Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নিগার জোহর খান: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম নারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল

মানুষের মধ্যে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল জীবন আর জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, প্রকৃতির রাজ্যের নৈরাজ্য থেকে বাঁচতে। নিরাপত্তার ধারণাকে সামনে রেখে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে, সামরিক বাহিনী তার একটি। ফলে, শত্রুর আক্রমণ থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সবসময় সম্মুখ ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছে, আবার শক্তিশালী সামরিক বাহিনী রাজ্যজয়ের মাধ্যমে রাজ্যের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ ঝুঁকিগুলোও মোকাবেলা করেছে।

সামরিক বাহিনীতে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পুরুষ সদস্যদের প্রাধান্য ছিল, সামাজিক কাঠামোর কারণেই নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব পুরুষদের দায়িত্ব হিসেবে মনে করা হতো। ফলে, সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে বীরত্বপূর্ণ অবদানগুলোর বেশিরভাগই পুরুষদের, সময়কে অতিক্রম করে যাওয়া যোদ্ধা আর জেনারেলদের অধিকাংশই পুরুষ। ফলে, ইতিহাসে জোয়ান অব আর্ক, রানি বৌডাকাহ্‌, প্রথম এলিজাবেথ, আর্টেমিসিয়ার মতো সফল নারী সামরিক নেতৃত্বের উদাহরণ থাকলেও, সামরিক বাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণ সংক্রান্ত আলোচনার বড় অংশ জুড়েই থাকবে আধুনিক যুগের সামরিক বাহিনীগুলো।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে নারী সদস্যরা; Image Source: Wikipedia.

লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিগার জোহর খান

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সামরিক বাহিনী। দেশটির সামরিক বাহিনীতে ৫ লাখ ৬০ হাজার সক্রিয় সেনা রয়েছে, যার বড় এক অংশ কাজ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। তাদের সেনাবাহিনীতে ২৬ জন লেফটেন্যান্ট জেনারেল রয়েছে, যাদের মধ্যে একমাত্র নারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিগার জোহর খান।

প্রথম নারী হিসেবে থ্রি-স্টার জেনারেল হওয়ার গৌরব অর্জন করা নিগার জোহর খান উঠে এসেছেন পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের সীমান্তে অবস্থিত খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াবি গ্রাম থেকে। বাবা সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই নিগার জোহরকে প্রতিনিয়ত স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে, প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়েছে বন্ধুমহল, প্রায় প্রতিবছরই বদলির কারণে নিতে হয়েছে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ। স্কুলজীবন থেকেই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা নিগার জোহরের পরবর্তী সময়ের কর্মজীবনে সহায়ক শক্তি হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস আর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তার পদোন্নতিগুলোতে।

বোর্ডে পজিশন নিয়ে মেট্রিক আর এফএসসি পরীক্ষা পাশ করা নিগারের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার, আবার স্বপ্ন ছিল বাবার মতো সামরিক বাহিনীতে কাজ করার। দুটি স্বপ্ন একসাথে পূরণের পথ ছিল একটিই- আর্মি মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়া। নিগার জোহর সেই সুযোগ প্রথমবারেই পেয়েছিলেন, সাথে পেয়েছিলেন আরো দুটি মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ। আর্মি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে বাবাকে রাজি করতে একমাস সময় লেগেছিল নিগার জোহর আর তার মায়ের।

বাবার সাথে নিগার জোহর খান; Image Source: DailyTimes.co.pk

আর্মি মেডিকেল কলেজেও নিগার জোহর রেখেছেন কৃতিত্বের ছাপ। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন আয়েশা কোম্পানির। ১৯৮৫ সালে আর্মি মেডিকেল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে কমিশন লাভ করেন। পছন্দের বিষয় কার্ডিওলজিতে পড়াশোনার সুযোগ আইনত না থাকায় বেছে নেন প্রশাসন। নিগার জোহরের বাবা-মা আর বোন মারা যায় ১৯৯০ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায়, বাবা কর্নেল কাদির দীর্ঘসময় কাজ করেছেন পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-তে।

আর্মির মেডিকেল কোরে বিভিন্ন দায়িত্ব আর স্থানে কাজ করেছে নিগার জোহর, সব জায়গাতেই রেখেছেন সফলতার স্বাক্ষর। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় নারী হিসেবে মেজর জেনারেল র‍্যাংকে পদোন্নতি পান নিগার জোহর, পদায়ন হয় ঝেলমের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের প্রথম কমান্ড্যান্ট হিসেবে। এরপর পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল নিগার জোহর খান দায়িত্ব পালন করেন আর্মি মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে, দায়িত্ব পালন করেন রাওয়ালপিন্ডির সামরিক হাসপাতালের কমান্ড্যান্ট হিসেবে।

কর্মজীবনে উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের পাশাপাশি নিগার জোহর খানের একাডেমিক ক্যারিয়ারও বেশ ঈর্ষণীয়। তিনি এমসিপিএস করেছেন ফ্যামিলি মেডিসিনের উপর, মাস্টার্স করেছেন পাবলিক হেলথের উপর, পাকিস্তানের আর্মড ফোর্সেস পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল ইন্সটিটিউট থেকে। একই প্রতিষ্ঠান থেকে এমএসসি করেছেন অ্যাডভান্স মেডিকেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের উপর।

নিগার জোহর খানকে লেফটেন্যান্ট জেনারেলের র‍্যাংক ব্যাচ পরিয়ে দিচ্ছেন সেনাপ্রধান; Image Source: defence.pk

৩০ জুন, ২০২০ সালে প্রথম নারী হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার সময় মেজর জেনারেল নিগার জোহর খান কমান্ড্যান্ট ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় হাসপাতালের। পাক-আমিরাত মিলিটারি হাসপাতালে জেনারেল নিগার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন পাকিস্তান সরকারের মহামারি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনায়। ২০২০ সালের জুনে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতির পাশাপাশি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রথম নারী সার্জন জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইন্টার সার্ভিসেস মেডিকেল কোরের প্রথম নারী ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে।

কর্মজীবনে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিগার জোহর খান হিলাল-ই-ইমতিয়াজ পদক পেয়েছেন, পেয়েছেন তামঘা-ই-ইমতিয়াজ পদকও। পাশাপাশি, তিনি আর্মি মেডিকেল কোরের প্রথম নারী কর্নেল কমান্ড্যান্ট। কর্নেল কমান্ড্যান্ট সাধারণত একটি আলঙ্কারিক র‍্যাংক, যেটি সম্মানসূচকভাবে কোরের এক্সিকিউটিভ কাঠামোর বাইরে থেকে অ্যাডভোকেসির জন্য দেওয়া হয়।

পুরো ক্যারিয়ারেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিগার জোহর খান; Image Source: The Young Start of Pakistan

কেন জেনারেল নিগার জোহর খানের উদাহরণ গুরুত্বপূর্ণ?

সামরিক বাহিনীতে পদায়নের ধাপগুলো অতিক্রমের জন্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিগার জোহর খানকে প্রশাসক হিসেবে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কৃতিত্ব দেখাতে হয়েছে, অধীনস্থদের মধ্যে দক্ষতানুযায়ী কর্মবণ্টনের পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হয়েছে দক্ষতাবৃদ্ধি আর কোরের সামগ্রিক সক্ষমতার বিষয়টি। সামরিক বাহিনীর ক্যারিয়ারে জেনারেল নিগার জোহর অনেক ক্ষেত্রেই দায়িত্ব পালন করেছেন প্রথম নারী হিসেবে, নিজের দায়িত্বের পরিসরকে ছাড়িয়ে গিয়ে ভূমিকা নিতে হয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি পরিবর্তনে। সবগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মধ্যে দিয়েই ক্যারিয়ারে সাফল্যের দেখা পেয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিগার জোহর, তৈরি করেছেন অনেকগুলো ইতিহাস। অনেকগুলো কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানের সমাজের জন্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিগার জোহর খানের উদাহরণটি গুরুত্বপূর্ণ।

পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজে নিগার জোহর খানের উত্থান গুরুত্বপূর্ণ; Image Source: Hamari Web. 

প্রথমত, বিয়ে পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজের বিভিন্ন সামাজিক আর ধর্মীয় নিয়ম দ্বারা আবদ্ধ। বিয়েকে পাকিস্তানের সমাজে দেখা হয় বাধ্যবাধকতা হিসেবে। পাকিস্তানে পরিবারের প্রধানরাই সাধারণত বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, সেটি সাধারণত বাবা বা দাদাদের দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়। মায়েরা বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রের ব্যাপারে পছন্দ-অপছন্দ জানাতে পারেন। তবে, অধিকাংশ সময়ই বিয়েতে মেয়েদের পছন্দকে জিজ্ঞেস করা হয় না, গুরুত্ব দেওয়া হয় না তাদের পছন্দ-অপছন্দ। একটি জরিপ দেখাচ্ছে, পাঞ্জাবের মাত্র ৪.৮ শতাংশ নারীর বিয়েতে পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়, সুযোগ পায় বিয়ের সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেওয়ার বা কখন বিয়ে করবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সামাজিক রীতি অনুযায়ী, ‘ভালো মেয়েরা’ তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত গুরুজনদের উপর ছেড়ে দেয়।

আবার, ইউনিসেফের ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের ১৮ শতাংশ মেয়ের বিয়ের হয়ে যায় ১৮ বছর হওয়ার আগেই, ৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছর হওয়ার আগেই। বাল্যবিবাহের ঘটনা মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক জটিলতার কারণ হয়, অধিকাংশ মেয়ে স্কুল থেকে ঝরে যায়, শিক্ষাহীনতার দুষ্টচক্রে আটকে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আবার, অল্প বয়সের মেয়েরা নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জটিলতার মুখোমুখি হয়।  

এরকম সমাজে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিগার জোহর খানের উদাহরণটি সামাজিক কাঠামোকে পরোক্ষভাবে বদলের প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে, স্কুল থেকে ঝরে যাওয়ার সংখ্যা কমাতে পারে, শিক্ষাহীনতার দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনতে পারে গ্রামীণ পাকিস্তানি সমাজগুলো।

নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিগার জোহর খান; Image Source: The Pakistani 

দ্বিতীয়ত, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ২৬ বছর বয়সী কান্ডেল বেলুচ তার ভাইয়ের হাতে হত্যার শিকার হন। অনলাইনে পাওয়া ভিডিওগুলোতে কান্ডেল বেলুচের ভাইকে বলতে দেখা যায়, তার বোন পরিবারের প্রতি অসম্মান বয়ে আনায় সে এই হত্যা করেছে, হত্যা করে নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের অনুসরণ না করায়। এই ধরনের হত্যাকে বলা হয় ‘অনার কিলিং’।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ‘অনার কিলিং’ এর ঘটনা থাকলেও, এদিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে পাকিস্তান। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, প্রতিবছর কান্ডেল বেলুচের মতো প্রায় এক হাজার নারীকে ‘অনার কিলিং’ এর শিকার হতে হয় নিজের পরিবারের সদস্যদের হাতে। এর পাশাপাশি, পাকিস্তান ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের ১৫-৪৯ বছর বয়স্ক নারীদের মধ্যে ২৮ শতাংশ নারী তাদের জীবনসঙ্গীর হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।

তৃতীয়ত, অন্যান্য রক্ষণশীল সমাজের মতো পাকিস্তানের সমাজেও নারীদের কর্মজীবনের জন্য সহযোগিতামূলক সংস্কৃতি নেই, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের শিক্ষার উপর বিনিয়োগ আর সময়ক্ষেপণকেও ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে না। অভিভাবকদের নারীদের ক্যারিয়ার নিয়ে সংশয় থাকে, মেয়েদের ক্যারিয়ারের চেয়ে ভালো জায়গায় বিয়েকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি। এ কারণেই, অনেক এমবিবিএস পাস করা পাকিস্তানী নারীকে বেছে নিতে হয় পুরোপুরি গৃহিনীর জীবন। ডাক্তারি পাস করা নারীদের ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের হার পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শীর্ষে।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিগার জোহর খানের উদাহরণ পাকিস্তানের সমাজের এই নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে, নারীদের ক্যারিয়ারের ব্যাপারে সময় দিতে আগ্রহী করবে, ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক ঝুঁকিগুলোতে পরিবারের সমর্থন দেওয়াকে উৎসাহিত করবে।

This article is written in Bangla about the forst female Lieutenant General of Pakistan Army, Lieutenant General Nigar Johar Khan. 

All the necessary links are hyperlinked inside. 

Feature Image: The Dawn.

Related Articles