সম্প্রতি চীনের ৫৯টি অ্যাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ভারত সরকার, যার মধ্যে ছিল বেইজিং ভিত্তিক জনপ্রিয় ভিডিয়ো শেয়ারিং অ্যাপ টিকটকও। ভারতকে অনুসরণ করতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত ৩১ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি টিকটক এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। যদিও এরপর তিনি এই বক্তব্য কিছুটা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কারণ মার্কিন টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট টিকটকের আমেরিকান ব্যবহারকারীদের ডেটা সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে নিতে চাচ্ছে। অর্থাৎ, তারা টিকটকের কিছু অংশ কিনে নিতে চাচ্ছে।
টিকটকের স্বত্ত্বাধিকারী চীনা কোম্পানি বাইটড্যান্সের সাথে সংলাপ চালানোর জন্য মাইক্রোসফট ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়েছে। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যদি মাইক্রোসফট বা অন্য কোনো আমেরিকান কোম্পানি টিকটককে কিনতে না পারে, তাহলে ট্রাম্প এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। হুয়াওয়ের পর এটা হবে দ্বিতীয় কোনো চীনা জনপ্রিয় টেক কোম্পানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। হুয়াওয়েকে যে কারণে নিষিদ্ধ করেছিলেন, একই কারণে টিকটককেও নিষিদ্ধ করতে চাচ্ছেন ট্রাম্প।
টিকটক অল্প সময়ের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর স্বত্ত্বাধিকারী বাইটড্যান্সের বয়সও মাত্র আট বছর। ২০১৭ সালে ভিডিয়ো শেয়ারিং অ্যাপ মিউজিকেলি (Musical.ly) কিনে নেয় বাইটড্যান্স। এরপর তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে গুগল প্লে স্টোর ও অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর থেকে সর্বমোট ২ বিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক বার ডাউনলোড হয়েছে। অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর থেকে সবচেয়ে বেশিবার ডাউনলোড হওয়া অ্যাপ হচ্ছে টিকটক। চীনা কোম্পানি হলেও চীনে টিকটকের কোনো অস্তিত্ব নেই। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কঠোর সেন্সর নীতি থাকার কারণে চীনের অভ্যন্তরে ভিন্ন নেটওয়ার্কের টিকটক ব্যবহার করা হয়। চীনা অ্যাপটির নাম ডউয়িন (Douyin)।
বর্তমানে বিশ্বে ৮০ কোটিরও বেশি টিকটকের সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এটি ১৭৫ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক বার ডাউনলোড করা হয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের কাছে এটি খুবই জনপ্রিয় মাধ্যম। বর্তমানে তারকারাও অনেকে ব্যবহার করছেন এই অ্যাপটি। তাহলে এই তুমুল জনপ্রিয় অ্যাপটি নিষেধাজ্ঞার খড়গে পড়তে যাচ্ছে কেন? এর মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্নতা।
টিকটককে ফেসবুক বা টুইটারের মতো রাজনৈতিকভাবে দেখার কথা ছিল না। বরং এটি ছিল একটি নিখাদ বিনোদনের মাধ্যম। কিন্তু হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করার পর যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য চীনা টেক কোম্পানিগুলোর ওপরও আস্থাহীনতায় ভোগে। হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করার কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারকারীদের তথ্য চীনা সরকারের কাছে পাচার করা। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দাগিরির অভিযোগও ছিল হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে। টিকটক নিয়েও একই সন্দেহ পোষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনা সরকারের একটি আইন হচ্ছে, তারা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে চীনভিত্তিক যেকোনো কোম্পানি থেকে তথ্য নিতে পারবে। অর্থাৎ কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কমিউনিস্ট পার্টিকে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। এটিই যুক্তরাষ্ট্রকে ভীত করে তুলেছে। টিকটক যেহেতু চীনা পণ্য, তারা বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারীর তথ্য চীন সরকারকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
নিরাপত্তার পাশাপাশি অ্যাপটির সেন্সরশিপও নিষেধাজ্ঞা আরোপের অন্যতম কারণ। গত বছর হংকংয়ে চীন বিরোধী আন্দোলনের সময় ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, টিকটকে হংকং আন্দোলন সম্পর্কিত ভিডিয়োগুলো সেন্সর করা হচ্ছে। অর্থাৎ এত বড় একটি ঘটনা নিয়ে অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কথা হলেও টিকটকে সেগুলো দেখা যাচ্ছে না। তখনই সন্দেহ করা হয়, চীন সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো সেগুলো সেন্সর করা হচ্ছে। অর্থাৎ, টিকটকের ওপর চীন সরকারের ভালোই নিয়ন্ত্রণ আছে।
গার্ডিয়ানের আরেক অনুসন্ধানে তার সত্যতা পাওয়া যায়। তাদের অনুসন্ধানে পাওয়া গোপন নথি থেকে জানা যায়, বাইটড্যান্সের পক্ষ থেকে টিকটকের মডারেটরদের প্রতি একটা গাইডলাইন দেওয়া হয়। সেখানে তিয়েনআনমেন চত্বরের গণহত্যা, তিব্বতের স্বাধীনতা কিংবা নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মীয় গোষ্ঠী ফালুন গং নিয়ে ভিডিও সেন্সর করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অর্থাৎ চীনা সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি তারা যুক্তরাষ্ট্রেও অবলম্বন করছে।
এগুলো ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। তাই গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর মারকো রুবিও, চাক শুমার ও টম কটন চীনা এই অ্যাপটি নিয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত কমিটি বাইটড্যান্সের মিউজিকেলির ক্রয় নিয়ে তদন্ত শুরু করে। ভারতের পক্ষ থেকে চীনা অ্যাপগুলোর নিষেধাজ্ঞার পর গত জুলাইয়ের শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও জানান, তারাও টিকটককে নিষিদ্ধ করার চিন্তাভাবনা করছেন। গত সপ্তাহে ট্রাম্পও একই কথা বলেন।
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তার প্রক্রিয়াটা কীরূপ হবে, তা নিশ্চিত ছিল না। ট্রাম্প এটা করতে পারেন প্রেসিডেন্টের এক্সিকিউটিভ অর্ডার দেওয়ার ক্ষমতার মাধ্যমে। আবার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে আমেরিকান অ্যাপ স্টোর থেকে এই অ্যাপ ব্লক করে দেওয়ার মাধ্যমেও হতে পারে। আবার বাইটড্যান্স যেহেতু মিউজিকেলি ক্রয়ের মাধ্যমে টিকটকের মালিকানাধীন হয়েছিল, তাদের কাছ থেকে টিকটক কিনে নেওয়ার মাধ্যমেও সেটি হতে পারে। মাইক্রোসফট এখন শেষের পন্থাতেই কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি নতুন কিছু নয়।
শেষ পর্যন্ত গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমেই টিকটককে নিষিদ্ধ করার কথা বলেন। তিনি সেখানে ৪৫ দিনের একটা আল্টিমেটাম দেন। এই সময়ের মধ্যে টিকটককে কোনো আমেরিকান কোম্পানি কিনে নিতে না পারলে টিকটক বা বাইটড্যান্সের সাথে আমেরিকান যেকোনো সম্পর্ক অবৈধ বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ, কোনো আমেরিকান সেখানে বিনিয়োগ করতে পারবেন না, চাকরি করতে পারবেন না বা কোম্পানি কিনতে পারবেন না।
এদিকে টিকটক বা বাইটড্যান্সের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভক্সকে দেয়া বিবৃতিতে টিকটকের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন,
টিকটক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখে। টিকটক নিয়ে এখন অনেক মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সত্যি কথা হচ্ছে চীনে টিকটকের কোনো অস্তিত্বই নেই। টিকটক আমেরিকান নির্বাহী দিয়ে পরিচালিত হয়। এখানে শত শত আমেরিকান চাকরি করছেন। নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টাও আছেন আমেরিকান। তাছাড়া টিকটকের ডেটা সংরক্ষণ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াতে। ব্যাকআপ সংরক্ষণ করা হয় সিঙ্গাপুরে।
আমাদের কোম্পানি সম্পর্কে প্রশ্ন বা জানার কিছু থাকলে সেটা নিয়ে আলোচনার জন্য আইনজীবীদের আমরা সবসময়ই আমন্ত্রণ জানাই। আমরা ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি টিম তৈরি করছি, যেন আইনজীবীরা আমাদের নিয়ে যেকোনো প্রশ্ন থাকলে এসে করতে পারেন। আমরা জানি, আমরা কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী।
চীনা টেক কোম্পানিদের জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করা ভাবমূর্তির সঙ্কট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। টিকটক গত মে মাসে মিউজিকেলির সাবেক নির্বাহী অ্যালেক্স ঝুকে সরিয়ে ডিজনির স্ট্রিমিং সার্ভিসের প্রধান কেভিন মেয়ারকে টিকটকের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব দেয়। কিন্তু তারপরও ট্রাম্প প্রশাসনের তোপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না টিকটক। বাইটড্যান্সের নির্বাহী ঝ্যাং ইমিং বলেছেন, ট্রাম্প আসলে টিকটককে শুধু নিষিদ্ধ করতে চাচ্ছেন না। এটাকে বিলুপ্ত করে দিতে চাচ্ছেন। এদিকে ফেসবুক টিকটকের অনুকরণে নিয়ে এসেছে ইন্সটাগ্রাম রিলস।
ট্রাম্প যদি টিকটককে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করেন কিংবা এটি যদি মাইক্রোসফটের অধীনে চলে যায়, তাহলে উভয় ক্ষেত্রেই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে টিকটক। ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামের মতো জায়ান্ট সোশাল মিডিয়ার কাছে আর পাত্তাই পাবে না। তাছাড়া টিকটক আমেরিকান ব্যবহারকারীদের ডেটা চীন সরকারের কাছে পাচার করছে, এমন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। বরং এতে বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
চীনের জন্য আরো দুঃসংবাদ হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এখানেই শেষ হচ্ছে না। এক্সিকিউটিভ অর্ডারে টিকটকের পাশাপাশি উইচ্যাটকেও নিষিদ্ধ করার কথা বলেছেন ট্রাম্প। উইচ্যাট চীনা টেক জায়ান্ট টেনসেন্টের অধীনস্থ একটি ম্যাসেজিং অ্যাপ। এছাড়া সামনে হয়তো ওয়েইবো, আলি এক্সপ্রেস, জুমের মতো অ্যাপগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রে। বোঝাই যাচ্ছে প্রযুক্তি এখন আর বৈশ্বিক রূপে থাকছে না। এখানেও সীমান্তের দেয়াল গড়ে তোলা হচ্ছে। চীন এখন পাল্টা কীভাবে জবাব দেয়, সেটাই দেখার বিষয়।