Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শ্রীলঙ্কার সঙ্কট: ক্ষমতান্ধ নেতারা আঘাত হানলেন গণতন্ত্রের মূলেই

গত ২৬ অক্টোবর দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ঘটে গেল এক বিপর্যয়। দেশের রাষ্ট্রপতি মৈত্রীপাল সিরিসেনা আচমকা সেখানকার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহেকে বরখাস্ত করলেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত করলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত শেষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এই রাজাপক্ষেকে পরাজিত করার জন্যে জোটবদ্ধ হন সিরিসেনা এবং বিক্রমসিংহে। সিরিসেনার এই পদক্ষেপ সাংবিধানিকভাবে বৈধ কিনা, তা নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল আলোচনা। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসস্থান ‘টেম্পল ট্রিজ’ থেকে সরে দাঁড়াতে অস্বীকার করেছেন বরখাস্ত হওয়া প্রধানমন্ত্রী। এবং তাকে হঠানোর জন্যে ‘টেম্পল ট্রিজ’-এর বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে বোঝা যায় কতটা সঙ্গীন শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই মুহূর্তে।

ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতা বিক্রমসিংহের সমর্থনকে সম্বল করেই প্রায় চার বছর আগে সিরিসেনা, যিনি আবার এক সময়ে রাজাপক্ষের ক্যাবিনেট সদস্য ছিলেন, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে পরাজিত করেন। রাজাপক্ষে পরিচিত ছিলেন তার চীন-কেন্দ্রিক বিদেশনীতির কারণে, আর তাই তার পরাজয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ভারতসহ পশ্চিমা দুনিয়া। দেশের অভ্যন্তরেও রাজাপক্ষের একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতার ফলে তার পরাজয় সুনিশ্চিত করতে কাছাকাছি আসে বিরোধীরা।

শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি মৈত্রীপাল সিসিরসেনা এবং নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে (বাঁদিকে), একটি জনসভায়; Source: Twitter handle @AzzamAmeen

কিন্তু আচমকা সিরিসেনার এই ডিগবাজিতে হতবাক শ্রীলঙ্কার মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মহলও। একথা ঠিক যে শ্রীলঙ্কার ঐক্য সরকারের দুই শরিকের মধ্যে সম্পর্ক অনেকদিন থেকেই খারাপ চলছিল। সম্প্রতি সিরিসেনা ইউএনপির বিরুদ্ধে তীব্র উষ্মা প্রকাশ করেন এই বলে যে তার হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠলেও তার সরকারের শরিক দল তাতে বিশেষ তৎপরতা দেখায়নি। অবশেষে নানা ঘটনার পরে ঘটে ২৬ অক্টোবরের ঘটনা। বিক্রমসিংহেকে বরখাস্ত করে সিরিসেনা অভিযোগ করেন যে, তিনি আদৌ দেশের মানুষের হিতের কারণে কাজ করছিলেন না; বরং খারাপ প্রশাসনের মধ্যে দিয়ে দেশের আরও ক্ষতি করছিলেন।

পাঁচ বছর আগে যেই রাজাপক্ষেকে হারাতে জোট বেঁধেছিলেন সিরিসেনা, তার সঙ্গেই পাতালেন সখ্য

এই কারণটি আপাত মনে হলেও সিরিসেনার এই পদক্ষেপের মধ্যে যে সুচিন্তিত কৌশল রয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। রাজাপক্ষের সঙ্গে সিরিসেনার সাক্ষাৎকার হয়েছে বেশ কয়েকবার। বিক্রমসিংহের সঙ্গে সিরিসেনার ক্রমশ খারাপ হতে থাকা সম্পর্কের দরুন সিরিসেনার শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির (এসএলএফপি) সঙ্গে ইউএনপি-র জোটের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, এই নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। হয়তো সরকারের দুই শরিকের মধ্যে সম্পর্ক এক সময়ে শেষ হতই, কিন্তু তা যে এত তাড়াতাড়ি হবে তা ভাবেননি অনেক রাজনৈতিক বিশারদই।

রনিল বিক্রমসিংহে; তাকেই শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেন রাষ্ট্রপতি সিরিসেনা; Source: Twitter handle of Ranil Wickremesinghe @RW_UNP

সিরিসেনা-রাজাপক্ষের এই পরিকল্পনা চলছিল অনেকদিন ধরেই। গত এপ্রিল মাসে বিক্রমসিংহের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পরেই খুব সম্ভবত তাকে হটানোর জন্যে আরও শক্তপোক্ত পরিকল্পনা আঁটতে শুরু করেন ওই দুই নেতা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কার স্থানীয় কাউন্সিল নির্বাচনে রাজাপক্ষে-সমর্থিত শ্রীলঙ্কা পদুজনা পেরুমানা বিরাট জয় পাওয়ার পরে রাজাপক্ষে সিরিসেনা-বিক্রমসিংহে সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেন, বলেন তারা তাদের জনসমর্থন হারিয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় সামনেই প্রাদেশিক কাউন্সিল নির্বাচন এবং এই নির্বাচনে যাতে এসএলএফপি ফের খারাপ ফল না করে, তার জন্যেই হয়তো সিরিসেনা ফের রাজাপক্ষের হাত ধরার সিদ্ধান্ত নেন।

একে তো রাজনৈতিক জটিলতা চলছিলই, তার উপরে সিরিসেনাকে খুন করার যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সামনে আসে, তাতে দুই শরিকের সম্পর্কে আরও বড় চিড় ধরে। সিরিসেনার সন্দেহ হয় এর নেপথ্যে রয়েছে বিক্রমসিংহের ইউএনপি। আর এই অভিযোগের বিরুদ্ধে ইউএনপি সেভাবে গা করেনি বলেও সিরিসেনা শিবির আরও অভিযোগ আনে।

সিরিসেনা বুঝেছিলেন যে শরিকি সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে এবং এর ভবিষ্যৎও বিশেষ সুবিধের নয়। শ্রীলঙ্কার পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে নতুনভাবে সমীকরণ সাজানোর আশু প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সিরিসেনার কাছে কারণ একদিকে যেমন রাজাপক্ষে ফের তার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াচ্ছিলেন, অন্যদিকে বিক্রমসিংহের সঙ্গে তার সম্পর্কের ইতি হওয়া ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর তাই কালক্ষেপণ না করে এক ঝটকায় প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করে সিরিসেনা রাজাপক্ষের আগমনের পথ প্রশস্ত করলেন। কারণ আর কিছুই নয়, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে যাতে নিজের অস্তিত্ব বজায় থাকে, তার জন্য ন্যূনতম প্রয়াসটুকু করা।

শ্রীলঙ্কার অপসারিত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহের সমর্থনে রাজধানী কলম্বোর রাস্তায় মানুষের ঢল; Source: Twitter handle of Ranil Wickremesinghe @RW_UNP

বছর তিনেক আগে রাজাপক্ষেকে হারানোর জন্যে একসঙ্গে জোট বাঁধলেও ক্রমশ এটা পরিষ্কার হয় যে বাম-ঘেঁষা এসএলএফপি এবং ডান-ঘেঁষা ইউএনপির মধ্যে আদর্শগত এবং রাজনৈতিক বিভেদ কমার নয়। এই ব্যবধানের প্রভাব পরবর্তীকালে পরে শাসনকার্যের উপরে এবং শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে জোটটাই।

বিদেশী শক্তির সুবিধা বড় কথা নয়, বড় কথা শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়

শ্রীলঙ্কার এই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সঙ্কটকে অনেকে বিদেশনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন- এতে বিশ্লেষণ করে বলেছেন এতে কোন বৈদেশিক শক্তির সুবিধা হলো, কার হলো না। ঘটনা হচ্ছে, এই রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পূর্ণভাবেই শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ। ক্ষমতা দখলের লড়াইতে আগাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যুযুধান নেতারা এখানে কেউই কারও বন্ধু নয় (সেটা রাজাপক্ষে এবং সিরিসেনাও জানেন একে অপরের বিরুদ্ধে) কিন্তু আগামী নির্বাচনগুলোতে এগিয়ে থাকার জন্যে স্বার্থে হাত মেলাতে তৎপর। রাজাপক্ষে তো ইতিমধ্যেই শ্রীলঙ্কার তামিল রাজনৈতিক শক্তিগুলির মন জয় করতে তৎপর হয়েছেন যাতে তাদের সমর্থন নিয়ে তিনি আইনসভায় নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারেন। বলা হচ্ছে, দেশের তামিল বন্দিদেরও ছেড়ে দেওয়া হবে। এখানে উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে রাজাপক্ষে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন শ্রীলঙ্কার সেনা শ্রীলঙ্কায় পৃথক তামিলভূমি গড়ার লক্ষ্যে সংগ্রামে সামিল এলটিটিই-র বিনাশ করে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সঙ্কটের উপরে নজর রাখছে তার সরকার; Source: Twitter handle of Narendra Modi @narendramodi

রাষ্ট্রপতি সিরিসেনার এই ‘গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান’ অবশ্য শ্রীলঙ্কার মানুষ ভালো চোখে নেয়নি। সাধারণ মানুষ থেকে ছাত্র, সুশীল সমাজ সবাই তার কড়া নিন্দা করেছে। রাষ্ট্রপতিকে অভিযুক্ত করে বলা হয়েছে যে তিনি গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন। পরিস্থিতির উপরে নজরে রাখছে ভারত সহ পশ্চিমা বিশ্বও। চীন মুখে “এটা শ্রীলঙ্কার নিজেদের ব্যাপার” বললেও বিশেষজ্ঞদের মতে, বেইজিং খুব একটা অসন্তুষ্ট হবে না রাজাপক্ষের ফের ক্ষমতার কাছাকাছি আসার ফলে।

শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এখন কোন দিকে এগোয়, তা সময়ই বলবে। কিন্তু যেভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে কয়েকজন ক্ষমতান্ধ নেতা সমস্ত দেশবাসীর মতাদেশকে অগ্রাহ্য করলেন, তা যথেষ্ঠ লজ্জাজনক এক নিদর্শন তুলে ধরল শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে।

This article is in Bangla language, written on political crisis in Sri Lanka.

Featured Image Source: Vatican News

Related Articles