আগস্ট, ২০১৭। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আক্রমণ করে সামরিক বাহিনীর ত্রিশটি চৌকিতে, তাদের আক্রমণের শিকার হয় মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনীও। হামলার অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়, প্রতিক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের উপর পাল্টা সামরিক আক্রমণ করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতমাদৌ। তাতমাদৌর আক্রমণে নির্বিচার হত্যার শিকার হয় রোহিঙ্গা যুবকেরা, ধর্ষণের শিকার হয় নারী আর কিশোরীরা, পুড়িয়ে দেওয় হয় গ্রামের পর গ্রাম। বিভিন্ন জায়গায় পুতে দেওয়া হয় ল্যান্ড-মাইন। জীবন বাঁচাতে তাই রোহিঙ্গারা তাদের আবাসভূমি ছেড়ে পালাতে শুরু করে, কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে, এদের বড় একটা অংশ আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে। প্রায় একলাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে যায় মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিনপ্রধান দেশগুলোতে, ক্ষুদ্র একটা অংশ আশ্রয় নেয় ভারতে।
নিজ দেশের নাগরিকদের উপর তাতমাদৌর এই হামলার নিন্দা জানায় গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতারা, জাতিসংঘ একে আখ্যায়িত করে জাতিগত নিধনের চেষ্টা হিসেবে, পাওয়া গেছে গণহত্যার আলামত। সামরিক বাহিনীর আক্রমণ থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার, ব্যর্থ হয় রাখাইনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে। বরং, সময়ের পরিক্রমায় সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন সু চি, আন্তর্জাতিক আদালতে হাজির হন সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইতে।
এখন পর্যন্ত, রোহিঙ্গা সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে। গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে আলোচিত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারটি, আলোচিত হচ্ছে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে সংকট সমাধানের পথটি। কিন্তু, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, যেকোনো সংকটের সমাধান দেওয়ার আগে প্রয়োজন সমস্যাটা যেসব কারণে তৈরি হয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে বুঝতে পারা। রাখাইনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা অর্থনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর বাইরেও রোহিঙ্গা সংকটের যে আরো অনেকগুলো নেপথ্য কারণ রয়েছে, এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হবে সেগুলো নিয়েই।
রোহিঙ্গা কারা
আরাকান অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বসবাসের শুরু দ্বাদশ শতাব্দী থেকে। শুরুর দিকে তাদের বসবাস আবর্তিত হয়েছে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলোকে কেন্দ্র করে, গড়ে উঠে স্থানীয় বড় বড় ব্যবসায়িক কাঠামোও। সময়ের সাথে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বেড়েছে, প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে মধ্যযুগে আরাকানের রাজনীতিতে। মিয়ানমার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে আসলে বিভিন্ন স্থান থেকে আরাকানে এসে জড়ো হতে থাকে রোহিঙ্গারা, বাড়তে থাকে এই জনগোষ্ঠীর আকার। তবে, তখন মিয়ানমার যেহেতু ব্রিটিশ সম্রাজ্যের অধীনে ছিল, তাই এই অভিবাসনকে অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখেছেন ইতিহাসবিদেরা।
রোহিঙ্গা সংকটের নেপথ্য কারণ
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আমাদের আলোচনায় সবসময়ই প্রাধান্য পেয়েছে রাখাইনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কথা। প্রাধান্য পেয়েছে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে চীন, জাপান, ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর স্বার্থ, আলোচনায় থেকেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগও। এই অর্থনৈতিক দিকগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে একটি ‘কৃত্রিম সংকট’ হিসেবে, যে সংকট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমীকরণগুলোকে সামনে রেখে চাপিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গাদের উপর।
কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট কি আসলেই একটি ‘কৃত্রিম সংকট’, যেটা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তৈরি করেছে? এই সংকট যে হবে, সেটা কি আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব ছিল না? উত্তর হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকট কোনো কৃত্রিম সংকট নয়, এই সংকটের কারণগুলো বিরাজ করছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক বাস্তবতায়, মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের রাষ্ট্রচিন্তায়।
জাতিগত পরিচয়ের রাজনীতি
প্রাচীন বাংলাতে যখন সেন বংশের শাসন চলছে, মিয়ানমারে তখনও চলছিল নগররাষ্ট্রের যুগ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতো, গোষ্ঠীগুলোর ব্যবসায়িক লেনদেন বিরাজ করলেও সীমাবদ্ধ ছিল সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ধারা। বিচ্ছিন্ন এই নগররাষ্ট্রগুলো একাদশ শতাব্দীতে একত্রিত করেন বামার রাজারা, তাদের শাসন চলে ব্রিটিশদের আসার আগ পর্যন্ত। বামার রাজাদের এই কয়েক শতাব্দীর শাসনে অধিকাংশ সময়ই স্বাধীন ছিল আরাকান রাজ্য (বর্তমান রাখাইন), স্বাধীনতা রক্ষা করতে আরাকানিরা বারবার লড়েছে বামার রাজার বিরুদ্ধে।
উপনিবেশ শাসনকালেও এই জাতিগত বিভাজনের ধারাটি থেকে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বামাররা যেখানে স্বাধীনতার দাবিতে সংগ্রাম করছিল, রোহিঙ্গারা তখন অংশ ছিল ব্রিটিশ ক্ষমতাবৃত্তের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বামাররা যোগ দেয় জাপানিদের সাথে, রোহিঙ্গারা অনুগত থাকে ব্রিটিশদের প্রতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও চলতে থাকে এই জাতিগত পরিচয়ের রাজনীতি, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য রোহিঙ্গারা তৈরি করে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন। এরকমই একটি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), যারা সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা সংকট তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
মিয়ানমারে জাতিগত পরিচয়ের এই কারেন, কাচিন, চিন, শানদের সাথেও হয়েছে, এখনো সশস্ত্র সংগ্রাম চালাচ্ছে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। স্বাধীনতার পর থেকেই গৃহযুদ্ধ চলছে মিয়ানমারে, সামরিক বাহিনী বারবার অস্ত্র তুলেছে নৃগোষ্ঠীগুলোর দিকে। অর্থাৎ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর সামরিক আগ্রাসন মিয়ানমারে একটি বহুল ব্যবহৃত স্বতঃস্ফূর্ত সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতি কৃত্রিম না।
জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভূক্ত না করা
স্বাধীনতার আগে থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের বামারদের সাথে চলা রোহিঙ্গাদের জাতিগত রাজনীতির রেশ চলতে থাকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও। ইউ নু এর প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার স্বীকৃতি দেয়নি রোহিঙ্গাদের, বাইরে রাখে জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায়। তবে, ইউ নু এর সরকার রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি না দিলেও খোলা রাখে নাগরিকত্ব অর্জনের পথ, অনেক রোহিঙ্গা সে সময় দায়িত্ব পালন করেন নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবেও।
জেনারেল নে উইন এর সামরিক সরকার আসার সাথে সাথেই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে রোহিঙ্গাদের জন্য, স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনেও। নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, ১৮২৩ সালে ব্রিটিশদের আসার আগে যাদের পূর্বপুরুষেরা মিয়ানমারে ছিলেন, তারা পান পূর্ণ নাগরিকত্ব। উপনিবেশ কালে যারা মিয়ানমারে এসেছিলেন, তারা পান ‘সহযোগী নাগরিকত্বের’ স্বাকৃতি। এর বাইরেও থাকে সাধারণ নাগরিকত্বের সুযোগ। রোহিঙ্গাদের রাখা হয় এই প্রক্রিয়ার বাইরে, নাগরিকত্বের পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের দেওয়া হয় একটি পরিচয়পত্র, যেটি পরিচিত ছিলো ‘হোয়াইট কার্ড’ হিসেবে। এই হোয়াইট কার্ড ব্যবহার করেই রোহিঙ্গারা ২০১৫ সাল পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিয়েছে, সংবিধান অনুমোদনের গণভোটে ভোট দিয়েছে, ভোট দিয়েছে আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে। ২০১৫ সালের আগে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন অকার্যকর ঘোষণা করেন এই হোয়াইট কার্ডগুলোকে, রোহিঙ্গারা অফিসিয়ালি পরিণত হয় রাষ্ট্রহীন জাতিতে।
এখন, মিয়ানমার সরকার যে রোহিঙ্গাদের জাতীয় নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছে না, দিচ্ছে না নাগরিকত্বের অধিকার, তা কি কেবলই ঐতিহাসিক শত্রুতার উপর ভিত্তি করে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনেই। নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে রোহিঙ্গারা আবির্ভূত হবে রাখাইন প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নৃগোষ্ঠী হিসেবে। ফলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ নৃগোষ্ঠী হিসেবে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রাখাইনে স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ পাবে রোহিঙ্গারা, সুযোগ পাবে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পাওনা বুঝে নেওয়ার।
রোহিঙ্গারা যদিও মিয়ানমারের জনসংখ্যার কেবলমাত্র দুই শতাংশ ছিল, তবুও, একটি মুসলমান নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হতে দিতে কখনোই চায়নি মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীটি। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সহায়তায় রাখাইন স্বাধীনতার পথে হাঁটতে পারে, এই ভয় থেকে। এই ভয় থেকেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন করা হয়েছে এই গোষ্ঠীটির উপর।
রাখাইনে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ
রাখাইনের দক্ষিণ অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা, উত্তর অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান রোহিঙ্গারা। একটা দীর্ঘ সময় ধরেই এই দুই সম্প্রদায় একে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে, বার বার জড়িয়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে। ২০১২ সালের মে মাসে তিন রোহিঙ্গা যুবক এক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারীকে অপহরণ করে ধর্ষণ করে, পরবর্তীতে মারা যায় নির্যাতনের শিকার সেই নারী। জুনের শুরুতেই এই ঘটনা আলোড়ন তুলে রাখাইনের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে, তারা এক বাসে হামলা চালিয়ে হত্যা করে দশ রোহিঙ্গাকে। কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুতই হস্তক্ষেপ করে এই ঘটনাপ্রবাহে, একজন মন্ত্রীকে প্রধান করে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তথাপি, সামরিক বাহিনী আর পুলিশ বাহিনীর বিতর্কিত ভূমিকায় সংঘাতে বিস্তৃতি বাড়ে, কয়েক পর্বের এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা পৌঁছে যায় তিন অংকে। বাস্তুচ্যুত হন মংড়ু আর আশেপাশের অঞ্চলের প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা, তাদেরকে পাঠানো হয় বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি শরণার্থী শিবিরগুলোতে।
পরবর্তী সময়ের উন্নত হয়নি দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক, বাড়েনি পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া। বরং, ২০১৭ সালে যখন সামরিক বাহিনী পোড়ামাটির নীতিতে আক্রমণ শুরু করে রোহিঙ্গাদের উপর, তখন বৌদ্ধরা সঙ্গী হয় সামরিক বাহিনীর, অংশ নেয় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ আর হত্যায়। নিহত রোহিঙ্গাদের মাটি চাপা দিয়ে গণকবর তৈরিতে সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতার অভিযোগ পাওয়া যায় বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে, সংঘাত পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ছবিতে প্রমাণ মেলে রোহিঙ্গাদের জমি দখলের।
বৈদেশিক বিনিয়োগ ও জাতীয়তাবাদ
রোহিঙ্গা সংকট শুরু থেকেই চীন পূর্ণ সমর্থন বজায় রেখেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রতি, বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠলেও রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বারবার বাধাগ্রস্থ করেছে রোহিঙ্গাদের বিচার পাবার প্রক্রিয়া। এখনো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ঝুলে আছে অনেকটা চীনের রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার উপর। নিশ্চিতভাবেই, বিআরআই বাস্তবায়নে সমুদ্র তীরবর্তী রাখাইনের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থে কাজ করবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করেছে ভারত, জাপানের মতো দেশও, রাখাইনে বিনিয়োগ আছে ইইউর মতো প্রভাবশালী সংস্থারও।
কিন্তু, এই বিনিয়োগকারী দেশগুলোকে রোহিঙ্গা সংকটের জন্য দায়ী করলে এই সংকটের কারণ অনুসন্ধান ভুল দিকে যেতে পারে। রোহিঙ্গারা স্বল্প শিক্ষিত, অদক্ষ এক জাতি। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে পুঁজিপতিদের জন্যে এরা হয়ে উঠতে পারতো স্বল্প মূল্যের শ্রমের উৎস। রোহিঙ্গারা না থাকায় এখন তাদের তুলনামূলকভাবে বেশি দামে শ্রম কিনতে হবে। অর্থাৎ, অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই, রোহিঙ্গা সংকট থেকে লাভবান হয়নি বিনিয়োগকারীরা।
তবে, রোহিঙ্গাদের এপারে ঠেলে দেওয়ার পেছনে বিদেশী বিনিয়োগের পরোক্ষ ভূমিকা অবশ্যই আছে। মিয়ানমারের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ এখন তরুণ, অর্থনীতি বিকশিত না হওয়ায় তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধা সীমাবদ্ধ থাকছে রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র একটা অংশের মধ্যে। এদের জন্য কর্মসংস্থানের উৎস হবে চীন, জাপান, ভারত, ইইউয়ের বিনিয়োগে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো। তরুণদের উচ্চাশার সাথে তাল মিলায়ে গিয়ে মিয়ানমারের নীতি নির্ধারকেরা সামরিক বাহিনীকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে পারে।
রাজনৈতিক স্বার্থ
সামরিক বাহিনীর আক্রমণে হাজারো রোহিঙ্গা নির্বিচার হত্যার শিকার হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে অগণিত রোহিঙ্গা নারী। জাতিসংঘ একে আখ্যায়িত করেছে জাতিগত নিধনের চেষ্টা হিসেবে, বৈশ্বিক নিন্দার ঝড় উঠেছে মিয়ানমারের প্রতি। তবে, রোহিঙ্গাদের উপর সামরিক বাহিনীর নির্বিচার আক্রমণের ঘটনাকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই, উল্লসিত করেছে বৌদ্ধদের রক্ষণশীল অংশটা। ফলে, এই ঘটনায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে সামরিক বাহিনীর, রাজনৈতিক বাস্তবতার ফায়দা নিতে ভুল করেনি রাজনৈতিক দলগুলোও। অর্থাৎ, মিয়ানমারের মূলধারার প্রায় সব রাজনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর স্বার্থ রক্ষা করেছে রোহিঙ্গা সংকট।
রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যত
রোহিঙ্গা সংকটে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়া দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। গত পাঁচ বছর ধরে দ্বিপাক্ষীয় চুক্তিতে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হলেও ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ, সম্ভাবনা এসে শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থানের পর। মোটাদাগে, রোহিঙ্গা সংকট এর সাথে ক্রিয়াশীল প্রায় সবারই স্বার্থ বহন করছে। অর্থনৈতিক বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছে চীন, জাপান, ভারতের মতো দেশগুলো। এরা খুব দ্রুত রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা নেই। কার্যকর ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা নেই যুক্তরাষ্ট্রেরও।
রোহিঙ্গা সংকটকে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে। রোহিঙ্গা সংকটকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে মিয়ানমারকে চীনের প্রভাব বলয় থেকে ধীরে ধীরে বের করে আনতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা সুবিধা দিতে পারে বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন চুক্তির ক্ষেত্রেও। আবার, এই ইস্যুকে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতে পারবে চীনের বিরুদ্ধেও, তুলতে পারবে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনে তাতমাদৌকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগও। ফলে, খুব দ্রুত সম্ভাবনা নেই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের, একেবারেই সম্ভাবনা নেই আইসিজে বা আইসিসির রায়কে ব্যবহার করে সংকট সমাধানের।
যে রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে সীমান্ত অতিক্রম করেছে, তারা অধিকাংশই মিয়ানমারে তাদের প্রিয়জনকে হারানোর স্মৃতি নিয়ে এসেছে। দশ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে চারলাখ রোহিঙ্গাই ছিল শিশু, যাদের অনেকেরই আছে চোখের সামনে হত্যা দেখার অভিজ্ঞতা। কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে এদের থাকার নিশ্চয়তা হয়তো হয়েছে, কিন্তু তারা সবসময়ই দাঁড়িয়ে আছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে, যেখানে তার ইচ্ছার কোনো মূল্যই নেই। ফলে, স্বভাবতই এই প্রজন্মটা খুব দ্রুত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে জড়িয়ে যেতে পারে। বড় আকারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি চীনের নির্মাণ করা অবকাঠামোর ক্ষতি করতে পারে, বাধাগ্রস্থ করতে পারে চীনের বিআরআই-এর সোনালী স্বপ্ন। হুমকি হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্যও, অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে পুরো অঞ্চলকেই।