১৫২২ সাল থেকে প্রায় দুশো বছর স্প্যানিশ উপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল ভেনিজুয়েলা। প্রথমে স্পেনিশদের সাথে যুদ্ধ করে আর পরে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ভেনিজুয়েলার স্বাধীনতা আসে ১৮৩০ সালে। এরপর একটা দীর্ঘ সময় ভেনিজুয়েলা স্বৈরশাসনের অধীনে ছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রভাব বিস্তার করেছিল স্থানীয় সামরিক গোষ্ঠীর নেতারাও।
ভেনিজুয়েলায় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়, প্রবর্তিত হয় দুই দলীয় ব্যবস্থা। এরপর একটা দীর্ঘ সময় ভেনিজুয়েলার রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয় থার্ড ওয়ে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি আর মধ্যপন্থী বাম দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক।
কিন্তু, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতি বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে। এর মধ্যে আশি আর নব্বইয়ের দশকে দু’টি অর্থনৈতিক সঙ্কট টালমাটাল করে দেয় অর্থব্যবস্থা, ৮৯-তে হয় ভয়াবহ দাঙ্গা। এর মধ্যেই দুর্নীতি আর বৈষম্য দূর করতে সামরিক বাহিনীর একটা অংশ বিদ্রোহ করে ১৯৯২ সালে। ব্যর্থ সেই বিপ্লবকে নেতৃত্ব দেওয়া লেফটেন্যান্ট কর্নেল হুগো শ্যাভেজ দ্রুতই হয়ে উঠেন নাগরিকদের প্রত্যাশার প্রতীক ।
মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া হুগো শ্যাভেজের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষক, সাত ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা শ্যাভেজ শৈশবে খুব কাছ থেকে দেখেছেন ভেনিজুয়েলার দারিদ্র্য আর বৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষদের। ফলে, সতেরো বছর বয়সে ১৯৭১ সালে শ্যাভেজ যখন সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন, মিলিটারি কারিকুলাম ‘আন্দ্রেস বেলো প্ল্যান’ তাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে।
ফলে, মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশনড হয়ে শ্যাভেজ পড়াশুনা শুরু করেন ইতিহাস নিয়ে, আকৃষ্ট হন জমুরা, বলিভিয়ার আর রুদ্রিগেজের মতাদর্শের প্রতি। ভেনিজুয়েলাকে বদলে দেওয়ার স্বপ্নটা তখন থেকেই দেখতে শুরু করেন।
পরিবর্তনের স্বপ্ন থেকেই সামরিক বাহিনীতে তৈরি করেন গোপন সংগঠন, MBR-200 নামে। তাদের নিয়ে শ্যাভেজ বিদ্রোহ করেন ১৯৯২ সালে। বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়, তাকে সঙ্গীসহ কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। কিন্তু এই ব্যর্থতাই তাকে নায়ক বানিয়ে দেয়। দারিদ্র্য আর বৈষম্যের ভারে ক্লান্ত ভেনিজুয়েলার নাগরিকদের মধ্যে তিনি দ্রুতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
দু বছর পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দ্রুতই রাজনৈতিক দল গঠন করেন, জড়িয়ে পড়েন দেশব্যাপী জনসংযোগে। ফলাফল পান ১৯৯৮ এর নির্বাচনে, ৫৬.২ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
শ্যাভেজের যুগে ভেনিজুয়েলা
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই তেলের খনি আবিষ্কৃত হয় ভেনিজুয়েলায়, পুরো শতাব্দী জুড়েই এসেছে তেল রাজস্ব। কিন্তু স্বৈরশাসক আর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের দ্বারা শাসিত হওয়া ভেনিজুয়েলার নাগরিকদের বাড়েনি জীবনমান, তেল রাজস্বের সিংহভাগ গেছে আমলা আর শাসকদের পকেটে। এই বৈষম্য আর দারিদ্র্যর ভেনিজুয়েলাতেই পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন হুগো শ্যাভেজ।
বলিভিয়ান বিপ্লব
হুগো শ্যাভেজ ক্ষমতার আসার সময়ই আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পায় তেলের দাম, ব্যাপক রাজস্ব আয় পেতে থাকে ভেনিজুয়েলা। শ্যাভেজ এই রাজস্ব আয় দিয়ে শুরু করেন বলিভিয়ান বিপ্লব। সামরিক বাহিনীকে যুক্ত করেন এই কাজে, জনগণের কাছে সামরিক বাহিনীকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন উন্নয়ন আর নিরাপত্তার ধারক হিসেবে। সামাজিক সাম্য, সমাজকল্যাণ আর দারিদ্রতা দূরীকরণের লক্ষ্যে বলিভিয়ান রেভ্যুলেশন প্রোগ্রামে যুক্ত করা হয় মৌলিক অধিকারগুলো, নিশ্চয়তা তৈরির চেষ্টা করা হয় নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে।
মিশন রবিনসনের মাধ্যমে বয়স্কদের বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়, নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় মিশন রিবাসের মাধ্যমে। হাইস্কুল ড্রপ আউটদের নতুন করে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, বিনামূল্যে করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাও।
দরিদ্রতাকে খুব কাছ থেকে দেখার কারণেই শ্যাভেজ বলিভিয়ান রেভ্যুলেশনের যুক্ত করেছিলেন সকলের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের অধিকার। নিরাপদ আর ভেজালমুক্ত খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন সবার জন্য। যদিও এই প্রকল্পের মাধ্যমে বৈদেশিক খাবারের প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে, স্থূলতাজনিত বিভিন্ন রোগ আক্রান্তের হার বেড়েছে।
স্বাস্থ্যসেবাকেও তিন ধাপে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন শ্যাভেজ, অনুমোদন করেছিলেন মিশন বারিও আদেন্ত্রো। বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ছিল পশুপাখিদের জন্যও, নির্যাতনের শিকার হওয়া বিভিন্ন পশুপাখির জন্যও। বলিভিয়ান রেভ্যুলেশনের অংশ ছিলো দরিদ্রের জন্য আবাসন প্রকল্প, ২০১১ সালে আরো বর্ধিত হয় এই প্রকল্প। এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ভূমিসংস্কার প্রকল্পও, বড় বড় এস্টেটগুলোকে চেষ্টা করেছিলেন কৃষিজমিতে রূপান্তরের। ভূমিহীন কৃষকদের চেষ্টা করেছিলেন ভূমি ব্যবস্থাপনার অংশ করার।
বলিভিয়ান রেভ্যুলেশনের অংশ হিসেবে শ্যাভেজ প্রাপ্তবয়স্কদের আধুনিক পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করেছিলেন, যার মাধ্যমে সহজ হয়েছিলো বিভিন্ন নাগরিক সুবিধার কার্যক্রম। পরিবেশ রক্ষায়ও করেছেন বিনিয়োগ, বরাদ্দ বাড়িয়েছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মকাণ্ডেও। নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গঠন করেছিলেন সিভিল মিলিশিয়া বাহিনী।
সংবিধান সংশোধন
১৯৯৮ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই শ্যাভেজ উদ্যোগ দেন সংবিধান পরিবর্তনের। রাষ্ট্রের নাম ‘রিপাবলিক অব ভেনিজুয়েলা’ থেকে করেন ‘বলিভিয়ান রিপাবলিক অভ ভেনিজুয়েলা’। শাসনকাজে সুবিধার জন্য সরকারকে ভাগ করেন পাঁচটি অংশে। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগের সাথে স্বতন্ত্র অংশ হিসেবে যোগ করেন নির্বাচন বিভাগ ও নাগরিক অংশগ্রহণকে। দ্বি কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টকে করেন এক কক্ষবিশিষ্ট, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন নাগরিক সুবিধাকে করেন বিনামূল্যে। সংবিধান সংশোধন ছিলো হুগো শ্যাভেজের কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা চেষ্টার প্রথম ধাপ।
সময় যতই গড়িয়েছে, হুগো শ্যাভেজ ততটাই সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছেন, যার ফলাফল ২০০৭ সালে সংবিধান পরিবর্তনের চেষ্টা। প্রেসিডেন্টের টার্ম লিমিট তুলে দিতে চেয়েছিলেন তিনি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্টের। বাড়াতে চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্টের প্রতি টার্মের মেয়াদ, স্থানীয় প্রশাসনিক কাঠামোগুলোতে চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্টের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। এর সাথে ছিল ভোটার হওয়ার বয়স কমিয়ে দেওয়া, কমিয়ে দেওয়া কর্মঘণ্টাও।
হুগো শ্যাভেজের একমাত্র পরাজয় হয় ২০০৭ সালের গণভোটে, জনগণ কর্তৃত্ববাদের বদলে বেছে নেয় গণতন্ত্রকেই। ২০০৯ সালের গণভোটে পরিবর্তনগুলোর কিছুটা বাস্তবায়িত হয়েছে, উঠে গেছে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত হওয়ার টার্ম লিমিট। হুগো শ্যাভেজ এরপরও চেষ্টা করেছেন দেশকে সমাজতান্ত্রিক করার, কলিম্বিয়ার শাসক সিমন বলিভিয়ারের প্রতি অন্ধভক্তি ছিলো যার চালিকাশক্তি।
ভেনিজুয়েলার নতুন পররাষ্ট্রনীতি
ক্ষমতাই এসেই শ্যাভেজ খোলনলচে বদলে দেন ভেনিজুয়েলার পররাষ্ট্রনীতি। শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ঘন যাতায়াত থাকলেও দ্রুতই তিনি নিজেকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু করেন। বিরোধী ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত নব্য উদারবাদেরও। ফলে, আন্তর্জাতিক পরিসর সম্পর্ক গড়ে তোলেন মার্ক্সিস্ট-লেনিনপন্থী কিউবার সাথে, সম্পর্ক উন্নয়ন হয় বলিভিয়া, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়ার মতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সাথেও। লক্ষ্য ছিলো, নতুন আঞ্চলিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করা।
ক্যারিবিয়ান ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন চালিয়ে যান শ্যাভেজ, আমদানিনির্ভর দেশগুলোকে তেল সরবারাহ করেন কম মূল্যে। জোর দেন পারস্পরিক সম্পর্কবৃদ্ধির উপর। শেষের দিকে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক উদ্যোগ নিয়ে শ্যাভেজ পরিণত হয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদীদের চক্ষুশূলে।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে শ্যাভেজ ভেনিজুয়েলায় নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন সামাজিক ন্যায্যতা, নিরাপত্তা আর সাম্য। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক কাঠামো আর প্রশাসনের কারণে সেগুলো অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে। এখন ডাচ ডিজিজের যে প্রভাব ভেনিজুয়েলায় দেখা যাচ্ছে, তার দায়ও আছে তার শাসনামলের।