১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চারটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাইয়ের শিকার হয়, ছিনতাই করা বিমানগুলোর মধ্যে প্রথম দুটি আঘাত হানে নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভবন দুটি বিধ্বস্ত হয়, ধোঁয়ার কুণ্ডলী তুলে মিশে যায় মাটির সাথে। তৃতীয়টি আঘাত হানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর পেন্টাগনে, চতুর্থ বিমানটি ভূপতিত হয় পেনসিলভেনিয়ায়।
নাইন ইলেভেন হিসেবে পরিচিত এই ঘটনায় সব মিলিয়ে মারা গিয়েছিল প্রায় তিন হাজারের মতো মানুষ। চারটি যাত্রীবাহী বিমানের সকলেই মারা যান, টুইন টাওয়ার থেকে মারা যান ২,৬০৬ জন মানুষ। হামলায় প্রাণ হারান পেন্টাগণের কর্মকর্তারাও, হামলার তাৎক্ষণীক ও পরে মিলিয়ে প্রাণ হারান পেন্টাগনের ১২৫ জন মানুষ। নিহত তিন হাজার মানুষের মধ্যে ছিল ৭৭ টি দেশের নাগরিক, যাদের বড় একটা অংশই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিভিন্ন কাজ করতেন। মোট ১৯ জন ছিনতাইকারী চারটি দলে বিভক্ত হয়ে এই হামলা চালায়, যাদের মধ্যে ১৫ জনই ছিল সৌদি আরবের নাগরিক।
নাইন ইলেভেনের হামলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দায়ী করে আল-কায়েদাকে, আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করা হয় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে। নাইন-ইলেভেনের ঘটনার এক মাসের মধ্যেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আফগানিস্তানে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন, শুরু হয় অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করা, আফগানিস্তানে আল-কায়েদার ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দেওয়া।
অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম
আল-কায়েদার সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি ছিল আফগানিস্তানে। ধারণা করা হচ্ছিল, আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনও তখন অবস্থান করছিলেন আফগানিস্তানেই। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যখন এই তথ্য নিশ্চিত করে, প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তখন আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবানদের সামনে দুটি বিকল্প উপস্থাপন করেন। হয় ওসামা বিন লাদেনসহ আল-কায়েদা সাংগঠনিক কাঠামোর সাথে যুক্ত সকলকে তালেবান শাসকেরা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিক, অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র পূর্ণশক্তি নিয়ে আফগানিস্তানে আক্রমণ করবে। তালেবান শাসকেরা দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নেন। ফলে, আফগানিস্তানে শুরু হয় অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম।
অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম শুরু হওয়ার এক মাসের মধ্যেই তালেবানরা কাবুল ছাড়তে বাধ্য হয়, আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ওসামা বিন লাদেনকে তাৎক্ষণিকভাবে ধরতে সক্ষম না হলেও, দুই মাসের মধ্যেই তালেবানদের সাংগঠনিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে যায়, আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত সরকার। তবে, যুদ্ধ চলতে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানে শুরু করে ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ নির্মাণের প্রক্রিয়া।
রাষ্ট্র নির্মাণের পদ্ধতি
ভূরাজনৈতিক কারণে আফগানিস্তান সবসময়ই বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ফ্রন্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ১৯৭৮ সাল থেকেই আফগানিস্তান পরাশক্তিগুলোর সরাসরি সংঘাতের শিকার হয়েছে। প্রতিনিয়ত সংঘাত আর যুদ্ধ আফগানিস্তানকে একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করে, আমলাতন্ত্র পরিণত হয় দুর্নীতির আখড়ায়। রাজনৈতিক বিভাজন সময়ের সাথে আফগানিস্তানে কেবল প্রকাশ্য হয়েছে, যুদ্ধবাজ নেতা আর জাতিগোষ্ঠীগুলো বাড়িয়েছে সেই বিভাজন। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদায়ের পরও আফগানিস্তানে প্রকৃত রাষ্ট্র গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি, বিকশিত হয়নি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আফগানিস্তানের ভৌগলিক অবস্থান একদিকে যেমন দেশটিকে বহু সভ্যতার মিলনস্থল বানিয়েছে, একইভাবে নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কাছেও।
রাষ্ট্রনির্মাণের তিনটি তাত্ত্বিক পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমত, হিস্টোরিক্যাল অ্যাপ্রোচ। প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ আর আধুনিক যুগে বিভক্ত হিস্টোরিক্যাল অ্যাপ্রোচ রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয় ভৌগলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক কাঠামো, সামাজিক প্রথা আর সাংস্কৃতিক ইভেন্টগুলোকে। এর পাশাপাশি গুরুত্ব পায় ধর্মীয় পরিচয় আর জাতিগত রাজনীতিও। অর্থাৎ, রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে জটিল প্রভাবকগুলোকে বিশ্লেষণ করে নীতি নির্ধারণ হয় হিস্টোরিক্যাল অ্যাপ্রোচে।
দ্বিতীয়ত, এক্সেজোনাস অ্যাপ্রোচ। এক্সেজোনাস অ্যাপ্রোচে রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া চলে একটি যুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্রে, যেখানে রাষ্ট্রকাঠামো দুর্বল, রাষ্ট্রকাঠামো নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছে না। এই প্রক্রিয়াতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে সামরিক বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করে, প্রয়োজনে পাঠায় শান্তিরক্ষী বাহিনী।
তৃতীয়ত, ডেভেলপমেন্টাল অ্যাপ্রোচ। ডেভেলপমেন্টাল অ্যাপ্রোচে রাষ্ট্র নিজেই রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ করে, কাজ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র অনুসরণ করে ওইসিডির ২০০৭ সালের নির্দেশিকাগুলো। রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ডেভেলপমেন্টাল অ্যাপ্রোচ একেবারেই রাষ্ট্রভিত্তিক ভিন্নতা অনুসরণ করে চলে, রাষ্ট্র নির্মাণ চলে রাষ্ট্র আর সিভিল সোসাইটির সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে।
আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এক্সেজোনাস অ্যাপ্রোচ অনুসরণ করেছে। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার পশ্চিমা মিত্রদের সাথে নিয়ে বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটায় আফগানিস্তানে, দেয় বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সাহায্য। গত বছর তালেবানদের ক্ষমতা নেওয়ার আগে, আফগানিস্তানের মোট জিডিপির এক-চতুর্থাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক সাহায্য, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সিভিল সোসাইটির কাঠামো আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
অর্থাৎ, আফগানিস্তানে রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্রই প্রথম’ অ্যাপ্রোচ অনুসরণ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটি আবার টপ-ডাউন এপ্রোচ নামেও পরিচিত। এটা অনুসারে, কোনো সামরিক বাহিনী যদি রাজনৈতিক সত্ত্বার উপর সামরিক কর্তৃত্ব আরোপ করতে পারে, তাহলে সামরিক বাহিনী সেই রাজনৈতিক কাঠামোর উপর নিজেদের ইচ্ছাকেও চাপিয়ে দিয়ে পারে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর অনেক জায়গাতে টপ-ডাউন অ্যাপ্রোচ সফর হলেও, রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাওয়া আফগানিস্তানে টপ-ডাউন অ্যাপ্রোচ ব্যর্থ হয়েছে, তৈরি করেছে সংঘাতের চক্র।
আফগানিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রঘেঁষা পলিটিক্যাল এলিটরা টপ-ডাউন অ্যাপ্রোচ গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রকে উৎসাহিত করেছে, যাতে তারা কাবুল থেকে পুরো আফগানিস্তানকে শাসন করতে পারে। কিন্তু, আফগানিস্তানের অধিকাংশ জায়গাতেই রাষ্ট্র অনুপস্থিত, স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব উঠে আসাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে, কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্রের সাথে স্থানীয় গ্রুপগুলোর অল্পই সম্পর্ক ছিল।
আফগানিস্তানে কেন রাষ্ট্র নির্মাণ শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র?
নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পর থেকে আফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতি শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের, শুরু হয় রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া। বেশ কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল।
প্রথমত, দুর্বল রাষ্ট্রগুলো কেবল সীমাহীন অনিয়ম আর দারিদ্র্যের কারণ হয় না আধুনিক যুগে, দুর্বল রাষ্ট্রগুলো কারণ হয় সন্ত্রাসবাদেরও। আফগানিস্তানের অধিকাংশ জায়গায় রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি স্বর্গভূমি করে রেখেছিল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র নির্মাণের প্রথম লক্ষ্যই ছিল অনুগত রাজনৈতিক শ্রেণিকে ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরি করা, যাতে আফগানিস্তান আর ‘যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী’দের বিচরণভূমি না হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল নাইন ইলেভেনের হামলার জন্য দায়ীদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডমের মাধ্যমে এক মাসের মধ্যে আফগানিস্তানে সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যুক্তরাষ্ট্র। ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতে আঘাত করতে না পারে, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থকে বিঘ্নিত করতে না পারে, সেই লক্ষ্যেই শুরু হয় আফগানিস্তানে রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া।
তৃতীয়ত, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আফগানিস্তানে বিভিন্ন পরাশক্তির আগমন ঘটেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে যেমন আফগানিস্তানে এসেছিল ইংরেজরা, বিংশ শতাব্দীতে আসে সোভিয়েতরা। একইভাবে, একবিংশ শতাব্দীতে আসে মার্কিনরা। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আফগানিস্তান থেকে একদিকে যেমন মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে নজরদারি সম্ভব, নজরদারি সম্ভব যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি ইরানেও। পাশাপাশি, দক্ষিণ এশিয়া আর চীনের বিরুদ্ধে গেটওয়ে হিসেবে কাজ করতে পারে আফগানিস্তানের ভূমি। ফলে, ভূরাজনৈতিক স্বার্থকে মাথায় রেখেই আফগানিস্তানে রাষ্ট্র নির্মাণ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আফগানিস্তানের নির্মাণ সফল হলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থই বাস্তবায়ন করতো।