ইউক্রেনের জনজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সূর্যমুখী ফুল, জড়িয়ে আছে সূর্যমুখী ফুলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক গুরুত্ব। সূর্যমুখী ফুল ইউক্রেনের জাতীয় ফুল। সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে বলে সূর্যমুখীকে ধরা হয় সূর্যের উষ্ণতা আর ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে। ইউক্রেনের সব অঞ্চলেই দেখা যায় সূর্যমুখী ফুল, ইউক্রেনীয়রা বাড়ির পিছনে, খোলা জায়গা আর কৃষিজমিতে সূর্যমুখী ফলায়। ইউক্রেনে উৎপাদিত সূর্যমুখী ফুলের বেশিরভাগই রপ্তানি হয়, বেশিরভাগই রপ্তানি হয় সূর্যমুখীর বীজ হিসেবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সূর্যমুখী বীজ রপ্তানির ৪৬ শতাংশের উৎস ইউক্রেন, যেগুলো বেশিরভাগই পরবর্তীতে ভোজ্য তেল হিসেবে বিভিন্ন দেশ ব্যবহার করে। সূর্যমুখীর তেলের উৎপাদনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে রাশিয়া, বৈশ্বিক সূর্যমুখী তেল রপ্তানির ২৩ ভাগ আসে রাশিয়া থেকে। দু’টি দেশই এর পাশাপাশি গমের বড় উৎপাদক, যুগ্মভাবে বৈশ্বিক গম উৎপাদনের ২৫ ভাগ হয় ইউক্রেন আর রাশিয়াতে। বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে দুইটি দেশই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছে, স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন শিরোনামে রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় রুশভাষী অঞ্চলগুলোকে দখল করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সহিংস এই সংঘাতের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন, সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে সূর্যমুখীর তেলের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। আবার ইউক্রেনের পক্ষে পৃথিবীর যেসব প্রান্তে সংহতি দেখানো হচ্ছে, সেসব সংহতি সমাবেশেও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিচ্ছে সূর্যমুখী ফুল। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সূর্যমুখী ইউক্রেনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
সূর্যমুখীর আদি উৎস
ইউক্রেনের জাতীয় ফুল সূর্যমুখীর বীজ বপন করা হয় বসন্তের শেষদিকে, মার্চ বা এপ্রিল মাসে। গ্রীষ্মের উষ্ণতায় রঙিন জীবনের প্রতীক নিয়ে ফুটে সূর্যমুখী ফুল, গ্রীষ্মের শেষদিকে কৃষকেরা সংগ্রহ করে সূর্যমুখী ফুলের বীজ। ইউক্রেন বিশ্বের শীর্ষ সূর্যমুখী বীজ উৎপাদনকারী দেশ হলেও, সূর্যমুখী ফুলের আদিম উৎস উত্তর আমেরিকার সমতলভূমিতে। উত্তর আমেরিকার আদিবাসীরা সূর্যমুখী ফুলের চাষ শুরু করেন সাড়ে চার হাজার বছর আগে, যখন প্রতিটি সূর্যমুখী গাছের একাধিক মাথা থাকত, প্রতিটি মাথায় ফুল ধরত। সময়ের আবর্তে উত্তর আমেরিকা থেকে সূর্যমুখী চলে আসে ইউরোপে, বহু মাথার গাছ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সূর্যমুখী গাছ হয় এক মাথা আর এক ফুলবিশিষ্ট উদ্ভিদে।
উত্তর আমেরিকার আদিবাসীরা সূর্যমুখী ফুলের বীজ থেকে কেক-ব্রেডের মতো দৈনন্দিন খাবার তৈরি করতেন, বীজ ভাজা খাওয়ার পাশাপাশি বাদামের সাথে মিশিয়েও খেতেন উত্তর আমেরিকানরা। পরবর্তী সময়ে উত্তর আমেরিকাতেই সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল উৎপাদন শুরু হয়, শুরু হয় সূর্যমুখীর বীজ থেকে বিভিন্ন ধরনের রঙ উৎপাদনও।
ইউরোপে সূর্যমুখীর বিস্তৃতি
পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে স্প্যানিশদের মাধ্যমে সূর্যমুখী ফুল ইউরোপে ছড়িয়ে পরা শুরু করে, শুরু হয় ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে সূর্যমুখীর উৎপাদন। শুরুর দিকে সূর্যমুখী ফলকে ব্যবহার করা হতো গহনা হিসেবে, সূর্যমুখী ফুল থেকে তৈরি করা হতো বিভিন্ন রোগের ওষুধ। প্রদাহজনিত রোগের ক্ষেত্রেও ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো সূর্যমুখী।
পরবর্তী দুইশ’ বছর ধরে অব্যাহত থাকে ইউরোপজুড়ে সূর্যমুখী ফুলের বিস্তৃতি, শুরু হয় সূর্যমুখী ফুলের বাণিজ্যিক উৎপাদন। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে খ্রিষ্টান চার্চগুলো, বিভিন্ন ধরনের তেল আর চর্বির ব্যবহার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে। সূর্যমুখীর বীজ থেকে উৎপাদিত তেল চার্চের নিষেধাজ্ঞার বাইরে ছিল। ফলে, দৈনন্দিক খাবার সামগ্রী প্রস্তুতে তেলের চাহিদাকে সামনে রেখে কৃষকেরা সূর্যমুখী ফুলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়, উর্বর আর উষ্ণ ভূমি থাকায় ইউক্রেন হয় সূর্যমুখী উৎপাদনের কেন্দ্র, রাশিয়াতেও শুরু হয় বড় স্কেলের উৎপাদন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই কেবল ইউক্রেন আর রাশিয়াতে দুই মিলিয়ন একর কৃষিজমিতে সূর্যমুখী উৎপাদন হচ্ছিল, পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির সাথে যেটি কেবলই বেড়েছে। চার্চের এই বাধ্যবাধকতার বাইরেও মানুষ আবিষ্কার করতে শিখল, সূর্যমুখীর বীজ থেকে ভালো মানের ভেজিটেবল ওয়েল উৎপাদিত হয়, শরীরের জন্য উপকারী এইচডিআই কোলেস্টেরল উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে সূর্যমুখী আবার ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকায় ফিরে আয়, রাশিয়ার উৎপাদকেরা সেটি নিয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রেও বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত সূর্যমুখী উৎপাদিত হয়। সময়ের সাথে সূর্যমুখী ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সব প্রান্তেই।
সূর্যমুখীর রাজনৈতিক গুরুত্ব
নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে, পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে তৈরি হয় ১৫টি নতুন রাষ্ট্র, ইউক্রেন যার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম রিপাবলিক। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির সময় ইউক্রেনের ছিল পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম পারমানবিক অস্ত্রের মজুত। কিন্তু ইউক্রেনের ছিল পারমানবিক অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব, ছিল দক্ষ জনবলেরও অভাব। ১৯৯৬ সালে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় পারমানবিক অস্ত্র পরিত্যাগ করে, পারমানবিক অস্ত্র রাখার স্টেশনগুলোতে স্থাপন করা হয় সূর্যমুখী ফুল।
সূর্যমুখী ফুলের সুনাম আছে মাটি থেকে হেভি মেটাল পরিষ্কার করার ব্যাপারে, কার্যকারিতা আছে রেডিয়েশন শুষে নেওয়ার ব্যাপারেও। ফলে ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলের ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর তেজস্ক্রিয়তা শোষণ করার জন্য আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে রোপণ করা হয় বিপুল পরিমাণ সূর্যমুখী ফুল। চেরনোবিল বিপর্যয়কে আখ্যায়িত করা হয় সবচেয়ে প্রলয়ংকারী পারমাণবিক দুর্ঘটনা হিসেবে।
একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১১ সালে জাপানে ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনার পরও। এই বিপর্যয়ের শুরুতে নয় মাত্রার এক ভূমিকম্প আঘাত হাতে জাপানে, যেটি থেকে তৈরি হওয়া সুনামি আঘাত হানে ফুকুশিমা বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর প্লাবিত হয় পারমাণবিক চুল্লি। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শোষণ করে নিতে জাপানেও রোপন করা হয় সূর্যমুখী ফুল।
চলমান সংকট ও সূর্যমুখী উৎপাদন
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়ার ইউক্রেনে সামরিক আক্রমণ শুরুর পরই সূর্যমুখীর বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন বিঘ্ন ঘটা শুরু হয়, তেলের বাজারে শুরু হয় দামের উত্থান-পতন। ইউক্রেনে সামরিক আক্রমণ শুরুর পরপরই ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, ভেঙে যায় পণ্য পরিবহনের চ্যানেলও। বন্দরগুলো পরিণত হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে, বন্দরগুলোতে জাহাজ এসে ভিড়ছে না, হচ্ছে পণ্য উঠা-নামা। ফলে বন্দরকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে প্রায় পুরোপুরি, থমকে আছে সূর্যমুখীর বীজ রপ্তানিও। ‘ব্ল্যাক সি’-কেন্দ্রিক সূর্যমুখীর রপ্তানি চ্যানেলটিও আটকে আছে একই কারণে।
বন্দর পরিহার করে স্থল সীমান্তের মাধ্যমে সূর্যমুখীর বীজ রপ্তানি করাও সোজা নয়। কারণ, যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই চলছে জ্বালানি সংকট, কয়েকশ কিংবা হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সূর্যমুখী স্থলপথে রপ্তানির সুযোগ পাচ্ছেন না উৎপাদকেরা। ফলে ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধ কেবল সামরিক যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি পরিণত হয়েছে একটি অর্থনৈতিক যুদ্ধেও। যেসব এলাকাতে সূর্যমুখীর উৎপাদন বেশি হয়, সেসব এলাকা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠছে ইউক্রেনের যেসব স্থানে সূর্যমুখীর বীজ মজুত করা হয়, সেসব এলাকাও।
যুদ্ধের কারণে সূর্যমুখী উৎপাদন আর পরিবহনের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও একটি বিপরীত চিত্রও তৈরি হচ্ছে। সূর্যমুখী ফুলের উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন কিছু অঞ্চলের কৃষকেরা, কোনো কোনো অঞ্চলে ফ্রন্টলাইনের দশ কিলোমিটারের মধ্যেই উৎপাদন শুরু হয়েছে সূর্যমুখী। সূর্যমুখী উৎপাদনকে সেইসব অঞ্চলের কৃষকেরা দেখছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র এক যুদ্ধ হিসেবে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের টিকে থাকার উপায় হিসেবে। কৃষকেরা সূর্যমুখী উৎপাদন করছেন যুদ্ধের খরচ জোগাড় করতে, সৈন্যদের খাবারের ব্যবস্থা করতে, ইউক্রেনীয়দের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার পথ সুগম করতে। সেই কৃষকদের স্বপ্ন, ইউক্রেনে ধেয়ে আসা সংঘাতের লাল চোখ দ্রুতই নিভে যাবে, সূর্যমুখীর শক্তি আর উষ্ণতায় ফিরবে গোধূলিরঞ্জিত আনন্দময় মুহূর্তগুলো।