ছিল, তা ক্রমেই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট সম্পর্ক তো বন্ধ করা হয়েছেই, পাশাপাশি তাদের সঙ্গে সৃজনশীল শিল্পের ক্ষেত্রেও নিয়মিত বাধা দান করা হচ্ছে; সেখানকার শিল্পীদের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব চলুক, তা চলবেই; কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের আদান-প্রদানের উপরে চোখ রাঙানো আদতে উগ্রবাদকেই উজ্জীবিত করা এবং সেটা কাম্য নয়।

গত ১৮ আগস্ট পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন প্রাক্তন ক্রিকেটার ইমরান খান; Source: Twitter @KPKUpdates

অটলবিহারীর মৃত্যুর সময়ে সিধুও তার পথেই চলেছেন

যে অটলবিহারি বাজপেয়ীর মৃত্যুর শোক পালনের সময়ে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্যে সিধুর সমালোচনা করছে বিজেপি, সেই বাজপেয়ী কিন্তু তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে কম উদ্যোগ নেননি। তিনি সাফল্য পাননি; বারেবারেই তার উদ্যোগের উত্তরে ওয়াঘার ওপর থেকে এসেছে বিশ্বাসঘাতকতা- কিন্তু বাজপেয়ী তাতে টলে যাননি। নিজের রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকাতে অবিচল থেকেছেন। সেজন্যই তাকে মনে রেখেছে সীমানার দু’পারের মানুষই। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে শুধুই ক্ষুদ্র মানসিকতার বহর। পাকিস্তানী সেনা ভারতের বিরুদ্ধে যে পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছে দশকের পর দশক ধরে, তা নির্মূল করতে প্রয়োজন বড়সড় প্রতিরক্ষা নীতি এবং কূটনৈতিক অবস্থান। সেসব না করে শুধুমাত্র ‘সিধু কেন এমন করলেন’ জাতীয় প্রতীকী বিরোধিতা তুলে ধরে আদতে কিছুই প্রমাণিত হয় না। 

সিধু যদি পাকিস্তানী সেনাপ্রধানকে আলিঙ্গন করেই থাকেন, তাতে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে কোনো বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা অমূলক। সিধু ভদ্রতার খাতিরে বাজওয়ার হাত ধরতেই পারেন, তার সঙ্গে ভারত বা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সিধু ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব তো আর করেননি সেখানে। তিনি গিয়েছেন তার একদা সহ-খেলোয়াড় ইমরান খানের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে।

সমস্যা হচ্ছে, ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের এগিয়ে চলার পথ সবদিক থেকেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর সেটা দুই দেশের কারোরই পক্ষে সুলক্ষণ নয়।

বাজপেয়ী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির শীর্ষ নেতা হয়েও সেটা বুঝেছিলেন বলেই পাকিস্তানের সঙ্গে বারংবার বন্ধুত্বের হাত বাড়িতে দিয়েছিলেন। ২০০১ সালে কার্গিল যুদ্ধের অন্যতম হোতা পারভেজ মোশারফের সঙ্গে আগ্রায় শীর্ষ সম্মেলনও করেছেন তিনি। ২০০২ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় আরেকটি যুদ্ধের পরিস্থিতি হওয়া সত্ত্বেও ২০০৪ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে পাকিস্তানে একটি পূর্ণ সিরিজ খেলার ছাড়পত্রও দিয়েছিল তার সরকার।

ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী; Source: Twitter @jitkhatrri

বিজেপির একজন প্রাক্তন শীর্ষ নেতা যদি এই পদক্ষেপ নিতে পারেন, তাহলে বর্তমানে তাদের ছোট-বড় নেতাদের সিধুর পাকিস্তান সফর নিয়ে এত গায়ে ফোস্কা পড়ছে কেন তা বোধগম্য হয় না। তবে এটা পরিস্কার হয় যে, পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে মৈত্রীর নীতি ভারতের বর্তমান নেতৃত্ব নিতে আর উৎসাহী নন বিশেষ। সেটিও বেশ দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে।

সর্বগ্রাসী রাজনীতিকরণ প্রভাব ফেলেছে ভারত-পাক সম্পর্কের উপর

এই সর্বগ্রাসী রাজনীতিকরণের ফলে এখন ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যপন্থী সম্পর্ক স্থাপনের পথ সংকুচিত হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশী যেমন বদলানো যায় না, তেমন নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তার সাথে সম্পর্ক সহজ রাখার প্রয়োজন রয়েছে। আগ্রাসী মনোভাবে শত্রুমনোভাবাপন্ন প্রতিবেশীরই আখেরে লাভ হয়। সিধু একটা ছোট্ট সুযোগ আমাদের করে দিয়েছেন ফের বন্ধুত্বের পথে এগোতে। পাকিস্তানে এক নতুন সরকার এসেছে। তারও শান্তির লক্ষ্যে কিছু করার তাগিদ থাকবে। তাই এই সময়ে সম্পর্ক ভালো করার এই বড় সুযোগটি হাতছাড়া করা ভারতীয় নেতৃত্বের উচিত হবে না। কিন্তু ওই যে ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষণ সীমান্তের দু’পারেই; আর তাতেই বিশ বাওঁ জলে সমস্ত উদ্যোগ-উৎসাহ।

Featured Image Source: DNA India

Related Articles